প্রসঙ্গ: সৌদি আরবে শ্রমিক প্রেরণ

ফরহাদ আল করিম
Published : 15 Feb 2015, 11:02 AM
Updated : 15 Feb 2015, 11:02 AM

বিদেশের শ্রমবাজারের সাম্প্রতিক খরার শিগগিরই অবসান হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সহসা কাজের ভিসায় আবার সৌদি আরবে যেতে পারবেন। গত জানুয়ারিতে বাদশা সালমানের দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিনের মাথায় সৌদি রাজকীয় সংসদে স্থগিতাদেশ কাটিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের অনুমতি বিষয়ে প্রস্তাব আসে। সঙ্গে সঙ্গে সেটি পাশ হয়ে যায়। এর ফলে এখন বিভিন্ন পেশায় প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক আগের মতো কাজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

সে ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডেপুটি মিনিস্টারের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসেন। ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটনের প্রবাসী কল্যাণ ভবনে প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে হাউজ সার্ভিস ওয়ার্কার নিয়োগের একটি চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের সচিব ড. ইফতেখার হায়দার ও সৌদি ডেপুটি মিনিস্টার আহমেদ এফ আল-ফাহিদ নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিটিতে হাউজ সার্ভিস ওয়ার্কার হিসেবে ১২টি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়। একটি ক্যাটাগরির অধীনে শুধুমাত্র গৃহকর্মীর বেতন নির্ধারণ করা হয় বাংলাদেশি টাকায় ১৬ হাজার টাকা।

এখন সকল বিদেশগামী কম খরচে সৌদি আরবে যেতে পারবেন। লেভি, যাতায়াত ভাড়া, ভিসার খরচ ও মেডিকেল বাবদ যেসব সম্ভাব্য খরচ পড়বে তার শতভাগ নিয়োগকর্তা বহন করবেন। বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবসম্মত। সারা বিশ্বে শ্রমিক গ্রহণকারী দেশকে নিজ খরচে শ্রমিক এনে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে হয়। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে কেন?

নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে সৌদি সরকার পুনরায় নামমাত্র খরচে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে যাচ্ছে, এটি এ দেশীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জন্য বেশ ইতিবাচক। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসের শেষে আমাদের সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসনের নেতৃত্বে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল সৌদি আরব সফরে গিয়ে সৌদি উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় পুনরায় শ্রমিক প্রেরণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ওই সময়ের আলোচনায় সৌদি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের করিৎকর্মা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর যুগোপযোগী পদক্ষেপে সৌদিতে শ্রমিক প্রেরণের অতীত জট ধীরে ধীরে খুলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে।

আমাদের শ্রমিকদের বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজন, রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালের মাধ্যমে বিদেশে যান। তবে সরকারিভাবে সরাসরি জি টু টি (গর্ভনমেন্ট টু গর্ভনমেন্ট) পর্যায় ও সরকারের রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেলের মাধ্যমেও সীমিত আকারে বিদেশে লোক প্রেরণ হয়। সরকারি লাইসেন্সভুক্ত হাজার খানেক রিক্রুটিং এজেন্সি, যারা বিদেশে শ্রমিক প্রেরণে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগের অবস্থান ঢাকাকেন্দ্রিক। মাঠ পর্যায় থেকে বিদেশগামীদের সংগ্রহ করতে এই সব এজেন্সিকে প্রতিনিয়ত দালাল, উপ-দালাল ও উপ-দালালের দালাল তৈরি করে ব্যবসা করতে হয়। এসব দালাল চক্র প্রায়ই মানুষকে সঠিক তথ্য না দিয়ে বিভ্রান্ত করে। বিদেশ যাওয়ার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হাতের কাছে না থাকায় মাঠ পর্যায়ে বিদেশগামীদের বিভিন্ন সময়ে দালালের দ্বারস্থ হতে হয়।

এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে দালালরা সহজ সরল বিদেশগামীদের নানাভাবে প্রলোভনের মাধ্যমে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ থেকে আগে যারা সৌদি আরবে গেছেন তাদের একটি অংশও দালালের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। দালালের মাধ্যমে বিদেশ গেলে চড়া দামে ভিসা কিনতে হয়। এসব ভিসাসমূহের বিপরীতে অধিকাংশ শ্রমিকের বেতন প্রায়ই কম ও চাকরির মেয়াদ ক্ষেত্র বিশেষে স্বল্পকালীনও হয়। বিদেশে যাওয়ার আগে চাই লাভক্ষতির হিসাব ও প্রশিক্ষণ নেওয়া। কিন্তু অনেকে হিসাব-নিকাশ না করে দালালের ফাঁদে পা দেন। বেশি আয়ের লোভে অনেক সময় ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যেতে পিছপা হন না।

বেশি টাকায় ভিসা কিনে বিদেশে গেলেও শ্রমিকেরা কখনও কখনও নতুন ধরনের প্রতারণার শিকার হন। দালাল কিংবা তার এজেন্সি শ্রমিককে পূর্ব-প্রতিশ্রুত কাজ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। চাকরিতে প্রতিশ্রুত বেতনের ক্ষেত্রেও গরমিল দেখা দেয়। ফলে বিদেশ নামক সোনার হরিণের বাস্তব চিত্র দেখে তারা হতাশ হন। দেশীয় দালাল ও নিয়োগকর্তারা পারস্পরিক যোগসাজসে গ্রুপ ভিসার নামে জাল ভিসা দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক বিদেশে নিয়ে যায়। তাছাড়া কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট কাজের ভিসায় না গিয়ে বেশি বেতনের আশায় তথাকথিত প্রি-ভিসায় যান।

এসব বিরাজমান অনিয়মের ফলে কাজের খোঁজে বিদেশে গিয়েও তাদের বেকার থাকতে হয়। অধিক ভিসা খরচের বিনিময়ে কম বেতনে চাকরির ভিসায় বিদেশে গিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, খরচের টাকা তুলতে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও অমানুষিক পরিশ্রম করে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যান অনেকে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। বিদেশি শ্রমিক দ্বারা সেখানকার প্রচলিত আইন-কানুন ভঙ্গের কারণে যে কোনো অপরাধীকে তাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ জেল-জরিমানা, শিরোচ্ছেদ বা ফাঁসির মুখোমুখি হতে হয়েছে। অতীতে আমাদের শ্রমিকের একটি অংশ এসব অমার্জনীয় আচরণজনিত কারণে শাস্তি পেয়ে তাদের পেশাগত জীবন একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি বিদেশে আমাদের দেশের সম্মান বিনষ্ট করেছে।

৭ বছর আগেও সৌদি আরবে বছরে গড়ে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতেন যা আমাদের শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। দেশটিতে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, শ্রমিক কর্তৃক অপেশাদারি আচরণ, অপরাধ সংগঠন ও সেখানকার প্রচলিত আইন ভঙ্গ করার অভিযোগে ২০০৮ সালে সৌদি সরকার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে শ্রমিক নেওয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়। শুধু তাই নয়, যারা অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করত তাদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে। এই সংকটে আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ঐ সময় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও বড় এক হোঁচট খায়। সরকারি মতে, শুধুমাত্র ২০০৮ সালে যেখানে ১,৩২,১২৪ জন শ্রমিক কাজের ভিসায় সৌদি আরবে যান, সেখানে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ২০০৯ সালে যান মাত্র ১৪,৬৬৬ জন; এটা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, আমাদের অতীত ভুলের কারণে বাংলাদেশ কতটা কর্মসংস্থানের সুযোগ ও রেমিটেন্স আহরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র সৌদি আরবে সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশে শ্রমিক প্রেরণে আমাদের অব্যবস্থাপনা, নানাবিধ অনিয়ম ও বিদেশে এদেশীয় শ্রমিক কর্তৃক অপরাধ সংগঠন করার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বড় বড় শ্রম গ্রহণকারী দেশেও আমাদের শ্রমবাজার সাময়িকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। ঠিক একই কারণে বিগত সময়ে মালয়েশিয়াতেও শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত ছিল।

২০১৩ সালে তৎকালীন প্রয়াত বাদশা সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে সৌদিতে অবস্থানরত সকল অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের নির্ধারিত ফি দিয়ে বৈধ হওয়া ও আকামা পরিবর্তন করার বিশেষ সুযোগ দেন। সেখানে অবস্থানরত আমাদের শ্রমিকদের জন্য এটি একটি মোক্ষম সুযোগ ছিল। ফলে ঐ সময় প্রায় ৮ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক এই সুযোগ গ্রহণ করে সৌদি আরবে কাজ করার অনুমতি নিয়ে পূর্ব-অনিশ্চয়তা দূর করেন। তবে অর্থাভাবে যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক বৈধতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন তারা চরম অনিশ্চয়তার মাঝে এখনও সৌদি আরবে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করছেন। পুলিশের সহযোগিতায় সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয় সেখানে নিয়মিতভাবে অভিযানটি অব্যাহত রেখেছে যার ফলে সকল অনিয়মিত শ্রমিককে উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার অনেককে আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে যেতে হচ্ছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ছাড়াও জিসিসিভুক্ত (গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল) অন্য ৫টি দেশ, বাহরাইন, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত ও কুয়েত নিজ নিজ দেশে শ্রম আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনেছেন। বিদেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানে তাদের দেশের নিয়োগকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছেন যা খুবই প্রশংসনীয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, সৌদি সরকার তাদের নাগরিকদের বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করেন। জেদ্দা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সুত্রে জানা যায় যে, যে সৌদি নাগরিকদের মাসিক আয় ১৫ হাজার রিয়েলের কম (বাংলাদেশি টাকায় ৩ লাখ) তারা কোনোভাবে বিদেশি গৃহকর্মী (খাদ্দামা) ও হাউজ ড্রাইভার নিয়োগ দিতে পারবেন না। কম আয়ের কারণে এসব নাগরিক গৃহকর্মীর বেতন দিতে ব্যাংক ঋণ নেন। সৌদি সরকারের মতে, এটি তাদের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক। তাই নতুন আইনে শ্রমিকের বেতন ও ভিসা বাবদ অপ্রয়োজনীয় খাতে প্রদেয় অর্থ সে দেশের জন্য সাশ্রয়ী হবে। কম আয়ের কারণে অনেক সৌদি নাগরিক শ্রমিকের বেতন দিতে গড়িমসি করে যা চুক্তির ক্ষেত্রেও নতুন জটিলতা তৈরি করে। এসব কারণেই সৌদি সরকার ছোট পরিবারগুলোকে গৃহকর্মী নিয়োগদানে নিরুৎসাহিত করছে। তাছাড়া সকল নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে সরকার-নিয়ন্ত্রিত ওয়েবসাইটে গৃহকর্মীদের মজুরি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।

বিদেশে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে শীর্ষের দেশ হল সৌদি আরব। সরকারের জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর সূত্র মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজের ভিসায় বিদেশে যাচ্ছেন এবং বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ শ্রমিক বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। প্রতি বছর এসব প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতি চাকা প্রতিনিয়ত গতিশীল রাখছে। সরকারি মতে, বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন যা সারা বিশ্বের শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে বেসরকারি মতে, সৌদিতে বর্তমানে ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি তেলসমৃদ্ধ এবং আয়তনে বড় দেশ সৌদি আরব। রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ, নতুন নতুন কাজের সুযোগ ও ভালো বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ থাকার কারণে সূদূর অতীত থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজের খোঁজে সৌদি আরবে যাওয়া শুরু করেন। সেখানে কনস্ট্রাকশন, ড্রাইভিং, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েলডিং, ক্লিনার, প্লাম্বিং, টেইলারিং, ক্যাটারিং, খনি শ্রমিক, হোটেল কর্মচারি, কার্পেন্টার, হেয়ার স্টাইলার, সিকিউরিটি গার্ড, সেলসম্যান, এগ্রিকালচার ও হাউজ কিপিং ইত্যাদি পেশায় কাজ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজের ভিসায় বিদেশে যেতে চাইলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে পারেন না। সবচেয়ে প্রকটভাবে যেটি দেখা দেয় তা হল, মাঠ পর্যায়ে বিদেশে যাওয়া বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সেবাদানকারী সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি। জেলা পর্যায়ে সরকারের জেলা জনশক্তি অফিস ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছাড়া আর তেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। তাছাড়া সব জেলাতেও এসব প্রতিষ্ঠান নেই। যদিও দেশের কিছু নির্ধারিত এলাকায় স্বল্প সংখ্যক এনজিও বিদেশগামীদের পরামর্শ দিচ্ছে; তবে এটি প্রয়োজন অনুযায়ী খুবই অপ্রতুল।

বিদেশগামী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে সঠিক তথ্য যথাসময়ে পান না। তাছাড়া সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর শাখা মাঠ পর্যায়ে নেই। ফলে বিদেশে যাওয়া নিয়ে তথ্য-ঘাটতি বা ভিসা ব্যবসায়ী ও তার এজেন্ট দালালদের ফাঁদে পড়ে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হন, তেমনি অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাছাড়া অভিবাসীদের অধিকার ও আইন সম্পর্কে কম ধারণা থাকার কারণে তারা প্রাপ্য অধিকার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত হন।

সার্বিক পরিস্থিতি যাই হোক, সবচেয়ে আশাজাগানিয়া কথা হল, দীর্ঘ দিনের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে আমরা আবার আগের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রম বাজারটিতে শ্রমিক প্রেরণ করতে যাচ্ছি। এ কথা সকলে জানি যে, ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার জি টু জি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে স্বল্প খরচে শ্রমিক প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছিল। নিরাপদ উপায়ে বিদেশ গমন ও দালালদের ভিসা ব্যবসা ঠেকাতে সরকারের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আমাদের বিদেশগামীদের জন্য সুসংবাবাদ ছিল। তবে সরকারের এ উদ্যোগ খুব বেশি সফলতার মুখ দেখেনি। জি টু জি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পর্যন্ত মাত্র হাজার দশেক শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়।

নতুন চুক্তির অধীনে সরকারের পরিবর্তে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সৌদিতে শ্রমিক পাঠাবেন। যে মাধ্যমে শ্রমিক সৌদিতে যাক না কেন, যাওয়ার প্রক্রিয়াটি যেন স্বচ্ছ, নিরাপদ ও লাভজনক হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শ্রমিকদের দেশত্যাগের আগে সরকারি ডাটা বেইজে বাধ্যতামূলক জব সিকারস রেজিস্ট্রেশন করা ও কাজের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কাজের প্রশিক্ষণ ছাড়াও আরবি ভাষাজ্ঞান দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে সফল হওয়া যাবে। বর্তমানে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উদ্যোগে বিদেশগামীদের ২ ঘণ্টার একটি 'প্রি-ডিপারসার ট্রেনিং' দেওয়া হয়। বিদেশের নিয়ম-কানুন, করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে আরও বেশি ধারণা দিতে এই ট্রেনিংএর মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক প্রেরণে আমাদের আগের বেশ কিছু অব্যস্থাপনা ও অনিয়ম রয়ে গেছে। আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখন সময় এসেছে সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে নতুনভাবে শ্রমিকের বিদেশে কর্মসংস্থানে সুযোগ তৈরি করা।

এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। অভিবাসন সম্পর্কিত সরকারি দপ্তর, এনজিও/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রিক্রুটিং এজেন্সি ও প্রাইভেট সেক্টরের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন জরুরি। সৌদিতে শ্রমিক প্রেরণের নামে যাতে কেউ সহজ সরল বিদেশগামীদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখতে হবে।

সর্বোপরি, দেশের সার্বিক স্বার্থে নিরাপদ ও গুণগতমান বজায় রেখে বিদেশে শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুবর্ণ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে।