ফিরে দেখা শাহবাগ

ওমর শেহাব
Published : 7 Feb 2015, 01:23 PM
Updated : 7 Feb 2015, 01:23 PM

শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তার প্রায় এক বছর পর, ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল আমি এই পাতাতেই 'চেতনা: মুক্তিযুদ্ধ থেকে শাহবাগ: প্রথম পর্ব' নামে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে বুঝি সেটি বলেছি। সেখানে এটাও ওয়াদা করেছিলাম যে, পরের পর্বে লিখব শাহবাগ আন্দোলন নতুন কী অনুভবের জন্ম দিয়েছে। এরপর আরও এক বছর পেরিয়ে গেল। শাহবাগ যেসব চেতনার জন্ম দিয়েছে বা এখনও দিচ্ছে সেটি নিয়েই এখনকার লেখা।

শাহবাগের চেতনার দুটি দিক থাকার কথা– কিছু ব্যাপারে এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরও সুসংহত ও স্পষ্ট করবে; আর অন্য কিছু ব্যাপারে এটি একেবারেই আনকোরা কিছু ধারণা এনে আমাদের জাতীয় পরিচয়ের পরিধি বাড়িয়ে একে আরও ন্যায়সঙ্গত করবে। এ লেখায় আমি আবারও নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করার চেষ্টা করব এসবের মধ্যে কী কী হল আর কী কী হয়নি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল যে চারটি মূলনীতি বাহাত্তরের সংবিধানের ছিল সেগুলো কি আরও স্পষ্ট করার কোনো জায়গা আছে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আছে। খুব সম্ভবত ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্র হল সেই দুই মূলনীতি– ১৯৭২ সালে সংবিধানের খসড়ার ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনায় যেগুলোর কথা সবাই বলছিল (১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর সাধারণ মানুষের মতামত নেবার জন্য এটি পত্রিকাতেও ছাপা হয়), তখনও তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি; এখনও কোনো বিতর্ক নেই। পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতিটি মূলনীতির জন্য আলাদা আলাদা শিরোনাম দিলাম।

ধর্মনিরপেক্ষতা

যে কোনো সুবিবেচক মানুষই এ ব্যাপারে একমত হবেন যে, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে শুধু এটি বুঝায় না যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্ম রাষ্ট্রপরিচালনায় অন্য ধর্মের তুলনায় আলাদা গুরুত্ব পাবে না। এর পাশাপাশি এও বুঝায় যে, ধর্মে বিশ্বাসীদের পাশাপাশি ধর্মে অবিশ্বাসীরাও (অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক, সংশয়বাদী এই ধরনের মানুষ) রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান গুরুত্ব, মর্যাদা ও অধিকার পাবে। বিভিন্ন মূলধারার ধর্মের বিশ্বাসীদের রাষ্ট্রপরিচালনায় সমান মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নটি ১৯৭২ সালেই সুরাহা হয়ে গেলেও 'বিশ্বাসী বনাম অবিশ্বাসী'দের বিষয়টি রাজনৈতিক বিতর্কে খুব বেশি উঠে আসেনি।

এর কারণ এই নয় যে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করেন; বরং এর মানে হল, ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে গুটিকয়েক ব্যক্তি যারা ধর্মবিশ্বাস ব্যবহার করে ব্যবসাপাতি করে খাচ্ছেন (বেশিরভাগ লোক ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা খারাপ চোখে দেখেন) তারা অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে বেশ প্রতিক্রিয়াশীল।

এই গুটিকতক মানুষকে ভয় পেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতারা (স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির নেতারা এই আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন; কারণ ন্যায়ভিত্তিক সমাজের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই) বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের পাশাপাশি অবিশ্বাসীদের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার ব্যাপার থেকে পালিয়ে রইলেন কেন? এর কারণ দুটি– আদর্শের সঙ্গে তাদের নিজেদের অসততা; আর দ্বিতীয়টি হল, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ গণমাধ্যমের ব্যর্থতা।

প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যর্থতার ব্যাপারটির উদাহরণ প্রায় প্রতি বছরই আমরা নিয়মিত বিরতিতে দেখতে থাকি– সেই খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় নেতাদের চুক্তি থেকে শুরু করে ২০১১ সালে তাদের স্থানীয় কর্মীদের বাউলদের ধরে চুল কেটে দেওয়া পর্যন্ত নানা গন্ধে ও বর্ণে। অপ্রধান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল বলতে মূলত আমরা বামপন্থী দলগুলো বুঝি। স্বাধীনতার পর থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দলগুলো এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগে এসেছে আওয়ামী লীগকে নিয়ে। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে অন্য একটি রাজনৈতিক দল কেন এগিয়ে যাচ্ছে এই জ্বালা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার পাগলামো যে কেউ করতে পারে, এটি আমাদের কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক দল না দেখলে কখনও বিশ্বাস হত না।

যখনই তাদের সামনে সংকটময় মুহূর্ত এসেছে, কালজয়ী পদক্ষেপ নিয়ে ইতিহাসের বাঁক না ঘুরিয়ে তারা নিজেদের মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে ফেলেছেন। 'দেশের পক্ষ নেওয়ার চেয়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষ নেওয়া বেশি জরুরি'– বামপন্থী দলগুলোর এই ধরনের প্রবণতার একটি চমৎকার উদাহরণ হল, বিএনপি-জামাত যখন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে বেরিয়ে এল, কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে তাদের নৌকায় উঠে নির্বাচন বর্জন করল।

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ব্যর্থতাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান দুটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকই এক সময় ছিলেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ। একজন ছিলেন সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা; অন্যজন ছাত্র ইউনিয়নের। এই বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে মূলধারার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আদর্শ, ক্ষমতা, রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ও কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের ইতিহাস (বিশেষ করে স্বাধীনতার আগের বছরগুলিতে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে) মোটামুটি সবাই জানেন।

আমি নিশ্চিত, কয়েক দশকে নিশ্চয়ই এই প্রাক্তন বামপন্থী কর্মী ও বর্তমান সাংবাদিকদের চিন্তা-ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তরুণ বয়সে পৃথিবী পাল্টানোর যে চমৎকার স্বপ্ন আর আশা নিয়ে তারা বাম দলে যোগ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট কি এখনও তাদের সাংবাদিক সত্তার অবচেতনে লুকিয়ে আছে? কে জানে, হয়তো মনোবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। আমি নিজে মাঝে মাঝে সেটির ছাপ দেখতে পাই।

সবচেয়ে বড় ইংরেজি দৈনিকের প্রাক্তন বামপন্থী সম্পাদক যখন ২০১৪ সালে চালানো বিএনপি-জামাত জোটের সন্ত্রাসের যৌক্তিকতা প্রমাণের জ্বালানি হিসেবে ইংরেজি ও বাংলায় নির্বাচন বন্ধ করতে বলে দুটি সম্পাদকীয় লিখলেন, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর 'দেশের পক্ষ নেওয়ার চাইতে আওয়ামী লীগের বিপক্ষ নেওয়া বড়' এই চিন্তাধারা কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমকেও পেয়ে বসেছে। আমার শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সে সময় এক আগুনঝরা বক্তৃতায় নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতার পাটিগণিত একদম পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও তাঁর মতো কিছু মানুষ আমাদের নৈতিকতা ও আশার বাতিঘর হয়ে আছেন।

দেশের বিভিন্ন সংকটের সময় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের ব্যর্থতার সুযোগ নিল কারা? অবশ্যই বিএনপি-জামাত জোট যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না; যারা মনে করে অন্য সব ধর্মের উপর একটি নির্দিষ্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গ। রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমগুলো এই ন্যূনতম মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেন যে, যে কোনো সভ্য সমাজে কেউ যদি রাজনীতি করতে চায় তাকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি আর বড় বড় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকেরা সেই সব মানুষের সঙ্গে উঠতে, বসতে আর চা খেতে থাকলেন, যারা মনে করে দেশের সব মানুষ সমান হলেও তাদের পছন্দের ধর্মবিশ্বাসীরা একটু বেশি সমান; শুধু তাই নয়, ধর্মে অবিশ্বাসীরা হল 'ক্রিমিনাল'!

অনেকেই ব্যর্থ হলেও, সবাই ব্যর্থ হননি। রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ, বিকল্প ধারার গণমাধ্যমকর্মী অর্থাৎ ব্লগাররা ঠিক আদর্শের জায়গাটি ধরে রাখলেন। শাহবাগ আন্দোলন যখন শুরু হল, খুব দ্রুত একে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে চালানোর জন্য বিএনপি-জামাত আর কলমসন্ত্রাসী মাহমুদুর রহমান উঠেপড়ে লাগল। এমনকি একসময় ধর্মীয় উন্মাদনা উস্কে দেওয়ার অপরাধে মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হলেও বড় বড় দুটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকের সম্পাদককে সে তার পাশেও পেল! কী লজ্জা, কী লজ্জা!

যাহোক, শাহবাগ আন্দোলন ঠিকই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানের একটি মূলনীতি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' আমাদের স্বাভাবিক পরিচয়ের অংশ। তাদের বিভিন্ন শ্লোগানে আর পোস্টারে বার বার এসেছে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় পরিচয়ের কথা। এমনি বেশ কয়েকটি গান হয়েছে যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মব্যবসার প্রতি ঘৃণা আর ধর্মে অবিশ্বাসীদের অধিকার ও মর্যাদার কথা ছিল মূল সুর।

শাহবাগ আন্দোলন খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের অংশ– কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম কখনও রাষ্ট্রের চোখে বাকি ধর্মগুলোর উপর প্রাধান্য পাবে না। সেটি হবে অন্যায়। শাহবাগ তরুণদের মধ্যে চিরতরে এই বীজটি বুনে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ঠিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো।

গণতন্ত্র

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানের আরেকটি মূলনীতি হল, 'গণতন্ত্র'। আন্দোলনের ধরনের কারণেই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের তাৎক্ষণিকভাবে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সংগঠন হিসেবে এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চের দেশজুড়ে বিস্তৃত প্রাণবন্ত সাংগঠনিক কাঠামো এখনও তৈরি হয়নি। অথচ আমরা একাধিকবার এর সম্ভাবনা দেখেছিলাম। কেন তৈরি হয়নি এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার মতো গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা কিংবা জ্ঞান আমার নেই। ঘটনাচক্রে আমি গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের সমবয়সী, কিন্তু আমার আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ভীষণ ক্ষুদ্র পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র হাজারখানেক ছাত্রছাত্রী নিয়ে। ইমরানের বিশাল জুতো যখন আমি পায়ে দিই সেটি ঢলঢল করে।

সেই তুলনায় গণজাগরণের কাজের ধরনটি বেশ বড় ও জটিল। আমি সবসময় কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনকে যখন বুঝার চেষ্টা করি, তখন দাঁড়িপাল্লা হিসেবে ব্যবহার করি নিজের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বিশাল সংগঠক জীবনের অভিজ্ঞতা। এটি খুবই যৌক্তিক দাঁড়িপাল্লা; কারণ বঙ্গবন্ধু সফল হয়েছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত ফসল তাজউদ্দীন আহমদই মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তবে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারটি, এমনকি বঙ্গবন্ধুর সময়কার আওয়ামী লীগের চাইতেও জটিল। আওয়ামী লীগে সবাই একই আদর্শের সদস্য। সেই আদর্শটি কী? দলীয় গঠনতন্ত্র। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চে বেশ কয়েক ধরনের সদস্য আছে– রাজনৈতিক সংগঠন (যেমন, ছাত্র ইউনিয়ন), বাম ঘরানার সাংস্কৃতিক সংগঠন (যেমন, উদীচি), অরাজনৈতিক সংগঠন (যেমন, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি), অরাজনৈতিক ব্যক্তি (যেমন, ইমরান এইচ সরকার, আরিফ জেবতিক প্রমুখ)।

কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যখন গণজাগরণ মঞ্চের বিবৃতির নিচে মুখপাত্র হিসেবে ইমরানের সই দেখি এটি আসলে তার কথা নয়। সেই বিবৃতি আসলে কোনো নীতিনির্ধারণী সভায় অনেক মানুষের মধ্যে আলোচনার ফসল। সে সভায় সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ সংগঠনের অনুমোদিত সিদ্ধান্ত ও এজেন্ডা নিয়ে এসেছেন, ব্যক্তি সদস্যরা তাদের নিজেদের আদর্শে থেকে উজ্জীবিত মতামত দেন। ইমরানকে মুখপাত্র হিসেবে সেখানে সবার মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা তৈরি করতে হয়; এমনকি সেই সমঝোতা যদি তার নিজের মতো নাও হয় তাতে তার কিছু করার নেই। এটি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা নয় যে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী যাই বলবেন মন্ত্রীরা 'জি হুজুর, জি হুজুর' করবেন (শেখ হাসিনার সময় তাও মন্ত্রীদের মতামতে কিছু বৈচিত্র্য ও স্বাধীনতা টের পাওয়া যায়, কিন্তু খালেদা জিয়ার সময় পাগলেও সেটি আশা করে না)।

একই সঙ্গে সংগঠনের প্রতিনিধি ও স্বাধীন ব্যক্তি সদস্যদের মধ্যে আলোচনা করে ইমরান বেশিরভাগকে এক নৌকায় নিয়ে আসছে– বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব বেশি সংগঠককে মনে হয় এ রকম কঠিন কাজ করতে হয়নি। এ কারণে আমি একে ভালো বা খারাপ এ রকম অতিসরল বিচার করতে চাই না।

এটি খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, গণজাগরণ মঞ্চ আসলে বাম ঘরানার রাজনৈতিক সংগঠন (এখন আর ছাত্রলীগ বা এই ধরনের মধ্যপন্থী সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চের সদস্য নয়) আর অরাজনৈতিক সদস্যদের মধ্যে 'টাগ অব ওয়ার'। গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচি দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় যে কখন এই প্রাধান্য বিস্তারের ব্যাপারটি কার অনুকূলে। আমি ভয় পাচ্ছি, আমার দুর্বল লেখনির কারণে আবার কেউ ব্যাপারটিকে ক্ষমতার কাড়াকাড়ির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন কিনা।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে– সাধারণ মানুষকে নিজের আদর্শের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করে যত বেশি সম্ভব মানুষকে নিজের কর্মসূচির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার নামই রাজনীতি এবং এটি একটি অত্যন্ত চমৎকার বিষয়। গণজাগরণ মঞ্চের ভিতরে ঠিক সেটিই হচ্ছে। এটির সঙ্গে কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইদানিং চলা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন তাহলে কিন্তু হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ যখন অন্য গ্রুপের কাউকে অপছন্দ করে তাকে কুপিয়ে দেয় (আমি ছাত্রলীগের যেসব সদস্য সন্ত্রাস করেন না, সত্যিকারের রাজনীতি করেন তাদের জন্য সহানুভূতি নিয়েই এ কথা লিখছি)।

গণজাগরণ মঞ্চ কিন্তু সেটি করছে না। এটি ঠিক তাই করছে যেটি সত্যিকারের রাজনীতিতে হয়। সবাই মিলে আলোচনা করে তারপর সংগঠনের বেশিরভাগ মানুষ যা চায় তাই করা।

নিজের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা একটি সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলে। সংগঠনটির নিজের শক্তি কতটুকু তা বুঝা যায় তার কর্মসূচি দেখে। কর্মসূচির কথা চিন্তা করলে গণজাগরণ মঞ্চের কাজের তিনটি ধারা– ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি, সাংগঠনিক কর্মসূচি আর প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচি। একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, এসব নাম একেবারেই আমার নিজের দেওয়া। গণজাগরণ মঞ্চ নিজের কাজ এভাবে নাও দেখতে পারে। ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল, সাভারের রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার সময় স্থাপন করা গণজাগরণ মঞ্চের ফিল্ড হাসপাতাল (যেহেতু ইমরান নিজে পেশায় চিকিৎসক, আমি নিশ্চিত এই কাজের জন্য সারাজীবনই তার মধ্যে একটি অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করবে)।

সাংগঠনিক কর্মসূচির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল, ২০১৩ সালের জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন। প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচিগুলো মূলত বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি যার মূল বক্তব্য থাকে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব– এর একটি উদাহরণ হল, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আইতে প্রচারিত ইমরানের দেওয়া বক্তব্য যেখানে তিনি দাবি করেন টাকা খেয়ে আদালত সাঈদীকে ফাঁসি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিগুলোর ব্যাপারে একটি কথাই বলব– এ সব কাজের জন্য দেশের মানুষ সারাজীবন গণজাগরণ মঞ্চকে ভালোবেসে যাবে। আমার কেন যেন মনে হয় এখনও যেসব অরাজনৈতিক সদস্য মঞ্চের সঙ্গে জড়িত আছেন তারা আছেন মূলত এসব ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির টানে। এর সবচেয়ে ভালো বৈশিষ্ট্য হল, এতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, ডেটলাইন, কর্মপদ্ধতি ও কর্মীদের মাঝে দায়িত্বের সুষ্পষ্ট বন্টন থাকে। কাজেই কেউ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মসূচিতে ঢুকলে তাকে সহজেই ধরে ফেলা যায়। রানা প্লাজার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল ছাড়াও এ রকম আরও একটি কর্মসূচি ছিল, হেফাজতের তের দফার বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চ আয়োজিত প্রতিবাদী নারী সমাবেশ।

সাংগঠনিক কর্মসূচি হল যে কোনো সংগঠনের প্রাণ। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়ি, তাহলে আবিষ্কার করব, প্রতিটি মহুকুমা, থানা আর গ্রামে আওয়ামী লীগের কমিটি তৈরি করার জন্য বঙ্গবন্ধু কী করে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। তখন তিনি মুসলিম লীগের একজন তরুণ মাঝারি সদস্য। তাঁর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল, দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে কর্মী সংগ্রহ করা এবং তাদের দিয়ে স্থানীয় কমিটি তৈরি করে রেখে আসা। এ ব্যাপারটি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য সহজ ছিল; কারণ, দিন শেষে তাদের পরিকল্পনা ছিল নির্বাচনে জেতা।

এখন সংসদের প্রত্যেকটি আসনে জেতার জন্য সেখানকার স্থানীয় রাজনীতিতে উপস্থিতি থাকতে হবে। তা না হলে তো হবে না। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের অবস্থা একদমই অন্য রকম। এটি নির্বাচন কমিশনে রেজিস্টার্ড রাজনৈতিক দল নয়। কাজেই ভোটের জন্য তাদের প্রত্যেক নির্বাচনী আসনে স্থানীয় কমিটির তাগিদ নেই (ভোটের জন্য এটি করা খারাপ কিছু নয়)।

অন্য একটি তাগিদ ছিল; সেটি হল, তারা চেয়েছে দেশের সব মানুষকে তাদের পতাকার নিচে নিয়ে আসতে। কাজেই স্থানীয় কমিটিগুলো অনেক বেশি জটিল ছিল, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী মুসলিম লীগের তুলনায়। অনেক জায়গাতেই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর স্থানীয় সংগঠনগুলোই গণজাগরণ মঞ্চের স্থানীয় কমিটির দায়িত্ব নিয়েছে। যখন ছাত্রলীগ মঞ্চের সঙ্গে ছিল, ঢাকার বাইরে তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে দিয়েছে। আমি ভালো কী মন্দ জানি না; তবে তার ফলে যেটি দাঁড়াল সেটি হল, গণজাগরণ মঞ্চের নিজস্ব বিশাল কর্মী বাহিনী তৈরি হয়নি। এমনকি গণজাগরণ মঞ্চের গঠনতন্ত্রও এখনও নেই।

আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ২০১৪ সালে জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন হয়েছিল কিনা। কিন্তু যেহেতু বোয়ান আর গণজাগরণ মঞ্চ, এই দুটিরই ওয়েবসাইট এখন অচল সেটি আর জানতে পারিনি। এ বছরও জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন হবে কি না এখন পর্যন্ত জানি না।

সাংগঠনিকভাবে নাজুক করে রাখা গণজাগরণ মঞ্চের এই পরসংগঠন-নির্ভরতার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। এটি বুঝা যায়, গণজাগরণ মঞ্চের প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচি দেখে। একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, আর দশটি রাজনৈতিক দলের মতোই এদের আনুগত্য নিজের দলের প্রতি, মঞ্চের প্রতি নয়। বাংলাদেশের যে কোনো বামপন্থী সংগঠনেরই প্রধান প্রতিপক্ষ, তাদের ভাষার বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ। তাদের রাজনৈতিক সমীকরণে বিএনপি-জামাতের কোনো হিসাব নেই।

এর কারণও আছে। যখন কোনো উৎসাহী ধর্মনিরপেক্ষ কিশোর বা তরুণ রাজনীতিতে যোগ দিতে চায় তার সামনে বাংলাদেশে কেবল দুটি উপায়– আওয়ামী লীগ ও কোনো একটি বাম দল। আমাদের এখনকার বাম দলগুলো আর ষাটের দশকের বাম দল নেই। এ যুগের মুনীর চৌধুরীরা আর কম্যুনিস্ট পার্টি করেন না। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ঢাকাভিত্তিক এসব বামপন্থী দলগুলো মাঝে মধ্যেই তাদের কাজকর্মের কারণে মানুষের হাসির খোরাক হয়।

তার উপর সম্প্রতি দেশের বেসরকারি খাতের পুঁজির বিকাশ এখন কেবল আর সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ পাশ করার আগে থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং আওয়ামী লীগ সরকার নিজেও এ ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগেছে। একজন মেয়ে যখন ফেসবুকে বিয়ের মেহেদি লাগানোর ব্যবসা করে আর একটু বিকশিত হয়ে দু-চারজনকে চাকরি দিতে পারে, তখন সে টেকনিক্যালি একজন পুঁজিপতি হয়ে যায়। এটাই এখন বাংলাদেশের তরুণদের চিন্তার মূলধারা– তারা দেশ পাল্টানোর জন্য রাজনীতি না করে কোম্পানি দিতে চায়।

কাজেই বামপন্থী রাজনীতির আকাশে এখন ঘোর দুর্যোগ। এ কারণে তারা শাহবাগ এখনও আঁকড়ে রেখেছে। তাদের নিজেদের ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি আছে। সেগুলো চালানোর ফাঁকে ফাঁকে, যখনই তাদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে 'শ্রেণিসংগ্রাম' চালানোর জন্য একটি স্বল্পকালীন ফ্রন্ট দরকার হয়, তখন তারা গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তারা সেটি নিয়ে কখনও সরাসরি কথা বলবে না।

আমরা ইমরান এইচ সরকারকে মুখপাত্র হিসেবে জানি, কিন্তু সে কাদের মুখপাত্র সেই তালিকা কি সুনির্দিষ্ট করে জানি? এমনকি শিবিরের মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনও কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছে তাদের বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নাম। এই ন্যূনতম স্বচ্ছতাও গণজাগরণ মঞ্চকে রাখতে দেওয়া হয়নি। কারণ, আমার অনুমান হল, বামপন্থী সংগঠনগুলো জানে, যখনই সাধারণ অরাজনৈতিক সদস্যরা দেখবে গণজাগরণ মঞ্চে কোনো কোনো বামপন্থী সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে আছে, তখনই তারা যে পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন কেবল শাহবাগ মোড়কেন্দ্রিক একটি বুদবুদের ভিতর ঢুকে আছে, সেই বুদবুদটি ফেটে যাবে।

কারণ, আমরা জানি, মৃত ঘোড়া রেসে জিতে না। বাম রাজনীতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৃত ঘোড়া। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রে, কম্যুনিজমে নয়। এ কারণে যতদিন পারা যায় বাম সংগঠনগুলো ইমরানের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আমার খুব কষ্ট হয় যখন মানুষ গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারে কখনও হতাশা প্রকাশ করতে হলে ইমরানকে 'পাঞ্চিং ব্যাগ' হিসেবে ব্যবহার করে। আমাদের এই প্রশ্ন করতে হবে, ইমরান যাদের মুখপাত্র তারা কারা, তারা কী করে?

গণজাগরণ মঞ্চের প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচিতে তাই আমরা টিপিক্যাল সিপিবি সিগনেচারটি দেখতে পাই– সেটি কখনও 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' বা কখনও একতরফা অভিযোগ। সাংগঠনিক কর্মসূচির কথা চিন্তা করলে গণজাগরণ মঞ্চের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্র এখনও সুসংহত নয়। যতদিন এই স্বচ্ছতা আর প্রতিনিধিত্বশীলতা নিশ্চিত না হবে, গণজাগরণ মঞ্চ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চর্চাতেও খুব বেশি অবদান রাখতে পারবে না।

জাতীয়তাবাদ

গণজাগরণ মঞ্চ জাতীয়তাবাদ প্রশ্নেও খুবই চমৎকার এবং অত্যন্ত স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। সত্তরের দশকের শ্লোগান 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি' এখন পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে 'তুমি কে আমি কে, চাকমা মারমা বাঙালি'। এই নতুন শ্লোগান আমার অসম্ভব প্রিয়। আদালত রায় দিয়েছেন, আমাদের জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন জনপ্রতিনিধিরা। এই লেখার আগের পর্বে আমি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে যোগাযোগ ও দ্বন্দ্ব ছিল সেটি কিছুটা বলেছি। আমরা এখনও ১৯৭৫ সালের সেই অমীমাংসিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আওয়ামী লীগ ও সংসদের অন্য দলগুলোর কেউ সেটি তো এখনও করেনি, তার উপর আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আকিকাটি করে আমাদের দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর কাজগুলোর একটি করে বসে আছে।

আমি জানি, একদিন না একদিন এটির সুরাহা হবে, আমাদের সংসদেই হবে। আশা করব, সেদিন রাজনীতিবিদরা শাহবাগ আন্দোলন আর গণজাগরণ মঞ্চকে ধন্যবাদ জানাবেন এই প্রশ্নের একটি সহজ সরল উত্তর দেওয়ার জন্য– আমরা কে? চাকমারা চাকমা, মারমারা মারমা, সাঁওতালরা সাঁওতাল, বাঙালিরা বাঙালি আর সবাই মিলে বাংলাদেশি। আমাদের সবার নববর্ষের খাবার এক নয়, সবার ভাষা এক নয়, কিন্তু সবার পতাকা লাল সবুজ। গণজাগরণ মঞ্চকে ধন্যবাদ, তাদের দ্বিগুণ বয়সী রাজনীতিবিদরা যেটি পারেন না সেটির সমাধান দেওয়ার জন্য।

সমাজতন্ত্র

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সর্বশেষ ফসল অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র ব্যাপারটিও আসলে এই মুহূর্তে গণজাগরণ মঞ্চের নিজের কাজের পরিধির সঙ্গে সরাসরি যুক্তি নয়। তাই এ নিয়ে আর কথা বললাম না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাহবাগ আন্দোলন আরও স্পষ্ট ও বিকশিত করেছে। যে জিনিস চল্লিশ বছরে হয়নি, সেটি মাত্র দুই বছরে কী করে হল? এর কারণ হল, শাহবাগ আন্দোলন ছিল এক ধরনের গণবিস্ফোরণ। তেতাল্লিশ বছরের ধরে এই চেতনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপরিচালনার সময় যখনই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, মানুষের মনের মধ্যে একটু করে ক্ষোভের বারুদ জমা হয়েছে। জমতে জমতে যখন এই বারুদের স্তূপ পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গেল, তখনই এল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি।

শাহবাগ এল আর ভাসিয়ে দিয়ে গেল দেশকে, সমাজকে, সময়। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যাওয়ার পথে, ব্যবসায়ী দোকানের দরজার ফাঁক দিয়ে, রাজনীতিবিদরা তাদের কর্মসূচির অবসরে, 'সুশীল বুদ্ধিসমাজ' টকশো স্টুডিওতে তাদের পাহাড়সম দ্বিচারিতা আর নির্বুদ্ধিতা নিয়ে দেখল, স্বপ্ন, আশা, ক্ষোভ আর সংকল্পের এক অদ্ভুত অদম্য জলোচ্ছ্বাস। মাত্র দুই বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ পাল্টে গেল। ছোট ছোট বাচ্চাদেরও পকেটে এখন আছে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার। যারা এই ফিল্টারের ভিতর দিয়ে পাশ করে যেতে পারবে, তারাই কেবল বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে পারবে। যেটি আসলে খুবই স্বাভাবিক হওয়ার কথা মানুষ প্রথম বারের মতো সেই প্রশ্ন তোলা শুরু করল– কেন বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী সব দলই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হবে না? এসবই হয়েছে শাহবাগের জন্য।

এখন প্রশ্ন হল, শাহবাগ আমাদের চেতনায় নতুন কিছু দিয়ে কি সমৃদ্ধ করেছে? হ্যাঁ, করেছে। আমি এই লেখার আগের পর্বে বলেছি:

"আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হল 'কেন বাংলাদেশ চাই' এই প্রশ্নের উত্তর। আর 'কেমন বাংলাদেশ চাই' এই প্রশ্নের উত্তর হল শাহবাগের চেতনা।"

গত দুই বছরে শাহবাগ আন্দোলন থেকে আমার নিজের ঘরে তোলা ফসল হল–

বাকস্বাধীনতার চর্চা, দায়িত্বশীল সুসংহত সাংগঠনিক কর্মসূচি, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা, গণমুখীতা, দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণ– এই সব শিক্ষা। এর মানে কি এই যে, এর সবকিছুই শাহবাগ আন্দোলনে বা এর সবচেয়ে বড় সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চে ছিল? সবসময় ছিল না। কখনও কখনও এসবের অভাবে আন্দোলনের কোনো কোনো কর্মসূচি সফল হয়নি। এই থেকেই এই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাগুলো অনুভব করা যায়।

বাকস্বাধীনতা

জাতীয় চেতনার দিক থেকে শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ফসল হল, বাকস্বাধীনতা বলতে আসলে কী বুঝায় সেই বোঝাপড়াটি স্পষ্ট হওয়া। বাকস্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা বলার স্বাধীনতা নয়, বরং কেউ যখন যা ইচ্ছা তা বলবে তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশে আমি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব সেই সীমাই হল বাকস্বাধীনতা। এই ব্যাপারটি কী করে শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে পরিষ্কার হল?

বিভিন্ন সময়ে যখন কলমসন্ত্রাসী মাহমুদুর রহমান শাহবাগের তরুণদের বিরুদ্ধে যখন ধর্মদ্রোহিতা আর নাস্তিকতার অভিযোগ আনলেন, তখন শাহবাগ আবারও সময়ের নায়ক হয়ে সবাইকে শিখিয়ে দিয়ে গেল দেশের আইন না ভেঙে নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার সবারই আছে। সবাই যখন মতপ্রকাশের অধিকারটি চর্চা করবে আপনার মতের বিপরীতে কারও না কারও মত থাকবেই। তখন আপনি কী করবেন?

শাহবাগ ভলতেয়ারের সেই অমর বাণীই ছড়িয়ে দিল, আপনি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন, কিন্তু তার সেই দ্বিমত পোষণের অধিকারটুকুর জন্য দরকার হলে আপনি প্রাণ দিবেন। যদি সেই লোক দ্বিমত প্রকাশ করতে গিয়ে আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তাহলে কী করবেন? আওয়ামী লীগের কিছু উৎসাহী কর্মীদের মতো বঙ্গবন্ধুকে কটুক্তি করলেই জেলে ঢুকিয়ে দিবেন?

একটি জিনিস, আমাদের বুঝতে হবে কটুক্তি করা ফৌজদারি অপরাধ নয়। এটি সামাজিক অপরাধ। আমাদের হাজার বছর ধরে চলে আসা সামাজিক রীতিনীতিতে এর প্রতিকার আছে। কটুক্তির প্রতিবাদের উপায় হল শোভন উক্তি, প্রতিবাদ ও এরপর কিছু না হলে সামাজিক বয়কট। সিস্টেমেটিক কুৎসা ও বিদ্বেষ রটনার জন্য অর্থ ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি প্রয়োজন যেটি মাহমুদুর রহমান ব্যবহার করেছিলেন। তখনই কোনো মতপ্রকাশ অপরাধে পরিণত হয় ও তখন দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার করতে হবে।

বাকস্বাধীনতার এই বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা আমার তৈরি হয়েছে শাহবাগের সময়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন পরিস্থিতি বুঝতে ও তা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, এক সময় এই বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের নিরঙ্কুশ অধিকারটি আমাদের সংবিধানের অংশ হবে। সেদিন আমরা সবাই নিশ্চয়ই শাহবাগ আন্দোলনকে কৃতজ্ঞতা জানাব।

সুসংহত সাংগঠনিক কর্মসূচি

দায়িত্বশীল সুসংহত সাংগঠনিক কর্মসূচি যে কোনো ভালো সংগঠনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এটি নিশ্চিত করতে ওই সংগঠনটির প্রয়োজন স্বচ্ছ দায়িত্ব বন্টন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কাছাকাছি সময়ে শুরু হওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে আমার জানামতে এ ব্যাপারে সবচেয়ে গোছানো অবস্থায় আছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম, (সংক্ষেপে, আইসিএসএফ)।

গণজাগরণ মঞ্চের তুলনায় আইসিএসএফ খুবই ছোট সংগঠন। এছাড়া তাদের কাজের পদ্ধতি ও ক্ষেত্রও ভিন্ন। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক দূত স্টিফেন রেপ, জামায়াতের ১৯৬ কোটি টাকা দামের লবিস্ট টবি ক্যাডম্যান আর হলুদ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য আইসিএসএফের যে মাসের পর মাস ধারাবাহিক ও গোছানো পরিশ্রম তার জন্য সদস্য হিসেবে আমার গর্বের শেষ নেই।

গণজাগরণ মঞ্চ যখন তাদের গঠনতন্ত্র তৈরি করবে, তাদের নীতিনির্ধারণী কমিটির সব সদস্যদের সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রকাশ করবে তখনই আমরা জানব গণজাগরণ মঞ্চ আসলে কারা, কাদের জন্য এবং সবচেয়ে বড় এ কথা এই মানুষদের নিয়ে মঞ্চ কতদূর যাবে।

একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার দু'চার বছরের কাজ নয়। আমরা মাত্র ব্যক্তি পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধের বিচার কিছুটা গুছিয়ে এনেছি। সামনে শুরু হবে সাংগঠনিক যুদ্ধাপরাধের বিচার। তারপর একসময় আমরা বিদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করব। এটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমাদের কয়েক দশকের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। শুধু একজন মুখপাত্র নিয়ে মঞ্চ খুব বেশিদূর যেতে পারবে না। মঞ্চ যখন ইসলামি ব্যাংকের চাঁদা নেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের স্বচ্ছতা দাবি করে তখন তাকে বুঝতে হবে, এই দাবির নৈতিক ভিত্তি থাকবে তখনই যখন মঞ্চ নিজের আর্থিক ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ করবে।

এটি খুব সহজ নয়। কারণ, বাংলাদেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসেই আর্থিক স্বচ্ছতার সংস্কৃতি খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। কিন্তু এটির বিকল্প নেই। নিশ্চয়ই একদিন বাংলাদেশের আইনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দায়িত্বশীল সাংগঠনিক চর্চা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে। শাহবাগ আমাদের সেই আশা দেখায়।

গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা

মূলধারার গণমাধ্যমে গত দু' বছর ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সাংবাদিকতার ইতিহাস অবহেলার ও লজ্জার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্যতিক্রম, কিন্তু প্রধান বাংলা দৈনিক নিয়মিত জামাতের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা, 'বিচার স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না', এর প্রতিধ্বনি করে গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলোর শুনানিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের কত গৌরব ও শোকের ইতিহাস উঠে এসেছে– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো আদালতের খাতা থেকে পত্রিকার পাতা পর্যন্ত আসতে পারেনি।

আমি জানি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন আমাদের প্রজন্মের সাংবাদিকদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবে– 'শুধুমাত্র খারাপ খবরই বিক্রয়যোগ্য' এই নীতি কি যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্যও প্রয়োগ করতে হবে? এটি কি আরেকটু মনোযোগ, আরেকটু ভালোবাসা পেতে পারত না? প্রসিকিউশনের পান থেকে চুন খসলেই তিন কলামের হেডলাইন কিন্তু জামায়াতের আইনজীবী যখন জালিয়াতি করেন তখন সেটি চেপে যাওয়া? এটি কেমন সাংবাদিকতা? রাশিফলের জন্য ক'কলাম ইঞ্চি আর শহীদদের জন্য ক'কলাম ইঞ্চি?

বয়সে নবীন হয়েও গণজাগরণ মঞ্চ কিন্তু এ ক্ষেত্রে রীতিেো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। গণজাগরণ মঞ্চের পত্রিকা 'গণজাগরণ' যুদ্ধাপরাধের মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে নিয়মিত রিপোর্টিং শুরু করে দিয়েছিল। পরে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলেও নিয়মিত রিপোর্টিং আলাদা একটি উদ্যোগে পরিণত হয়। একরামুল হক শামীমের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই ওয়েবসাইট এখন এ নিয়ে সবচেয়ে সমৃদ্ধ বেসরকারি সংগ্রহ।

মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর নিরন্তর অবহেলা আর শাহবাগ আন্দোলন বিকল্প গণমাধ্যমে প্রকৃত খবরের বিশাল চাহিদার সৃষ্টি করেছে। এর কিছুটা কুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন অস্বীকৃত খবরের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর চর্চা ছড়ানো দেখে। একসময় আশা করি, এই নিয়ে খুবই সুন্দর কিছু আইন ও বিধিমালা তৈরি হবে যেটি সৎ বিকল্প সাংবাদিকতার জন্য একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

গণমুখীতা

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে সরকারের যে ঘাটতি আমরা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি সেটি হল, পিআর বা গণসংযোগের অভাব। দেশময় জামায়াতে ইসলামী মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকারের সেটি সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে সামলানোর ন্যূনতম জনবল ও সামর্থ্যটি অর্জন করতে কয়েক বছর লেগে গেছে। তারপরও যা আছে তা যথেষ্ট নয়। শাহবাগের পর যখন জামায়াতে ইসলামী গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধেও একই প্রচারযুদ্ধ শুরু করল তখন গণজাগরণ মঞ্চ সেটি বেশ ভালোভাবে সামলালো।

আনন্দের বিষয় হল, অনেক সংগঠনই তখন স্বাধীনভাবে মঞ্চের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এই দুটি অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সবচেয়ে শিক্ষণীয় বিষয় হল, গণসংযোগ রাষ্ট্রপরিচালনার অপরিহার্য অংশ। শুধু দায়িত্ব পালন করে গেলেই হবে না, আপনি যাদের কাছে দায়বদ্ধ সেই জনগণের কাছে এই দায়িত্বশীলতা যেন স্পষ্ট হয় সেই যোগাযোগের সেতুটি থাকতে হবে। একে বলে গণমুখীতা। আমার কাছে মনে হয় শাহবাগ আন্দোলনের কাছ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল গণমুখীতা।

রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রত্যেকটি অফিসের কোনো না কোনো কাজ আমাদের কারও না কারও জীবন প্রভাবিত করছে। কাজেই আমাদের সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত যোগাযোগ থাকতে হবে। গণজাগরণ মঞ্চ শুধু নিজের ক্ষেত্রেই সেটি সফলভাবে করেনি, এমনকি একবার রাষ্ট্রকেও এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। ২০১৪ সালের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঞ্চ যে তিনটি দাবি সরকারের কাছে তুলেছিল তার মধ্যে একটি ছিল, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণঅবহিতকরণের জন্য স্থায়ী জনবল ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। ২০১৩ সালের ৬ দফার পরে এই দাবিগুলোই ছিল গণজাগরণ মঞ্চের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।

দুঃখজনক ব্যাপার হল, এ রকম ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি একটি করে সমস্যা সমাধান না করে মঞ্চ পরের দিকে কিছুটা প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচির দিকে ঝুঁকে পড়ে। আশা করি, মঞ্চ আবার ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ থেকে নতুন করে শুরু করবে। সেটি নিশ্চয়ই সম্ভব হবে। যেদিন আমাদের দেশের প্রতিটি সরকারি অফিসে তথ্য অধিকার আইনের সুবিধা নাগরিকদের দেওয়ার জন্য আলাদা বাজেট, অবকাঠামো ও জনবল বরাদ্দ সম্ভব হবে, তখন নিশ্চয়ই আমরা শাহবাগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করব।

দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণ

শাহবাগ আন্দোলন কারা শুরু করেছিল? কিছু নাগরিক যারা রাষ্ট্রের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে গিয়েছিল। যখন এ আন্দোলনের আগুন সবদিকে ছড়িয়ে গেল তখন কত মানুষ নিজের মতো করে এই তাড়না অনুভব করল। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বিএনপি-জামাত যখন ধরে ধরে দায়িত্বরত পুলিশদের হত্যা শুরু করল তাদের মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য একেবারেই ব্যক্তি উদ্যোগে জিনাত জোয়ার্দার রিপা শুরু করলেন 'স্যালুট টু পুলিশ' কর্মসূচি। খুব জটিল কোনো কাজ নয়, কেবল একটি লাল টুকটুকে গোলাপ নিয়ে কর্তব্যরত পুলিশদের হাতে দিয়ে তারা বলে আসতে লাগলেন, আমাদের নিরাপদে রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই মানুষগুলো যাদের আমরা ঠিকমতো কাজের পরিবেশ দিতে পারি না, ভালো বেতন দিতে পারি না, তাদের জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কী-ই-বা দেওয়ার আছে?

আনন্দের ব্যাপার হল, কিছু দায়িত্বশীল মানুষের মাথায় ঠিকই এই উদ্যোগটি এসেছিল। যখন কিছু তরুণ-তরুণী রাত জেগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, দেশে-বিদেশে আরও কিছু মানুষ বসে পড়লেন কণ্ঠ ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। ইউটিউবে আরব বসন্তের গান খুঁজলে একুশটি গানের একটি তালিকা পাওয়া যায়। কেউ কি বলতে পারেন, শাহবাগ নিয়ে মৌলিক গানের সংখ্যা কত? একশ' তেত্রিশটি– প্রতি দুই দিনে প্রায় একটি নতুন গান!

সরকার যখন জনবল আর অবকাঠামোর অভাবে বিএনপি-জামাতের প্রোপাগাণ্ডা যুদ্ধ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, কিছু উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী তৈরি করলেন মানুষকে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য 'বিডিফ্যাক্টচেক ওয়েবসাইট'। নিজেদের মেধা, সৃজনশীলতা আর পরিশ্রমের উপর তাদের আস্থা ছিল। যখন দেশের ডাক এসেছে, তখনই তারা নিজেদের মতো করে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছেন।

যারা এসব করেছেন তারা জানেন এই দেশকে দিয়েই সবকিছু হবে। এ কারণেই তারা দেশের দায়িত্ব নিজেদের দক্ষতা অনুসারে বুঝে নিয়েছেন।

দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণ বলতে আসলে কী বুঝায়? এটি হল, 'আই হেইট পলিটিক্স' ভাবনাটির সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মানে, রাজনীতিকে আমরা ঘৃণা করব তো না-ই বরং রাজনীতি আমাদের অংশীদারিত্ব আবারও প্রতিষ্ঠা করব। কী করে করব? আমরা সবসময়ই দেশের রাজনীতিকে চোখে চোখে রাখব। দরকার হলে রাজনীতিও করব। কখনও সেটি পছন্দ না হলে আমরা সেটি নিয়ে কথা বলব। আর দশটি বিষয়ের মতো রাজনীতিও আমরা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে ঝগড়া না করে আলাপ করতে পারব।

প্রথমদিকে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অভ্যাসের কারণে টক শোর 'সুশীল বুদ্ধিসমাজের' মতো উত্তেজিত হয়ে পড়বে। কিন্তু পরের প্রজন্ম আসতে আসতে এসব ছোটখাট বিষয় নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। শাহবাগ আন্দোলন 'আই হেইট পলিটিক্স' মনোবৃত্তির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। আজ থেকে কয়েক দশক পরে তরুণ প্রজন্ম যখন আরেকটু অভিজ্ঞ হয়ে দেশের দায়িত্ব নিবে, তখন তাদের মনে সবসময়ই এই আত্মবিশ্বাস থাকবে যে দেশের প্রয়োজনে তারা কখনও মুখ ঘুরিয়ে ছিল না। শাহবাগে যেমন সে গেছে আবার দরকার হলে আবারও নিশ্চয়ই সে যাবে।

জন্ম থেকেই এমন দেশ পেয়েছি যেটি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, এই চমৎকার ব্যাপারগুলিতে বিশ্বাস করে। আমরা কতই না সৌভাগ্যবান। যেদিন আমরা শাহবাগ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলব সেদিন এই বাংলাদেশ হবে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত; বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রাণবন্ত দক্ষ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভরপুর; সৎ সাংবাদিকতার চর্চায় অভ্যস্ত; গণমুখী, দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণের এক স্বপ্নের বাংলাদেশ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঠিক এই বাংলাদেশই তো আমরা চাই, তাই না?

শাহবাগ না হলে কি আমরা একসঙ্গে এত স্বপ্ন এত তাড়াতাড়ি দেখতে পারতাম?

তথ্যসূত্র:

১. "চেতনা: মুক্তিযুদ্ধ থেকে শাহবাগ: প্রথম পর্ব"

এপ্রিল ৫, ২০১৪; মতামত-বিশ্লেষণ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

২. এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার: মাহফুজ আনাম

সি বাংলা; জুলাই ৪, ২০১৩

৩. বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গোলটেবিল বৈঠকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্য

জানুয়ারি ৪, ২০১৪

৪. "শাহবাগের একশ বাইশটি গান"

এপ্রিল ৫, ২০১৪; মতামত-বিশ্লেষণ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

৫. ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ওয়াচ

সম্পাদক: একরামুল হক শামীম

৬. বিডিফ্যাক্টচেক