কারা আসলে আমাদের সামনে নিয়ে যেতে পারবে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 Feb 2015, 04:34 AM
Updated : 16 Feb 2015, 04:34 AM

এটা মানতেই হবে যে, দেশের অবস্থা ভালো নয়। ৫ জানুয়ারির পর বিএনপি বা বিশ দলীয় জোট তাদের সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় আজ সব মিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি। আন্দোলন বা কর্মসূচি দেওয়ার মতো অনেক ভালো ও যথাযথ ইস্যু হারাবার পর হঠাৎ করেই ময়দানে নামার সুযোগ পেয়ে যায় তারা। এর আগে কিছুতেই তাদের ব্যাটে-বলে হচ্ছিল না। যতবারই নামতে চেয়েছে, সরকারি বেসরকারি তৎপরতায় নেতা-কর্মীদের জেলে যাওয়া আর মাঠ পর্যায়ে নিস্ক্রিয়তার কারণে সে চেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি।

আওয়ামী লীগের ভুল চাল আর সহযোগী মানুষ ও গোষ্ঠীগুলোকে সঙ্গে না রাখার ফলে এখন এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা দেখতে হচ্ছে আমাদের। এটা অপ্রত্যাশিত হলেও এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগের অতীত আর বর্তমান এক নয়। তাদের ভেতর আত্মশুদ্ধি বা সংস্কার বলতে কিছু নেই। এত পুরনো আর প্রাচীন একটি দলে সংস্কার না থাকলে সীমাবদ্ধতা বাড়বে, কচুরিপানার মতো আগাছা জন্মাবে এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের দুর্ভাগ্য, এই দলটি কখনও আয়নায় নিজের মুখ বা চেহারা দেখতে চায় না। চাইলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্তি থাকত না কারও। সেটা না করে ব্যক্তি-নির্ভরতা আর অতীত সম্বল করায় এবার জাতিই পড়েছে চরম বিপাকে। এই বিপদ অবাঞ্চিত হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। সময়ের হাত ধরে নষ্ট হয়ে যাওয়া চেতনা আর অন্যরকম মূল্যবোধের এই জাতিকে কি আমরা আসলে পরখ করে দেখি? না বোঝার চেষ্টা করি?

সত্যিকার অর্থে আমাদের পরাজয়ের সূচনা ঘটেছে আগেই। এখন যখন একজন একজন করে অনেকে তাদের আসল চেহারায় আবির্ভূত হচ্ছে– আমরা হৈচৈ, চিৎকার করে চেতনার নাম করে পার পেতে চাচ্ছি। কিন্তু ঘটনার ভেতরে যাচ্ছি না। আমরা কি একবারও হিসাব করে দেখেছি যে, এ যাবত কত জন মানুষ মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাজাকারে পরিণত হয়েছে? বা কতজন তাদের অবস্থান পাল্টেছে? সবাইকে ঢালাওভাবে রাজাকার বলে গাল দিলেই কি সমস্যার সমাধান মিলে যাবে? একবারও ভাবি না উল্টো দিক থেকে একজন মানুষও আমাদের দিকে আসার তাগিদ অনুভব করেনি। কেউ একবারের জন্যও বলেনি, আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত।

এর কারণ ও ব্যাখ্যা জানা জরুরি। কারণ যেসব দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বা রক্ত ঝরেছে তাদের ইতিহাসে পাপবোধ ও গ্লানি থেকে মানুষ সত্য ও সুন্দরের দিকে ছুটে এসেছে। আমি কম্বোডিয়ার যাদুঘরে দেখেছি বিশ্বাসঘাতকদের লিখিত মার্জনা চাইবার দলিল। আমাদের বেলায় তা হয়নি। কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযোদ্ধা, ড. কামাল হোসেনের মতো সংবিধান লিখিয়ে, মতিউর রহমানের মতো বাম সম্পাদকরা আজ নানা কারণে বিরোধী শিবিরের, এর সবটাই কি আসলে তাদের দায়? না তা হতে পারে? বেগম জিয়ার সঙ্গে গুলশানে দেখা করতে যাওয়া মান্না বা সুলতান মনসুর তো এখনও আওয়ামী পরিবারের; তাহলে এই প্রশ্ন কি জরুরি নয় যে, এই পথ হারানোর আসল কারণ কী?

আমার তো ধারণা, আমরা মানুষের বিশেষত বাঙালির জীবনকালের কথাও বিবেচনায় রাখছি না। পঞ্চাশোর্ধ বাঙালির জীবনে ধর্মসংস্কার আর চেতনার পরিবর্তন দেখে মনে হয়, বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগের শোকের উৎস নেতাদের অনেকেই আজ হয়তো খালেদা জিয়ার দলে বা অন্য দিকে থাকতে পারতেন। সময়ই হয়তো আমাদের সেই অপমান ও লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

রাজনীতিতে কেবল চেতনা আর অতীত নিয়ে কাজ হয় না। আমরা দুনিয়ার দেশে দেশে দলগুলোর বিবর্তন আর বদলে যাওয়া দেখছি। দল যেটা পারে না বা পারবে না সেটা দূরে রাখে। তা নিয়ে রাজনীতি করতে যায় না। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা সেই আক্কেল হারিয়ে ফেলেছেন। একাত্তরের বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়। সে সময়ের চাহিদা আর আজকের প্রয়োজনও এক নয়। ফলে বিচার, ফাঁসি বা কাউকে নির্মুল করার আগে নিজের পায়ের তলার মাটি পরখ করে নেওয়াটাই ছিল কাজের কাজ। সে 'সয়েল টেস্ট' না করেই আবেগের পায়ে ভর দিয়ে নেমে এখন কোথায় আমরা? আর আবেগই যদি অবলম্বন, তো গণজাগরণের মতো বড় একটা বিষয় নিজের নিয়মে শেষ হতে দেওয়া হল না কেন? তারা কতটুকু যেতে পারত তার চেয়ে বড় কথা, তাদের শেষের একটা ফলাফল থাকত। সেটা যেহেতু হতে দেওয়া হয়নি, মানুষ আরেকবার তার ছায়ায় যাতে চাইবে কোন দুঃখে?

আমরা কি এটা জানতাম না যে, জামাতের খাতায় নৈতিকতা বা মূল্যবোধ বলে কিছু নেই! যে দেশ ও মাটিকে তারা নিজেদের মনে করে না, আর করলেও তাদের মতো করে 'পাক নাপাক' করে ভাবে, তাদের ক্যাডার বা দলীয় সন্ত্রাস করার শক্তি খাটো করে দেখার কারণ নেই। আজ আমরা যে পেট্রোল বোমা দেখছি, যেসব নাশকতা চলছে, এগুলো খুব মজবুত আর সংগঠিত না হলে করা অসম্ভব। জনগণের পরিবর্তে ভয় ও আক্রমণ বেছে নেওয়ার ভেতর দিয়ে মানুষকে আস্থাহীন করে তোলার কাজে তাদের সঙ্গে পুলিশ, র‍্যাবও পেরে উঠছে না। এই কারণে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে, মিডিয়ায় এত কথার তোড়জোড়।

যাদের আমরা বদলে গেছে ভাবছি, তারা বদলায়নি; সুবিধামতো জায়গা বেছে নিয়েছে। কারণ তাদের নাসিকায়ও ঘ্রাণ আছে। তারা বুঝতে পারছে, সময় বা মানুষ আসলে কোনদিকে ঘুরতে পারে। চেতনা বা আদর্শের দোহাই দিয়ে যাদের কোনোভাবেই বাগে রাখা যায় না, তাদের কথা আওয়ামী লীগ বোঝেনি। তারা যে দ্বৈত নীতি আর উন্নয়নের নামে রাজনীতি করছে, সেটা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। মানুষ ভাবে, উন্নয়ন একটি স্বাভাবিক ধারা, সেটা আপনাতেই হয়। তাছাড়া আমি যদি কিছু করেই বারবার মনে করিয়ে দিতে শুরু করি, তবে তার আবেদন কমে যায়; মনে হয়, খোাঁটা দিচ্ছে কেউ!

প্রগলভতার দায় সরকারি দল কিছুতেই এড়াতে পারবে না। তাদের সবাই হয় প্রগলভ, নয়তো কড়া ভাষায় কথা বলেন। শুনে মনে হয়, তারা ছাড়া আর কারও দেশপ্রেম নেই। এটা আর যাই হোক, মানুষকে আকৃষ্ট করে না।

এই যে ধরুন, মানুষ মরছে, পুড়ে কয়লা হচ্ছে রুটির মতো, তাদের কণ্ঠে আফসোস বা কান্না নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি বা যে কোনো মূল্যবোধে মানুষ সবসময় নির্যাতিতের দিকে থাকে। সে জায়গাটা সহানুভূতি ও সমবেদনার। মানুষের জান বাঁচানোতে অপারগ রাজনীতি যদি হুংকার ছাড়ে, তখন তার প্রতি মমত্ব বা ভালোবাসা থাকবে কী কারণে? ফলে সে জায়গাটা এখন আসলেই নড়বড়ে।

অন্যদিকে বিএনপি এখন শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ভাসানী ন্যাপ আর জাসদের চৈনিক অংশের ক্যারিশমা খতম। এখন এটি জামাতের ছায়া দল। কাজেই তারা করবে ভাঙচুর আর হত্যার রাজনীতি। ফলে জনগণের সামনে ঘোর আঁধার। আমাদের এটা মানতেই হবে, এখন নির্বাচন দিলেও বিএনপির লাক তাকে ফেভার করতে পারে। এই জায়গাটুকু বোঝে বলেই কি আওয়ামী লীগ সব বাদ দিয়ে খালি কথা বলছে? কথায় তো কাজ হবে না। কেন মানুষ তাদের চায়, কোথায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির দুর্বলতা আর কেন আমরা আগ্রাসী ভাষায় কথা বলি, এগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।

আমাদের দেশ মানে সবার দেশ, তাই যদি হয় তবে শান্তি ও সহাবস্থানের কথায় ফিরুন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মুষ্টিমেয় বিরোধীদের মোকাবেলা করুন। একজনকেও দূরে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। সে রাজনীতি শুরু না হলে গৃহযুদ্ধের আভাস স্পষ্ট।

বাংলাদেশ তার চারিত্র না হারিয়ে শুদ্ধতায় ফিরুক এটা চাইলে অনেক উগ্রতা বন্ধ করতে হবে। দেশপ্রেম যেন হতাশ আর ব্যর্থ মানুষের পুঁজি না হয়। আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ করার কাজটিও যে আওয়ামী লীগই করবে এমন নাও হতে পারে। তারা তাদের কাজ করে দিয়েছে; স্বাধীনতার কাজ। এখন কারা একে শান্তি ও আনন্দের দিকে নেবে সেটাই বোধকরি দেখার বিষয়। জামাত, বিএনপি তো নয়ই। ফলে আমরা একটা দেশপ্রেমী, মুক্তিযুদ্ধ ভালোবাসে এমন শক্তির কামনা করতেই পারি।

পারি না কি?