যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ২৮ ‘‘যারা মানুষ পুড়াইয়া মারছে, তারা কি মানুষ’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 18 Feb 2015, 02:32 PM
Updated : 18 Feb 2015, 02:32 PM

''যুদ্ধে যাব, এ খবর পৌঁছে যায় মায়ের কানে। শুনেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। যুদ্ধে গিয়ে কেউ কি জীবন নিয়ে ফিরে আসে! মায়ের মনে নানা ভয়, নানা শংকা। আমাকে তিনি চোখে চোখে রাখলেন। রাতে ঘুমাতেন না। যদি পালিয়ে চলে যাই। মাকে শান্ত করতে প্রতিশ্রুতি দিই, 'কখনও মুক্তিযুদ্ধে যাব না'। কিন্তু কয়েক দিন পরই তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়।

দিনাজপুরের বুড়িতলা। আমাদের পাশের গ্রাম। খানদের ঘাঁটি শহরে। শহর থেকে একদিন তারা হানা দেয় ওই গ্রামে। দূর থেকে শুনি খানদের জিপ আসার শব্দ। ভয়ে গ্রামবাসী গা ঢাকা দেয় ক্ষেত-খামারে। কাউকে না পেয়ে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়। জ্বালিয়ে দেয় গোটা গ্রামটি।

আশপাশের গ্রামবাসী তখন ভয়ে তটস্থ। অন্যদের মতো আমরাও উতরাইল গ্রাম ছাড়ি। পরিবার নিয়ে পাড়ি জমাই ভারতে। বনতারা ও খানপারের মাঝামাঝিতে ভারতীয় সীমান্ত। তা পেরিয়ে চলে আসি ভারতের ফকিরগঞ্জে। আশ্রয় মিলে এক আত্মীয়ের বাড়িতেই।''

জীবনের গল্প শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সাদেক আলীর জবানিতে।

প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ। তার ওপর দেশজুড়ে অবরোধ। এরই মাঝে আমরা পা রাখি দিনাজপুরের উতরাইল দক্ষিণ কামাতপাড়া গ্রামে, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর বাড়িতে। ঢাকার ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন এই মুক্তিযোদ্ধা। টানা অবরোধের কারণে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামে ফিরে তাই তিনি অন্যের জমি বর্গা নিয়েছেন।

মাঈনুদ্দিন সরকার ও শমিরুন্নেছার দ্বিতীয় পুত্র সাদেক। সংসার ছিল বড়। সাত ভাই এক বোন। জমিজমা ছিল না। বাবা চাষাবাদ করতেন অন্যের জমিতে। তাঁর ভাষায়: ''গরিব ছিলাম খুবত আমরা। কষ্ট করি লেখাপড়া করিয়েছে বাবায়। এরপরই তো যুদ্ধ।''

ঊনিশশ একাত্তরে সাদেক আলী ছিলেন উদরানি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। ফুটবল খেলার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। খেলার সাথী বাল্যবন্ধু শাহজাহান, কিরন, কালিসহ অনেকের কথা বলতে গিয়ে আজও তিনি আবেগতাড়িত হন। আমরা আলাপ জমাই তাঁর জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে। প্রশ্নের পিঠে চলে প্রশ্ন।

সাদেক আলী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেডিওতে। তাঁর কাছে সেটিই স্বাধীনতার ঘোষণা। তিনি বলেন, '''তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব…' এই কথার পর স্বাধীনতার ঘোষণার আর কী দরকার পড়ে?''

ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়টায়?

মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর উত্তর, ''খানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে আমরা ভিন দেশে। এভাবে আর কত দিন বসে থাকব! দেশটা তো মুক্ত করতে হবে। জানটা না হয় যাবে। তাতে কী! নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। মনে মনে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে ফেলি। কিন্তু মাকে জানাই না। এক দুপুরে বেরিয়ে পড়ি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে। কেউ না জানলেও আমার সব পরিকল্পনার কথা জানতেন বাবা মাঈনুদ্দিন সরকার।''

কোথায় ট্রেনিং নেন?

''প্রথমে নাম লিখাই ফকিরগঞ্জ রিক্রুটিং ক্যাম্পে। আমাকে প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়, 'কেন যুদ্ধে যাবে?' উত্তরে বলেছিলাম, 'দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধ করতে চাই। দেশ না বাঁচলে তো আমরাও বাঁচব না।' প্রাণসাগরে প্রথম সাতদিন লেফট-রাইট করানো হয়। অতঃপর শিববাড়ী, রায়গঞ্জ, তরঙ্গপুর হয়ে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ট্রেনিং হয় ২৮ দিন। অস্ত্র চালানো থেকে শুরু করে যুদ্ধের সব রকম কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনিংয়ে। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল ১৪৮৭।''

অপারেশন করেন কোথায় কোথায়?

''ট্রেনিং শেষে আমরা আসি ৭ নং সেক্টরের বড়গ্রাম ক্যাম্পে। আমাদের ৩৮ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল ছিল। কমান্ডে বসাদ মাস্টার। আমরা ছিলাম গেরিলা। ট্রেনিংয়েই আক্রমণের নির্দেশনা ছিল, হিট অ্যান্ড রান। এভাবে বড়গ্রাম ক্যাম্পে থেকেই আমরা অপারেশন চালাই দাইনর, পাতইলশাহ, হাকিমকুড়ি, বড়গ্রাম, ত্রিশুলা, মোহনপুর এলাকাগুলোতে।

অক্টোবর মাস তখন প্রায় শেষ। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। একটা সার্কুলার জারি হয়। এখন আর গেরিলা আক্রমণ নয়, ফ্রন্ট ফাইটে যেতে হবে। প্রথম প্রথম কিছুটা ভয় পেতেন সাদেক আলী। তখন তাঁর মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। একমাত্র আদরের বোন মনোয়ারা, তাঁর কথা মনে হলেই সাদেকের বুকটা হু হু করে উঠত। তবুও পরিবারের মায়া তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সব ভুলেই তাঁরা সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

গম্ভীর কণ্ঠে সাদেক জানান সে যুদ্ধের কথা। আমরাও চোখ ফেরাই চুয়াল্লিশ বছর পেছনে। শুনি তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া যুদ্ধদিনের গদ্য। তাঁর ভাষায়–

''৬ নভেম্বর, ১৯৭১। পরিকল্পনা হয় মোহনপুর ত্রিশুলায় পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের। ইন্ডিয়ান আর্মিসহ আমরা দুশ জন। কমান্ডে ছিলেন ফজলুর রহমান স্যার এবং ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন এসএস বার্ট। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা বনতারা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি। পরিকল্পনামতো ফকিরগঞ্জ থেকে ত্রিশুলার দিকে আর্টিলারি সেল ছোঁড়া হল। সে সুযোগে আমরাও অগ্রসর হই।

পায়ের দিকে তাকালে আজও সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কাছে–

''রাত তখন দুটো। ত্রিশুলায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের চারপাশে আমরা পজিশন নিই। টের পেয়ে খানরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। আমার পাশেই ছিল সহযোদ্ধা প্রফুল্ল। একটি গুলি এসে লাগে তার বুকে। যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। থানিক পরেই তার দেহ নিস্তেজ হয়ে যায়। খুব কাছ থেকে দেখেছি তার মৃত্যুযন্ত্রণা। বুকের ভেতরটা তখন কেঁপে উঠছিল। তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! আমরা চর্তুমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা নেই। ফলে তারা টিকতে পারে না। থেমে থেমে গোলাগুলি চলে ভোর পর্যন্ত। অতঃপর তাদের ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে আমাদের হাতে।''

আহত হওয়া ও দেশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী:

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় সাদেক আলীর ডান পা। ফলে পঙ্গু অবস্থাতেই কাটছে তাঁর জীবন। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত সে দিনটিতে। আমরা প্রশ্ন করি। কিন্তু উত্তর মিলে চোখের জলে। ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। আমরাও আনমনা হই। তাঁকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই। তাই তাঁর হাতে শুধু হাত রাখি। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলতে থাকেন–

''মোহনপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি শক্তিশালী ঘাঁটি। ত্রিশুলায় তাদের ক্যাম্প দখলে নেওয়ার দিনই পরিকল্পনা হয় মোহনপুর আক্রমণের। ক্যাম্পে ফিরেই আক্রমণের সব কৌশল জানিয়ে দেওয়া হয়।

৭ নভেম্বর, ১৯৭১। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা প্রথম ত্রিশুলা ক্যাম্পে পৌঁছি। তখন রাত ২টা। ত্রিশুলা থেকেই যেতে হবে মোহনপুরের দিকে। যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি কাঁচা। রাস্তার মাঝে বড় বড় গর্ত। খানরা সেখানে বিছিয়ে রেখেছে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন। কিন্তু তবুও সে পথেই আমাদের এগোতে হবে। সবার সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে। হঠাৎ সামনে একটি গর্ত পড়ে। সেটি লাফিয়ে পার হয় সবাই। আমি ছিলাম মাঝের সারিতে। লাফ দিতেই পা গিয়ে পড়ে উঁচু একটি জায়গায়। অমনি বিকট শব্দ। আমি ছিটকে পড়ি। শুয়ে সবাই পজিশন নেয়। আমি তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। চারপাশে কুণ্ডলি পাকানো ধোয়া। দাঁড়াতে যাই, কিন্তু ডান পা ফেলতে পারছি না। পড়ে যাচ্ছি। পায়ে কী হল!

পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ডান পায়ের বেশ কিছু অংশ উড়ে গেছে। কয়েকটি রগ ঝুলে আছে শেকড়ের মতো। রক্তের সঙ্গে বেরুচ্ছে হাড়ের মজ্জাগুলো। আমি তখন স্থির হয়ে যাই। খানিক পরে জ্ঞান হারাই। চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু পায়ের দিকে তাকালে আজও সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে।''

চিকিৎসা নিলেন কোথায়?

''প্রথম ভাবিনি বেঁচে যাব। আমার পাশেই ছিল বগুড়ার ইসহাক, সাবের মৌলভী, রহমান সোনাহার। একটি কাঠের তক্তায় আমাকে তুলে নিয়ে তাঁরা পৌঁছে দেয় বড়াহার ক্যাম্পে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে ভারতের রায়গঞ্জ হাসপাতাল, শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতাল, উত্তর প্রদেশের এমএস খিরকী হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। অতঃপর কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুনা হাসপাতালে। সেখানেই দেড় মাস কেটেছে কর্নেল তাহের স্যারের সঙ্গে।''

কর্নেল তাহেরের সান্নিধ্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ''অসাধারণ মানুষ ছিলেন। মনটা ছিল অনেক বড়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। তিনি থাকতেন অফিসার্স কেবিনে। কিন্তু খাওয়ার সময় সবাইকে ডেকে বসাতেন। এটা ওটা খেতে দিতেন। দেশের কথা বলতেন। উৎসাহ দিতেন। যেদিন দেশ স্বাধীনের খবর পেলাম, সেদিন মহাআনন্দে তিনি বললেন, 'চল, দেশে ফিরে যাই। যে দেশের জন্য তোমরা রক্ত দিয়েছ।' আমি কর্নেল স্যারকে বলতাম, 'দেশ তো স্বাধীন হল স্যার, কিন্তু আমাগো তো পা নাই। কী দাম আছে আমাগো। বিয়ের জন্য মেয়েও তো দিবি না কেউ।' কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে ওঠেন।''

কথা ওঠে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়, ''এইডা যারা করছে তারা মানুষ না। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তো যুদ্ধে গেছি। স্বাধীন দেশে তারেই বাঁচতে দিল না। আমরাও কিছু করতে পারি নাই। কোনো বাঙালির পেডে মুজিবের মতন আর কোনো বাঙালির জন্ম হবি না!''

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি বলেন, ''জিয়া যদি মুক্তিযোদ্ধাই হয় তাইলে কেমনে তিনি আলবদর, আলশামস আর রাজাকারগো নিয়া মন্ত্রী বানাইল। উনি যেই রাস্তা তৈরি করে গেছেন সে পথেই হাঁটছে তার স্ত্রী। এখনও তার দল রাজাকারগোই কোলে নিয়া বইসা আছে।''

বিএনপি-জামাতের ডাকা চলমান অবরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ''জিয়া রাজাকারগো ক্ষমা করেছিল আর তার স্ত্রী ওই রাজাকারগো নিয়াই অবরোধ ডাকছে, সাধারণ মানুষরে পুড়াইয়া মারছে। দেশটারে কি ওরা পাকিস্তান বানাইব! যারা মানুষ পুড়াইয়া মারছে, তারা কি মানুষ?''

সরকারের কী করা উচিত?

খানিকটা নিরব থেকে তিনি বলেন, ''কথা কম বইলা কঠোর হইতে হইব। কই, আওয়ামী লীগের লোকদেরও তো আমরা মাঠে পাই না। তারা যদি এ সময় মানুষের পাশে না থাকে তাইলে আর কবে থাকব!''

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকারদের অত্যাচার প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়– ''আমাদেরকে মুড়ি, চালভাজা, পানি আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করত সাধারণ মানুষ। রাজাকাররা লুটতরাজ করত, মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত খানদের ক্যাম্পে। ত্রিশুলা ক্যাম্প থেকে বিবসনা অবস্থায় উদ্ধার করি তিন বাঙালি হিন্দু মেয়েকে। তাদের সারা শরীর সিগারেটের আগুনে ঝলসে দেওয়া হয়েছিল। শরীর ছিল ক্ষত-বিক্ষত। শুধু পুরুষরাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের আত্মত্যাগও কম ছিল না।''

সাদেক আলী বলেন, ''মনে রাখতে হবে, রাজাকার সব সময়ই রাজাকার। স্বাধীন দেশে এদেরই সবার আগে বিচার করা প্রয়োজন ছিল। তাই খুব দ্রুত এদের শাস্তি কার্যকর করা উচিত। তা না হলে এরাই দেশে অশান্তি ডেকে আনবে। জ্বালাও পোড়াও করবে।''

মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী বলেন, ''এটি ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। এতে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরুদণ্ডই ভেঙে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি আর একতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আজ আর আমরা জাতির কাছে ওইভাবে দাঁড়াতে পারছি না।''

স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুচকি হেসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ''দেশটা স্বাধীন, এটাই তো সবচেয়ে বড় ভালোলাগা।''

খারাপ লাগে কখন? খানিকটা নিরব থেকে উত্তরে তিনি বলেন, ''টিভিতে ও পত্রিকায় যখন ছোট ছোট বাচ্চার ঝলসানো মুখগুলো দেখি, তখন ঠিক থাকতে পারি না। এদের দোষ কী! পেট্রোল বোমা মেরে যাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে তাদের পরিবারের অভিশাপেই তো পুড়ে যাবে এ দেশের রাজনীতি।''

মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর নাতি সাব্বির হোসেন পড়ে কলেজে। মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা নানাকে ঘিরে ধরে সে। শুনতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সব কথা। সাদেক আলীও আনন্দ নিয়ে স্মৃতির ভাণ্ডার তখন উজাড় করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাহিনি শুনে সে বলে, 'নানা, এত কষ্টে আমরা দেশ পেয়েছি!' সাদেক আলী তখন নাতির উদ্দেশে বলেন, 'আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একদিন থাকব না। কিন্তু ভবিষ্যতে তোমরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।'

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সাদেক আলী।

ট্রেনিং নেন: ২৮ দিনের ট্রেনিং করেন ভারতের শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল- ১৪৮৭।

যুদ্ধ করেছেন: ৭ নং সেক্টরের বড়গ্রাম ক্যাম্পে থেকেই অপারেশন করেন দিনাজপুরের দাইনর, পাতইলশাহ, হাকিমকুড়ি, বড়গ্রাম, ত্রিশুলা, মোহনপুর এলাকাগুলোতে।

যুদ্ধাহত: ৭ নভেম্বর, ১৯৭১। রাত ২টা। ত্রিশুলা থেকে মোহনপুরের দিকে যাওয়ার রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা অ্যান্টি ট্যাংক মাইনের বিস্ফোরণে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে যায়। ফলে ডান পাটি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।