যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ২৭ ‘‘মানুষকে জিম্মি করা কি গণতন্ত্র’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 31 Jan 2015, 05:59 PM
Updated : 31 Jan 2015, 05:59 PM

''মূল বাড়ি আমাদের পাবনায়, বেড়া উপজেলায়। একবার যমুনার করাল গ্রাসে আমাদের বাড়িঘর সব বিলীন হয়ে যায়। আমরা হই নিঃস্ব। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুক নাই। পরিবার নিয়ে তখন চলে আসি যশোরে। আশ্রয় মিলে দূরসম্পর্কের এক মামার বাড়িতে। দুই ভাই, এক বোন আমরা। আমি সবার ছোট। বাবার প্রেসের ব্যবসা ছিল কোলকাতায়। কিন্তু সে আয় দিয়ে চলত না। স্বচ্ছলতাও ছিল না। ফলে অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয় বড় ভাই আবদুল গাফ্ফার লালকে।

বাল্যবন্ধু শরিফুল ইসলাম চৌধুরী, খালেদ মাহমুদ, সানোয়ার, রব, আবুল খায়ের, বাবলু, মনির প্রমুখের কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের গ্রামে প্রতি বছর হাডুডু খেলার আয়োজন হত। দূর গ্রাম থেকে আসত নামকরা সব টিম। আমাদের টিমে এক বড় ভাই খুব ভালো খেলতেন। কী এক কারণে তিনি খেলবেন না। সবাই মিলে তখন আমাকেই মাঠে নামালেন। ওইবার আমরাই চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম! ঘাড়ে চড়িয়ে সবাই আমায় গোটা গ্রাম ঘুরিয়েছিল।

একটা সুশৃঙ্খল সামাজিক অবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের বড় হতে হয়েছে। বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করত শিশু লতিফ। অতঃপর যেতে হত স্কুলে। পাশের বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলত। সামর্থ্য না থাকায় ওরা পড়ত হ্যারিকেনের আলোতেই। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই খুব মন খারাপ হত। শিশু লতিফ দূর থেকে তাকিয়ে থাকত ওই ঝলমলে বাতির দিকে।

বাবা-মায়ের পরেই ছিল শিক্ষকের স্থান। একদিন স্কুলে না গেলেই পরের দিন শিক্ষক বাড়িতে এসে হাজির হতেন। পরীক্ষার আগে বাসায় বাসায় গিয়ে দেখতেন প্রস্তুতি। তাদের পা ধরে সালাম করতে হত। 'ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটাই ছিল অন্যরকম। এখন তো সেইটা নাই। সবাই এখন কমার্শিয়াল হয়ে গেছে'– আফসোস লতিফের।

ট্রেনিং ও আপরেশনের কথা শোনাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ:

শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ। বাড়ি তাঁর যশোরের সদর উপজেলার চাঁচড়া রেলগেট নামক স্থানে। বাবা মোহাম্মদ মোকসেদ আলী ও মা রাহেলা বেগম। আবদুল লতিফের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি চাঁচড়া প্রাইমারি স্কুলে। এসএসসি করেন মুসলিম একাডেমি থেকে। পরে সরকারি মাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।

স্বাধীনতার আগে বাঙালি জাতি নানা বৈষম্যের শিকার হয়। সে প্রসঙ্গ আবদুল লতিফ আমাদের জানালেন:

''আমাদের মুরব্বিরা হতেন বড়জোর কালেক্টরেটের ক্লার্ক। পাঞ্জাবিদের দৌরাত্ম্যই ছিল বেশি। অফিসাররা প্রায় সবাই ওদের। ফলে বাঙালিদের নানা বঞ্চনার শিকার হতে হত। মনের ভেতর তখন নানা ক্ষোভ জমাট বাধত। এ সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। যুক্ত ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। আবু সাঈদ বাবলু ও আবদুল্লাহ আল কাফি, ফারুক ছিলেন তখনকার নেতা। তরিকুল ইসলাম ও মিসেস নার্গিস আপা আমাদের নিয়ে মাসে একবার বসতেন পাঠচক্রে। সরকারি কলেজের জিএস তখন জাকারিয়া মিলন।''

যশোরের রাজনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানালেন, তাদের এলাকায় বাম রাজনীতির চর্চা ছিল বেশি। পাড়ায় থাকতেন আহমেদ আলী সরদার, শওকত আলী ও ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর প্রতিনিধি এডভোকেট আবদুল রাজ্জাক। কমরেড আবদুল হক, এডভোকেট মশিউর রহমান, এডভোকেট মোশাররফ হোসেন, এডভোকেট এনামুল হক, ডা: রবিউল ইসলাম প্রমুখের সান্নিধ্য পেয়েছি। ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপ ছিল বেশ তৎপর। সমাজের মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সব মিলিয়ে যশোরের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন রাজনীতি-সচেতন।

আহত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ:

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফরা দেশের নানা খবরাখবর জেনে যেতেন চিত্রালী, দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক, জং নামক উর্দু পত্রিকার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেডিওতে। তাঁর ভাষায়:

''আল আমিন নামে একটি ক্লাব ছিল আমাদের। পুলিশের এক সদস্য তার ফিলিপস রেডিওটি দেন ক্লাবে। সেটাতেই শুনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কথার বিকল্প কিছু ছিল না। তাঁর কথাই ছিল চূড়ান্ত। আমরা সবাই সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তিনি বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', আমাদের জন্য ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় নির্দেশনা।''

আপনারা তখন কী করলেন?

''প্রথম সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হল। এলাকার কমিটিতে ছিলেন শরীফুল ইসলাম চৌধুরী, একরামুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল গাফফার লাল প্রমুখ। ২৫ মার্চ রাতেই পরিবার নিয়ে আমরা যশোর শহর থেকে ৪-৫ মাইল ভেতরে ঘুরে গ্রামে চলে যাই। আমার চাচির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ২৬ মার্চ সকালে আবার শহরে আসি। ওই দিনই আমার সামনে এডভোকেট মইনুদ্দিন আহম্মেদ নিয়াজিকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সত্তরের নির্বাচনে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এরপরই যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাও করে রাখে সাধারণ জনতা। সবার হাতে লাঠি, দা, কুড়ালসহ নানা অস্ত্র। নেতৃত্বে ছিলেন পালিয়ে আসা বাঙালি আর্মি, ইপিআর ও পুলিশরা। পাঁচবাড়ি মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা, পুরোটাই মানুষ অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের তোপের মুখে তারা টিকতে পারে না। এপ্রিলের ১-২ তারিখে চাঁচড়া মোড়ে পাওয়ার হাউজ নামক জায়গায় জড়ো হয় প্রায় ১০-১২ হাজার লোক। সবাই স্লোগান তুলছে 'জয় বাংলা' বলে। সন্ধ্যা হয় হয়। খুলনা থেকে আসা পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়ি দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। ওরা এসে ঢুকবে যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সবাই ভেবেছে বাঙালি আর্মি। কিন্তু মুখোমুখি হতেই ঘটল অঘটন। তারা ফায়ার ওপেন করে দিল। ফলে পাখির মতো মারা পড়ে প্রায় ৮-৯শ সাধারণ মানুষ। পথে পথে ছিল লাশ আর লাশ। যে যার মতো পালাতে থাকল। আমি তখন চলে যাই ঘুটে গ্রামে, পরিবারের কাছে।''

এরপর পাকিস্তানি সেনারা যশোর শহরের নিকটবর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পরিবারসহ লতিফরা তখন চলে আসেন মনিরামপুর থানার ভোজঘাটি গ্রামে। সেখানে মা-বোনকে রেখেই তিনি ঘর ছাড়েন। পণ ছিল, মরতে হয়, লড়াই করেই মরবেন। পায়ে হেঁটে তিনি হাসনাবাগ ও কালিগঞ্জ হয়ে প্রথমে চলে আসেন ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ। পরে বশিরহাট হয়ে পৌঁছান বনগায়, চাপাবাড়িয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। শাহ হাদিউজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মুখার্জি ছিলেন এর দায়িত্বে। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহার প্রদেশের সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে।

আবদুল লতিফের কাছে জানলাম, পাঁচ সপ্তাহের সেই ট্রেনিং ছিল খুবই কষ্টের। পাহাড়ের ওপর তাঁবু টাঙ্গিয়ে থাকতে হত। দুই সঙ্গীকে সাপে কেটে মেরে ফেলে। খুব ভয় হত তখন। কিন্তু দেশের চিন্তায় ভয়ও জয় হয়ে যায়। ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি, টুইনস মর্টার, গ্রেনেড থ্রোইং প্রভৃতি। সাতদিনের ট্রেনিং হয় এক্সপ্লোসিভের ওপর। ট্রেনিং ক্যাম্পে আসেন আতাউল গনি ওসমানী ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। লতিফের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল-৪৭৬১৯।

ট্রেনিং শেষে লতিফদের আনা হয় কল্যাণীতে। গ্রুপ করে দু'শ জনকে পাঠানো হয় অ্যাকশন ক্যাম্পে। পরে তাদের পাঠানো হয় ৮ নং সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে। সেখানকার কমান্ডার ছিলেন কাজী নাজমুল হুদা। তিনি একদিন বললেন, 'ছাত্র যারা আছ, তারা গেরিলা অপারেশন করবে।' আলাউদ্দিন, কোরবান ও লতিফসহ বাছাই করা যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় দশজনের একটি গেরিলা দল। কমান্ডে লতিফ নিজেই। তাঁরা অপারেশন করেন চুরামনকাঠি রেলস্টেশনে (বর্তমানে মুন্সি মেহেরউল্লাহ স্টেশন), হালশা, ছুটিপুর, কায়েমখোলা,শাহবাজপুরসহ যশোরের বিভিন্ন এলাকায়।

স্বাধীনের পরের দেশ ও পরবতী প্রজন্ম নিয়ে কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ:

গেরিলাদের কাজ কী ছিল?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফের উত্তর: 'আমরা দেশের ভিতরে আত্মগোপন করে থাকতাম। রেললাইন, কালভার্ট, গ্রিডলাইনের পিলার উড়িয়ে দিতাম। পাকিস্তানি সেনারা যেন নির্বিঘ্নে চলতে না পারে সে দিকে নজর থাকত। তাদের ভয়-ভীতি দেখানোই ছিল গেরিলাদের কাজ। আক্রমণ করেই মানুষের সাথে মিশে যেতাম। এক্সপ্লোসিভের বড় কোনো ঘটনা ঘটাতে ডাক পড়ত আমার।''

একটি অপারেশনের কথা শোনান তিনি:

''ম্যাসেজ আসল, পাকিস্তানি আর্মিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে যেন চৌগাছির দিকে আসতে না পারে। কী করতে হবে? ব্রিজগুলো আর ২টি ইলেকট্রিক পোল উড়িয়ে দিতে হবে। শীত হয় হয়। সামান্য কুয়াশা পড়েছে। এর মধ্যেই আমরা ইলেকট্রিক পোলে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দূরে গিয়ে তার বিষ্ফোরণ ঘটাই। দেখি দুপাশে তখন পাকিস্তানি আর্মিরা দৌড়াচ্ছে। তারা যে অ্যামবুস করে বসেছিল আমাদের তা জানা ছিল না। তারাও টের পায়নি আমাদের উপস্থিতি। ফলে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।''

একাত্তরে রাজাকারদের ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ এক বাক্যে বললেন: ''রাজাকাররা পাকিস্তানি আর্মিদের গাইড হিসেবে কাজ করত। আর সাধারণ মানুষ জায়গা দিয়ে, নিজে না খেয়েও আমাদের খাওয়াত। প্রবাসী সরকার তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পকেট খরচ দিত মাসে ৭৫ টাকা। এই টাকা খরচ করার উপায় ছিল না।''

একাত্তরে এক অপারেশনে বাম পা হারান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ। শেলের স্প্রিন্টারে তাঁর পায়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়। ফলে বাম পা কেটে ফেলা হয় হাঁটুর নিচ থেকে। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত সে দিনটিতে? জানতে চাই আমরা। প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ আনমনা হয়ে যান। চোখ দুটো তাঁর জলে ভরে ওঠে। খানিকটা নিরব থেকে অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন:

''৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকাল তখন ১১টা। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে দখল করে নিচ্ছিল যশোর শহর। তুমুল গোলাগুলি চলছে। ভারতীয় বিমান হামলার জবাবে পাকিস্তানি সেনারা শেলিং করছে অবিরত। চারপাশে আগুন আর আগুন। আমরা ছিলাম শংকরপুর এলাকায়। রাজারহাটের দিকে অগ্রসর হব। হঠাৎ শত শত শেল এসে পরে আশেপাশে। নিজেকে বাঁচাতে সবাই ছত্রভঙ্গ হই। পাঁচজন ছিলাম একসাথে। দেখলাম বঙ্কিম আর কাউসারের নিখর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। শেলিংয়ের শব্দ হতেই একটি বাঙ্কারের ভেতর আমি আশ্রয় নিতে লাফ দিই। মাথাসহ শরীরের অর্ধেক বাঙ্কারের ভেতরে পৌঁছালেও পা দুটি থেকে যায় বাইরে। সে সময়ই শত শত স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয় দুই পায়ে।

সারা শরীর জ্বলতে শুরু করল। চারপাশে সহযোদ্ধাদের লাশ। ভেবেছিলাম আমিও মরে যাব। প্রচণ্ড পিপাসা পাচ্ছিল। মায়ের মুখখানা চোখে ভাসছিল বারবার। বাঙ্কারের পাশেই ছিল কচুরিপানা ভর্তি একটি পুকুর। সেখানে পানি খেতে গিয়েই মাটিতে পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরে পাই পরদিন সকালে। তখন আমি যশোরের ফাতেমা ক্যাথলিক হসপিটালে। স্প্রিন্টারের আঘাতে আমার দু'পা ক্ষতবিক্ষত হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়াতে তা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। অন্য পায়ের অনেক জায়গাতেই মাংস নেই।

সেদিনই যশোর শহর হানাদারমুক্ত হল। এখনও পায়ের দিকে তাকালে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে। তবুও আফসোস নেই। বরং আমি গর্বিত। আমার ত্যাগ উৎসর্গ করে দিয়েছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।''

স্বাধীনতা লাভের পরের দেশ নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

''কোতোয়ালি থানার এক ওসি ১৯৭১ সালে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর তার কাছ থেকেই আমাদের ভেরিফিকেশন সনদ নিতে হয়েছে। এটা দেখে সত্যি অবাক হয়েছি। বড় ভুল ছিল পাকিস্তানে বন্দি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এনে চাকুরিতে যোগদান করানো। আর্মিতে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাদের দুই বছরের সিনিওরিটি দেওয়াটাও ছিল মস্তবড় ভুল। উচিত ছিল সকল মুক্তিযোদ্ধাকে দেশগড়ার কাজে সম্পৃক্ত করা।''

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে, মানে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সাম্প্রদায়িক চেতনার উত্থান ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুিণ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব হয় বিপন্ন। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা যেত না। স্বাধীন দেশের সরকারের মন্ত্রী ছিল রাজাকাররা। জিয়ার হাত ধরেই রাজাকাররা পুনর্বাসিত হয়েছে। এ ক্ষতি এ দেশ কোনোদিনও শুধরাতে পারবে না। জিয়াউর রহমানের রাজনীতি ছিল অন্যরকম। প্রকাশ্যে সমাবেশে তিনি বলতেন, 'টাকা কোনো সমস্যা না। আমি রাজনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে মানুষ আর রাজনীতি করবে না'– এভাবেই নিজের ক্ষোভ জানালেন এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তাঁর মত, স্বাধীনতার পর মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট ছিল। তা দিয়েই সে সময় তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। এখন রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে। যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তারাই নিজেদের সুবিধার জন্য সংখ্যা বাড়ায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত নন; আবার কেউ কেউ লেজুড়বৃত্তি করেন। গ্রামে-গঞ্জে যাঁরা আছেন তাঁরা আজ সমাজ ব্যবস্থায় পরাজিত। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সংখ্যকের লোভ ও রাজনৈতিক চাপ, উভয় কারণেই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়েছে।

এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন আবদুল লতিফ:

''শহুরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভালো কাপড়-চোপড় পরে মিডিয়াতে বক্তৃতা দিলেও, এটা কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বাস্তব চিত্র নয়। বাস্তব অবস্থা জানতে রুটে আসতে হবে। বেনাপোল রেল স্টেশনের ওয়াগনের ভেতর বসবাস করছে এমন দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাও আপনাকে দেখাতে পারব। তাঁর কাছে দশ হাজার টাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেও বড়। মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দুইটা স্যালুট মারলেই রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যার পরিবার খেতে পারে না, চিকিৎসা পায় না, তাঁর কাছে এর কোনো মূল্য নেই। সরকার ভাতা বৃদ্ধি করেছে, পাশাপাশি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও নেওয়া উচিত সরকারের।''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা; উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''ভালো লাগে স্বাধীন দেশে রেললাইনের ধার দিয়ে শিশুদের যখন বই হাতে বাড়ি ফিরতে দেখি; যখন শুনি এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বিদেশে নানা কাজে আমাদের পতাকার সম্মান বাড়িয়েছে; জেলায় জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণদের আগ্রহ দেখলে সত্যি আনন্দে মন ভরে যায়।''

খারাপ লাগে কখন?

খানিকটা নিরব থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফের উত্তর:

''দেখছেন তো দেশে অবরোধ চলছে। জ্বালাও, পোড়াও আর সাধারণ মানুষকে পেট্রোল বোমা মেরে জ্বলসে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য কি দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। এটা কি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড? মানুষকে জিম্মি করার অর্থ কি গণতন্ত্র? এসব দেখলে কোনো সুস্থ মানুষের কি ভালো লাগে?''

তাহলে কী করা উচিত…

''নেতারা কথা কম বলে কাজ বেশি করলে ভালো হয়। একজন নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেটা কীভাবে দিতে হবে সরকারই ভালো বোঝে। মনে রাখতে হবে, কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। তবে এই মানুষ মারার কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে না পারলে বর্তমান সরকারকেও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।''

কথা উঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা লতিফের মতামত:

''তারা তো এই দেশই চায়নি। আজ স্বাধীন এ দেশের আইন মেনেই তাদের শস্তি হচ্ছে। আমি মনে করি, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শাস্তি। কিন্তু রায়গুলো অতিদ্রুত কার্যকর করা উচিত।''

কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতরেই গণতন্ত্র নাই। অথচ তারা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলছে। এ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্ম ব্যবসা বাদ দিয়ে যদি গণতান্ত্রিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে দেশ অনেক এগোবে বলে মনে করেন লতিফ।

আমাদের সঙ্গে কথা বলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফের ছেলে সিকান্দার মাহমুদ। মুক্তিযোদ্ধা বাবার প্রসঙ্গে তার ভাবনার কথা শুনি। বললেন: ''আমরা গর্বিত। বাবার সহজ সরল জীবনযাপন থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি। তাঁর মধ্যে অহংকার কখনও দেখিনি। সৎভাবে জীবনযাপন করা এবং কারও ক্ষতি না করার শিক্ষা পেয়েছি বাবার কাছ থেকেই। যদি দেশের কোনো কাজে নিয়োজিত হই, তবে অবশ্যই আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে তা করব।''

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফের বিশ্বাস, এ দেশ একদিন অনেক উন্নত হবে। তবে তার কাণ্ডারি হতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন: ''মেধায়, বুদ্ধিতে, সততায় আর দেশপ্রেমে তোমরা উজ্জীবিত হয়ো। দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে প্রশয় দিও না। মনে রেখ, সবার উপরে দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের দেশ তোমাদেরকেই গড়তে হবে।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ।

ট্রেনিং নেন: পাঁচ সপ্তাহের ট্রেনিং নেন ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল- ৪৭৬১৯।

যুদ্ধ করেছেন: ৮ নং সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে। দশজনের একটি গেরিলা দলের কমান্ডে ছিলেন তিনি। অপারেশন করেন চুরামনকাঠি রেলস্টেশনে (বর্তমানে মুন্সি মেহেরউল্লাহ স্টেশন), হালশা, ছুটিপুর, কায়েমখোলা, শাহবাজপুরসহ যশোরের বিভিন্ন এলাকায়।

যুদ্ধাহত: ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকাল ১১টায়। যশোর শহর অপারেশনের সময় শেলিংয়ের শত শত স্প্রিন্টারে বিদ্ধ হয়ে তাঁর দুই পা ক্ষতবিক্ষত হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়াতে তা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। অন্য পায়ের অনেক জায়গাতেই মাংস নেই। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করছেন।

ছবি ও ভিডিও : সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।