বিএনপির ‘সাফল্য’ ও ঝুঁকি

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 25 Feb 2015, 10:09 AM
Updated : 25 Feb 2015, 10:09 AM

'সুশীল' বা নাগরিক সমাজের ভেতর থেকে সংলাপের উদ্যোগের বিষয়ে ক্রিটিক্যাল একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিশ্লেষণ বিভাগে। ওটায় বলা হয়েছিল, তাদের উচিত নয় শুধু সংলাপের ওপর জোর দেওয়া। নিরীহ মানুষের ওপর বারে বারে যে সহিংসতা হচ্ছে, তার বিচারের দাবিও এদের তুলতে হবে। নইলে মনেই হবে, তারা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় বিএনপির 'অ্যাজেন্ডা' বাস্তবায়নে কাজ করছেন।

ওই নিবন্ধে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, পেট্রোল বোমা হামলায় নাম-না-জানা মানুষ হত্যা সুনির্দিষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর বিচারে ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে।

এরই মধ্যে নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ সরকার নাকচ করে দিয়েছে এবং সেটা আলোচনায়ও নেই আর। সরকার বরং এটা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যে, সংলাপে যাওয়ার অর্থ হল সহিংসতার কাছে নতি স্বীকার। এর মধ্যে অবরোধ-হরতালও দুর্বল হয়ে পড়েছে। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডও কমে এসেছে মনে হয়। কতদিন আর উৎসাহ থাকে! আমরা তো জেএমবির জঙ্গিদেরও উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে দেখেছি।

যত নাশকতাই চলুক, মানুষই-বা কতদিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকবে? বিএনপির লোকদের মালিকানাধীন কল-কারখানা, দোকানপাট আর যানবাহনও বন্ধ করে রাখা হয়নি বলে খবর মিলছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নও তো রয়েছে। তারা যদি দেখতেন 'আন্দোলন' সফল হতে চলেছে, তাহলেও না হয় স্বীকার করতেন কিছুটা ত্যাগ। মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার বাজারে আসা ফোনালাপেও বোঝা গেছে, দলটির জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মান্না সাহেবকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং তাতে আরও নতুন মাত্রা দেওয়ার বিষয়ে যত উৎসাহীই দেখা যাক না কেন, খোকা সাহেব কিন্তু বুঝতে পারছেন পরিস্থিতিটা। বিএনপি আসলে এখন এটা থেকে বেরুতে চাইছে।

নাশকতাময় আন্দোলনে বিএনপির একটা সাময়িক সাফল্য অবশ্য ছিল। সেটা হল, মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘিরে সংলাপের দাবি সামনে আনতে পারা। নাগরিক সমাজের একাংশকেও তারা প্রভাবিত করে ফেলেছিলেন বলে মনে হয়। নইলে তারা সহিংসতার দিকে না তাকিয়ে বা সেটায় কম জোর দিয়ে কেন শুধু সংলাপের কথা বলবেন?

আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এর মধ্যে যেসব আহ্বান এসেছে, সেগুলো কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ। এক এক পক্ষ বা মিডিয়া সেটাকে এক একভাবে উপস্থাপন করতে পারে, কিন্তু পুরোটা (এবং 'বিটুইন দ্য লাইনস') পড়লে দেখা যায়, তারা সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপ আয়োজন দুটোর ওপরই সমান বা প্রায় সমান জোর দিচ্ছেন। এমনটি বলেননি যে, সংলাপে বসে গেলেই সব মিটে যাবে। অবাক হব না অবরোধ একেবারে শিথিল হয়ে পড়ার পর নিরীহ মানুষের ওপর সংঘটিত সহিংসতার ন্যায়বিচারের দাবি পশ্চিমা দুনিয়া থেকে জোরেসোরে উঠলে। এ কাজে তারা নিজেদের 'সহায়তা'ও অফার করতে পারেন। কারণ খুব কম দেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনেই দিনের পর দিন এমনি ধারার সহিংসতা হয়েছে। এর কোনো রকম যৌক্তিকতা নেই, যদিও এটির পক্ষে কিছু তত্ত্বায়নের চেষ্টা করেছেন অনেকে।

গণতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত রাজনৈতিক অধিকার চর্চা থেকে সরকার বিএনপিকে খারাপভাবে বঞ্চিত করেছে, যে কোনো বিবেকবান মানুষই এটা বলবেন অবশ্য। কিন্তু এমনতরো পরিস্থিতিতে দলটি কীভাবে তার জবাব দেবে, সেটা নিয়ে কোনো রকম ভাবনাচিন্তা না করে তারা ঝুঁকে পড়লেন টানা অবরোধ ও সহিংসতার দিকে। এটা কোনো কথা হল?

বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার মতো সংগ্রামেও এমন মনোভাব বা কৌশলের শরণাপন্ন হয়নি এ অঞ্চলের নেতৃত্ব। গান্ধীজির কথা আমরা জানি। তাঁর আহুত একটি কর্মসূচি পালনকালে সহিংসতা হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা থেকে সরে আসেন। গান্ধীর মতো নেতা বিশ্বপরিসরেও কম পাওয়া গেছে। সুতরাং তাঁর সঙ্গে আমাদের কারও তুলনা চলে না। তারপরও প্রসঙ্গটা কিন্তু আসে।

কেউ বলতে পারেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও সন্ত্রাসবাদী ধারা ছিল। এর উত্তরে বলব, সেটা কখনও মূলধারা ছিল না। আর তারও একটা চরিত্র ছিল। সন্ত্রাসবাদী ধারার সংগ্রামীরা বিদেশি শাসকদের কাবু করতে নিরীহ মানুষ হত্যা করেননি। তখনকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রচেষ্টাও চালাননি। তারা আঘাত হানতে চেয়েছেন শাসক ও তার তল্পিবাহকদের ওপর।

তখনও কি 'রাজনৈতিক অধিকার' খর্ব করা হয়নি? এটা খর্ব করার মতো কানুনও তো জারি ছিল। না, বিদেশি শাসনের সঙ্গে স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক শাসনামল গুলিয়ে ফেলতে চাইছি না। এখানে অবশ্যই বিরোধী দল অনেক বেশি রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করার কথা। শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশের অধিকার তাদের দিতে হবে। অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সেটা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।

এখন কথা হল, সরকার যদি কোনো কারণে সেটি করেই থাকে, তার বিরোধিতার উপায় কী? সরকার খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করেছে, ঠিক আছে। এর জবাবে তিনি ও তারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে অবরুদ্ধ করবেন কেন? আর সেটা চলবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস? ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পাবলিক পরীক্ষা, জাতীয় দিবস পালন কোনো কিছুই গ্রাহ্য করা হবে না?

আর একটি বিকাশমান অর্থনীতির ক্ষতি? বেসরকারি খাতনির্ভর এ অর্থনীতির গোড়াপত্তন কিন্তু করেছিল বিএনপি। জিয়াউর রহমান-সাইফুর রহমান জুটিই এ জন্য দায়ী। অথচ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপি নেতৃত্ব এ অর্থনীতিরও পরোয়া করছে না। দেশের কৃষক সমাজে না হয় আওয়ামী লীগের ভিত্তি জোরালো। কিন্তু ব্যবসায়ী সমাজে, বিশেষত রফতানিকারকদের মধ্যে বিএনপি সমর্থক কি কম?

একটি রাজনৈতিক দল, যেটি তার প্রতিষ্ঠাকালীন মলিন অতীত থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বারবার নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে, তারা এ দেউলিয়া আচরণ কেন করবেন? অনেকে অবশ্য বলেন, সরকারই বিএনপিকে এদিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তো সেটা আরও দুর্ভাগ্যজনক। সরকার ঠেলে দিলেও সে কেন একটা অন্ধকার টানেলে ঢুকে পড়বে?

বিএনপির ভুলের সূচনা হয়েছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতকরণে। ওটা বর্জন করলেও প্রতিহত তারা করতে পারেনি এবং একই ধরনের সহিংসতার আশ্রয় নিয়েও। সর্বোচ্চ আদালতে একটি ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্যও বুঝতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব। তারই মতো শক্তিশালী একটি দল এর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পর সেটা তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।

হ্যাঁ, তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প একটা কিছুর ব্যবস্থা করা যেতেই পারে এবং করা দরকারও। সেটা আবার হতে হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। নইলে তা আবারও বাতিল হয়ে যাবে আদালতে। এটা বুঝে সংলাপে গিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থাপনা আদায় করা যেত না-কি? সে চেষ্টা তো বিএনপিকে করতে দেখলাম না, গোঁয়ার্তুমি করা ছাড়া।

'আন্দোলনের অংশ হিসেবে' বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে গেলেও বিএনপি জোট বোধহয় জিতে যেত। পাবলিক মুড সে রকমই ছিল। এখনও একটা মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে না, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু নির্বাচনটা তো হতে হবে। এদিকে, বাংলাদেশ জাপান নয় বলে সরকার স্বভাবতই নির্বাচন দেবে না।

এ অবস্থায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় করে নিতে হবে বিএনপিকে। কিন্তু সেটা কীভাবে? মাসের পর মাস অবরোধ চালিয়ে আর শুধু সহিংসতার ওপর নির্ভর করে নিশ্চয়ই নয়? সরকার এদিকে ঠেলে দিতে চাইলে তাকে বরং কৌশলে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণ ও অর্থনীতিকে 'হার্ট' করার বদলে সরকারকে হার্ট করার উপায় বের করতে হবে তাকে। বিএনপি এ পর্যন্ত যা করেছে, তার নিট রেজাল্ট হিসেবে সরকার কিন্তু শক্তিশালী হয়েছে।

খালেদা জিয়া মাঝে একটা কথা বলেছিলেন যে, সরকারকে 'পচতে' দিচ্ছেন। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা নিজ কর্মকাণ্ডে পচবে আর তাতে ব্যাপক মানুষ বিরূপ হবে তাদের প্রতি। অবধারিতভাবে সহানুভূতি ও সমর্থন পাবে বিএনপি। আরেকটি উপায় ছিল, দল ও জোট গুছিয়ে ধীরে ধীরে জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের পথে এগোনো। সরকারের চাপে সেটাও কি করা যাচ্ছিল না?

চলার পথে কান পাতলে কিন্তু বোঝা যায়, বিএনপির দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এ সমর্থন দিয়ে কী করবে দলটি যদি এ নজিরবিহীন অবরোধ মাঠে মারা যায়? দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলছে। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এখন বেশি করে বলছেন, 'ক্রসফায়ারের' মাধ্যমে পাল্টা সহিংসতা শুরু করেছে সরকার।

'মামলা-হামলা' বলে যে অভিযোগ করে থাকে বিএনপি, তা এখন আরেক দফা মোকাবেলা করতে হবে এর নেতা-কর্মীদের। জোটসঙ্গী জামাতও এ থেকে রেহাই পাবে না। বন্ধ হবে না এদের অভিযুক্ত নেতাদের ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়া। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে যদি নিরীহ মানুষ হত্যার অভিযোগে নতুন করে মামলা হয়? এর পারিবারিক, আর্থিক চাপও তো আছে, নাকি? নাশকতাময় আন্দোলনে ঢুকে পড়ার ঝুঁকিটা এখানেই। বিজয়ী না হলে এর জন্য চরম মাসুল দিতে হয় আন্দোলনকারীদের। বিএনপি তো জামাতের মতো দল নয় যে, ইতিহাসে বারে বারে ভুল করে এসেছে। সে কেন জামাতের মতো আচরণ করবে আর সেটা 'হার্ট' করবে জনগণ ও অর্থনীতি? একে কি 'ঔন' করেন না তারা?

মাহমুদুর রহমান মান্না কী বললেন সাদেক হোসেন খোকাকে, তা নিয়ে বিচলিত না হলেও চলবে। তার নেতা আবু তাহেরও ছিলেন রোমান্টিক বিপ্লবী। তিনি টেকেননি; টেকেনি জাসদের গোটা ধারাটাই। ওখান থেকে হঠকারিতা ছাড়া অন্য কিছু হবে বলেও মনে হচ্ছে না। সেটার সুযোগও কম, যেহেতু বিএনপি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দলটির 'বি' বা 'সি' টিম একা স্বপ্ন দেখলে তো লাভ নেই।

সরকারকে 'পচতে' দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও দু'বছরের মাথায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিটা হয়তো জোরদার করতে পারত বিএনপি। দেড়-দুই মাসের নাশকতাময় এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে কী হবে দলটির পরিণতি? সরকার প্রথমত একে দমন করবে এবং সেটা এক ধরনের জনসমর্থনও পাবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে আর দাঁড়াতেই দেবে না। একে 'সন্ত্রাসী দল' বলে চিত্রিত করার সুযোগও সরকারের হাতে এসে যাবে।

সরকার চাইবে এভাবে মেয়াদটাই পূর্ণ করে ফেলতে। এর ভেতর দিয়ে বিএনপির অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, সেটা তাদের ভেবে দেখতে হবে এখন। 'ফ্রিঞ্জ' বা ছুটকো গোষ্ঠীগুলো তাকে আন্দোলনে অটল দেখতে চাইলেও বিএনপির আসলে এখন গোটা এ যাত্রাপথটি পুনর্বিবেচনা করে দেখার সময়। দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্য থেকে সে বোধহয় আরও পিছিয়েই পড়ল!

যেনতেন উপায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে বিএনপি যদি প্রায় অনির্বাচিত একটি সরকারকে নতুন করে বৈধতা দিয়ে দেয়, সেটাও কি দুর্ভাগ্যজনক হবে না? উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি যদি ভুল নীতি-কৌশলের কারণে বারে বারে মার খায় এবং আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, সেটাও কি রাজনীতির জন্য শুভ হবে?

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিএনপির জায়গা নিয়ে নিতে পারে অন্য কোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠী। নানা কারণে মুসলিম উগ্রবাদের ঝুঁকি রয়েই গেছে দেশে এবং বিএনপি ব্যর্থ হলে পরে সে কারণেও এটা বাড়তে পারে। উদারনৈতিক না হলেও সমন্বয়বাদী পথে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারও কি এ বিপদের কথা চিন্তা করে দেখবে না?

পরবর্তী নিবন্ধে সরকারের করণীয় বিষয়ে আলোকপাতের ইচ্ছা রেখে এটির ইতি টানছি।