মান্না নাটকের শেষ কোথায়

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 Feb 2015, 08:19 PM
Updated : 25 Feb 2015, 08:19 PM

ইউনাইটেড কিংডম, মানে বিলেতকে বলা হয়, 'ইউকে'। ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাকে সবাই বলে, 'ইউএস'। বাংলাদেশকেও আমরা আদর করে ডাকি, 'বিডি'। ইদানিংকার রাজনীতি তো দেখছি 'বিডি'কে 'জিডি' বানিয়ে ছাড়বে! মাহমুদুর রহমান মান্নার অডিও টেপ ফাঁস হবার পর খোদ ঢাকাতেই প্রায় অর্ধশতাধিক জিডি দাখিল হয়েছে বলেই এটা মনে হল।

মান্না যা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন তার প্রতি সমর্থন তো দূরের কথা, নিঃশর্ত ঘৃণা রেখেই বলি, কবে থেকে এত জিডিবাজ হলাম আমরা? যে আইনের প্রতি আমরা অশ্রদ্ধাশীল, যে দেশের পুলিশের মাথা থেঁতলে দিতে পারার ভেতর বিকৃত আনন্দ, যে দেশে ক্রসফায়ার আর গুলিতে মৃত্যু নিয়ে শীর্ষ দৈনিকের ঘুম হারাম– সেখানে হঠাৎ এত জিডি দেখে মনে হয়, আসলে আমরা কি সুস্থ বা স্বাভাবিক!

সব কিছু রাজনীতির আওতায় এনে আজ আর কিছু স্বাভাবিক নেই। এমন রাজনীতিনির্ভর দেশ বা সমাজ আসলেই বিপজ্জনক। আমাকে আপনি এমন একটা দেশ দেখাতে পারবেন না, যেখানে মিডিয়া সারাদিন সারারাত সামান্য কিছু মানুষের খবরাখবর নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আমাদের মিডিয়াগুলো এখন সত্যি উদ্বেগের কারণ। এর পেছনে যে কারণই থাক, এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ। রাজনীতি চলবে তার নিয়মে, জীবন চলবে জীবনের নিয়মে– তাই কি হওয়ার কথা ছিল না?

যে রাজনীতি মানুষের ভালোবাসা-ভালোলাগা, যৌনতা-মৌনতা, চা-কফি, বই-খাতা, কাগজ-কলম, আবেগ-আদর্শ কেড়ে নেয়– কেন মানুষ তা বর্জন করতে পারছে না?

দুটো কারণ; প্রথমত, এটি এখন মাফিয়াদের হাতে। মৌরসীপট্টি বাঁধা চাকের জাল ছিন্ন করা সহজ কিছু নয়। শেষত, মিডিয়া এ ছাড়া আর কিছু ফোকাস করছে না। করলে অনেক কিছুর তীব্রতা কমে আসত। খেয়াল করবেন, এবারের মমতার সফরও তেমন সাড়া তুলতে পারেনি। আমাদের জীবনে পেট্রোল বোমা আর আগুন এমন প্রভাব ফেলেছে যে, আমরা শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে প্রসেনজিৎ আর দেবের বিকৃত অঙ্গভঙ্গির ছবিও আমলে নিতে ভুলে গেছি।

ভুলে গেছি মমতার এই সফরের একটা চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল। মমতার এক পিঠে মমতা আর অন্য পিঠে যে মমতাহীনতা, আওয়ামী-বিরোধী পাকি কাগজ বা মিডিয়াও সে দিকে খেয়াল রাখেনি। রাখলেও তাদের দূুঃসময় বলে মুখ খোলেনি। ফলে এটি যে একটি প্রমোদ ভ্রমণ আর সরকারি ইলিশের ভোজনবিলাস, সেটাও বলা হয়নি। এটি অবশ্য মমতা দিদির বিদায়ের দিনেই বোঝা গেছে। এয়ারপোর্টে ছেঁকে ধরা এক সাংবাদিককে তিনি সরাসরি বলেছেন, 'এক কথা বারবার বলার দরকার পড়ে না'। কোনো ধরনের কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতিও দেননি তিনি।

আমাদের সাংবাদিকরা দেশের আগুনে পোড়া; তাদের জীবনে না আছে শান্তি, না অবসর; না আছে সুস্থ ভাবনার সময়। থাকলে এ কথা বলতেন, 'এক কথা বারবার বলার দরকার পড়ে, কারণ নদী বা পানাধারের পানি যে বারবার লাগে, দিদি। একদিনে সহস্রবার। তাই উত্তরটা জানা জরুরি।' যে আমরা 'ফেলানি ফেলানি' বলে ফেনা তুলি, সে মেয়েটির আত্মার শান্তির কারণে যে বিষয়গুলো পাড়ার দরকার ছিল, কেউ তা বলেছে বলে মনে হয় না। খেয়াল করলাম, দেশজুড়ে অশান্তি আর ঝামেলায় থাকতে থাকতে আমাদের মেরুদণ্ডও আগের মতো সোজা থাকছে না। মূখ্যমন্ত্রী থেকে চাপরাশি– বিদেশি কাউকে দেখলেই আমাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে উঠতে চাইছে।

ভাবতে কষ্ট হয়, এই আমরাই পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এ দেশ পেয়েছিলাম!

যে কথা বলছিলাম, মান্না ভাই এদেশের একজন পরিচিত নেতা। যৌবনে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নদেখা ও স্বপ্নদেখানো নেতা। ধীরে ধীরে আর দশটা সমাজতন্ত্রীর মতো তিনিও ঘুরেছেন। আপন বলয় চ্যূত হয়ে কিছু পাবার আশায় নানা দলে নাম লিখিয়েছেন। যে দলটিকে এখন 'অগণতন্ত্রী' বলেন, সেনা-সমর্থন বা লাশের বদলেও যার সরকারের অবসান চান, এই সেদিনও তিনি সে দলের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। মান্না ভাই লীগে যোগদানের পর আওয়ামী সমর্থকদের মুখে শুনেছি, 'আর ভয় নেই, দল এবার অন্য চেহারা ধারণ করবে'– আমি তখন ভেবেছি, কীভাবে সম্ভব? অন্য দলের লোক বা কারিগর দিয়ে সেতু বানানো যায়, অন্য দেশের মানুষ এনে ডিজাইন করা যায়, কিন্তু সে সব সেতুু বা রাস্তায় গাড়ি চালাবে তো নিজেদের মানুষ। সে জায়গাটাই ছেড়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ!

অবশ্য এখন তারা পুরনো জাসদ বা বামদের সঙ্গে এমন এক আঁতাতে আছেন, যেখানে আপন-পর বলে কিছু নেই। বামদের কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে খালেদা জিয়ার মুণ্ডুপাত করে দলের শীর্ষনেতার আস্থায় থাকেন প্রতিদিন। এতে মাঠ বা জেলা পর্যায়ে কী অসুবিধে হয়, জনমনে কী প্রভাব পড়ে, তাতে দলছুটদের কী যায় আসে? যে একবার শয্যা বদল করে, তার কি পুর্নবার শয্যা বা আসন পরিবর্তনে ভয় থাকে? না লজ্জা?

মাহমুদুর রহমান মান্নারা বদলের রাজনীতিতে ঢুকে হাতবদল হতে হতে অনেক আগেই নিজেদের আসল আদল আরিয়ে ফেলেছেন। গত কিছুদিন থেকে নিছক পাগলামি করছিলেন। একবার ঐক্য ফোরাম, একবার গণফোরাম, এসব করতে করতে খালেদা জিয়ার দরবারে গিয়ে হাজির হবার পরই বুঝেছিলাম, তার বিপদ আসন্ন।

সেই মাহমুদুর রহমান মান্নার এক অডিও টেপ এখন 'টক অব দ্য গ্লোবাল'। বাঙালিদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও বটে। মান্না ভাইয়ের এই টেপে কি আসলে খুব অবাক হবার মতো কিছু আছে? হৈ চৈ আর হট্টগোল করতে গিয়ে আমরা কখনও কখনও আসল বিষয়ে ফোকাস করি না। মান্না যখন ডাকসুর ভিপি, তখনও তিনি আওয়ামী-বিরোধী। যে ভোটের জোরে মুজিববাদীদের হারাতেন সেগুলো আসলে কার ভোট? সমাজতন্ত্রীদের? হাসালেন রে, ভাই!

তখন বিএনপি ছিল দুর্বল; জামাত হচ্ছে সংগঠিত; সে সময়কালে মান্নাদের মতো বিপ্লবীদের পেছনে কাতার বেঁধে দাঁড়ানো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ভোটেই এরা জিতে আসতেন। জাসদের মতো মান্না ভাই্য়ের ভাগ্যও একসময় ফিকে আর দুর্বল হয়ে পড়ল। খুব অবাক হয়েছিলাম তিনি যখন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। সে পেয়ার মহব্বত যে বেশি দিন টিকবে না এটাই ছিল স্বাভাবিক।

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ব্যবধানে কত বড় বড় মানুষের মাথা ঘুরে গেছে, আর ইনি তো নস্যি। আস্তে আস্তে তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ল। আবার এমনও হতে পারে, আওয়ামী লীগের অনমনীয় দুর্বিনীত আচরণে তিনি আসল পথে ফিরে গেলেন। খালেদা জিয়া বা বিএনপিও তার তুরুপের তাস। যেন তেন প্রকারে নিজের কাজ হাসিলের জন্য তিনি অনেক ধরনের কথা বলেছেন। এটা কি নতুন যে 'বাম' নামে পরিচিতদের একটি ঘরানা চিরকাল বলে আসছে 'বন্দুকের নলই সব কিছুর উৎস'? নকশাল, জাসদ বা আমাদের চৈনিক বামরা কি তার বাইরে? মান্নার বর্তমান থিওরিও তাই।

খালি মুশকিলটা হল, গণতন্ত্রের সংগ্রাম করার নামে তারা এখন উত্তরপাড়ার পায়ে ধরতেও আগ্রহী। আমি এতে একটুও অবাক নই। কথোপকথনে অষ্ট্রেলিয়ার কথা এসেছিল। যদি বুঝে থাকি, চিনে থাকি, তো সে লোকটিও ছিলেন আওয়ামী আশীর্বাদপুষ্ট; এক্সটেনশন পাওয়া ভদ্রলোক।

জানি না কী হবে। তবে একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের যৌবনে, জেনারেল জিয়ার সময়ে নানাভাবে প্রগতিশীলরা আন্দোলনে নয়তো নির্বাচনে থাকার কৌশল বেছে নিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল ওসমানীকে সামনে রেখে একবার দেশ প্রধানের পদে নির্বাচনে নেমেছিল সবাই। লাল দিঘীর মাঠে পড়ন্ত সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষের এক সমাবেশে তরুণ মান্না ভাই ওসমানীকে 'সিপাহশালার', আরও কী কী যেন ডেকে বক্তৃতা দীর্ঘ করছিলেন। মঞ্চ থেকে প্রচণ্ড এক ধমকে তার ভাষণ থামিয়ে দিয়েছিলেন ওসমানী স্বয়ং। 'পুঁচকে ছোড়া' বলে তাকে ভৎর্সনা করতেও কসুর করেননি।

মান্নার গ্রেপ্তার নিয়েও তৈরি হল নতুন নাটক। তার পত্নী বলছিলেন, তার স্বামীকে আটক করা হয়েছে। আইনের মানুষ ও ডিবির মানুষরা বলছিল, না। প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, মাহমুদুর রহমান মান্না কি তাহলে নব্য ইলিয়াস আলীতে পরিণত হতে চলেছেন? এর পেছনে কি আছেন সে সব বড় বড় রাঘব বোয়াল যারা এক এগারোর স্বপ্ন দেখিয়ে থাকেন? মান্না ধরা পড়লে কি তাদের সব খবর বেরিয়ে যাবার ভয়? নাকি অন্য কোনো ইশারা বা ছায়ায় গায়েব হয়েছিলেন মান্না?

শেষাবধি তাকে পাওয়া গেল। মামলাও হল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর কি আমরা পাব? আদৌ? নাকি আরও নতুন সব আটকের আবর্তে পড়ে আবার কিছুদিন মাতম চলবে দেশে?

হায় রে বাংলাদেশ, কে জানে এর শেষ কোথায়?