মুক্তিযুদ্ধে বাম দলগুলোর ভূমিকা

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 25 March 2011, 01:49 PM
Updated : 25 March 2011, 01:49 PM

দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। গণ-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। আর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এটাই ছিল মহত্তম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেশে-বিদেশে নানা রকম তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মোটাদাগে আমরা জানি দক্ষিণপন্থি দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, কিন্তু বামপন্থি দলগুলোও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কম বিভ্রান্তিতে ছিল না। চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব, নানা রকম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কারণে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

১৯৭১ সালে 'কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির'র অঙ্গ সংগঠন 'বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন বলে "মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের খুব একটা আশান্বিত করতে পারেনি, সেদিনই তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এত বিপুল রক্তক্ষয়কে এড়ানো যেত।…. মাও সেতুঙের চিন্তাধারা আমাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও যুদ্ধকালে গণচীনের ভূমিকার আমরা তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ছিল আমাদের ঘোষিত শত্রু । সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে ভারতের সাহায্যকে আমরা স্বাগত জানালেও সে প্রশ্নে আমাদের সন্দেহ ছিল, সংশয় ছিল। আমরা কোনো পর্যায়েই চাইনি যে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিক। ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন-বিশেষ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতা আমাদের অনেক উপকারে এসেছে। "(১) একেবারে বিপরীত না হলেও, কিছুটা ভিন্ন মূল্যায়ন পাওয়া যাবে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিং এর ভাষ্যে। তিনি মনে করেন, "১লা মার্চের পর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেস কোর্সের জনসমাবেশ থেকে "এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম" বলে ঘোষণা দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন আমরা তার পুরোপুরি সমর্থক ছিলাম।… আমরা সচেতন ছিলাম যে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কতকগুলি দুর্বলতা থাকবে। মধ্যস্তরের জনগণের যে দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও তার বিরুদ্ধে আপষহীন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চেতনার ঘাটতি ছিল। এবং শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের সংগঠন শক্তি ছিল দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।… বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য এবং তা সশস্ত্র সংগ্রাম হতে পারে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের পার্টি ঐকমত্যে পৌঁছেছিল।… অন্যান্য দলের মধ্যে কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননদের দলের সঙ্গেও আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। এরা স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দিলেও আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী, স্বাধীনতার শক্তিগুলোর ঐক্য এবং স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্র সম্পর্কে এঁদের নীতির সঙ্গে আমাদের প্রভূত পার্থক্য ছিল। (২) পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মো-(লে) এর কেন্দ্রিয় কমিটির মূল্যায়ন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

"আওয়ামী লীগ, ভাসানী ও অন্যান্য বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া নেতাদের নেতৃত্বে উগ্র বুর্জোয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে যে যুদ্ধ চলছে তা প্রতি বিপ্লবী যুদ্ধ, তা মুক্তিযুদ্ধ নয়। সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা-প্রশ্রতাশী দুই কুকুরের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তা হচ্ছে প্রতি বিপ্লবী গৃহযুদ্ধ।"

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বামপন্থীদলগুলো মুজিবনগর সরকারের ওপর চাপসৃষ্টি করে তাদের দলীয় কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সুযোগ দানের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। আর এই সিদ্ধান্তের বৈধতা দিয়েছে সত্তর সনের নির্বাচনের রায়। এছাড়া প্রলস্বিত যুদ্ধে নেতৃত্ব বামদের হাতে চলে যাবার আশঙ্কা কম ছিল না।

সে মাসের শেষ দিকে দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি), নাসিম আলী (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, হাতিয়ার), অমল সেন (কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র), ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ) কাজী জাফর আহমদ (কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি) সদস্য আর মওলানা ভাসানীকে তাঁর অনুপস্থিতিতে সভাপতি করে "জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি" গঠন করা হয়। এই কমিটির পক্ষ থেকে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, এবং হায়দার আকবর খান রনো প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন, তাদের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে সহযোগিতার জন্য। কাজী জাফর উল্লেখ করেছেন যে, "তিনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের মুক্তিবাহিনীতে আমাদের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি (তাজউদ্দিন) হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীনে কমিউনিস্টদের শ্রেণী সংগ্রামের এবং স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতার উল্লেখ করেন।

নানা রকম সীমাবদ্ধতা, আশঙ্কা সত্বেও বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন অ্নুভুত হয়। বিশেষ করে ভারত সরকারের একটি অংশ বামদের অংশগ্রহণের বিষয়ে উৎসাহী ভূমিকা নেয়। এছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন-চীনের সোচ্চার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকারের জন্য অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এমনি প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর সরকার সমমনা বাম দলগুলো নিয়ে "জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি' গঠন করে। এই কমিটিতে ছিলেন পিকিং পন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিং, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি এই কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের নীতি নির্ধারণে এই কমিটির কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান না হলেও এর কূটনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তারপরও ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং আওয়ামী লীগের একাংশ বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্তিকে ভালো চোখে দেখেনি। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি এই কমিটি গঠনের জন্য ভারতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক সমর গুহ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভি.পি. ধর এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি.এন. কলকে সম্পূর্ণ দায়ী করে বলেন যে, "সোভিয়েত সাহায্য ও সমর্থন লাভের নামে জোর করে এই দুই ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।" এমনি নানা ধরণের বিতর্কের মধ্যে বামদলগুলো তাদের ক্যাডারদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর ছোট/বড় অনেক গ্রুপ গড়ে তোলে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির দাবী তারা ৬০০০ কর্মীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা ১০,০০০ কর্মী নিয়ে "লাল গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। চীনপন্থী পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদার, এম. এ. মতিন, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন– তাঁরা চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ি নীতি গ্রহণ করেন। তাঁদের স্লোগান ছিল, "চেয়ারম্যান মাও আমাদের চেয়ারম্যান, চারু মজুমদার আমাদের নেতা।" এই দলের দাবী তারা ১৫,০০০ সদস্যের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিল।

১৯৭১ চীনাপন্থী বামদের বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধকে "দুই কুকুরের লড়াই" বলতে কুন্ঠাবোধ করেনি। ষাটের দশকে চীন-রাশিয়া মেরু করণের সময়ে মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করেই চীনাপন্থীরা একত্রিত হয়। আবার চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ভাসানী সক্রিয় হতে পারেন নি। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকায় চীনাপন্থীরা কখনোই আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিতে পারে নি। তবে মস্কোপন্থীদের মূল্যায়ন ছিল ভিন্ন, দুর্বল জনভিত্তির কারণে রুশপন্থীরা আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবে থাকতে চেয়েছে। বিশিষ্ট বাম নেতা খোকা রায় তাঁর সংগ্রামের তিন দশক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, "কমিউনিস্ট পার্টির উপলদ্ধি ছিল যে, বাস্তব অবস্থা স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুকূলে হলেও একার প্রচেষ্টায় তখন কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না এবং এই কারণেই ১৯৬১ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কয়েকটি সমঝোতার বৈঠক হয়।"

চীনাপন্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমনি সমঝোতা বা আস্থা কখনও গড়ে ওঠেনি। চীনাপন্থীদের দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ হচ্ছে ডানপন্থী সুবিধাবাদী দল। সুতরাং এর বিরোধিতা করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও চীনাপন্থীদের মনোভাব কম-বেশি অপরিবর্তিত ছিল এবং নানা দলে উপদলে বিভক্ত হবার কারণে চীনাপন্থীদের সংহত কোনো প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে অনুভূত হয় নি।

স্বাধীনতার পর বাম রাজনীতি বিশেষভাবে মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। স্বল্প সময়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাসদ বিরাট সংখ্যক তরুণকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। এবং মওলানা ভাসানীও সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। পরিণতিতে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে হতাশা অস্তিরতা ও এক ধরণের অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোন রাজনৈতিক দলের জন্যই শুভ হয়নি। এই বিভেদ, অনৈক্য ডানপন্থীদের সংগঠিত হবার সুযোগ দিয়েছে। ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের একটা ফ্যাক্টরে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। এর বিপরীতে বামপন্থীদের মধ্যে আদর্শ তত্ত্বের ব্যবধান, দল উপদলের বিভাজন জাতীয় রাজনীতিতে ক্রমে প্রান্তিক অবস্থান নিয়ে গেছে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

১. তালুকদার মনিরুজ্জামান, The Bangladesh Revolution and its Aftermath. UPL, 2003

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খন্ড।

৩. অজিত কুমার দাস, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাথে কতিপয় নির্বাচিত বামপন্থী দলসমূহের সম্পর্ক, অপ্রকাশিত গবেষনা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, মে ২০০৪।