এক পাল্লায় দুই নেত্রী এবং কিছু ব্যক্তিগত কৈফিয়ৎ

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 23 Feb 2015, 12:47 PM
Updated : 23 Feb 2015, 12:47 PM

'জামাতের কালো রাজনীতি ঢেকে দিচ্ছে বিএনপির মুখ' শিরোনামে আমার লেখাটির জন্য পাঠকদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেয়েছি। অনেকেই আমাকে ফোনে, ই-মেইলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। লেখাটির প্রশংসা করেছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ সমালোচনাও করেছেন। কারও কারও সমালোচনায় যুক্তি আছে; কারওটায় নেই, আছে ব্যক্তিগত আক্রমণ।

আসলে কলেবরের কথা বিবেচনায় রেখেই লিখতে হয়। একটি লেখায় সব বিষয় পরিষ্কার করে তুলে ধরা যায় না। তাছাড়া আমার মতের সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করবেন, সেটাও কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। দ্বিমত, ভিন্নমত প্রত্যাশিত কারণ যুক্তি, পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়েই সমাজে একটি মত বা বিশ্বাস দৃঢ়তা পায়। তবে কতগুলো ঐতিহাসিক সত্য আছে, যা নিয়ে বিতর্ক তুলে ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না। সে ধরনের বিতর্ক সুস্থতার লক্ষণ নয়, তাই সেগুলো কাম্যও নয়। আমাদের দেশে যেটা প্রায়ই হয়, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কিংবা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক পাল্লায় মাপার আমি বিরোধী। এটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত অবস্থান। তবে অন্ধ অনুরাগ বা বিরাগের বশে আমি আমার এই অবস্থান তৈরি করিনি। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার কোনো দোষ-ত্রুটি নেই তা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগকে আমি একটি রাজনৈতিক দল বলেই মনে করি, কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়।

আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো নয়। কাজেই তাদের কাছে আমি শুধু ভালোটাই প্রত্যাশা করি না, অনেকে যেমন করেন। বিএনপি বা বেগম জিয়া খারাপ কিছু করলে সেটা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে হবে, কিন্তু আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার বেলায় উল্টোটা– এই দ্বৈত অবস্থান মেনে নিতে পারি না বলেই দুই দল ও দুই নেত্রীর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা উঠলে আমি আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে একটু এগিয়ে রাখি।

এ ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, লেখালেখিতে আমার অবস্থান 'নিরপেক্ষ' নয়। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত না হলেও আমার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাও আছে। নির্বাচনের সময় আমি একজন রাজনৈতিক প্রার্থীকেই ভোট দিই। সে প্রার্থী যে রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত হন, সেই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম না হলে নিশ্চয়ই আমি সে প্রার্থীকে ভোট দিতাম না। তার মানে আবার এটা নয় যে, ওই রাজনৈতিক দল যা করে আমি তার পক্ষেই ডুগডুগি বাজাই বা বাজাব। ভালো কাজের পক্ষে থাকা এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করা, প্রতিবাদ করাই আমি যৌক্তিক মনে করি। আমি আওয়ামী লীগকে ভোট দিই বলে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা অন্য অন্যায়-অনিয়ম, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ 'লীগ' পরিবারের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস সমর্থন করি বা করব, তা কখনও নয়।

যারা আমার লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত তাদের এটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, আওয়ামী লীগের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য বা কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য আমি কিছু লিখি না। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে লিখছি। স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনামলে আমি যখন রাজনৈতিক বিষয়ে লিখেছি, তখন দেশে এত সংবাদপত্র ছিল না, ছিলেন না এত কলাম লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বরং এখন যেসব অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা কলাম লিখে নাম করেছেন, তারা তখন সবাই ছিলেন স্বৈরশাসকের তল্পিবাহক। এরা এখন দেশে গণতন্ত্র কীভাবে মজবুত হবে, সরকার কতসব ভুল করছে সে বিষয়ে দেশবাসীকে কত জ্ঞান দিচ্ছেন। চাকরিরত অবস্থায় সরকারের কোনো গণবিরোধী পদক্ষেপের তারা বিরোধিতা করেছিলেন, জনগণের পক্ষে কোনো কথা বলেছিলেন বলে কি শোনা গিয়েছিল? তাদের জন্য গণমাধ্যমের দুয়ার এখন অবারিত। আর সাংবাদিকতা করেও কোনো সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখার সুযোগ পর্যন্ত পাই না। সংবাদপত্রে চাকরি জোটে না। সব পত্রিকায় আমার লেখা ছাপাও হয় না।

সংবাদপত্র সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম প্রায় দু' দশক। অথচ কোন কাগজে কোন লেখা কেন ছাপা হয় অথবা কেন ছাপা হয় না সেটা এখন আমি আর বুঝতে পারি না। আজকাল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি সরকার হরণ করছে? সরকার কি কোনো সংবাদপত্রে কারও লেখা ছাপতে বা না ছাপতে বাধ্য করছে? টেলিভিশন টকশোতে যিনি গলা ফাটিয়ে বলেন যে, সরকার বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, তিনি ভুলে যান যে তিনি যেসব কথা বলেন তা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। তিনি সরকারকে 'অবৈধ' বলছেন। সরকার আরও কী কী 'দুষ্কর্ম' করেছে তার বিবরণ দিচ্ছেন। এমনকি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ মানুষ হত্যার পক্ষেও সওয়াল করছেন। আবার একই মুখে বলছেন, সরকার বিরোধী মত প্রকাশ বা প্রচার করতে দিচ্ছে না!

প্রসঙ্গত অতি সাম্প্রতিক দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি জাতীয় দৈনিকে মাঝে মাঝে আমার লেখা ছাপা হয়। ওই কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে আমার একজন বন্ধু কাজ করেন, যিনি নিজেও চমৎকার কলাম লিখেন। তার ভরসাতেই ওই কাগজে লেখা পাঠাই, দেরি হলেও তা ছাপাও হয়। তো, কয়েক দিন আগে একটি লেখা পাঠালাম। কিন্তু লেখাটি ছাপা হয় না। সপ্তাহ খানেক পর বন্ধুবরের সঙ্গে দেখা হলে তিনি নিজে থেকেই জানালেন যে, লেখাটি পরের দিন ছাপা হবে। তবে এটাও বললেন, লেখাটি একটু 'বিএনপিবিরোধী' হয়েছে। আমি বললাম, ''তাহলে তো ভালোই, সরকার 'হস্তক্ষেপ' করবে না, আপনাদের প্রতি তুষ্ট হবে।''

যাহোক, ওই লেখাটি আর ওই কাগজে ছাপা হয়নি। আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিল কে, সরকার, না ওই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ? তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে বলা বা লেখার নামই কি বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা?

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটিও কম চমকপ্রদ নয়। মালিক এবং সম্পাদক আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা পাঠিয়ে দু'দিন পর সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ফোন করলাম একটি ভুল শব্দ শুদ্ধ করার জন্য। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমার পরিচিত এবং নামজাদা সাংবাদিক। নানা বিষয়ে কথার পর লেখার প্রসঙ্গ উঠতে তিনি যা বললেন, সেটা শুনে লজ্জা পেলাম, মর্মাহত হলাম। মনে হল, তওবা করে কলাম লেখা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তিনি বললেন, ওই পত্রিকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পেশাদার সম্পাদক নাকি সাংবাদিকের লেখা ছাপতে উৎসাহ বোধ করেন না। এটা কি বিশ্বাস করার মতো? কিন্তু নিজের কানেই তো শুনলাম। অবিশ্বাস করি কী করে!

ওই কাগজে একজন সাবেক আমলার একটি ঢাউস সাইজের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম এটা বোঝার জন্য যে, ওই লেখায় এমন কী আছে যার জন্য লেখাটি ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। শেষ প্যারায় এসে মনে হল, পেয়েছি, কারণ খুঁজে পেয়েছি। আসলেই অত চমৎকার এবং মূল্যবান পরামর্শ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরামর্শটা কী?

আমলা-পণ্ডিত লিখেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আলোচনায় বসা সুবিবেচিত হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ আলোচনায় অন্তর্ভুক্তি যুক্তিযুক্ত হবে না। না পাঠক, এত বড় 'নিরপেক্ষ' হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে প্রচার করা হলেও মূল সংকট কিন্তু জামাত এবং যুদ্ধাপরাধ ইস্যু কেন্দ্র করেই। তাই জামাত-যুদ্ধাপরাধ ইস্যু পাশ কাটিয়ে রাজনীতি থেকে অস্থিরতা দূর করা যাবে না।

ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম। পাঠক মার্জনা করবেন। এবার আসি আমার লেখার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে। একজন পাঠক আমাকে 'সাংবাদিক ও কলামিস্ট পরিচয় না দিয়ে', 'বিশিষ্ট আওয়ামী চামচা বলে পরিচয়' দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাতে নাকি আমার অনেক উন্নতি হবে। তার জ্ঞাতার্থে সবিনয়ে শুধু এটুকুই জানাতে চাই যে, চামচাগিরি করে উন্নতি করার ইচ্ছা থাকলে এই পরিণত বয়সে সংবাদপত্রে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে বিফল হতে হত না। আমি সরকারের কতটা কাছের অথবা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে কতটুকু 'উন্নতি' করেছি, সে সম্পর্কে একটি তথ্য।

বছর খানেক আগে হঠাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংবাদপত্র বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, যাক শেষ পর্যন্ত আমার প্রতি নজর পড়েছে। কিন্তু দিন কয়েক পর হঠাৎ করেই আমার ডাক আসা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ কী? যতটুকু বুঝতে পেরেছি, একটি অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়ে আমি বলেছিলাম, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়ার আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বক্তব্য দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর উচিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন বক্তব্য দিলে সুষ্ঠু তদন্ত ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ব্যস। তারপর থেকেই বিটিভির দুয়ার আমার জন্য বন্ধ।

এবার তাহলে বুঝুন আমি কত বড় চামচা!

'জামাতের আলকাতরায় ঢেকে যাচ্ছে বিএনপির মুখ' লেখাটির উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের খারাপ দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা আড়াল করা নয়। আওয়ামী লীগ ধোয়া তুলসি পাতা নয়। খারাপ কাজ এই দলও করে। তবে আওয়ামী লীগ ভালো হওয়ার চেষ্টা করলে ফল কী হয়? এরশাদ পতনের পর আওয়ামী লীগে যোগ দিতে গিয়েছিলেন বিতর্কিত মামলা এম কে আনোয়ার। আওয়ামী লীগ তাকে 'আবর্জনা' মনে করে দলে নেয়নি। তিনি কালবিলম্ব না করে বিএনপিতে নাম লেখান, নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে জিতে এসে মন্ত্রীও হয়ে যান। তিনি এখন মস্তবড় জিয়ার সৈনিক। আওয়ামী লীগ হারিয়েছে একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক!

বিষয়টি কী দাঁড়াল? আওয়ামী লীগ যাদের দলে নেয়ার অযোগ্য মনে করে বিএনপি যদি তাদের জন্য দরজা খুলে দেয় এবং দেশের মানুষও সেটা সমর্থন করে তাহলে আওয়ামী লীগ কী করবে? জনসমর্থন পাওয়ার জন্য দু'চারজন বিতর্কিতদের দলে জায়গা না দিলে টিকে থাকাই তো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ক্ষমতায় থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহসিন হলে সাত খুনের ঘটনা ঘটিয়েছিল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ। ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম প্রধান ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হয়নি। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। আদালতে তার শাস্তি হয়েছিল। অথচ তার শাস্তি মওকুফ করলেন কে? জিয়াউর রহমান। সেই 'খুনি' সফিউল আলম প্রধান এখন দেশের একজন রাজনৈতিক নেতা এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক। বেগম জিয়ার সঙ্গে এক মঞ্চে ভাষণ দেন। আওয়ামী লীগ সরকার খুনের বিচার করে খুনিকে শাস্তি দিয়েছে, আর জিয়াউর রহমান তাকে 'ক্ষমা' করেছেন; বেগম জিয়া তাকে জোটসঙ্গী করেছেন।

এখন আমি কি বলব, আওয়ামী লীগ খারাপ করেছে, বিএনপি ভালো করেছে?

শেখ হাসিনার আগের মেয়াদে বিএনপি জোটের ডাকা এক হরতালের দিন পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসী। ঘটনাটি দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। ছাত্রলীগ বলে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়নি। ঘাতকদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে, আদালত শাস্তির রায়ও ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে বেগম জিয়ার প্রধামন্ত্রিত্বের সময় বুয়েটের ছাত্রী সনি নিহত হয়েছিলেন ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের গুলিতে। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ঘাতকদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল খালেদা জিয়ার সরকার।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কি এগিয়ে না পিছিয়ে?

দেশের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'বাকশাল' তৈরি করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন, আর তাঁকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিয়েছেন– তথ্যটি নির্ভুল নয়। তবে শুধু এই তথ্য উল্লেখ করলেই সে সময়ের বাস্তবতা ও রাজনীতির সব সত্য প্রকাশিত হয় না। এটা একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় বলে সেদিকে না গিয়ে আমি শুধু বলতে চাই, দরখাস্ত দিয়ে রাজনৈতিক দল করার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান কি দেশের প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, নাকি, নির্বাচনী ব্যবস্থা তামাশায় পরিণত করেছিলেন? সাজানো-পাতানো নির্বাচনী ধারার জনক জিয়া নিজে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়ে 'হ্যাঁ-না' ভোটের আয়োজন করে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট নিয়ে যে গণতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, তার বিষজ্বালা থেকে জাতি কি এখনও মুক্ত হতে পেরেছে? জিয়াউর রহমান পিপিআরের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিয়ে দেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে পোক্ত করেছেন, নাকি এর আড়ালে ধর্মভিত্তিক দল গঠনের সুযোগ দিয়ে গণতন্ত্রের জন্য স্থায়ী বিপদের বীজ রোপণ করে গেছেন?

বিএনপির সঙ্গে জামাতের ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির প্রসঙ্গ তুললেই কেউ কেউ এই বলে তেড়ে ওঠেন যে, জামাতের সঙ্গে ঐক্য করা যদি দোষের হয় তাহলে আওয়ামী লীগ যে জামাতের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছিল সেটা কি দোষনীয় নয়? অবশ্যই সেটা দোষের। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সঙ্গে জামাত তাল মিলিয়েছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে সে সময় মতিউর রহমান নিজামী একসঙ্গে সংসদ ভবনে একটি বৈঠকও করেছিলেন। জামাতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই কৌশলের ঐক্যও আমি সমর্থনযোগ্য মনে করি না। জামাতকে জাতে ওঠার এই সুযোগ আওয়ামী লীগ না দিলেই ভালো হত। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, তখন জামাতকে এড়ানোর সুযোগ আওয়ামী লীগের ছিল কি-না। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সংসদে তাদের সঙ্গে বসতেই হত। জামাতকে রাজনীতি করার সুযোগ বিএনপি দিয়েছিল বলেই তাদের পক্ষে সংসদে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে কার জন্য? উত্তরটা নিশ্চয়ই জিয়াউর রহমানের কল্যাণে। আর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জামাত মাঠে নেমেছিল বিএনপির লেজ ধরে, বেগম জিয়ার প্রশ্রয়ে। এরশাদ পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামাতের সঙ্গে গোপন সমঝোতার কারণেই বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হয়েছিল।

বিএনপির সঙ্গে জামাতের ঐক্য ও সমঝোতার বিষয়টি যারা আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সঙ্গে এক করে দেখেন, তারা বড় মতলববাজ। ওই আন্দোলনে থেকে তখন আওয়ামী লীগের কাছে জামাত কোনো সুবিধা পায়নি। সে সময় জামাতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের বোঝাপড়া হলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংসদে জামাতের আসন সংখ্যা তিনে নেমে আসত না। বিএনপির সঙ্গে থেকে জামাত ফুলে ফেঁপে ওঠে, আর আওয়ামী লীগের লেজ ধরে তার শক্তি ক্ষয় হয়। তারপরও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জামাতকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ যদি কোনো লঘু 'পাপ' করেও থাকে, তাহলে তার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগ করছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হত্যা বা বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে এটা কি বলা যায় যে, আওয়ামী লীগই দেশে হত্যার রাজনীতি বা বিচারবহির্ভূত হত্যার সূত্রপাত করেছে? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি কম নির্দয় ও নিষ্ঠুর, সেটা প্রমাণ করা মতো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় কি?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে বর্বরভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা বদলের যে ধারার সূচনা হয়, তার 'বেনিফিশিয়ারি' কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ নয়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন তারা একটি ভুল যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে তা করেন। যদি এই যুক্তি সত্য বলে ধরা হয় তাহলে জিয়াউর রহমানের হত্যার জন্য সেনাবাহিনীকেই দায়ী করতে হয়। কারণ জিয়াউর রহমান কয়েক জন 'বিক্ষুব্ধ' সেনা সদস্যের হাতেই নিহত হয়েছেন। 'কয়েক জন' সেনা সদস্যের জন্য যেমন গোটা বাহিনী দায়ী হতে পারে না, তেমনি একজন খোন্দকার মোশতাকের জন্য পুরো আওয়ামী লীগকে দায়ী করা যায় না।

হত্যার রাজনীতির পথ ধরেই জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেই তার রাজনৈতিক দল গঠন করা। সে দলের নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বিএনপি যে হত্যার রাজনীতির ধারা থেকে সরে এসেছে সেটা কি প্রমাণ করা যায়? বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হয়েছেন। যেমন, শাহ এএসএম কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মনজুরুল ইমাম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল একাধিকবার। তাঁর জনসভায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ 'নির্মূল' করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ কমপক্ষে ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন ওই হামলায়।

এটা কি ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতা নয়? বিএনপি নেতারা আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর কথা কি প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেননি?

বলা হতে পারে, এসব হত্যাকাণ্ড বিএনপি ঘটিয়েছে সেটা বলা কি ঠিক? বিএনপিকে অভিযুক্ত করার কারণ এসব ঘটনা ঘটেছে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে। তখন এসব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য সরকার, প্রশাসন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং প্রতিটি ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কিংবা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সরকারের স্পষ্ট ভূমিকা ছিল। সে জন্য ওইসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অনেকেই বিশ্বাস করেন।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বিএনপির কোনো যোগ না থাকলেও ওই ঘটনা না ঘটলে তো বিএনপির জন্মই হত না। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের রক্ষা করার জন্য জিয়া সব রকমের চেষ্টা করেছেন। তাদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন। তাদের বিচার যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা করেছেন। আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন। জিয়ার শাসনাবসানের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিএনপিও সে পথ থেকে সরে আসেনি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েই ১৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন হিসেবে পালন করা শুরু করলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তার এই জন্মদিনের কথা জানা যায়নি। এমনকি তার বাবা-মাও জানতেন না যে, তাদের মেয়ে কোনো এক ১৫ আগস্টে জন্ম নিয়েছেন!

এরপরও বলতে হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক? শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে এক পাল্লায় উঠিয়ে বলতে হবে, দেশের রাজনৈতিক সংকটের জন্য তারা দুজনেই সমান দায়ী? আওয়ামী লীগ যদি একটা খারাপ করে থাকে তাহলে বিএনপির খারাপের সংখ্যা হবে কমপক্ষে তিনটা। একটা খারাপ আর তিনটা খারাপ কখনও সমান হতে পারে না। এক সের আর তিন সের নিশ্চয়ই সমান ওজন নয়।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।