বিএনপির মিথ্যাশ্রয়ী রাজনীতির নেপথ্যে

বিজন সরকার
Published : 26 Feb 2015, 03:48 AM
Updated : 26 Feb 2015, 03:48 AM

সাদা মিথ্যা বলতে আমরা ছোট আকারের সেই সব মিথ্যা বুঝি, যেগুলি অন্যের ক্ষতি করে না। আমরা অনেকেই বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, এমনকি নিজের কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীদের সঙ্গে সাদা মিথ্যা ব্যবহার করে থাকি। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন কেউ আপনাকে একটি উপহার দিল। কিন্তু উপহারটি আপনার পছন্দ হয়নি। তবু উপহারদাতাকে খুশি করার জন্য আপনি বললেন, "আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। উপহারটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।"

আরেকটি উদাহরণ দিই। আপনার বন্ধু আপনাকে একটি কাজ করতে দিয়েছে। কিন্তু আপনি কাজটি করেননি। আপনি আপনার বন্ধুকে বললেন, "গত রাতে অসুস্থ ছিলাম। তাই করতে পারিনি। আজ অবশ্যই করে দিব।"

সাদা মিথ্যা বলায় কারও তেমন ক্ষতি হয় না। আবার অবিরাম সাদা মিথ্যা বললে একটি বিরাট সমস্যা তৈরি হয়, এটি আচরণের অংশ হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তি বিশেষের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা সন্দেহের মধ্যে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিটি যদি কোনো দলের প্রতিনিধি হয়ে অবিরাম সাদা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং সেটি যদি জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে, তবে ফলাফল যে কত ভয়ানক হতে পারে তা বিএনপির বর্তমান অবস্থান থেকে বোঝা যায়।

ছয় কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর নকল করে বিবৃতি জালিয়াতি, ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহের সঙ্গে ফোনালাপের মিথ্যা দাবি এবং অতিসম্প্রতি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়ার কথিত ইনজেকশনের দাবির ঘটনাগুলিতে ব্যক্তি বিশেষের তেমন ক্ষতি হয়নি। তাই আমরা সেগুলিকে সাদা মিথ্যা হিসেবে ধরে নিতে পারি। তবে মিথ্যাশ্রয়ী হওয়ার ফলে দল হিসেবে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে। দলটির কর্মকাণ্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অমিত শাহের সঙ্গে মিথ্যা ফোনালাপের ঘটনায় সারাবিশ্বে বিএনপিসহ বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রশ্ন জাগে, বিএনপির এই মিথ্যাশ্রয়ী প্রবণতার পিছনে কি কেবল ক'জন ব্যক্তিই দায়ী? দল হিসেবে বিএনপির কি দায় নেই? অনেকেই হয়তো বলবেন, মাত্র ক'জন ব্যক্তিই এই মিথ্যাচারের জন্য দায়ী। দলের দায় নেই। তবে গত আড়াই দশক বিএনপির রাজনৈতিক ডিসকোর্স থেকে এর উত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠে। কেবল ক'জন ব্যক্তি নয়, দল হিসেবে বিএনপি মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে উঠছে। এই মিথ্যাচারের প্রকল্পে কিছু আছে ইতিহাস বিকৃত করার উদ্দেশ্য, আর কিছু আছে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশা।

একটি পাল্টা বিতর্ক হয়তো আনা যাবে। কেবল বিএনপিই কি মিথ্যাচার করছে? আওয়ামী লীগ কি করছে না? অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি, এমনকি ধর্মীয় দলগুলি কী করছে? আওয়ামী লীগ কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-কর্মীরা একেবারেই যে সাধু-সন্ন্যাসী, তা নয়। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি যেভাবে মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে উঠছে, সে নজির অন্য কোনো দল স্থাপন করতে পারেনি। রাজনৈতিক কৌশলের কারণে দলগুলির অবস্থান পরিবর্তন মিথ্যা হিসেবে গণ্য করা যাবে না।

বিশ্বব্যাপী রাজনীতিবিদেরা হরহামেশাই মিথ্যা কথা বলে থাকেন। আমরা যারা সাধারণ জনগণ, তারাও সত্য তেমন শুনতে চাই না। আমরা সেটিই শুনতে চাই, যেটি শুনতে পছন্দ করি। আবার নির্ভেজাল সত্য শুনতেও কর্কশ লাগে, রসহীন মনে হয়। সত্য শুনতে মানুষের তেমন আগ্রহও থাকে না। বিখ্যাত রচনাকার ফ্রান্সিস বেকন তাঁর বিখ্যাত রচনা 'অব ট্রুথ'এ লিখেছেন: "সত্যানুসন্ধানে একটি জটিল বিষয় হচ্ছে মানুষ নিজের স্বার্থেই মিথ্যা লুফে নেয়; কারণ মানুষ মিথ্যা শুনে পরমানন্দ পায়।"

". . men should love lies; where neither they make for pleasure, as with poets, nor for advantage, as with the merchant; but for the lies sake."

ফ্রান্সিস বেকনের মতে, ''মানুষ মূলত নির্জলা সত্যের চেয়ে সত্যের সহিত মিথ্যার মিশ্রণই অধিকতর পছন্দ করে। কারণ সত্য ততটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়, যতটা সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ।''

"A mixture of a lie doth ever add pleasure."

সত্য-মিথ্যার মিশ্রণের ফলে বক্তব্য বেশি গ্রহণযোগ্য হয় এবং সত্য থেকে মিথ্যা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বেকনের সত্য-মিথ্যা মিশ্রণ-প্রণালী প্রয়োগ করেছে। এতে দলটি রাজনৈতিকভাবে অনেক লাভবানও হয়েছে। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতার বাইরে সুনির্দিষ্ট চার প্রকারের অভিযোগ ছিল এগার হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মানের দণ্ড প্রদান করা হয় এবং এদের মধ্যে অন্তত ৩০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান সমর্থিত বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশ জারি করেন। সকল যুদ্ধাপরাধীকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ দীর্ঘ তিন দশক ধরে বাংলাদেশে কয়েকটি প্রজন্ম বড় হয়েছে এটি জেনে যে, বঙ্গবন্ধু সরকার সকল যুদ্ধাপরাধীর সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পরও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায় থেকে সাধারণ ক্ষমার বিষয়টিকে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ফেলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে।

অনুরূপভাবে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিএনপি একই পদ্ধতি ব্যবহার করছে। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা হয়। কিন্তু সত্য হল, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকদের অন্যতম এবং তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ২৭ মার্চ।

জিয়াউর রহমান-উত্তর বিএনপি জ্ঞাতসারেই এ দুটি বিষয়ে মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। গত প্রায় তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগবিরোধী গোষ্ঠীগুলির অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক সুসংহত করার জন্য বিএনপি এই দুটি বিষয় পুঁজি করে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে।

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়েও নির্লজ্জের মতো একটি মিথ্যাচার বিএনপি করে থাকে। ১৯৯১ সালের পর থেকেই খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করতে শুরু করেন। তাঁর একাডেমিক রেকর্ড এবং বিবাহের কাবিননামা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন জন্ম তারিখের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন মিথ্যাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

খালেদা জিয়ার এই বিতর্কিত জন্মদিন উৎযাপন করে বিএনপি হয়তো সরাসরি রাজনৈতিক সুবিধা পায় না। তবে এর একটি বিশাল প্রতীকী মূল্য আছে। এতে দলের ভিতরে এবং বাইরে থাকা ডানপন্থীদের প্রতি খালেদার একটি আদর্শিক বার্তা যায়। তাঁর প্রতি উগ্র ডানপন্থীদের বিশ্বস্ততা সুদৃঢ় হয়।

অতিসম্প্রতি বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের তথাকথিত ইতিহাস গবেষণা এবং কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, অমিত শাহের মিথ্যা ফোনালাপ ও বেগম জিয়ার ইনজেকশন নেওয়ার ঘটনাগুলির মধ্যে একটি রাজনৈতিক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় তারেক রহমান তেমন আলোচনায় ছিলেন না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই বিএনপির আন্দোলনের ফলাফল তারেক রহমান আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। অনেকটা হতাশা থেকেই সাধারণ মানুষের আলোচনায় আসার জন্য ইতিহাস বিকৃত করার ভয়ংকর পদ্ধতি তিনি বেছে নেন। আর তারেকের এই আত্নঘাতী কর্মকাণ্ডে লন্ডনভিত্তিক জামাত-শিবিরের সকল থিংক ট্যাংক উৎসাহ জুগিয়ে গেছে।

বিএনপির সাম্প্রতিক মিথ্যাচার প্রকল্পগুলি দলটির সিনিয়র নেতাদের অজ্ঞাতসারে তারেক রহমান এবং তার অনুসারীদের ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কার কথায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তা আর গোপন থাকেনি। তারেক রহমান বন্ধবন্ধুকে পাক-বন্ধু ও রাজাকার বলায় নিজের দলের ভিতরেই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। তার কথাবার্তায় রাজনৈতিক শিষ্টাচার না থাকায় দলের নেতা মেজর আক্তারুজ্জামান তারেক রহমানকে 'বেয়াদব' বলে তিরস্কার পর্যন্ত করেছেন।

বিএনপি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দল। দলটি দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে। মাঠ পর্যায়ে রয়েছে একটি বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো। যখন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া বিবৃতি দেওয়া দলটির জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে, ভারতবিরোধী রাজনীতি করার পরও বিজেপি প্রধানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার মিথ্যা ফোনালাপের প্রয়োজনীয়তা বিএনপির জন্য অপরিহার্য হল, কথিত ইনজেকশনের অজুহাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়– তখন সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, দলটির ভিতর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা, অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস ও অনৈতিকতা দলটির উপর জেঁকে বসেছে।

বিএনপির এই পরিবর্তন হঠাৎ করে হয়নি। একটি চলমান পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আজ মিথ্যাচারে মেতে উঠছে দলটি। যদি এখনও দলটি নিষ্ক্রিয় থাকা রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবানদের গুরুত্ব না দেয়, সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করে, আগামীতে তাদের আরও ভয়ানকভাবে মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে উঠবার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির একটি রমরমা বাজার রয়েছে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী চেতনার নামে বিএনপির রাজনীতির উত্থান হয়েছিল মূলত চারটি উৎস থেকে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধিতা; দ্বিতীয়ত, রাজনীতিতে ধর্মের কৌশলগত অপব্যবহার; তৃতীয়ত, স্বাধীনতাবিরোধীদের সুরক্ষা প্রকল্প এবং চতুর্থত, আওয়ামী লীগের বাইরে শক্তিশালী প্রগ্রেসিভ অল্টারনেটিভের অভাব।

বিএনপির জাতীয়তাবাদের শ্লোগানটি অনেকটা 'সুগার কোটেড পিল'এর মতো। উপরিভাগে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী চেতনা, ভিতরে রয়েছে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে উল্লিখিত চারটি উৎস থেকে রাজনৈতিক সুবিধা কোষাগারে জমানোর একটি বহুমুখী পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি দলটি বেশ দক্ষতার সঙ্গে দু'দশক করে ব্যবহার করে আসছিল। ২০০১ সালের পর থেকেই দলটির ভিতরকার প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির ফলে বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণের মাল্টি-লেয়ার সিস্টেমে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেলেও আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট পড়েছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে আজ বিএনপি যে ভোট পায়, তা তাদের নিজস্ব ভোট নয়। এই ভোটগুলি আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলি থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায় যে, ভোটের পরিসংখ্যানে দল হিসেবে একক আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট রয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। বলা যায়, ১৯৭০ সালের ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে তা আজ ৪০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। তাই বিএনপির জায়গায় অন্য কোনো দল যদি আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করে, বিএনপির বর্তমান ভোট সে দলই পাবে।

বিএনপির গঠন-প্রক্রিয়া ও কাঠামোতে আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা ও অংশীদারিত্ব ছিল। আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন দল থেকে আগত রাজনীতিবিদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলটিতে ঠাঁই করে নেয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগবিরোধী গোষ্ঠীগুলি নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীলতা নিজেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দিয়েই রক্ষা করেছিল।

দলটির সেই বহু-আদর্শিক প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোতে মূল সমস্যাটি ২০০১ সালের পর থেকে বড় আকারে দেখা দিলেও, সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৯১ সালের পর পরই। আওয়ামী লীগবিরোধী গোষ্ঠীর পাশাপাশি একটি বিশাল সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী শ্রেণিকে 'সুগার কোটেড' জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয় বিএনপি। এই ব্যবসায়ী শ্রেণির অনেকেই ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেন। বিএনপির রাজনৈতিক সুবিধার কারণেই রাজনীতি পল্টন ময়দান থেকে মতিঝিল ব্যাংক পাড়ায় চলে যায়। এতে তারা দল হিসেবে যত ক্ষতির মুখে পড়েছে, দেশের রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে তার চেয়েও বেশি। দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলির গুণগতমানে ঋণাত্নক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ী শ্রেণির দাপটের কুফলের চিত্র আমরা সবাই জানি।

২০০১ সালের পর থেকেই বিএনপির প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। দলটির ভিতরে থাকা উদার ও স্বাধীনতাপন্থী গোষ্ঠীগুলি আস্তে আস্তে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যায়। দলটির আদর্শিক অবস্থান আরও ডানে হেলে পড়ে। দলে উগ্র ডানপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যায়। বিশেষ করে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব জামায়াতে ইসলামীর দিকে ঝুঁকে পড়ায় দলটির ভিতরের উদার গোষ্ঠীগুলি আর দলের কেন্দ্রে আসতে পারেনি।

গঠনগত দিক দিয়ে বিএনপি বহু আদর্শের একটি সমন্বিত আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম। যে কোনো সময় যে কোনো আদর্শিক গোষ্ঠী দলটির কেন্দ্রে এসে ড্রাইভিং সিটে বসতে পারে। প্রতিনিধিত্বশীল গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে, সেই গোষ্ঠী ড্রাইভিং সিটে বসে। আজ বিএনপির ভবিষ্যৎ তারেক রহমানের হাতে, আর তারেক রহমান কট্টর আওয়ামীবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে। কোকো মারা যাওয়ায় তারেক রহমানের প্রতি খালেদা জিয়ার নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়ে যাবে, এটি অনুমানের বিষয় নয়। এটিই এখন নির্মম বাস্তবতা।

অদূর ভবিষ্যতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিতে উগ্র ডানপন্থীদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হবে। উদারমনা অভিজ্ঞরা ক্রমশ অন্ধকারের অতল গহ্বরে চলে যাবেন। বিএনপির এই দুরবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা তরিকুল ইসলামের মতো পোড় খাওয়া নেতারা স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটের কাছে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বোঝাপড়ার সমস্যার কথা চিন্তা করে তাদের আর দায়িত্ব দেওয়া হবে না। তারেক রহমানের আস্থাভাজন শ্রমিক নেতা শিমুল বিশ্বাস, মারুফ কামাল খান সোহেল এবং আবাসিক নেতা রুহুল কবির রিজভির মতো যন্ত্রমনস্ক কিছু অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যাচারের মেশিন হিসেবে কাজ করে যাবেন।

বিএনপি এখন রাজনৈতিক যোগ্যতা ও প্রজ্ঞার অভাবেই মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে উঠছে, যার সঙ্গে দলটির সিনিয়র নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। একই সঙ্গে এ মিথ্যাচার কেবল শিমুল বিশ্বাস, মারুফ কামাল এবং রিজভির সিদ্ধান্তে পরিচালিত হচ্ছে, তা ভাববার কারণ নেই। এ সব মিথ্যাচার প্রকল্প লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছে।

তারেক হয়তো ভাবতে পারছেন না যে, বাংলাদেশ কতদূর এগিয়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি অসুস্থতার অজুহাতে ফেরারি আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন; এমনকি হেফাজতের সমাবেশের হতাহতের ঘটনা নিয়ে তিনি কী ভুল তথ্য দিচ্ছেন; বন্ধবন্ধুকে নিয়ে কি মিথ্যাচার করছেন, তাও আজ দেশের মানুষ তৎক্ষণাৎ জানতে পারছে। মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে দলীয় রাজনৈতিক সুবিধা ক্যাশ করার দিন শেষ।

এই নির্মোহ সত্য বিএনপি, বিশেষ করে তারেক রহমান যত আগে বুঝবেন, দলের জন্য, এমনকি দেশের জন্য ততই মঙ্গল।