‘তারেকে বন্দি’ বিএনপি

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 3 Feb 2015, 08:48 AM
Updated : 3 Feb 2015, 08:48 AM

বিএনপির রাজনীতিতে যখন তারেক রহমান নাম লিখিয়েছিলেন সেই ২০০১এর নির্বাচনের সময়, তখন দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি অংশ খুব আশান্বিত হয়েছিল। বিশেষ করে তাদের কেউ কেউ রাজনীতিতে তরুণ নেতার আগমন স্বাগত জানিয়েছিল এই ভেবে যে, অন্তত দুর্নীতির অভিযোগমুক্ত একজন তরুণ ক্ষমতাসীন দলের হাল ধরতে যাচ্ছেন। আর যারা দুই নেত্রীর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত তারাও তারেক রহমানকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। অনেকেই প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছিলেন। 'প্রথম আলো' আর 'ডেইলি স্টার' পত্রিকা তারেকের সঙ্গে একজন করে রিপোর্টারও ট্যাগ করে দিয়েছিল তার কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য। তাদের মোহ ভাঙতে বেশিদিন সময় লাগেনি।

২০০১এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পরপরই তারেক রহমানের নেতৃত্বে 'হাওয়া ভবন' হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দুর্নীতির আখড়া হিসেবেও দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে ভবনটি। ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর প্রকাশিত 'ডেইলি স্টার'এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার ছক আঁকা হয় এই ভবনে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, হরকাতুল জেহাদ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েক জন সেখানে একসঙ্গে বসে ঠিক করেছিল, 'দেশ ও ইসলামের' শত্রু শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। সে অনুযায়ী খুনিদের গ্রেনেড সরবরাহ এবং তাদের জন্য পাসপোর্ট তৈরি করিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল হাওয়া ভবনে বসেই।

এই তারেক রহমানকেই দুর্নীতির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দিতে ঢাকা দূতাবাস ওয়াশিংটনে গোপন বার্তা পাঠিয়েছিল। আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা ওই বার্তা ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। এতে বলা হয়, 'রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত' ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতির জন্য তারেক দায়ী বলে দূতাবাস মনে করে। আরও বলা হয়: ''তারেক রহমান সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয় এবং রাজনৈতিক পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে যত্রতত্র ঘুষ চাওয়ার জন্য কুখ্যাত। দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত তিনি।"

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাকে বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির দৃষ্টান্ত বলে মনে করছে সেই তারেক রহমান এখন বিএনপির রাজনৈতিক কলাকৌশল পুরোটাই ঠিক করে দিচ্ছেন। লন্ডনে বসে তিনি যেরূপ আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছেন, বিএনপি সেটাই বাস্তবায়ন করে চলেছে। তিনিই যে এখন বিএনপির একক চালিকা শক্তি তা বুঝতে আর বাকি নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, শেখ হাসিনা বিদায় না হওয়ার আগে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হচ্ছে তারাও সহজে ছাড় দিচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিলই করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ হরতাল, অবরোধ আর আগুনে পুড়ে মরার হাত থেকে শিগগিরই জাতির মুক্তি মিলছে না।

গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক যে নির্বাচন আয়োজনে সংলাপে বসতে সরকারকে বাধ্য করতে এখন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ওই রকম একটি সংলাপ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে হয়েছিল। জাতিসংঘের দূতিয়ালিতে সংস্থাটির মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানোকের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল আর বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বে ১৮ দলের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, সেই আলোচনা এক পর্যায়ে ইতিবাচক পরিণতির দিকে এগিয়েছিল। কিন্তু তারেক রহমানের আপত্তির কারণে তা শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। এরপর আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে।

তখন থেকেই তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃতির প্রকল্প হাতে নিলেন। আওয়ামী লীগকে গালমন্দ করতে করতে করতে একসময় তিনি প্রয়াত বঙ্গবন্ধুরও সমালোচনা শুরু করেন। আসলে তিনি ভালোভাবেই জানেন যে, ঠিক কোথায় আঘাত করতে হবে। তাই একের পর এক বয়ান দিয়ে গেলেন তিনি– বঙ্গবন্ধু নাকি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি; তিনি ছিলেন 'পাকবন্ধু'; ছিলেন 'রাজাকার'। বিএনপি তার এইসব বক্তব্য কার্যত অনুমোদন করেছে। দলের নেতারা ইনিয়ে বিনিয়ে তারেকের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। দলের একজন নেতাও পাওয়া যায়নি যিনি তারেকের এই মিথ্যা তত্ত্বের প্রতিবাদ করেছেন; অথবা, বলা যায়, মেরুদণ্ড আছে এমন কোনো নেতা বিএনপিতে নেই।

শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াও তারেককে সমর্থন দিয়েছেন। বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূত্রপাতও মূলত জিয়াপুত্রের বক্তব্য কেন্দ্র করেই। সরকার খালেদা জিয়াকে সমাবেশ না করতে দেওয়ার যে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিরও উছিলা পেয়েছে তারেক রহমানের মন্তব্যের কারণে। সরকার যেদিন খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা শুরু করে সেদিন তিনি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন, ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। তার ভাষায়, ''প্রয়োজনে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। অবৈধ আওয়ামী লীগের সরকারকে একেবারে এক ঘরে করে ফেলতে হবে। যে কোনো মূল্যে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করে তুলতে হবে। আওয়ামী লীগের সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করতে হবে। শেখ হাসিনার বিদায় না হওয়ার আগে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। রাজপথ ছাড়া যাবে না।''

বিএনপির কর্মসূচি দেখে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তারেকের ঘোষণা অনুযায়ীই বিএনপি এগুচ্ছে।

খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্বাভাবিক মৃত্যুতে একটি সুযোগ এসেছিল চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠে আলোচনা শুরু করার। যদিও আমি মনে করি না বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংকট চটজলদি কেটে যাবে। তারপরও সাধারণের মনে আশা জেগেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন খালেদা জিয়ার কাছে ছুটে গেলেন, তখন। খালেদা জিয়া দরজা খুলে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত করতেই পারতেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারাও ওই রকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারা খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন।

শেষ পর্যন্ত সেটি হল না ওই তারেকেরই নির্দেশে। ওইদিন বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন এমন নেতারা প্রকাশ্যে বলতে সাহস না দেখালেও আমাদেরকে জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই এগুচ্ছিল। শেখ হাসিনাকে গেটে কে রিসিভ করবেন, তাঁকে কোথায় বসতে দেওয়া হবে, কী কী বিষয়ে কথা বলা হবে, এইসব খুঁটিনাটি আলোচনা যখন চূড়ান্তে তখনই শিমুল বিশ্বাসের ফোন বেজে উঠে। ফোনে তাকে অপর প্রান্ত থেকে কে কী বলল তা বোঝা না গেল না, কিন্তু তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানো যাবে না। এটা বলেই তিনি দৌড়ে গিয়ে গেট বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। উপস্থিত নেতারা হতবাক হয়ে গেলেও কেউ প্রতিবাদ করলেন না। কারণ ততক্ষণে তারা জেনে গেছেন, 'লন্ডন থেকে ওহি নাযিল হয়েছে'।

'ওহি নাযিল' হওয়ায় বিএনপি এবার কোনো কিছুই মানছে না। যে বিএনপি ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের সমর্থন পেয়ে আসছে, তারা ইজতেমায় ছাড় দেয়নি। সারাদেশে যখন একযোগ এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে– বিএনপি নেতারা বলছেন, কীসের পরীক্ষা? অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাব তো রয়েছেই। কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না, গোল্লায় যাক দেশ। এ সব কিছুই হচ্ছে লন্ডন থেকে প্রাপ্ত নির্দেশে। আর সরকারও মনে হয় পোড়া মানুষের মৃতদেহ দেখিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তুলতে চাইছে। তারা সবাই অনড়। শুধু পুড়ছে সাধারণ মানুষ।

এই পোড়া কপালের বাঙালিদের গণতন্ত্রের জন্য যতবারই আন্দোলন করতে হয়েছে ততবারই সাধারণ মানুষকে মরতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে সরকারের কোনো না কোনো বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময়, নয়তো সরকার ও বিরোধী দলের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে। তথাকথিত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই বা ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনৈতিক লড়াইয়েও সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে এবং নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা।

এবার আরেকটি নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনেও বিএনপি-জামাত ওই কৌশল নিয়েছে। অপহরণকারীরা যেমন কাউকে তুলে নিয়ে গিয়ে বলে যে, মুক্তিপণ না দিলে তাকে হত্যা করা হবে– তেমনি বিএনপি-জামাতের আন্দোলনের মুক্তিপণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সরকার যত দিন দাবি না মানবে তত দিন পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হবে।

১১ জানুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের 'মতামত-বিশ্লেষণ' কলামে আমার লেখার শেষ কথা ছিল: "যত দিন আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মনোজগতে বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন না আসবে তত দিন অন্তত এই মানুষ-মারার রাজনীতি বন্ধ হবে না।… তত দিন ধরে পেট্রোলের আগুনে আমরা পুড়তেই থাকব।"

এই নেতিবাচক বক্তব্য বা মন্তব্যে হতাশ হয়ে কেউ কেউ আমাকে ইমেইল করেছেন। বলেছেন, আমরা কেন আশার আলোর কথা বলতে পারি না। পারি না এই কারণে, যেদিন আমি ওই কলাম লিখেছি সেদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিসংসতায় নিহতের সংখ্যা ছিল ১০। আর ৩১ জানুয়ারিতে এসে দেখা যাচ্ছে, হরতাল অবরোধে হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জনকে। এর মধ্যে পেট্রোল বোমায় বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ২২ জনকে। এখন এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আমরা সহিংস রাজনীতির আগুনে আরও পুড়ব। রাজনৈতিক দাবি আদায়ের মুক্তিপণ হিসেবে সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে; রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেকটা হয়ে গেছেও বলা যায়।

আবারও বলি, এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোজগতের পরিবর্তন দরকার। সেই পরিবর্তন কবে আসবে তা বলা যাচ্ছে না। বাঙালি জাতির ভাগ্যে অমন একজন মহান নেতা কবে আসবেন আর আঙুল উঁচিয়ে বলবেন, 'বন্ধ কর এই মানুষ মারার রাজনীতি'– তারপর শুরু হবে অহিংস রাজনীতি– সেই দিনের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

তেমন কোনো নেতার পদধ্বনিও তো মিলছে না।

২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫