সবই কি চলে যাবে নষ্টদের অধিকারে

আবেদ খান
Published : 26 Jan 2015, 05:11 PM
Updated : 26 Jan 2015, 05:11 PM

জঙ্গিবাদের হাতে নৃশংসভাবে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই আক্রমণজনিত কারণে প্রয়াত প্রতিভাধর লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর এক লেখায় অতিশয় খেদ এবং ক্রোধের সঙ্গে বলেছিলেন– 'সবকিছুই নষ্টদের হাতে চলে যাবে।' সেটাই দেখছি আমি বেশ কিছুদিন ধরে। বুদ্ধি, বিবেক, ন্যায়নীতি-রুচি, শিষ্টাচার, সভ্যতা, ভদ্রতা, শিক্ষা-দীক্ষা কিছুই বোধহয় আর অবশিষ্ট রইল না আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষের জন্য। সত্যি করে বলছি, কলম দিয়ে এখন আর কোনো কথা বেরুতে চায় না– প্রতিটি বর্ণমালা ক্রুদ্ধ হয়ে যায় যখন শব্দ সাজানোর চেষ্টা করি।

বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তার অকালপ্রয়াণ নিঃসন্দেহে তাঁর মাতাকে শোকাভিভূত করবে। কারণ কোনো পিতা বা মাতা চায় না মৃত সন্তান, তা সে দেহযন্ত্র বিকল হওয়ার কারণে মৃত্যুই হোক কিংবা পেট্রোল বোমায় অঙ্গার হয়ে অথবা গুলির ঘায়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যুই হোক। আরাফত রহমান কোকোকে নিয়ে কোনো বিশদ আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। তবে তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী বিভিন্ন নাটক যে ঢাকায় গত দুই দিন ধরে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে, সেটাই আমাকে বিস্মিত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেলেন বিএনপি নেত্রীর গুলশান কার্যালয়ে শোকবিধুর মাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না, প্রধান ফটক তালাবন্ধ করে রাখা হল, পাশের ছোট ফটকটিও দ্রুততার সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী যে শোকপ্রকাশ করতে সেখানে যাবেন, সেটা সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমেই আমরা জেনেছিলাম; দেখেছিলাম, বিভিন্ন চ্যানেলের ক্যামেরা কী পরিমাণ সক্রিয়, সাংবাদিকরা মাইক্রোফোনে ক্রমাগত ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছেন। স্টুডিয়োতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বসেছেন একটি অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎকারের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করার আশায়।

প্রধানমন্ত্রী এলেন, আট মিনিট বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তারপর চলে গেলেন। মিলনাত্মক নাটকের পরিবর্তে বিয়োগাত্মক নাটক দেখলেন দেশের মানুষ। খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে মুখপাত্র হিসেবে শিমুল বিশ্বাস জানালেন, পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে এবং তাঁর শয়নকক্ষের দরজা বন্ধ। কেউ কিন্তু প্রশ্ন করল না যে, ঘুমের ওষুধই তো ঘুম আনানোর জন্য যথেষ্ট; তাহলে ইনজেকশনের প্রয়োজন হল কেন? কী ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, কে ইনজেকশন দিয়েছিল? দেশের অন্যতম বিখ্যাত ডাক্তার প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী তো তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন সমবেদনা জানানোর জন্য। তিনি তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কিনা কিংবা তাঁকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার ব্যাপারে প্রফেসর চৌধুরী কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা, আমরা জানি না। এক সময় দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি, কাজেই অনুমান করি সহজে তিনি অসত্য ভাষ্য দেবেন না।

ব্যারিস্টার রফিকুল হক ছিলেন সেখানে। তিনি দাবি করেছেন, খালেদা জিয়া ঘুমোচ্ছিলেন না বলেই তাঁর বিশ্বাস। এমনকি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম নাকি এটাও উল্লেখ করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী গুলশান এলাকা পরিত্যাগের পর কিছুক্ষণের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর উচ্চস্থানীয় কেউ কেউ কার্যালয়ের দোতলায় তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না, আর শিমুল বিশ্বাসের কথা তো বিশ্বাস করছিই না। তিনি যত গল্পই বানান না কেন, টিভির ক্যামেরা তো তাঁকে দেখিয়েছে দীর্ঘক্ষণ। তিনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন সবই তো দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী চলে যাবার কিছু পরেই তিনি একটা মুদি দোকানের খাতার মতো একটা খাতার ওপর শোকবই লিখে নিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে নির্জলা মিথ্যার ঝাঁপি খুলে ধরলেন। সেটা মানুষ বিশ্বাস করল কি করল না, তাতে তাঁর বা ওই ভবনের কারও কিছু যায় আসেনি।

যাই হোক, এরপর মুখরক্ষার জন্য একটা শোকবই আনা হল এবং আমার ধারণা অনেককে ফোন করে অনুনয় করে সেই শোকবই-এ সই দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। আমার সবচাইতে অবাক লেগেছে যখন দেখলাম বিদেশি দূতাবাসের লোকজনও লাইন দিয়ে সেই শোকবইতে বার্তা লিখছেন। কেন এবং কার জন্য? কোনো কোনো দূতাবাসের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা তাঁদের কূটনৈতিক দায়িত্বের অন্তর্গত কিনা। তাদের প্রায় সবারই দ্বিধাজড়িত উত্তর ছিল– একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের মৃত্যুতে তো এটা করাই যেতে পারে। তাছাড়া তোমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যখন গেছেন সেখানে, তখন আমাদের যাওয়ার দোষ কী?

আশ্চর্য যুক্তি! বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্থপতি ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর জ্যেষ্ঠপুত্র সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মোহাম্মদ সেলিম তো প্রয়াত হলেন দু'দিন আগে। তিনি বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানেও গিয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের তো কোনো উপস্থিতি দেখা গেল না সেখানে! মাত্র কয়েক বছর আগে জাতির জনকের ছোট বোন প্রয়াত হলেন। কই, সেখানেও তো দূতাবাসগুলোর কোনো আনাগোনা চোখে পড়েনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ সৌজন্যের অংশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যদি আইনের দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত না হতেন এবং সাজা পেলেও যদি দেশে ফিরে আইনি লড়াই করতে করতে এক সময় স্বাস্থ্যগত কারণেই প্রয়াত হতেন তখনও কূটনীতিকদের শোকজ্ঞাপন অর্থবহ হয়। কিন্তু হঠাৎ করে একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ব্যক্তির প্রয়াণ তাদের কাছে এত কূটনৈতিক গুরুত্ববহ হয়ে গেল কেন– এ অঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না।

না, তাদের কিছু বলে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে আমি বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কূটনৈতিক পারদর্শিতার তারিফ করব। শুধু সেদিকেই নয় যে, কোকোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, তাকে বিএনপি জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক পরিপক্বতার কাছে আওয়ামী লীগ পরাস্তই হয়েছে বলতে হবে। এ ব্যাপারে তারা সরকার এবং আওয়ামী লীগকে কয়েক মাইল পেছনে ফেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শঠতা জয়যুক্ত হয়েছে, শঠতা জয়যুক্ত হয়েছে, শঠতা জয়যুক্ত হয়েছে।

তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সততা পরাজিত শঠতার কাছে, সত্য পরাজিত মিথ্যার কাছে, শালীনতা পরাজিত আশালীনতার কাছে, বিবেক পরাজিত বিবেকহীনতার কাছে, নীতিবোধ পরাজিত অনৈতিকতার কাছে।

বুঝি না, এভাবেই কি সব নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে? কোথাও কি কোনো সাহসী শিশু চিৎকার করে বলবে না: ''অ্যাই রাজা, তোর কাপড় কোথায়?''

ঢাকা: ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

আবেদ খান: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।