মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতি: এগিয়ে বিএনপি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 27 Jan 2015, 07:41 PM
Updated : 27 Jan 2015, 07:41 PM

জীবিতকালে ও মৃত্যু-পরবর্তী– রাজনীতিকে এ দু'ভাগে ভাগ করলে বিএনপি পরেরটিতে সার্থক। তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে ঢের এগিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মতো শতাব্দীশ্রেষ্ঠ বাঙালির শেষ বিদায় ঘটেছিল নিরবে। তাঁর জন্যে লুকিয়ে চোখের জল ফেলার বিকল্প ছিল না আমাদের। চার নেতা হত্যার দিন ছিল কালী পুজো। শোক করব, না কালীর প্রতিমা পাহারা দেব, এই ভয়ে রাত কেটেছিল। পর দিন হতবিহ্বল মানুষ আর যাই করুক, নেতাদের জানাজায় ঢল নামাতে পারেনি।

অন্যদিকে, জিয়াউর রহমান উড়ে গেলেন আমাদের বাড়ির কাছের সার্কিট হাউসে। ঘটনার পর দিন বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখি থমথমে আবহাওয়া। চারদিকে ভয়-ভীতি আর ত্রাস। তাঁর দাফনও নিরবে হয়ে গিয়েছিল, রাঙ্গুনিয়ায়। সেই লাশ যখন দ্বিতীয়বার দাফনের জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হল, মানুষে মানুষে সয়লাব। সেদিনই মূলত খালেদা জিয়ার ভাগ্যাকাশের সূর্য প্রথম হেসেছিল। দুই নাবালক পুত্রের হাত ধরে স্বামীহারা বেগম জিয়ার কান্না ও বেদনার ভেতর দিয়ে যে আবহ সেটা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্ব।

শুধু তাদের কথা বলি কেন? আমাদের ইতিহাসের ঘোর দুশমন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দেশমাতার প্রধান শত্রু আমীরে আজম গোলাম সাহেব কীভাবে গেলেন? ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে হাসপাতালে; ঘি-ননী-মাখন খেয়ে মানুষের কাঁধে চড়ে শোকের মিছিলে একপাটি জুতোর দিকে ভেংচি কেটে বিদায় নিলেন। আজ আবার কোকো মারা যাবার পর মানুষের উত্তেজনা ও শোকের বাতি উসকে উঠলে আমি খুব অবাক হব না।

আজ সকালে আমি যখন সিডনিতে বসে 'একাত্তর' চ্যানেলটি দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল এটির নাম হওয়া উচিত 'পঁচাত্তর'। শুরুতে যেভাবে কোকোর, তার লাশের খবর এবং মালয়েশিয়ার বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথোপকথন দেখানো হল, আমি নিশ্চিত এর পেছনে সমবেদনা ও ভয়ের রাজনীতি কাজ করেছে। প্রচ্ছন্নভাবে বিএনপির প্রতি সমবেদনা ও ভবিষ্যতে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থেকে তারা এ কাজ করেছে। এদেশের একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির এবং কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রী থাকা অন্যতম প্রধান এক রাজনৈতিক দলের নেত্রীর পুত্রের অকালমৃত্যু বড় ধরনের খবর হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কত বড়? কতটা নৈতিক আর আইনসিদ্ধ?

আমাকে ভুল বুঝলে আমি দুঃখিত। কোকোর মৃত্যুতে আমার আনন্দের কিছু নেই। বরং তাদের পরিবারের বেদনাই আমার কাছে মূখ্য। তাছাড়া এই ছেলেটিই রাজনীতিতে ছিলেন না। বিএনপির রমরমা সময়েও তার বিরুদ্ধে তেমন কিছু শুনিনি। বড় ভাইয়ের মতো হাওয়া ভবন বা খাম্বা কেলেঙ্কারিও ছিল না তার। যদিও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারায় ভাগের ভাগ হিসেবে বড়লোক হবার পথ তৈরিই ছিল তার জন্য। আমার এখনকার আবাস অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে একদা পিৎজা সরবরাহের কাজ করা পরিশ্রমী কোকো মায়ের সিংহাসন লাভের পর দেশে চলে গিয়েছিলেন। বৈধ অবৈধ যেভাবেই হোক, নৌযানসহ তার নানা ব্যবসায় ফুলে-ফেঁপে ওঠার কারণে সাজা পেতে হবে এমন এক অবস্থায় মুচলেকা দিয়ে অথবা সমঝোতার চোরাপথে বিদেশ যাওয়া ছেলেটি আজ অকালমৃত।

এই সংবাদ কী কারণে, কেন এমন ব্যাপক সেটা বুঝতে না পারার কি আসলে কোনো রহস্য আছে? কোকো না ছিলেন মান্নান ভুঁইয়া, না সালাম তালুকদার! এই দুই ভদ্রলোক জটিল সময়ে সেক্রেটারি হয়ে দলের হাল সামলালেও, শোকের মাতমে ভাসার ভাগ্য নিয়ে জন্মাননি। উপমহাদেশের রাজনীতি এমনই। ইন্দিরার স্নেহের পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুতে কারও টনক নড়েনি। রাজনীতিবিমুখ পুত্র রাজীব গান্ধী সময়ের প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে পরে প্রাণ দেওয়ার ভেতর দিয়ে কংগ্রেসকে তাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিজয় উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। কোকো এমন এক সময় মারা গেলেন যখন বিএনপির প্রয়োজন সহানুভূতি আর সমবেদনা। মানুষ যদিও একে নিয়তির অভিশাপ মনে করছিল– ভাবছিল, পেট্রল বোমা আর নাশকতায় মানুষ জ্বালানোর দৈব অভিশাপ– মিডিয়া, সুশীল ও রাজদূত এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় তা আজ অন্য খাতে প্রবাহিত হলেও অবাক হব না।

মিডিয়ার কাজ তারা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল একটাই, যদি আমরা মনে করি বিএনপি বা খালেদা জিয়া ভুল করছেন না বা শেখ হাসিনার সরকার ঠিক করছে না, সে বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার হওয়া জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের তকমা ও লেবাস যদি গান-বাজনা, নাটক, থিয়েটার আর বিনোদন প্রচারের ভার বা বাহন হয়, তাহলে কিন্তু এ ধারা চলতে থাকবেই। নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ হবার ভয়ে জামাতি ও উগ্রবাদীরা মুক্তিযুদ্ধের আলখেল্লা পরিধান করে ব্যবসা চালাবে, আর আমরা ভেতরে ভেতরে চাইব বিএনপি বা জোটই আখেরাতের রাস্তা খুলে দিক, তাহলে আপনাদের এই মিডিয়া-নাটকও অবৈধ।

আপনারা যে কারণে, যে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এসব প্রচার চালু রাখেন, সে গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের পোড়া মুখ কোথায়? কোনো চ্যানেল এ যাবত একদিনও দেখিয়েছে একটি পোড়া মুখ ও লাশের বাড়িফেরার কাহিনি? খালেদা জিয়া এখন না সরকারপ্রধান, না বিরোধী দলের নেতা। তাঁর প্রয়াত পুত্র জীবদ্দশায় এ দলের কোনো পদে ছিলেন না; পদ নেবার তার কোনো আগ্রহ ছিল বলেও মনে হয়নি। কোন কারণে তবে এই ব্যাপক প্রচার? শুরু থেকে শেষ অব্দি এমন প্রচার তো এদেশে বঙ্গবন্ধুও পাননি।

আপনাদের সর্ষেতে যে ভূত তা মৃত কোকোকেও শান্তি দেবে না। বেচারি তার মায়ের কাছে থেকে মরতে পারেননি। তার মা তাকে শেষ দেখা দেখতে পাননি। ভাইও নয়। বাজারের গুজবে কান দেওয়া যায় না। আমরা আসলে এক বিশাল বর্বর জাতি; মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিয়েও বাজে কথা বলি। এই আমরাই এখন আবার মাতমে নেমে পড়েছি। যেসব মানুষ ভয়ে তার ছায়া মাড়াত না, তারা আজ আবার লাশের রাজনীতিতে বেপরোয়া।

সারাদেশে সন্ত্রাস আর বোমার আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া মানুষের লাশ আপনাদের ছেড়ে কথা বলবে না। মাওলানা ভাসানী বলতেন, মজলুমের নিঃশ্বাস নাকি আকাশগামী। সব রেখে বেচারি কোকোর লাশ নিয়ে যে রাজনীতি, তাতে আগুনে পোড়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস কতটা যাবে বলতেও ভয় হচ্ছে।

দেখছি আমরাই আমাদের বড় শত্রু। আজ বাজারে গুজবের যত ডালপালা, তার একটাও যদি সত্য মানি, এই মৃত্যুও অস্বাভাবিক। তারপরও আমাদের শোক এখন মাছের মায়ের শোকের মতো হয়ে উঠছে। মিথ্যা তালা, কপাট, চাবি, বিবৃতি আর ইনজেকশনের চাপে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আসল সত্য।

পরিত্রাণ নেই? কী মুশকিল! যারা গদিতে তারা বলছেন, এ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মানুষরা নাকি গণতন্ত্রের শহীদ। তাই যদি হয়, তাদের দেখতে যাওয়ার চাইতে অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকে দেখতে যাওয়া জরুরি হল কোন শোকে? আর যারা বলছেন, এ অবরোধ গণতন্ত্রের 'আখেরি সংগ্রাম', তাদের পরিবারতন্ত্রের প্রতি এমন নতজানু হবার কারণ কী? যিনি দলের কেউ নন, দলের হয়ে তার জন্য এই শোক, না পরিবারের জন্য মাতম? এরা তো দেখছি মানুষকে তাদের আত্মীয়ের জন্য কাঁদতেও দেবে না মন খুলে।

অগণতান্ত্রিকতা শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে গিয়ে ঠেকে কে জানে। তবে এ যাত্রায় আওয়ামী লীগকে টপকে গেছে বিএনপি। আবারও প্রমাণ করেছে, মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতিতে তারাই এগিয়ে। জীবনবিমুখ সমাজে এটাই ঘটবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।

সিডনি; ২৭ জানুয়ারি।