‘ঘরপোড়া গরু’দের কথা

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
Published : 19 Feb 2015, 03:48 AM
Updated : 19 Feb 2015, 03:48 AM

প্রচলিত প্রবাদ আছে, 'ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়'। আমি লেখার শিরোনাম এই পরিচিত প্রবাদ থেকে নিয়েছি। ঘরপোড়া গরুদের গল্প নয়, আমি লিখতে বসেছি তাদের ভয়ের কথা, যাদের অবস্থা 'ঘরপোড়া গরু'দের মতোই। তারা এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কথা বলছি আমি।

গত প্রায় দেড় মাস ধরে দেশজুড়ে নাশকতা ও সন্ত্রাস চলছে তাতে 'ঘরপোড়া গরু'র মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে চরম আতংকের ভেতর দিন কাটাচ্ছেন সে ব্যাপারে বোধহয় দ্বিমত করবেন না দেশের সচেতন কোনো মানুষ। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো, এনজিও, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরাও যে বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, সেটাও বুঝতে পারি। ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে জানি যে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। সচেতনও। কিন্তু তবুও যে আঁধার ঘোচে না। আতংক দূর হয় না। স্বস্তিতে কাটে না দেশের সংখ্যালঘুদের জীবন। কারণ ঐ যে, 'ঘরপোড়া গরু'র মতো দেশ একটু গরম হলেই তাদের আতংক বেড়ে যায়।

কারণ খুঁজতে একটু পেছনের দিকে তাকাই। দূর অতীতে যাব না। '৪৭-পরবর্তী সময়, '৫৮, '৬০, '৬৪, '৬৫ এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং ভিটামাটি ছাড়া করার ইতিহাস টেনে লেখাটি বড় করার দরকার নেই। সংখ্যালঘুদের মনে আতংক সৃষ্টি হওয়ার জন্য নিকট অতীতের কিছু ঘটনা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে।

পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার মাসুল বেশ ভালোভাবেই দিতে হয়েছে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। তখন হাজার হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একাত্তরের পর এই প্রথম বিরাট সংখ্যক হিন্দু বলতে গেলে সহায়সম্পত্তি ফেলে রেখে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং তাদের সমর্থকরাই এই ঘটনার জন্য দায়ী। কারণ তারা এই দেশ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দেশটাকে আবার পাকিস্তান বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।

পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত দেশে ছিল সামরিক-আধাসামরিক শাসন। তখনকার শাসকশ্রেণির কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুরা, ছিল চৌবাচ্চার মাছের মতো। ইচ্ছেমতো তাদের ধরো, মারো, ছাড়ো। মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙো, ঘরবাড়ি তছনছ করো, ব্যবসাবাণিজ্যে বাধা দাও, হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট ইত্যাদি যত রকম কুকর্ম আছে সবই করো ইচ্ছেমতো।

মজার ব্যাপার হল, '৭৫ থেকে '৯০ পর্যন্ত দুঃশাসনের হাত থেকে মুক্ত হতে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়, তার মাসুলও দিতে হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলন থিতিয়ে দেওয়ার জন্য। পাহাড়ের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীও সে সময় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। '৯০ সালে স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন 'ভারতে বাবরি মসজিদ হিন্দুরা ভেঙে ফেলেছে' জাতীয় গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে মন্দির ভাঙা, বাড়িঘর-দোকানপাট ধ্বংস ইত্যাদি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এই পরিকল্পিত নাশকতার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করলেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন থেকে আতংক দূর হয় না।

এর মাত্র দুই বছর পরে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে আবারও সেই পূর্ববর্তী ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নারী ধর্ষণ, জমি দখল, মন্দির-বিগ্রহ ভাঙা, দোকান লুট ইত্যাদি। এসব আমার মনগড়া কথা নয়। এসবের তথ্য-প্রমাণ আছে।

এরপর আসি ২০০১ সালের কথায়। জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে, লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক আমলে এবং নির্বাচনোত্তর খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের কথা তো ভুলে যাওয়ার নয়। প্রায় তিন-চার মাস ধরে সমস্ত দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে বীভৎস ও হৃদয়বিদারক নিপীড়ন চালানো হয় তার বিবরণ তখনকার জাতীয় সংবাদপত্র ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসবে। ঐ সময়ে দৈনিক কাগজগুলোতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওপর শত শত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ছাপা হয়েছে প্রচুর সংখ্যক সম্পাদকীয়, মন্তব্য রিপোর্ট, মতামত। বিদেশি গণমাধ্যমেও নির্যাতনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বারবার প্রচারিত হয়েছে। লাভ খুব একটা হয়নি। ভয়ের কালো মেঘ কাটেনি।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মপ্রতিষ্ঠান 'রামু প্যাগোডা' আক্রমণ করে ধ্বংস করা হয়। সেই সঙ্গে সাতক্ষীরা, চিরির বন্দর, উখিয়া, চট্টগ্রামের পাথরঘাটা জেলে পাড়া, হাটহাজারী, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালানো হয় সহিংসতার তাণ্ডব। 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ' কর্তৃক প্রকাশিত 'এট্রোসিটিজ অন মাইনোরিটিজ ইন বাংলাদেশ' শিরোনামের প্রামাণ্য গ্রন্থে নির্যাতনের ভয়াবহ দলিলচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের নামে তখন চালানো হয়েছিল মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা এবং ভয়াবহ নাশকতা। ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তথ্য তুলে ধরে বলেন:

''২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩২ জেলায় সংখ্যালঘুদের ৪৮৫টি বাড়ি-ঘর, ৫৭৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৫২টি মন্দির-উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর, হামলার ঘটনা ঘটে।''

এছাড়া হত্যা ও ধর্ষণের তথ্যও তারা তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনে। তাতে কি আর আতংক দূর হয়?

উপরোল্লিখিত ঘটনার বাইরেও ঘটনা আছে। তবু যেটুকু বলা হয়েছে সেটুকুই সংখ্যালঘুদের মনে সারাক্ষণ আতংক জিইয়ে রাখে। সারাক্ষণই কী হয় কী হয় ভয়। কখন কী ঘটে যায়! আবার উচ্ছেদ, আবার সর্বস্বান্ত হওয়া! আর কত অপমানের লজ্জা!

মাস দেড়েক ধরে দেশজুড়ে সন্ত্রাস ও পৈশাচিক নাশকতা যারা চালাচ্ছে তাদের হাতে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা নিরাপদ নয়। উচ্ছেদের ঘর কতবার আর বাঁধা যায়। প্রশাসন আর পুলিশ-র‌্যাব শুধু নয়, এদের পাশে দাঁড়াতে হবে জনপ্রতিনিধিদের, যাদের ভোটের বাক্সে সংখ্যালঘুদের ভোটও রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বলতে হবে, 'দূর হ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস'।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়: নাট্যব্যক্তিত্ব।