জামাতের আলকাতরায় ঢেকে যাচ্ছে বিএনপির মুখ

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 27 Feb 2020, 03:14 PM
Updated : 11 Feb 2015, 02:53 AM

দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে যে সংঘাত-সহিংসতা চলছে তার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমানভাবে দায়ী করার একটি প্রবণতা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। 'যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর'-এর মতো দেশে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দুই নেত্রীকে দোষারোপ করে কথা বলাও অনেকের কাছে একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

আমরা যারা রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, তারাও কোনো কিছু গভীরে গিয়ে দেখার চেষ্টা না করে সাদা চোখে যা দেখি, তাই বারবার বলে বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি করি, যাতে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। আমরা বলতে অভ্যস্ত হয়েছি, দুই দল ও দুই নেত্রীর জেদাজেদির জন্যই দেশে রাজনৈতিক সংকট কমছে না। এক দল ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং অন্য দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত বলেই রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা নেই, সমঝোতার পরিবেশ নেই। সত্যি কি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য দুই নেত্রী সমানভাবে দায়ী?

বর্তমান অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। কার কোন ভূমিকার কারণে এই অবস্থা তৈরি হল, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গিয়ে আমরা 'দুই নেত্রী'কে এক সঙ্গে গালাগাল দিয়ে এক ধরনের সুখ অনুভব করি। কিন্তু সব ঘটনার জন্য দুই নেত্রী যে সমান দোষী নন, দু'জন যে সমান অনুদার নন, তার সর্বশেষ প্রমাণ ২৪ জানুয়ারির ঘটনাবলী। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত অপমানিত হয়েই ফিরে আসেন। বেগম জিয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় তাঁর দলের ও পরিবারের সদস্যরা কার্যালয়ের গেট ভেতর থেকে বন্ধ রেখে প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি।

আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে সৌজন্য, শিষ্টাচার, শুভবোধ কীভাবে দূর হয়ে যাচ্ছে তা বোঝার জন্য এ ধরনের আরও ঘটনার উল্লেখ করা যায়। গত নির্বাচনের আগেও সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। ফলাফল কী হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর দিনে কেক কেটে জন্মদিন 'উৎসব' পালন করেন কে? কার শাসনামলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছিল? এসব জেনেও রাজনীতিতে 'তিক্ততা' তৈরির জন্য শেখ হাসিনাকে সমভাবে দায়ী করা মতলববাজি নয় কি?

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি– এই দুই দলের রাজনীতিককে এক পাল্লায় মাপার প্রবণতা যতদিন বন্ধ না হবে, রাজনীতিতে দুই দলের অবদান ও ভূমিকা যতদিন এক চোখে দেখা হবে, দুই নেত্রীকে সব কিছুর জন্য সমান দায়ী করার প্রবণতা যতদিন দূর না হবে, ততদিন আমরা যেমন সংকটের গভীরে যেতে পারব না, তেমনি সংকট সমাধানের পথেও অগ্রসর হতে পারব না। আমরা যখন 'দুই দল দুই দল' বলি তখন সাধারণত আওয়ামী লীগ কোন সময়, কোন রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায়, কাদের নেতৃত্বে এবং কী রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা যেমন মনে রাখি না, তেমনি বিএনপির জন্মের পটভূমিও আমরা বিবেচনা থেকে বাদ দিই।

আমরা এটা মনে রাখার চেষ্টা করি না যে, আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন করেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ এমন কিছু মানুষ, রাজনীতির সঙ্গে ছিল যাদের নাড়ির সম্পর্ক। মানুষের কল্যাণ, মঙ্গল এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা জীবনভর লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগের ক্রমবিকাশের ধারাও লক্ষ্যণীয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে উত্তরণ। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির অব্যাহত চর্চা এবং ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থনধন্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর এই দলটিতে ঘটেছে র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তন এবং এই দলের নেতৃত্বেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

আর বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এক দল সুবিধাভোগী, দলছুট, সুযোগ সন্ধানী, ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তির সামষ্টিক যোগসাজশে। জিয়াউর রহমানের অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রক্ষমতার রাজনৈতিক ভিত্তি ও নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম দেওয়া হয়েছিল বিএনপির। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে গড়া একটি রাজনৈতিক দল। মানুষের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে কোনো লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়নি। ক্ষমতার কেক-পেস্ট্রি মুখে নিয়েই এই দলের জন্ম।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এই দলের হাল ধরার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে দলটি কিছুটা জনসম্পৃক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক দলের চরিত্র অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই দলটি আবার ক্ষমতাসীন হয়। তারপর থেকে তারেক রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর ক্রমাগত প্রভাব ও পরামর্শে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মোহ বিএনপিকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক, উগ্র রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক দলে পরিণত করছে।

প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র বলে রাজনীতিতে একটি কথা আছে। বিএনপির রাজনীতি প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রমুক্ত নয়। বিএনপি জন্মলাভ করেছে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়; সে জন্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিএনপিকে স্বস্তি দেয় না– এ অভিযোগ যদি কেউ করেন, তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি?

আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, আমরা অনেকেই বিএনপিকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রচার করে দলটির এমন একটি ইমেজ দাঁড় করিয়েছি যা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম বিভ্রান্তি। এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি এবং জিয়া ও তার দল বিএনপি– এক ও অভিন্ন ধারার রাজনীতির অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এরশাদ স্বৈরাচারী আর জিয়া গণতন্ত্রের পূজারী। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন চক্র এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সম্মিলিত প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অসত্য ও অর্ধসত্য এমন কিছু 'মিথ' তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো দূর করার উপযুক্ত প্রচার কৌশল গ্রহণ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি।

এক শ্রেণির রাজনৈতিক পণ্ডিত ও বিশ্লেষক অর্ধসত্য ও তথ্য বিকৃত করে এমনভাবে ও ভাষায় কথা বলেন যা শুনে সাধারণ মানুষের এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, আওয়ামী লীগ বোধহয় সত্যি একটি 'ইভিল' সংগঠন এবং শেখ মুজিব একজন ব্যর্থ ও দুঃশাসক। বলা হয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ২০ থেকে ৩০ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০-৩০ জন রাজনৈতিক কর্মীর নামও কেউ বলতে পারবেন না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত কতজন সংসদ সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছিল, সেটা কেউ উল্লেখ করেন না।

নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফেরেশতা ছিলেন না, একজন মানুষ ছিলেন। মানুষ হিসেবে তাঁর ভুলভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতাও ছিল। দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ সব কিছু ঠিক করেছে, সব সময় সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়েছে তা হয়তো নয়। কিন্তু সব কিছুর উপরে এটাই সত্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হয়তো স্বাধীন হত না। তাঁর মতো হৃদয়বান, মানুষের মধ্যে জাদুকরি প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিভাবান সংগঠক শুধু এ দেশে কেন, সারা দুনিয়াতেই খুব বেশি নেই।

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যেমন জিয়াউর রহমানের তুলনা চলে না, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি এতটাই ম্লান যে, এ নিয়ে আলোচনা সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমান্তরাল করে ফেলেছি।

এটা ঠিক যে, নব্বইয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনের অবসানের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে একবার বিএনপি, আরেকবার আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এসেছে। দুই দলের ভোট ব্যাংক প্রায় সমান সমান। তারপরও দেশের রাজনৈতিক সংকট-সমস্যার জন্য আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি দলকে একমাত্রায় দোষারোপ করার মধ্যে সরলীকরণ আছে, সমাধানে পৌঁছানোর সৎ উদ্যোগ নেই।

কেউ কেউ এটা বলে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নয়। কথাটা হয়তো একেবারে অসত্য নয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে যে প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ তা করছে না। আওয়ামী লীগ এখন এমন অনেক কিছুর সঙ্গে আপস করছে, যা এই দলের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান।

প্রশ্ন হল, বঙ্গবন্ধুর সময় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি যে অবস্থায় ছিল, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শক্তির যে মেরুকরণ ছিল, এখন কি তা আছে? বঙ্গবন্ধুর সময় আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে প্রধানত মস্কোপন্থী বলে পরিচিত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। এই দুই দলের ত্যাগী ও আদর্শবাদী নেতাদের প্রভাব যেমন বঙ্গবন্ধুর ওপর ছিল, তেমনি এই দুই দলের 'সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার রাজনীতিও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অগ্রসর রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণে প্রভাবিত করত। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার বাস্তব শক্তি ও ক্ষমতা বাম-প্রগতিশীলদের নেই।

ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান প্রতিপক্ষ, বিএনপির মতো রাজনীতির নোংরা খেলায় অভ্যস্ত এবং হিংসাশ্রয়ী একটি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বিএনপির জনসমর্থনের অন্যতম ভিত্তি হল, মানুষের পশ্চাৎপদ চিন্তা, ধর্মাশ্রয়ী অনুদার মানসিকতা, ভারতবিরোধিতা ইত্যাদি বিষয়। এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকেও কখনও কখনও তার ঐতিহ্যের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, ক্ষমতার রাজনীতি না করেও আওয়ামী লীগের সামনে কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতার বাইরে থাকলে এই দলের পক্ষে সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য কোনো নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব নয়।

দেশের সব বাম-প্রগতিশীল শক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা পেলে আওয়ামী লীগ তাদের কিছু বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু বাম-প্রগতিশীলদের একটি অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্বের নীতি অনুসরণ করে কেবল আওয়ামী লীগের বিপদ বাড়ায়নি; দেশকেও জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিপদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানও বিপন্ন করে তুলেছে।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্য ঘটনা হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেও একটি ক্ষুদ্র অংশ জামাত-মুসলিম লীগের মতো ধর্মাশ্রয়ী দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা না গেলেও আমাদের দেশে তা রয়েছে এবং প্রবলভাবেই রয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দুর্বলতাসহ আরও সব বাস্তব ঘটনার কারণে বর্তমানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজনৈতিক বিভাজন ছিল তাকে অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

দেশের রাজনৈতিক সংকটের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমানভাবে যারা দায়ী করেন, তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই দুই দলের অবস্থানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে চান না। স্বাধীনতার এত বছর পরে আর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক তুলে জাতিকে বিভক্ত করার প্রয়োজন নেই বলে যারা বুলি কপচান তারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকেই প্রশ্রয় দেন, সহায়তা করেন। পৃথিবীর কোনো দেশে কি স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করে কাউকে রাজনীতি করতে দেওয়া হয়? স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি-গোষ্ঠী তাদের একাত্তরের ভূমিকার জন্য একবারও জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, ভুল স্বীকার করেনি। বরং এখনও তারা দেশের রাজনীতিকে ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ধারায় চালিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি।

অন্যদিকে, সব দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী-স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি-জামাতের ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এবং এরা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক অনুদার রাষ্ট্রে পরিণত করবে– এটা যারা বুঝতে চান না, তারাই আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে এক কাতারে ফেলে সস্তা মন্তব্য করে বাহবা কুড়িয়ে মজা পান।

গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আর বেগম জিয়া তাদের রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার করা শুধু নয়, দেশের রাজনীতির সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার জন্য, ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য জামাতের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে বেগম জিয়া বর্তমানে আন্দোলনের নামে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন, তাতে সফল হতে পারলে দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা সব মুছে ফেলা হবে।

এটা অমূলক আশঙ্কা নয়। এটা যে ঘটবে তার প্রমাণ, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এখন আন্দোলনের নামে একাত্তরের কায়দায় মানুষ হত্যা করে দেওয়া হচ্ছে।

দুই দলকে যারা সমানভাবে দায়ী করে তুপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, তাদের উদ্দেশে বিনীতভাবে বলার কথা এটাই যে, আওয়ামী লীগ পরাস্ত হলে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত না হয়ে তালেবানি রাজত্ব কায়েমের পথ প্রশস্ত হবে। আর বিএনপি-জামাত পরাস্ত হলে গণতন্ত্রের যে ত্রুটি-দুর্বলতা এখন দেখা যাচ্ছে তা দূর করার সুযোগ পাওয়া যাবে।

মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করলে ভালোর দিকেই যায়। অতীতে তার অনেক প্রমাণ আছে। আওয়ামী লীগ হল পানির মতো, এতে লাল রং দিলে তা তা লাল হবে, নীল রং দিলে নীল হবে। কিন্তু জামাত হল আলকাতরার মতো। ওতে যে রংই দেওয়া হোক না কেন ওটা কালোই থাকবে।

বিএনপি এখন জামাতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই রাজনীতি করছে। তাদের এ বন্ধন আর মুক্ত হওয়ার নয়। জামাতের আলকাতরার মতো কালো রাজনীতি এখন বিএনপির মুখ ঢেকে দিচ্ছে।

নাশকতা-সহিংসতার রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে বিএনপিও কি ক্রমান্বয়ে আলকাতরায় পরিণত হচ্ছে না?


বিভুরঞ্জন সরকার:
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।