সউদি আরবের শ্রমবাজার: বাংলার সঙ্গে ইংরেজিকেও গুরুত্ব দিতে হবে

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 4 Feb 2015, 10:11 AM
Updated : 4 Feb 2015, 10:11 AM

ত্রিশ বছর আগে, জেদ্দা দূতাবাসে আমার দায়িত্ব পালনকালে একটি স্মৃতি এত বছর পরও টাটকা রয়ে গিয়েছে। সউদি আরবে আবার আমাদের শ্রমবাজার খুলেছে বলে এই স্মৃতিটি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

ঢাকা থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একটি প্রতিনিধিদল গিয়েছে আবদুল আজিজ, আজিজ ভাইয়ের নেতৃত্বে। আজিজ ভাই তখন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি। আজিজ ভাই আমাদের ফরেন সার্ভিসেও অনেক বছর কাটিয়েছেন। আমি যখন ১৯৭৫-এর মার্চে নতুন দিল্লি থেকে বদলি হয়ে জেনেভা গেলাম, তখন আজিজ ভাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নতুন দিল্লিতে আমার ফার্স্ট সেক্রেটারির পোস্টে গেলেন। ব্যক্তিগত জীবনে আজিজ ভাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছোট বোনের জামাই। ত্রিশ বছর আগে আজিজ ভাই-ই আমাকে জাহানারা আপার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় নিয়ে গিয়ে আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আমাকে গভীর স্নেহ দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন।

আজিজ ভাই এবং তাঁর প্রতিনিধি দলের জন্য জেদ্দা চেম্বার অব কমার্স-এর সেক্রেটারি জেনারেল আবু দাউদ লোহিত সাগরের পাড়ে একটি বড় হোটেলে লাঞ্চের আয়োজন করলেন। তখন রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে আমি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। সুতরাং আমার আসনটি পড়ল আবু দাউদ সাহেবের ডানে, আজিজ ভাই তাঁর বামে। আবু দাউদ সাহেবের বয়স তখন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে, ইংরেজি ভাষায় তাঁর স্বাচ্ছ্যন্দে মুগ্ধ হলাম, লাঞ্চের প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনাকালে।

সউদি আরবে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য তাঁর সাহায্য, পরামর্শ চাইলেন আজিজ ভাই। আবু দাউদের জবাবটি বাস্তবসম্মত এবং মনে রাখার মতোই ছিল। বললেন তিনি, ''দেখ, আমাদের সউদি আরব দেশটি 'ক্যাপিটালিজম'এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ; তুমি বাক্সভর্তি সউদি রিয়াল বা অন্য কোনো বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে তোমাকে কেউ বাধা দেবে না বা থামাবে না; তোমাকে বাধা দেবে না বা থামাবে না তুমি যদি ক্রেস্টভর্তি সউদি মুদ্রা বা অন্য কোনো মুদ্রা এই দেশে আনতেও চাও। আমাদের এই দেশটিতে তীব্র প্রতিযোগিতা তুমি দেখতে পাবে ব্যবসায়-বাণিজ্যে। ভালো জিনিস যদি বাংলাদেশ রপ্তানি করতে চায় সউদি আরবে এবং তা যদি 'কম্পিটিটিভ' দামে দিতে পার, তাহলে কারও সাহায্য, সুপারিশ তোমাদের লাগবে না। তবে তোমাদের রপ্তানির জন্য ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত একজন সউদি আমদানিকারককে যদি ঠিক করতে পার, তোমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে।''

তারপর ক্যাজুয়েলভাবে তিনি আরও বললেন, ''যদি একজন সউদি প্রিন্সকে ধরতে পার, তাহলে তোমাদের কাজটি সহজতর হবে।''

এ বিষয়ে আরও কিছু আলোচনার পর আমি আবু দাউদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ''সউদি আরবের ব্যবসায়-বাণিজ্যে, নির্মাণকাজে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে, হাসপাতাল-ক্লিনিকে আমাদের বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যায়?''

তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ''তোমাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন এই দেশে, তারা ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। কিন্তু তোমাদের শ্রমিকরা বলতে গেলে, ইংরেজি মোটেই জানে না। দোকানপাটে তোমাদের লোকজনের চাকরি, তোমাদের লোকজনের ইংরেজি না জানার কারণে তোমাদের সম্ভাবনা বেশ সীমাবদ্ধ। যদি পার, তাহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, ইংরেজি বোঝে, এমন লোকজন পাঠাও। আর আমাদের এই দেশটির লোকসংখ্যা তো মাত্র দেড় কোটির মতো এখন। আমাদের উন্নয়নমূলক কাজ আরও অনেক বছর চলতে থাকবে। সুতরাং বিদেশিদের উপর আমাদের অনেক বছর নির্ভরশীল থাকতে হবে। তোমরাও আমাদের এই উন্নয়নযজ্ঞে আরও বেশি পরিমাণে অংশ নিতে পার। আমার পরামর্শ, এখন থেকে তোমাদের আগ্রহী লোকজনকে ইংরেজি ভাষাটিতে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু কর। যদি পার একটু আরবিও শেখাবে। তবে শেখাবে, সউদি আরবের আরবি। তুমি তো নিশ্চয়ই জান, আমাদের এতগুলো আরব দেশে বিভিন্ন ধরনের আরবি ভাষার প্রচলন রয়েছে।''

পরের স্মৃতিটা এগার বছর পরের, ১৯৯৬এর। আমি তখন ঢাকায়, নিয়মিত বিবিসি টিভি দেখি। একদিন দেখি ফিলিপিনস-এর প্রেসিডেন্ট ফিডেল রামোসের একটি সাক্ষাত্কার। ১৯৪৬ সালে ফিলিপিনস শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়, কয়েক শতাব্দীর স্পেনিস এবং আমেরিকান 'কলোনিয়েল' শাসনের পর। ফিলিপিনস-এর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসি তখন কতগুলো অনুষ্ঠান প্রচার করে। তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ফিডেল রামোসের সাক্ষাত্কার ছিল পরপর কয়েক দিন।

সাক্ষাত্কারের একদিন বিবিসির সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট রামোসকে, ''ফিলিপিনস-এর অনেক লোক তো বিদেশে চাকরি করে। তারা দেশে বিশাল পরিমাণে রেমিট্যান্সও পাঠাচ্ছে।''

উত্তরে ফিডেল রামোস বললেন, ''আমাদের দেশের এইসব লোক ভালো ইংরেজি জানে। সুতরাং আমাদের ইংরেজি ভাষা জানা লোকজন অন্যান্য দেশের ইংরেজি ভাষা জানা লোকজনের সঙ্গে ভালো কম্যুনিকেট করতে পারে। তারপর আমাদের লোকজন স্বাস্থ্যবান; সুতরাং আমাদের লোকজনের চাহিদা ভালোই আছে বিদেশে।''

-দুই-

উপরে বর্ণিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, তাতে কি কোনো বাহুল্য বা অতিরঞ্জন আছে?

ইংরেজি ভাষাটি অনেক দশক ধরে সারা দুনিয়াতেই 'লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা' হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এখন ইংরেজিই সবচাইতে বেশি প্রিয়। আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইংরেজি ভাষা। ভারতের মতো বিশাল দেশটিতে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের যোগাযোগের ভাষাও ইংরেজি। যে দেশে এতগুলো আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, সেই দেশেও তো বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এই ভাষার উপর নির্ভর করতে হয়।

আমাদের বাংলা ভাষার গুরুত্ব দিতে গিয়ে কেউ কেউ জাপানের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। জাপানে অবশ্যই জাপানি ভাষা তাদের মাতৃভাষা; লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায়ও জাপানি ভাষা খুব সমৃদ্ধ। কিন্তু যে কথাটি আমাদের কোনো কোনো পণ্ডিত উল্লেখ করেন না তা হল, জাপানিদের দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষাও রয়েছে। আমার ধারণা, ইংরেজি তাদের দ্বিতীয় ভাষা। আমার চাকরিজীবনে জাপান সফরকালে এবং বিভিন্ন দূতাবাসে জাপানিদের ইংরেজি শেখার যে 'সিরিয়াস' চেষ্টা লক্ষ্য করেছি, তা অনেক সময় আমোদজনকও ছিল। পরে আমরা, অন্য দেশের কূটনীতিবিদরা তাদের নিয়ে কখনও কখনও কৌতুকও করেছি। জাপানিরা 'L'কে 'R' এবং 'R'কে 'L' উচ্চারণ করে। একটি উদাহরণ, 'কারেকশন'কে 'কালেকশন' এবং 'কালেকশন'কে 'কারেকশন'; 'ফ্রাইড চিকেন'কে 'ফ্লাইড চিকেন'। তাই তাদের উচ্চারণও আমোদজনক হয়। তাই বলে ইংরেজি শেখায় তাদের উৎসাহ এতটুকু কম নয়।

তারপর, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ভাষার প্রায় সব বই তারা জাপানি ভাষায় অনুবাদও করতে পেরেছে। আমরা কি তা পেরেছি? এই ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আসতে আরও কত বছর লাগবে?

আমাদের বুঝতে হবে, ইংরেজি ভাষা এখন আর শুধু একটি ভাষা নয়, এটি একটি 'স্কিল'। অপারেশন করতে সার্জনকে যেমন দক্ষ হতে হয়, মাছের খামারিদের মাছের খাবার মিশ্রণে যেমন অভিজ্ঞ হতে হয়, কৃষিকাজেও যেমন বিশেষ কিছু জ্ঞান-গুণ কৃষকের থাকতে হয়, শ্রমিকদেরও যেমন বিশেষ কিছু 'স্কিল' থাকতে হয়, বিদেশে চাকরি করতে হলেও ইংরেজি ভাষাটা জানা গুরুত্বপূর্ণ; ইংরেজি ভাষাটাও বিদেশে একটি 'স্কিল' হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজি এই ভাষাটা জানা থাকলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি, সম্ভাবনা বেশি ভালো বেতনের ভালো চাকরি পাওয়ারও।

আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় পনের-ষোল লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে ঢুকছে। কিন্তু দেশে এত চাকরির ব্যবস্থা করা এত ছোট সাইজের একটি দেশ এবং এত ছোট একটি অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর যে দেশে এমন মারামারি, কাটাকাটি, খুন-জখম, 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো' চলছে, তাতে তো আমাদের বিদেশের উপর নির্ভর করতে হবেই। বৈধ, অবৈধ পথে এদেশের মানুষ পালাতে চাইছে। আজও কাগজে খবর আছে, ট্রলারে করে মালয়েশিয়াতে পালাতে গিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে অন্তত ৭ জন মারা গিয়েছে।

এখন প্রতি বছর সাত-আট লাখ লোকের চাকরি হচ্ছে বৈধপথে, বিদেশে। আরও কয়েক বছর হয়তো এমন চলবে। কিন্তু ওইসব দেশের লোকজনও তো বাড়ছে, তাদেরও তো চাকরির দরকার। ইতোমধ্যে কতগুলো দেশে বেকার তরুণ-তরুণীরা এক ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

কেউ কেউ বলেন, কতগুলো পশ্চিমা দেশে প্রবীণ লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে; মানে, এই সব দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমছে। আবার অন্যদিকে, এই প্রবীণ লোকদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা-খরচও বাড়ছে। এই কারণে এইসব দেশের অর্থনীতির উপর চাপও বাড়ছে। সুতরাং আমাদের দেশের প্রশিক্ষিত লোকজন ওইসব দেশে চাকরি নিয়ে গিয়ে ওদের অর্থনীতি সচল রাখবে। এ সব দেশে আমাদের জন্য বিশাল শ্রমবাজার খুলে যাবে।

এমন যুক্তি যারা দিয়ে থাকেন, তাদের অজ্ঞতার ব্যাপকতা এবং গভীরতা আমাকে দারুণভাবে বিচলিত করে। এই প্রসঙ্গে ছোট একটি প্রশ্ন, এত বিশাল সংখ্যার লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কত হাজার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কত লাখ প্রশিক্ষক, কত লাখ যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম দরকার, তার কোনো জ্ঞানই নেই বলে মনে হয় এইসব যুক্তিবাদীর।

এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করতে চাই, এখন যে আশি-নব্বই লাখ লোক বিদেশে আছে, তাদের মধ্যে মাত্র তের লাখ চার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশিকে 'এমআরপি' (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) দেওয়া সম্ভব হয়েছে গত সাড়ে চার বছরে। ২৪ নভেম্বর, ২০১৫ এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আরও কয়েক লাখকে 'এমআরপি' দেওয়া সম্ভব হবে; বাকিরা সব অবৈধ হয়ে যাওয়ার আশংকায় দিন কাটাচ্ছে। ষোল বছর আগে 'ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগ্যানাইজেশন' সকল দেশের সম্মতি নিয়েই এই তারিখ ঠিক করে দিয়েছিল। এই তারিখের পর কোনো দেশের বিমান হাতে লেখা পাসপোর্ট আর গ্রহণ করবে না। এই-ই যদি আমাদের দক্ষতার একটি উদাহরণ হয়ে থাকে, আমরা প্রতি বছর সাত-আট লোককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে ওইসব দেশের প্রবীণ, অক্ষম মানুষজনের শূন্যস্থান পূরণ করাব, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?

-তিন-

দুনিয়ার পঞ্চাশটি সার্বভেৌম দেশের সরকারি ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। ইংরেজিকে প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে ৩৫০ মিলিয়ন লোক; ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, এমন সব দেশের ইংরেজি ভাষাভাষীর সংখ্যা ৪৭০ মিলিয়ন। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যচর্চায় ইংরেজিই তো দুনিয়ার প্রথম ভাষা। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফেসবুক, টুইটার, মোবাইল ফোনের ভাষাও তো ইংরেজি।

পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকারও শেষ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। বামফ্রন্ট সরকার দেরিতে বুঝতে পারে, ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করার কারণে পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্যসব রাজ্য থেকে পিছিয়ে পড়ছে। দুনিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো– হার্ভার্ড, এমআইটি, প্রিন্সটন, কলম্বিয়া, স্ট্যানফোর্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ– এসব শীর্ষস্থানীয় এবং পশ্চিমের যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে হলে তো ইংরেজিতেই পড়তে হবে।

ইংরেজি জানা থাকলে চাকরিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং সমাজে জীবনে সাফল্য এবং উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা। আমার ধারণা, ব্যাপক বেকার সমস্যার সংকটের এই দেশেও ইংরেজি এবং আইটি জানা তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন প্রফেশনে, নতুন নতুন টেকনোলজি এবং ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জন সহজতর। আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী ঠিকই বুঝতে পারছে, নতুন এবং পুরাতন টেকনোলজি, বেশিরভাগই উদ্ভাবিত, আবিস্কৃত হয়েছে পশ্চিমের দেশগুলোতে। ওইসব নতুন নতুন ধারণা এবং টেকনোলজি বাংলাদেশে আনতে হলে, ইংরেজি ভাষাতেই আনতে হবে। বাংলাদেশে ইউরোপ আমেরিকার 'আউটসোর্সিং'এর কাজ করতে হলেও ইংরেজি ভাষা জানতে হবে।

-চার-

ফেনী জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে আমার জন্ম। আব্বা নব্বই বছরের পুরনো একটি মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমাস্টার ছিলেন; সব ভাইবোনের জন্য লেখাপড়া তাই বাধ্যতামূলক ছিল। আব্বা ইংরেজি গ্রামার পড়াতে বিশেষ আনন্দ পেতেন।

তারপরও বলি, আমাদের বাংলা ভাষা শিখতেও 'স্ট্রাগল' করতে হয়েছে। কারণ, নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা ছিল। বাংলা ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার দূরত্ব এবং ফারাকটা চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মানুষও ভালো জানবে। আমি মনে করি, জীবনে আমি যে এতটুকু উঠতে পেরেছি, ইংরেজি ভাষা আমার ক্ষেত্রেও প্রবল এক ভূমিকা রেখেছে। আমি তিনটি ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, নোয়াখাইল্যা, বাংলা এবং ইংরেজি। বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক ঐতিহাসিক খুশওয়ান্ত সিং বলতেন, উর্দু তাঁর মাতৃভাষা, কারণ লাহোরে তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর প্রায় কাজ হয়েছে ইংরেজি ভাষায়, ইংরেজি ভাষাতেই তাঁর দখল বেশি ছিল।

সবশেষে তিনটি কথা। সাধারণ চাকরি-বাকরির জন্য ব্যাকরণ-অনুসৃত ইংরেজির দরকার নেই। দুনিয়ার এক নম্বর ইংরেজি দৈনিক 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' এবং এক নম্বর ইংরেজি সাপ্তাহিক 'ইকোনোমিস্ট' পত্রিকায় 'ভার্ব' (Verb) ক্রিয়াপদ ছাড়াই বাক্য দেখি; বাক্য পড়ি। শুদ্ধ 'গ্রামাটিক্যাল' ইংরেজি না বললে তাৎক্ষণিকভাবে উপহাস করার জন্য আশেপাশে লোকজন, বন্ধুবান্ধব থাকে। কিন্তু ভুল বাংলা বললে তা কদাচিত কানে বাজে।

অন্য কথাটি, বাংলা ভাষার চর্চা এবং আমাদের এই ভাষাটির উন্নয়নে আমাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করলে আমরা পিছিয়ে পড়ব, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে। দেশের বিত্তশালী লোকজনের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষা ঠিকই শিখছে, কিন্তু পিছিয়ে থাকছে দেশের দরিদ্র শ্রেণিটি; গরিব কৃষক শ্রমিক এবং গ্রামের মানুষজন।

সবশেষের কথাটি, মাতৃভাষা বাংলাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে; তবে এই কথাটিও বুঝতে হবে যে, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে গরিব-দরিদ্র শ্রেণির মানুষজনের দারিদ্র বিমোচনও সহজতর হবে।

শিউলীতলা, উত্তরা; ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।