পেট্রোল বোমার রাজনীতির ‘বৈধতা’ বনাম নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 1 Feb 2015, 02:09 PM
Updated : 1 Feb 2015, 02:09 PM

পুলিশ সপ্তাহ ২০১৫ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'যারা মানুষকে পোড়াবে বা আঘাত করবে, তাদের বিরুদ্ধে যত কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা আপনারা নেবেন। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। যা কিছু হোক, সেই দায়িত্ব আমি নেব। কিন্তু মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতেই হবে।''

অন্যদিকে, বিএনপি জামায়াত জোটও হরতাল অবরোধের পর থেকে সরে আসবে না বলেই শোনা যাচ্ছে। ৬ জানুয়ারি থেকে যে অবরোধ চলছে সেটা চলতেই থাকবে। গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে যে, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনাও নাকি জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রয়েছে। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবার কথা ছিল; সেটি পিছিয়ে দিতে হল। পরীক্ষার বিষয়টি বেগম জিয়া মোটেও আমলে নিচ্ছেন না। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অবরোধ চললেও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রয়েছেন চরম উৎকণ্ঠায়। অবরোধের মধ্যে পরীক্ষা দিতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীও যদি কোনো ধরনের হামলার মুখে পড়ে, তাহলে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা তৈরি হবে।

ছোট ছেলে কোকোর অকালমৃত্যুতে শোকবিহ্বল বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া টানা অবরোধের কর্মসূচি প্রত্যাহার করবেন বলে যে আশাবাদ অনেকের মনে তৈরি হয়েছিল তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃতদেহ মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় এনে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। তার নামাজে জানাজায় বিপুল জনসমাগম হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না; ছিলেন না আর কোনো দিক দিয়েই জাতীয় পর্যায়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারপরও তার জানাজায় মানুষের ঢল নামল কেন, কারা যোগ দিলেন তার জানাজায়, এসব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা হয়তো চলবে আরও কিছুদিন।

২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা, অর্থপাচার মামলায় দণ্ডিত পুত্র কোকোর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে শোক মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া। ঘুমের ইনজেকশন নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার আগে তিনি তাঁর সহযোগীদের কাছে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। পুত্রশোক তাঁকে কাতর করলেও রাজনৈতিকভাবে যে দুর্বল করেনি এটা বেশ বোঝা যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন সেসব কথা এখন দেশবাসীর জানা। বেগম জিয়া ঘুমিয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর গুলশান কার্যালয়ে উপস্থিত দলের সিনিয়র নেতা এবং পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যরা জেগে থেকেও প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর সৌজন্যটুকু পর্যন্ত দেখাননি। কার্যালয়ের গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মন্ত্রিসভায় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ''শনিবার সন্ধ্যায় মা হিসেবে পুত্রশোকে কাতর আরেক মায়ের শোকের অংশীদার হতে গিয়েছিলাম। রাজনীতি করতে যাইনি। তবে তাদের কাছে যে আচরণ পেলাম তা প্রত্যাশিত ছিল না। সামান্যতম সৌজন্য বিএনপি দেখায়নি। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসতে হল, ঢুকতে দিল না। প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে রাখল। বেইজ্জতির ব্যাপার। এতে আমি অপমানিত হয়েছি। সেখানে বিএনপির সিনিয়র নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। তারা ইচ্ছে করলে কথা বলতে পারতেন।''

সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যান, তখন আরও কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে কার্যালয়ের ভেতরেই ছিলেন তিনি) একদিন পর সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সৌজন্য না দেখানো ঠিক হয়নি। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, কার্যালয়ের গেটে তালা দেওয়ার ব্যাপারটা বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানতেন না। তাহলে কার নির্দেশে গেটে তালা লাগানো হল সেটা জানার চেষ্টা কি দলের সিনিয়র নেতারা পরে করেছেন?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য মনে করেন, শুধু গেটে তালা দেওয়ার ব্যাপার কেন, দলের অনেক কিছুই সিনিয়র নেতারা জানেন না অথবা তাদের জানানো হয় না। দলের নামে যে কর্মসূচি ঘোষণা হয়, তাও স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয় না। আলোচনা যদি কোনো বিষয়ে হয়ও, তাহলেও ভিন্নমতের প্রতি সম্মান দেখানো হয় না। বেগম জিয়া যা বলেন সেটাই শেষ ও চূড়ান্ত কথা।

দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চা না থাকলেও দেশে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির আকুলি বিকুলির শেষ নেই। আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের 'বিজয়' না হওয়া পর্যন্ত নাকি বেগম জিয়ার অবরোধ, হরতাল অব্যাহত থাকবেই। তিনি নিজে পুত্রশোকে বিহ্বল হবেন– তাঁর ডাকা আন্দোলনের কর্মসূচিতে যেসব মায়ের বুক খালি হচ্ছে, তাদের বিহ্বলতা, কাতরতার কথা তিনি ভাববেন না?

ছেলের জানাজায় মানুষের ঢল নামতে দেখে বেগম জিয়া তবু সান্ত্বনা পাবেন এই ভেবে যে, জীবনে যে ছেলে ছিল সবার কাছে তুচ্ছ, আইনের চোখে অপরাধী– মরণে সে ছেলেই হয়ে গেল মহার্ঘ; মানুষের ভালোবাসায় ধন্য। অবরোধে যারা মারা গেল, বার্ন ইউনিটের বেডে শুয়ে দুঃসহ যন্ত্রণায় যারা আর্তচিৎকার করছে, তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি কতটুকু, সেটা পরিমাপের সুযোগ নেই। কারণ, পেট্রোল বোমায় পুড়ে মৃত্যুবরণ করা কোনো হতভাগ্যের জন্য কোনো টিভি চ্যানেল 'লাইভ' সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেনি; তাদের কারও জানাজায় উপচে পড়েনি মানুষের ঢেউ।

হায় রে, আমাদের মানবিক মূল্যবোধ!

আন্দোলনে লোক নামাতে না পারলেও কোকোর জানাজায় অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি নিশ্চয়ই বিএনপি-জামাত জোটের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্দোলনের বেহাল অবস্থা দেখে হতোদ্যম বিএনপির নেতাকর্মীরা কোকোর জানাজার পর মনে জোর ফিরে পেয়েছেন, সংবাদপত্রে এমন খবরই ছাপা হয়েছে। সভা-সমাবেশ করার অনুমতি না দিয়ে সরকার ২০ দলীয় জোটকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে। কিন্তু কোকোর মৃত্যু তাদের সুযোগ করে দিয়েছে বিনা অনুমতিতে বিরাট জমায়েতে সমবেত হওয়ার। কোকোর মৃত্যু ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়ার জন্য বিরাট ক্ষতি ও শোকের কারণ হলেও তাঁর দল ও জোটের জন্য তা স্বস্তি এনে দিয়েছে বলে মন্দ লোকেরা বলছেন।

শেখ হাসিনার জন্য দুয়ার বন্ধ রাখায় বিভিন্ন মহল থেকেই নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বইছিল। বলা হচ্ছিল, বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ও শিষ্টাচার পরিপন্থী আচরণ করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অনেক এগিয়ে গেছেন। কোকোর মৃত্যু নিয়ে 'নোংরা' রাজনীতি না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। কোকো নিজে রাজনীতি করতেন না। বিএনপির সাধারণ সদস্যও ছিলেন না। কিন্তু মৃত্যুর পর তিনি রাজনীতিমুক্ত থাকতে পারলেন না। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট তার মৃতদেহ ভর করেই সরকারকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টায় কিছুটা সফল হয়েছে বৈকি।

ধন্যবাদ দিতেই হয় আমাদের গণমাধ্যমকে, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে! কারণ, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উৎসাহী প্রচারণাই কোকোর বিদায় এমন রাজকীয় করে তুলেছে।

রাজনৈতিক পরিবারের এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সন্তান বিদেশে মৃত্যুবরণ করলেই গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে ওঠে তা কিন্তু নয়। কোকোর মৃত্যুর আগেই লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড. মোহাম্মদ সেলিম। তিনি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, জেলখানায় হত্যাকাণ্ডের শিকার চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে। শুধু তাই নয়, তিনি একজন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ নাসিম এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।

ড. সেলিমের মৃত্যুর খবর, প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রকাশ, তার মরদেহ দেশে আসা কিংবা তাঁর জানাজা, কোনোটা 'লাইভ' দেখানো হয়েছে কি কোনো টিভি চ্যানেলে? সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে, বিরোধী দলকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না বলে কত প্রচারণা! অথচ ড. সেলিমের মৃত্যু এবং পরবর্তী সংবাদ প্রচার হল কত দায়সারাভাবে। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর মৃত্যুপরবর্তী খবর আর সব কিছুকেই কত সহজেই ছাপিয়ে গেল।

৫ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য টানা অবরোধ ডেকে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা বেকায়দায় আছে বিএনপি-জামাত জোট। বিএনপি এবং জামাত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী ককটেল, পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষ হত্যার উৎসব শুরু করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ এই হত্যা, সন্ত্রাসের রাজনীতি পছন্দ করছে না। তারা এই রাজনীতির অবসান চাইছে। মানুষকে পুড়িয়ে মারা বন্ধ করতে বলছে।

আমাদের দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে যারা নিজেদের দাবি করেন এবং যারা নিজেদের নিরপেক্ষ সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন, তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে সংলাপের কথা বলছেন, দুই নেত্রীকে (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে) আলোচনায় বসার কথা বলছেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ করার কথা দৃঢ়ভাবে বলছেন না। তারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেন, যে হত্যার রাজনীতি চলছে তার দায় একা খালেদার নয়। পেট্রোল বোমা, ককটেল যারা মারছে তারা আসলে কারা তা নাকি পরিষ্কার নয়। চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর কারণে বোমাবাজদের সবাইকে ধরা বা শনাক্ত করা এখনও সম্ভব না হলেও এ পর্যন্ত যে কয়জন ধরা পড়েছে তারা হয় বিএনপি, না হয় জামাত-শিবিরের কর্মী। বোমা বানাতে গিয়ে হাত উড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ঢাকায় ছাত্রদলের থানা পর্যায়ের এক নেতা। তারপরও বোমাবাজি, সন্ত্রাস কারা করছে তা নিয়ে অতিবিচক্ষণ ভদ্রজনদের কত সন্দেহ!

এরা সংলাপের জন্য এত বিচলিত কেন? কেউ কেউ মনে করেন, চলমান আন্দোলনে খালেদা জিয়া এবং তার জোটের জয়লাভের সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরেই সংলাপ-আলোচনায় উৎসাহ দেখানো হচ্ছে মহল বিশেষ থেকে। বিএনপি যদি দুর্বল হয়, আওয়ামী লীগের অবস্থান যদি মজবুত হয়, তাহলে আমাদের দেশে অনেকেই স্বস্তিবোধ করেন না। সে জন্যই তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমান করার জন্য উতলা থাকেন। বলা হচ্ছে, এত মানুষ যে মারা যাচ্ছে, তার জন্য খালেদা জিয়ার চেয়ে শেখ হাসিনা বেশি দায়ী। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার 'জেদ' ধরেছেন বলেই না খালেদা জিয়া আন্দোলন করছেন! শেখ হাসিনা নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ল্যাঠা চুকে যায়; খালেদা জিয়া আন্দোলন তুলে নেন!

শেখ হাসিনা কেন নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন? দেবেন; কারণ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছে একতরফা। তখন বলা হয়েছিল এটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন। এই নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, পাঁচ বছর পর নির্বাচন হবে। এটা সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা। তারাই কেবল ক্ষমতা ভোগ করবে? বিএনপি-জামাত উপোসে থাকবে? এটা তো গণতন্ত্র হতে পারে না।

যারা এসব বলেন, তারা ভুলে যান যে রাজনীতিতে মামাবাড়ির আবদার চলে না। যারা এসব বলেন, তারা একবারও বলেন না, ৫ জানুয়ারির 'নিয়মরক্ষার' নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে দেওয়া হয়নি। সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য চরম বর্বরতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। শত শত মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ যাতে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে তার জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল।

এত কিছুর পরও ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি বিএনপি-জামাত। তারা পরাজিত হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট জিতেছে। বিজয়ী পক্ষ কি কখনও পরাজিত পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে? এই পরাজিত শক্তির জন্য যাদের দরদ উথলে উঠছে, তারা বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি তো এক বছর অপেক্ষা করল, কিন্তু সরকার নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা তো করছে না। বিএনপি আর কত অপেক্ষা করবে?

এসব কথা যারা বলেন, তারা রাজনীতির ইতিহাস-ভূগোল কিছুই জানেন না। এক বছরেই বিএনপি কেন অধৈর্য হয়ে পড়ছে? কেন অপেক্ষার পরিবর্তে মানুষ মারার আন্দোলন করছে? যারা কথায় কথায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সব কিছুর জন্য সমান দোষী বলে থাকেন, তারা যেন ভুলে যান যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। তারপরও আওয়ামী লীগ একুশ বছর অপেক্ষা করেছে। ধৈর্যহারা হয়নি। মানুষের ওপর আস্থা হারায়নি। সন্ত্রাসের পথে যায়নি। হত্যার রাজনীতি করেনি।

বর্তমান সরকারকে 'অবৈধ' বলে যারা আনন্দ লাভ করেন, তাদের তো জানার কথা যে, যে কোনো সত্যিকার 'অবৈধ' সরকারকেও এক বছরের মাথায় ক্ষমতা থেকে সরানোর রেকর্ড দুনিয়ার কোথাও নেই। আর সব উদাহরণ না হয় বাদই থাকল, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা কী বলে? আইয়ুব খানকে হঠাতে দশ বছর লেগেছিল। ইয়াহিয়া খানকে বিদায় করতে দরকার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের। স্বাধীনতার পর জিয়া-এরশাদ কেউই দু'চার বছরে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। যারা ইতিহাসের দোহাই দেন, তারা সম্ভবত ইতিহাসের অমনোযোগী পাঠক। বিএনপির সন্ত্রাস-নাশকতার রাজনীতির পক্ষে যারা ওকালতি করছেন তারা বুঝতে পারছেন না যে, দেশের ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তারা।

আমরা দেখে আসছি যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ কারও ভালো কাজ অনুসরণ না করলেও খারাপটা ঠিক অনুসরণ করে। পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলনের নামে পেট্রল বোমা হামলার বৈধতা দেওয়া হলে, বিএনপি কখনও ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ যদি পেট্রোল বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে, পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।