পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি বনাম শিশু মনস্তত্ব

শওগাত আলী সাগর
Published : 19 Jan 2015, 07:35 AM
Updated : 19 Jan 2015, 07:35 AM

আমার দু'মেয়েই কানাডার টরন্টোর একটি ইলিমেন্টারি স্কুলে পড়ে। গ্রেড টু আর ফাইভে পড়ুয়া মেয়েদের স্কুল ব্যাগ থেকে প্রতিদিনই এক বা একাধিক চিঠি আমাদের খুলতে হয়। স্কুল থেকে পাঠানো চিঠিগুলো থাকে খোলা; অর্থাৎ বাচ্চারাও চিঠির বিষয়বস্তু পড়ে ফেলতে পারে। বছরে কেবল দু'বার দুটো চিঠি আসে মুখবন্ধ খামে। সেই চিঠি অভিভাবককেই খুলতে হয়। সে দুটো হচ্ছে রিপোর্ট কার্ড।

রিপোর্ট কার্ড অভিভাবকদের মনোযোগ দিয়েই পড়তে হয়। শুধু তাই নয়, সন্তানকে রিপোর্ট কার্ডের পুরোটাই পড়ে শোনাতে হয়, আলোচনা করতে হয়। নিজের মতামতসহ স্বাক্ষর করে সে কার্ড স্কুলে পাঠাতে হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ কার্ডটি মুখবন্ধ খামে বাড়ি পাঠায় কেন? কারণ, তারা চায় না সহপাঠীদের একে অন্যের রিপোর্ট কার্ড দেখুক, কে ভালো করল কে খারাপ করল সে আলোচনা যেন শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে শুরু না হয়।

রিপোর্ট কার্ডে শিক্ষার্থীর স্ট্রেংথের বিবরণ এমনভাবে উল্লেখ করা হয় যে, আমি নিজেও চমকে উঠি, আমার মেয়ে অ্যাত্তো ভালো! রিপোর্ট কার্ডে 'উইকনেস' শব্দটা কোথাও ব্যবহার করা হয় না; যদিও একজন শিক্ষার্থী কোথায় কোন বিষয়ে পিছিয়ে আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণও থাকে। কার্ডে সে সব উল্লেখ করা হয় 'অপারচুনিটি' হিসেবে। যে শিক্ষার্থীটি 'এফ গ্রেড' পায়, মানে ফেল করে, তার রিপোর্ট কার্ডেও প্রথমে স্ট্রেংথের বিবরণ থাকে। শিক্ষার্থীর সক্ষমতা বা যোগ্যতা নিয়ে কোনো সংশয় বা প্রশ্ন রিপোর্ট কার্ডে থাকে না। এটাই পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিধান, শিশু মনস্তত্বে গুরুত্ব দিয়েই এ বিধান করা হয়েছে। শিশু মনস্তত্ববিদরা শিশুর যোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলা অনুমোদন করেন না।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ফাহমিদুল হক তার আত্মজার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটা তুলেছেন তিনি প্রকাশ্যে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে। সেই পোস্ট আবার ঢাকার মিডিওয়ালারা খবর বানিয়ে সারা দেশকে একজন শিশুর যোগ্যতাহীনতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। আধুনিক শিশু মনস্তত্বে শিশুর প্রতি সংবেদনশীলতার যে কথাগুলো বলা হয়, ফাহমিদুল হক নিজে যেমন সেটি বিবেচনায় নেননি, তেমনি ঢাকার মিডিয়াও একে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি।

ফাহমিদুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, সেটিই তার বড় পরিচয় নয়; মুক্তচিন্তা, লেখালেখির কারণে তার আলাদা একটা অবস্থান রয়ে সমাজে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরপরই তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:

'''আমার আর রিপার মেয়ে (ফাহমিদ তার পোস্টে মেয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। আমি তার মেয়েকে সম্মান জানাতে তার নাম ব্যবহারে বিরত থাকলাম) জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। সব সাবজেক্টে 'এ প্লাস'। কিন্তু আমি খুশিতে আত্মহারা নই। কারণ, আমি জানি, ও আপাতত 'জিপিএ ফাইভ' পাবার যোগ্য নয়।"

বাক্যগুলো আমি আবার পড়ি, বারবার পড়ি। ফেসবুকে প্রোফাইলে গিয়ে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করি, এটি অন্য কোনো ফাহমিদুল হক নন তো! প্রোফাইলে তার পরিচয় দেওয়া আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ক্লাস ফাইভ পাশ করা একজন শিক্ষার্থীকে জনসম্মুখে ঘোষণা দিচ্ছেন, 'এই মেয়ে এত ভালো ছাত্রী নয়, এই ফলাফলের যোগ্য নয়'। আশ্চর্য নয় কি? তিনি অবশ্য 'আপাতত' শব্দটা যোগ করেছেন। তিনি লিখেছেন, তার মেয়ে আপাতত 'জিপিএ ফাইভ' পাবার যোগ্য নয়।

মেয়েটি যে আপাতত জিপিএ ফাইভ পাবার যোগ্য নয়, তা ফাহমিদুল নির্ধারণ করলেন কীভাবে? তিনি মেয়েটির বাবা, এ কারণেই কি তিনি বলে দিতে পারেন তার যোগ্যতা, অযোগ্যতা সম্পর্কে শেষ কথাটি? ফাহমিদুলের লেখা থেকেই উদ্ধৃতি দিই:

"ও ওয়ান থেকেই মোটামুটি 'সি' পেয়ে পাশ করে আসছে। আমি জানি ওর 'জিপিএ ফাইভ' পাবার যোগ্যতা আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তা নেই।"

ফাহমিদই বলছেন, তিনি জানেন যে, তার মেয়ের 'জিপিএ ফাইভ' পাবার যোগ্যতা আছে। পরমুহূর্তেই আবার বলছেন, 'এই মুহূর্তে নেই'। যোগ্যতা কি মুহূর্ত হিসাব করে সক্রিয় হয়? ফাহমিদুলের যোগ্য মেয়েটির যোগ্যতা এই মুহূর্তে নিস্ক্রিয় হয়ে গেল কী কারণে, কীভাবে?

আসুন ফাহমিদের লেখা থেকেই মেয়েটির ব্যাপারে জানার চেষ্টা করি । তিনি লিখেছেন:

''ফাইভের পাবলিক এক্সাম চলে এল। আমরা ওকে চাপাচাপি শুরু করলাম। খেয়াল করা গেল, ও অংকে বেশ দুর্বল। হাফ ইয়ারলিতে পঞ্চাশের কম নম্বর পেয়েছে। টিউটর বিদেয় করে নিজেই অংক-বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করলাম। নির্বাচনী পরীক্ষায় অংকে সে ৭৩ পেল। এরপর প্রায় এক দেড় মাস ঘরে বসে প্রচুর পড়ল সে। ও খেটেছে অনেক। তাতে 'সি' থেকে 'বি' বা 'এ' হবার কথা। কিন্তু সবগুলোতে 'এ প্লাস' পাওয়া অ্যাবসার্ড ব্যাপার। আমি ওকে শেষ দুই মাস পড়িয়েছি। আমি জানি। ওর পরীক্ষাও ভালো হয়েছে; কিন্তু, দুই-তিন মাসে এমন কোনো ম্যাজিক কেউ দেখায়নি যে বা যিনি এসে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে যায়নি যে, ও 'গোল্ডেন এ প্লাস' পাবে।''

আগেই বলেছি, ফাহমিদুল সচেতন মানুষ। পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষা ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি আর দশটা অভিভাবকের মতো ফাহমিদুলকেও অস্থির করেছে স্বাভাবিকভাবেই। সেই অস্থিরতার কারণেই সম্ভবত তিনি যে স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা খেয়াল করে উঠেননি। ফাহমিদের বর্ণনা থেকেই পাই, মেয়েটি হাফ ইয়ারলির ৫০ থেকে নির্বাচনী পরীক্ষায় ৭৩ পেয়েছে। পরের দেড় মাসে সে প্রচুর পড়েছে, অনেক খেটেছে। এসবই যদি সত্যি হয় তাহলে মেয়েটি 'জিপিএ ফাইভ' পাবে না কেন? যে মেয়ের 'জিপিএ ফাইভ' পাওয়ার যোগ্যতা আছে বলে ফাহমিদ নিজেই স্বীকার করছেন, দেড় মাস প্রচুর খাটাখাটিও করেছে, তার প্রভাব কি ফলাফলে পড়তে পারে না? হাফ ইয়ারলির ৫০ থেকে নির্বাচনী পরীক্ষায় যে ৭৩ পায়, ফাইনালে তো সে একশও পেতে পারে। বিশেষ করে যে মেয়েটির যোগ্যতা আছে এবং খাটাখাটিও করেছে। তা হলে, "এই মুহূর্তে মেয়েটির 'জিপিএ ফাইভ' পাওয়ার যোগ্যতা নেই"– এ সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানো বাবা?

ধরেই নিলাম, ফাহমিদুল হক যেহেতু মেয়েটির বাবা, তার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তার মেয়ের যোগ্যতা, অযোগ্যতা তিনি নির্ধারণ করতে পারেন। কিন্তু সেটি পাবলিকলি ঘোষণা দেওয়া কি শোভন? একজন শিশুকে 'যোগ্য নয়' বলে ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিলেন, সে পোস্ট আবার অতিউৎসাহী জনতা শেয়ার করে আরও ছড়িয়ে দিল। আমাদের মিডিয়াও সেটি খবর বানিয়ে সারা দেশে রাষ্ট্র করে দিল। কী সেই খবর? এই মেয়েটি (আমি তার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তার নাম ব্যবহার করলাম না) অযোগ্য, কিন্তু তাকে ভালো ফল দেওযা হয়েছে। আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় এই কথাগুলো কি মেয়েটির কানে যাচ্ছে না? মেয়েটির মনে এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা কি আমাদের বিবেচনায় আছে? তাকে যদি তারই কোনো বন্ধু আঙুল তুলে বলে, 'তুই আসলে অযোগ্য একটা মেয়ে, তোর বাবা বলেছে'– মেয়েটির কেমন লাগবে?

লেখার শুরুতে আমার মেয়েদের রিপোর্ট কার্ডের কথা উল্লেখ করেছি। বোর্ডের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলও তারা প্রাইভেট ইনফরমেশন হিসেবে বিবেচনা করে। রিপোর্ট কার্ডে 'দুর্বলতার' বদলে 'অপরচুনিটি', সম্ভাবনার ব্যবহারটিও করা হচ্ছে শিশু মনস্তত্বের কথা বিবেচনা করেই। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে নানা সমীক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তারা এ ধরনের একটি নীতিমালায় উপনীত হয়েছে। ফাহমিদুল প্রচুর পড়াশুনা করেন, বহির্বিশ্ব সম্পর্কেও তারা পড়াশুনা আছে। ফলে মেয়ের কথিত 'অযোগ্যতা'র বারোয়ারি প্রচারণায় তাকে অত্যন্ত অসংবেদনশীল মানুষ বলে মনে হয়েছে।

যে প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের প্রতিযোগিতমূলক পরীক্ষা নেওয়া হয় তা নিয়ে আমার নিজেরও আপত্তি রয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার প্রশ্নে ফাহমিদুল হকের বক্তব্য এবং আন্দোলনের প্রতিও আমার সমর্থন যথেষ্ট। লেখাপড়া, পরীক্ষা এবং ফল প্রকাশ, এগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের হাতেই রাখার পক্ষে আমি। মিডিয়া, টিভি ক্যামেরা নিয়ে মন্ত্রী-আমলাদের পরীক্ষার হল পরিদর্শন, ফলাফল হস্তান্তরের প্রদর্শনী আমি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।

পাশাপাশি, মনে রাখতে হবে, র সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা যেন বাচ্চাদের প্রতি অসংবেদনশীল না হয়ে পড়ি।

শওগাত আলী সাগর: টরন্টো থেকে প্রকাশিত 'নতুন দেশ'এর প্রধান সম্পাদক।