‘আল্লারাখা’-র সত্য গল্প কিম্বা কাল্পনিক ‘মেহেরজান’

গৌতম দাস
Published : 8 Oct 2009, 07:28 PM
Updated : 23 March 2011, 01:17 PM

'আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি ওদের জন্য
আমাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নাই'

মেহেরজান ঘিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনের প্রধান আপত্তি হল; 'ওদের',পাকিস্তানিদের, কোন একজন পুরুষের সাথে বাঙালি নারীর প্রেম। এই প্রেমে আপত্তির মানে কী? 'ওই' ওয়াসিম একজন পাকিস্তানি, তাই তার সাথে বাঙালি মেহেরজানের প্রেম হতে পারে না- নাকি চলচ্চিত্রটি এই প্রেমের ঘটনা যেভাবে তুলতে গেছে তাতে পাকিস্তানির সাথে বাঙালি নারীর প্রেম হওয়া ন্যায্য মনে হয় নি, বা তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায় নাই! কোনটা? এইখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মন সোজাসাপ্টা বলছে, 'আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি ওদের জন্য আমাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নাই'।

অথচ প্রেম ছাড়া কোন কাহিনীই হয় না, তাতে কাহিনী মানে যাই হোক। প্রেম দুনিয়ার কোন বাধা মানে না, প্রেমের মরা জলে ডোবে না, প্রেমেতে মজে মুচির পা ধোয়া জলও খাওয়া চলে, ইত্যাদি। বৈষ্ণব পদাবলীর উপজীব্য হচ্ছে প্রেম, বলা হয় প্রেম না থাকলে ঐ পদাবলী রচিত হতে পারত না—প্রেম সার্বজনীন, যে কারো সাথে যে কারো প্রেম হতে পারে। প্রেম সর্বভেদী; যে-কোন দূরত্ব, বাধা, ভেদ ছাপিয়ে যাবার ক্ষমতা সে রাখে—এই হলো প্রেমের সার কথা।

তা-ই যদি হয় তবে বাঙালির সামনের প্রেমিক লোকটির পাকিস্তানি হওয়া তো বাধা হিসাবে হাজির থাকলেও প্রেমের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দ্যোতনা তৈরি করে। প্রেম এই বাধাকে তুচ্ছ প্রমান করে দিতে পারে। বিশেষত আবার যুদ্ধের পটভূমিতে, যে যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের অনেকেই বাঙালি ধর্ষণে লিপ্ত। এই ধরণের ঘটনা বাধা হয়ে আছে বলেই তো প্রেম এখানে নিজের শক্তি দেখাতে সক্ষম হবে, জমজমাট হবে। সব ধরণের অনতিক্রম্য অমিল আর বাধা অতিক্রম না করতে পারলে প্রেমের মহত্ব ও শক্তির প্রমাণ আমরা কী করে দেখবো! এমন জটিল পরিস্থিতিতে জটিলতর সব বাধা, সাংঘাতিক আর বিদঘুটে সব পরিস্থিতি ছাপিয়ে যেতে না পারলে সেটা আর প্রেম হয় কী করে!

পাঠক! ভুল বুঝবেন না, এতক্ষণ আমি প্রেম নিয়ে মশকরা করিনি। আমি আসলে প্রেমের এই সকল বাধা ভেঙে ফেলার ক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেবার জন্য মিনতি করছি। বাস্তবকে অতিক্রম করে যাবার, পরিচিত পরিপ্রেক্ষিতকে ছাপিয়ে সকল ছক তছনছ করে ফেলবার মৌলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকটা মনে করিয়ে দিতে চাইছি। ইংরাজিতে বলতে পারি এটা প্রেমের 'ট্রানশসেন্ডেন্টাল' (transcendental) দিক। বাংলায় আমরা সবকিছু 'ছাপিয়ে যাওয়া' দিয়েও বুঝতে পারি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রেমের প্রবেশ, গম্যতা ও চলাচল। অন্য আর আর সব সম্পর্ক, ভেদাভেদ, স্বার্থবিরোধ ইত্যাদির বাধা–সব কিছুকে যে ছাপিয়ে টপকে যেতে পারে।

এই ছাপিয়ে যাবার ধারণা আসলে, বিরাজমান দুনিয়ার অস্বস্তি-জাত অবস্থা থেকে মুক্তির এক কল্পনা। বাস্তব দুনিয়ায় মানুষ নানা স্বার্থে, নানান ভেদচিহ্নে, গায়ের রং, শরীরের গড়ন, সমতল-পাহাড়ী বা উপকূলীয়, ধর্ম, গোত্র, বংশ, প্রাচ্য-পশ্চিম, নারী-পুরুষ, শ্রেণী ইত্যাদিতে বিভক্ত হয়ে জীবনসংগ্রামে যুদ্ধে রত। আর এর ভিতর দিয়ে মানুষের যত ধরনের কদর্যতা, নৃশংসতা, সংকীর্ণতা, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাকার সব নেতি গুণগুলোও প্রকাশিত। এটাই বাস্তবের দুনিয়া, মানুষ বিভক্ত। কেউ কারও কাছে যেতে পারছে না। মিলনের আকর্ষণও বোধ করছে, কিন্তু মিলিত হতে পারছে না। এই পরিস্থিতি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার আকুতি ধারণ করতে পারে তা-ই প্রেম, যার মধ্যে এই ট্রানশসেন্ডেন্টাল—এই ছাপিয়ে যাওয়ার সর্বভেদী সর্বগামী গুণ আছে। মানুষের সব আরোপিত বিভক্তির ঊর্ধ্বে যা মানুষকে তার স্ব-ভাবের কথা মনে করিয়ে দেয়, স্ব-ভাবে ফিরিয়ে আনে।

'বাঙালি' হওয়ার 'দোষে' আমরা পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নির্যাতন, নৃশংসতা, ধর্ষণ সয়েছি—এ যেমন এক সত্য, বিপরীতে এই সব কিছু ছাপিয়ে যাওয়ার প্রেমও সত্য। কাজেই আমরা যদি ধরেই নেই যে, পাকিস্তানি বলে তার সাথে বাংলাদেশী মেয়ের প্রেম হতে পারে না—তার মানে তো হার স্বীকার; সেক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নির্যাতন, নৃশংসতা, ধর্ষণ—এটাই একমাত্র ধ্রুব সত্য হয়ে যায়। তাহলে তো দুনিয়ায় মানুষের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। দুনিয়ার সমাপ্তি ঘটে সেখানে। এটা হতে পারে না। কারণ মানুষের সাধ্য অসীম, এক সীমাহীন সম্ভাবনার নাম 'মানুষ'। মানুষের সে সম্ভাবনা জাগরূক রাখার প্রতীকই প্রেম ।

কিন্তু দুনিয়ায় দ্বন্দ্ব-বিরোধ সংঘাতে মানুষে মানুষে শত্রুতা তৈরি হয়, থাকে। ফলে তা থেকে কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি যদি অনিবার্য হয়েই ওঠে তবে ঐ যুদ্ধের মাঠে, শত্রুকে বলপ্রয়োগে দমন করতে পারা অবশ্যই খুবই জরুরী। আর এরপর পরিস্থিতিকে নিজের প্রভাবাধীনে নেয়াটা নিশ্চিত করলেই চলে। মানুষের সংকল্প এটাই। কিন্তু এরপর আবার শত্রুকে পরিকল্পিত কচুকাটা করে নির্মূল করতে চাওয়ার ইচ্ছা যদি কারও জাগে তবে বুঝতে হবে এটা তাঁর নিজের এক সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। যুদ্ধের শত্রুতার মানে শত্রুকে কচুকাটা করে নির্মুল করা না, এটা যুদ্ধের লক্ষ্যও না। কারণ, আমার স্বার্থচিন্তার বিপরীত স্বার্থচিন্তা আছে বলেই সে আমার শত্রু বটে, কিন্তু ওই বিপরীত স্বার্থচিন্তা শত্রুর মাথা থেকে আসে বলে শত্রুর মাথা কেটে ফেলে স্বার্থ-বিরোধের উদ্ভব হওয়া বন্ধ করা যায় না। বরং যেই বাস্তব পরিস্থিতির উৎস থেকে এত এত বিপরীত স্বার্থ তৈরি হয়, শক্তি-ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, শত্রুতা তৈরি হয়–সেই বাস্তব পরিস্থিতি বদলে দিতে হবে। বদলাবার সেই ক্ষমতাই আমাদের কাম্য, আমার শত্রুর বা আমার বিপরীত স্বার্থের প্রতিটা কাটা মুণ্ডু আমাদের কাম্য না।

অন্যদিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়: যুদ্ধ এমন এক মানবিক বিপর্যয়, যা এড়ানো যায় না। যেমন, ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের জমিদার-প্রজা সম্পর্কের অবসান ঘটেছে, জমিতে প্রজাস্বত্ব কায়েম করা গেছে, আকণ্ঠনিমজ্জিত ঋণ থেকে প্রজাকৃষককে মুক্ত করে আনা গেছে। সবই ঘটেছে রেশম কোমল ভাবে। প্রজার হাতে কোন জমিদার খুন হয়ে যায়নি। অথচ এই রেশম কোমলভাবে পরিবর্তনের মধ্যে বড় এক বিপর্যয় তখন এখানে ঘটে গিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান নামে দাঙ্গা আমরা কেউ এড়াতে পারিনি। যার দগদগে ঘা এখনও শুকায়নি। এর ছাপ, সামাজিক ঝাঁকুনি এতই বিভৎসভাবে ঘটেছে যে আজ প্রায় চার প্রজন্ম পরেও আমাদের পরস্পরের মধ্যে কোথায় যেন একটা মানবিক দূরত্ব আছে, অবিশ্বাস আছে, টের পাই। একবার মনে হয় সব মিলিয়ে গেছে আবার হঠাৎ করে তা উঁকি মারতে দেখি।

আমরা ভেঙেছি অনেক কিন্তু আবার তেমন গড়ে উঠতে পারিনি। মানবিক সমাজ গড়ার কথা ভাবতে গেলে এখনও আমাদের থমকে যেতে হয়। মানুষ মানে কী—মানুষের স্ব-ভাব মানে কী? টের পাই কোথায় কী যেন একটা হারিয়ে ফেলেছি। যদিও এর মাঝে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রেমের বিয়েও হতে দেখি, আধুনিক রাষ্ট্রের আইন আশ্রয় করে। তবু বোধহয় এখনও সেই সর্বভেদী, সর্বগামী ট্রানশসেন্ডেন্টাল প্রেম আমাদের আরাধ্য হয়ে ওঠে নি, হয়ে উঠতে পারেনি, বুঝি। মানুষের সেসব পরিবর্তন, সংশোধন, ঢেলে সাজানোর কর্তব্য ও দায়, আর সর্বোপরি, মানুষের সম্ভাবনার উপর আস্থা রেখে এখনও আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। জানি।

কিন্তু প্রেমের যেইসব মহত্ত্বের কথা শুরুতে বললাম, সেইসব মহত্ত্বের গভীরতা জেনেই যে সব প্রেমকেন্দ্রিক সাহিত্য গল্প সিনেমা ইত্যাদি শিল্প রচিত হয়- একথা ভাবলে ভুল হবে। গভীরভাবে বুঝে তবেই নিজের সৃষ্টিতে রচনাকারেরা ওসব মাহাত্ম্যের চেহারা হাজির করেন – তা তো নয়। তবু, শিল্প রচনার পেছনে প্রেমের তাৎপর্যে গভীর উপলব্ধি রচনাকারের থাক বা না থাক, তা শিল্প সৃষ্টির কাজ – কাজেই এই ভাবের ছায়া অলক্ষ্যে সেখানে কাজ করে থাকে; কারণ এটাই মানুষের স্ব-ভাব। 'অপর' এর সাথে মিলবার তাগিদ; এটাই অলক্ষ্যে কাজ করে যায়। যদি ধরেও নেই, এত কিছু না ভেবে যুদ্ধের বিপরীতে এক দারুণ প্রেমের ছবিই হতে চেয়েছিল মেহেরজান, তাবুও তাতে মানুষের স্ব-ভাবের ছায়া আকুতি ও অভিপ্রায় নিয়ে উপস্থিত দেখতে পাই।

বাঙালি আত্মপরিচয়ের তালা
প্রেমের প্রতীকী কথা, তাও আবার সিনেমার গল্পে, এসব ছেড়ে ভাবছিলাম, সত্যিকার ঘটনার কথা। মনে পড়ল এগার বছরের এক বালক-মুক্তিযোদ্ধার পরিণত বয়সে লেখা যুদ্ধস্মৃতির কথা, বছরখানেক আগে প্রকাশিত। মনজুরুল হকের আত্মকাহিনী, স্মৃতি ঘেটে লেখা। জনাব হক জেনেছি সাংবাদিক। ওনার স্মৃতিমূলক বইয়ে ('এ লিটল ফাইটার', ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১০) লেখা প্রথম ঘটনাটার শিরোনাম হলো, 'আল্লারাখা তোমায় ভুলিনি বন্ধু'—আমাকে ভাবিয়েছিল।
আল্লারাখা তৎকালীন ইপিআর মানে যা এখনকার বিডিআর বা বিজিবি, এর একজন বেলুচ সৈনিক। ঘটনা সংক্ষেপ হলো, ১১ বছরের বালক মনজুরুল হকের পাড়াতুতো সূত্রে এবং অবসরপ্রাপ্ত বৈমানিক চাচার বদৌলতে কুষ্টিয়া ইপিআর ক্যাম্পে তাঁর ওই বয়সে টো টো করে ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগ ছিল, ওই কারণে যাতায়াত ছিল। ক্যাম্পে বড়দের ভলিবল খেলার বলবয়ের মত বল কুড়িয়ে দিত বালক মনজুরুল, অবসরে সৈনিকদের সাথে গল্পগুজব করত ইত্যাদি। ওসবের মধ্য দিয়েই আল্লারাখার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার শুরু। তবে সেটা আল্লারাখার সাথেই বিশেষ কেন? এর কারণ হলো, লেখককে দেখে আল্লারাখার সুদূর বেলুচিস্তানে ফেলে আসা নিজের সমবয়সী ছেলের কথা মনে হত, নিজের ছেলের মতই নাকি তাঁকে মনে হতো; এটাকে আমরা আরও আগ বাড়িয়ে হয়ত তাঁর পুত্রবাৎসল্যে বলা কথা বলে মনে করতে পারি। এই হলো তাদের সম্পর্ক-ঘনিষ্ঠতার উৎস। এসবই একাত্তরের ২৫ মার্চের অনেক আগের ঘটনা। মনজুরুল হক জানিয়েছেন, আল্লারাখা জয় বাংলা বলে ভলিবল সার্ভ করত। কিন্তু শেষে যা ঘটার কথা, ২৫ মার্চের কালোরাত্রির পর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা আল্লারাখাসহ সব পাকিস্তানী সৈনিক অফিসারদের বন্দি করে রাখে এবং পরে একসময় তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়।

কিন্তু এ ঘটনায় ১১ বছরের বালকের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ও ভাববার বিষয়। বালক পরিণত বয়সে তার কাহিনীতে বলছে এভাবে: যুদ্ধের কথাবার্তা শুনতাম "কিন্তু এর সাথে আল্লারাখার সম্পর্ক কী তা বুঝে উঠতে পারলাম না। আল্লারাখাকে কেন বন্দি করেছে তাও বুঝলাম না। তাকে আমার কখনই শত্রুপক্ষ মনে হয়নি।" পরে বড়দের বারণে লেখকের ক্যাম্পে যাওয়াআসা বন্ধ হলেও লুকিয়ে একদিন সে আল্লারাখার সাথে দেখা করে এবং বন্ধুর সাথে সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের এক পর্যায়ে আল্লারাখা একটা ডাব খাওয়ার ইচ্ছা জানায়। তবে পরদিন সে ডাব জোগাড় করে নিয়ে গেলেও গার্ডদের বাধায় বালক তা আর দিতে পারেনি। এর কয়েকদিন পর ওদের মেরে ফেলার খবর শুনে মনজুরুল হক দেখতে গিয়েছিলেন। আর বইয়ে এর প্রতিক্রিয়া লিখছেন এভাবে: "চোখ জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছিল কাকে যেন। এক সময় পেলাম। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে আল্লারাখা, আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।"

শেষে একটু বলে রাখি, ঐ বয়সে মনজুরুল হক তাঁর সমান লম্বা অস্ত্র হাতে বাঙ্কারে বসে যুদ্ধ করা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
আজ এখন এই কাহিনী নিয়ে কোন চিত্রনাট্য-সিনেমা হলে হয়ত এর ভাগ্য মেহেরজানের চেয়ে আলাদা কিছু হত না। কেউ হয়ত আতঙ্কিত হয়ে বলত, এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সেন্সর বোর্ড কীভাবে এই ছবির ছাড়পত্র দেয়, কে-ইবা এর ফাইন্যান্সার কোন পাকিস্তানি লবী তা খুঁজতে বের হত, ইত্যাদি। এটা সত্য কাহিনী হলেও প্রিন্ট মিডিয়ায় বলেই হয়ত মনজুরুল হকের এখনও তেমন কিছু হয়নি।

রামায়ণ বা মহাভারতকে আমরা ধর্মগ্রন্থ হিসাবে জানি, গণ্য করতে দেখি। পুণ্য সঞ্চয়, মন ভাল রাখা ইত্যাদির কথা ভেবে ভক্তিভরে এই গ্রন্থ পাঠে ভক্তের হৃদয় ভরে ওঠে ভক্তিরসে। তবে আমার পছন্দ একে ন্যায়শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বই হিসাবে পড়া, যেখানে ওটা ন্যায়শাস্ত্রের নীতি বিষয়ক ভাব-বাক্যের আশ্রয়ে ন্যায় অন্যায়ের তুল্যমূল্যের আলোচনা। সে হিসাবে রামায়ণ বা মহাভারত আমার কাছে চমৎকার ন্যায়শাস্ত্রের বই। যেখানে কুরুক্ষেত্রের পটভূমিতে কৃষ্ণ-অর্জুনের কথোপকথনের ছলে ন্যায়-অন্যায়ের ভিত্তিজ্ঞান হিসাবে এই মহাকাব্য দাঁড়িয়ে আছে। মহাভারত তাই ন্যায়শাস্ত্রের ব্যাখ্যা টীকা হিসাবে পড়তেই আমার বেশি পছন্দ।

মনজুরুল হক তাঁর বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নিজের ছোটবেলার টানাপোড়েনের কাহিনী বয়ান করেছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে সে লেখার একটা ন্যায়শাস্ত্রীয় বিচার করতে পারলে বেশ হত। কিন্তু এখনকার প্রসঙ্গ সরাসরি মেহেরজান, ওটা শেষ করতে হবে। তাই আপাতত পাঠকের জন্য সওয়াল-জবাবের ঢংয়ে কিছু কথা দিয়ে এ দিকটা শেষ করব। আমার এর আগের লেখাটা মাথায় রেখে পাঠক নিজেও জবাব জেনে নিতে পারেন।

মনজুরুল হক বলতে চেয়েছেন আল্লারাখাকে মেরে ফেলা অন্যায় হয়েছে। তাঁকে মনজুরুলের "কখনই শত্রুপক্ষ মনে হয়নি।" পাকিস্তানি সৈনিক আল্লারাখাকে মনজুরুল হক "আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ" বলেছেন। মনজুরুল হক একজন মুক্তিযোদ্ধা; পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নির্যাতন, নৃশংসতা, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, শত্রুর বিরুদ্ধে এক লড়াকু বাঙালি।

দেখা যাচ্ছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক পরিচয়ের ফ্রেমের মধ্যে একজন অবাঙালি বেলুচকে ভিতরে কোথায় কীভাবে জায়গা দিবেন তা নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছেন। একদিকে পাকিস্তানী আল্লারাখার সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক, যে সম্পর্কের টান তিনি অনুভব করেন। এই অনুভুতি সত্য, আবার, তাঁর মুক্তিযুদ্ধও আলবৎ সত্য। এখন বাঙালি জাতীয়তার এই আত্মসঙ্কট ঢাকতে তিনি এই কাহিনী বই থেকে গায়েব করে দিতে পারতেন। কিন্তু সততার উদাহরণ রেখে তিনি নিজের মনের সাথে অসততা না করার পথ আঁকড়ে ধরেছেন। নিজের বইয়ে একে জায়গা দিয়েছেন, আমাদের সামিল করেছেন।

এটা মনজুরুল হকের একার সমস্যা না; বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই বিনির্মিত রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্কট। এই সঙ্কটে মনজুরুল হক আল্লারাখাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে নিজস্ব সাধ্য মত সমাধান টানতে চেয়েছেন। কিন্তু সমাধান হয়নি। কারণ আল্লারাখা 'শহীদ' হতে পারেন না। বরং তাতে আর এক নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হয়। আমরা এখন সেখানে প্রবেশ করব।
মেহেরজান নিয়ে ফারুক ওয়াসিফের লেখায় (ফারুক ওয়াসিফের ফেসবুক দেখুন) এমন একটা ধারণা আছে যে, যুদ্ধের বাস্তবতার বাইরে এক 'ইনোসেন্স'-এর আশ্রয় জোগাড় করে প্রেম বাড়বার সুযোগ নিয়েছে ওয়াসিম-মেহেরের। ইনোসেন্ট মানে জীবনযুদ্ধের বাস্তব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আছর যাকে এখনও স্পর্শ করেনি, বয়স বা অন্য কোন কারণে বাইরে থেকে গেছে। ইনোসেন্স এই অর্থে যে, এগার বছরের বালকের দেখা চোখের বিচারে আল্লারাখাকে মেরে ফেলা অন্যায় হয়েছে, অবশ্যই। কিন্তু যুদ্ধের নিয়মের মধ্যে দাঁড়ালে দেখা যায়; যখন পাকিস্তানি-বাঙালি বলে মানুষের ভেদচিহ্ন, অবিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে, ঘাড়ের ওপর বাস্তব তলোয়ার হাতে উপস্থিত সত্য হয়ে হাজির হয়ে গেছে যখন, তখন আল্লারাখার মৃত্যু অনিবার্য। মুক্তিযোদ্ধার হাতে তাঁকে মরতেই হবে।

মানুষের জনগোষ্ঠীগত স্বার্থ আর আলাদা আলাদা ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে সবসময় এক দ্বন্দ্ব থাকে, থাকবেই; এটা সাধারণ ও বিশেষের মধ্যে এমন এক দ্বন্দ্ব যা মীমাংসার অযোগ্য। ফলে ব্যক্তি মনজুরুল হকের তাই আল্লারাখাকে "কখনই শত্রুপক্ষ মনে" না হলেও, জনগোষ্ঠীগতভাবে তাঁরা দুইজন সেই সময় নিঃসন্দেহে পরস্পরের শত্রু ছিলেন। এবং অবশ্য অবশ্যই এটা "ব্যাতিক্রম"-এর মামলা নয়। ব্যাতিক্রম নয় এজন্য যে, আল্লারাখা যখন নিজের জনগোষ্ঠীর একজন, সে অবশ্যই বালক মনজুরুল হক এর শত্রুপক্ষ, সবসময়ই ব্যাতিক্রমহীনভাবে শত্রুপক্ষ। আর ব্যক্তি আল্লারাখা অবশ্য অবশ্যই নিজে ব্যাক্তি মনজুরুল হকের বন্ধু। মানুষ সব সময়ই একইসঙ্গে একার এবং অনেকের বা সবার প্রতিনিধি। একইসাথে বিশেষ আবার সাধারণও।

কিন্তু আল্লারাখা "মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ" কি? এর সোজা জবাব হলো; না। আল্লারাখা শহীদ নয়। হতে পারে না। সঙ্কট এখানেই। যদিও মনজুরুল হকের "মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ" একথার ভিতর দিয়ে আল্লারাখার সাথে তাঁর সম্পর্কের আবেগের দিকটা বোঝা যায় বড় জোর। কিন্তু আল্লারাখা শহীদ নয় এজন্য যে, তাঁর মৃত্যু হচ্ছে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তাই, আল্লারাখাকে শহীদ মানলে মুক্তিযোদ্ধারা আসলে আর মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে শত্রু হিসাবে তার মৃত্যু হওয়ার ফলে আল্লারাখা শহীদ হতে পারে না। তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনের যে সঙ্কটের প্রতিনিধিত্ব দেখি আমরা মনজুরুলের মধ্যে, তার কী হবে?

আসলে সমস্যাটা হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদী এই রাজনৈতিক পরিচয়ের ফ্রেমের মধ্যে একজন বেলুচের জায়গা নাই। এটা এই পরিচয়ের সীমাবদ্ধতা। ওখানে কেউ জায়গা পেতে গেলে জাত-পরিচয়ে বাঙালি হবার পূর্বশর্ত আছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে লড়তে পূর্ববঙ্গের সবাইকে এককাট্টা করে পেলে তবেই জয়লাভ সম্ভব, সে বিচারে পূর্ববঙ্গের আমাদের সবাইকে এক নৌকায় তোলার চিন্তা ঠিক আছে। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় কীভাবে তৈরি করবো? যথেষ্ট ভাববার সময় তখন ছিল না, এই প্রশ্নের সমাধান তখন এভাবে করা হয়েছিল যে, আমরা "বাঙালি"। বাঙালি জাতীয়তাবাদে পাকিস্তানিসহ দুনিয়ার যে কোনো 'না-বাঙালী'র ওখানে জায়গা নাই, তাকে ধারণ করার সুযোগ নাই। পক্ষত্যাগী কোন পাকিস্তানীরও না, তা সে পাঞ্জাবী বা বেলুচ যেই হোক, সেখানে জায়গা নাই।

বাঙালীর এই আত্মপরিচয়ের তালা ভেঙে কোন 'না-বাঙালি'র পক্ষে বাঙালি হয়ে যাওয়া অসম্ভব। আর, না বা অ-বাঙালি মানে কেবল পাঞ্জাবী বা বেলুচ না, দুনিয়ায় যত নৃগোষ্ঠী অথবা জাতীয়তাবাদ আছে তারা সবাই। এদের কারও সাথে আমাদের সম্পর্ক নাই, সম্পর্কের দরকার নাই, কারও সাথে আমরা একাত্ম অনুভব করি না, দরকারও নাই—এই ভাব সেখানে হাজির আছে। কিন্তু আমরা তো আবার আমাদের দাবি-সমস্যার পক্ষে, আমাদেরকে নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে দুনিয়ার সবার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ চেয়েছি, আন্তর্জাতিক সমর্থন কামনা করেছি। তাই না?

জর্জ হ্যারিসনকে আমাদের আপন মনে হয়, ভাল লাগে। মনজুরুল হকেরও বেলুচ আল্লারাখার সাথে সম্পর্ক হয়, ভাল লাগে। কোথায় যেন একটা গভীর টান অনুভব করে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয় সঙ্কট আমাদেরকে ছাড়ে না। সবাইকে এক পাত্রে ধারণ করতে পারি না। আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই কিন্তু পরিচয়ের সঙ্কট কাটেনি। মানুষের স্ব-ভাব গুণে মনজুরুল হক তাই আল্লারাখার সাথে গভীর সম্পর্কের টান অনুভব করবে, সব 'অপর' এর সাথে টান অনুভব করবে। তবুও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয় ফ্রেমের মধ্যে এর সমাধান খুঁজে পাবে না। পেতে পারে না।

মনজুরুল হককে কষ্ট পেতেই হবে। এটাই আমাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্কট, সীমাবদ্ধতা। সম্পর্ক ভাবনা ট্রান্সসেন্ডেন্টাল বা সর্বভেদী সর্বগামী না হলে এ সঙ্কট থেকে আমাদের মুক্তি নাই। মনজুরুল হকের ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটনা হলো, তিনি তাঁর ও আল্লারাখার সম্পর্ক কী, কোন বন্ধনে তিনি টান অনুভব করছেন সেই অনুভূতিকে যুদ্ধের উপস্থিত সত্য, বিভেদ ও বিভক্তি—এই শত্রু জ্ঞানের মধ্যে মেরে ফেলেন নি। সম্পর্ক অনুভবের সত্যকে জায়গা দিয়ে, সম্পর্কের নাম তালাশ করে ফিরেছেন। তবে, আল্লারাখার সাথে তাঁর সম্পর্কের নাম তালাশের কষ্ট আল্লারাখাকে শহীদ বলে মীমাংসা হয়নি। আল্লারাখা শহীদ নয়। মনজুরুল হক এর তালাশ শেষ হয়নি।

মেহেরজান-এর কাহিনীর ছক অনুযায়ী বেলুচ সৈনিক ওয়াসিম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য চরিত্র। কারণ নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেনকে এই চরিত্রের মারফতই যুদ্ধ-শত্রুর বাস্তবতাকে টপকে যেতে হবে, এক সর্বগামী সম্পর্ক ভাবনা হাজির করতে হবে। কিন্তু দর্শক হিসাবে আমরা কেন যুদ্ধ-শত্রুর বাস্তবতায় একজন পাকিস্তানী সৈনিক ওয়াসিমকে শত্রু ছাড়া ভিন্ন কোনোভাবে দেখবো? পাকিস্তানী সৈন্য মানেই আমাদের সাক্ষাৎ শত্রু – আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলকেন্দ্র ঘটনা তো এটাই।

একটা পথ আছে। ওয়াসিম চরিত্রটির চিত্রায়নে—ধাপে ধাপে চরিত্রের বিস্তারে দর্শকের মনকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম এমন বিশেষ মানবিক গুণ ফুটিয়ে তোলা। যাতে ওয়াসিম একজন পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও দর্শক ঐ চরিত্রের মধ্যে নিজেকে, মানুষের স্ব-ভাবকে খুঁজে পায়। 'সেই ক্ষেত্রে ওয়াসিম যে শত্রু -এই সাধারণ ভাবমূর্তি ছাপিয়ে দর্শকের কাছে মনের অজান্তেই ওয়াসিম আপন বলে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো, পাকিস্তানি শত্রুসেনা ওয়াসিমকে রূপান্তরিত এক চরিত্র হয়ে উঠতে হবে—তা অবশ্যই এমনভাবে হাজির হতে হবে যাতে দর্শক অস্বস্তি বোধ না করে। ওয়াসিমের মতন নির্মিত চরিত্রের ক্ষেত্রে যদি দর্শকের বিন্দুমাত্র সন্দেহ, ছেদ ঘটার কারণ বা ফাঁকি থাকে তবে দর্শকের সচেতন কিম্বা অবচেতন মন ঐ চরিত্র গ্রহণ করবে না।

'মেহেরজান' ছবি নির্মাণের দিক থেকে হয়ত তেমন ভাল হয় নি, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে সিনেমার কৃৎকৌশল নিয়ে বিস্তর তর্ক আমরা করতে পারি। কিন্তু এর প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে বিষয় হিসাবে যে প্রেমের কথা আমরা বলছি তা এই ছবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কীভাবে আমরা আমাদের জাতীয়তাবাদী মনের অসুখ সারাব, কীভাবে আমরা আমাদের ইতিহাসের ক্ষত অতিক্রম করে যাব, তার কোন পথ বাৎলাতে পারে নি এই ছবি। কিন্তু এই তর্ক আমরা কেউ করছি না।
নগদ লাভ এতোটুকুই যে এই ছবির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা বুঝতে পারছি আমাদের অসুখ কতো গভীর ও বিস্তৃত।