একটুখানি শান্তি

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 15 Jan 2015, 06:52 PM
Updated : 15 Jan 2015, 06:52 PM

১.

আমি জানি না সবাই লক্ষ্য করেছিল কিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছিল যে, এখন থেকে এসএসসি আর এইচএসসির রেজাল্টের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হবে। খবরটা জেনে আমি যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে বিষয়টা নিয়ে কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার মাঝে সারা দেশে অবরোধ শুরু হয়ে গেল, মানুষের কী কষ্ট! এখন কার আর মনের অবস্থা আছে পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে লেখা পড়ার? কিন্তু যেহেতু কথা দিয়েছি প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে লিখব, তাই কাগজ কলম নিয়ে বসেছি; কী লিখব নিজেও জানি না।

গণতন্ত্র নিয়ে লেখা যেতে পারে, পত্রপত্রিকায় দেখছি সবাই আজকাল গণতন্ত্র নিয়ে লিখছে, কথা বলছে। পৃথিবীর কতগুলো দেশে গণতন্ত্র আছে দেখার জন্যে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে বেশ অবাক হলাম। 'খাঁটি গণতন্ত্র' নাকি আছে মাত্র পঁচিশটি দেশে, বেশিরভাগই ইউরোপের দেশ, তার মাঝে ভারতবর্ষের নাম নেই। 'খাঁটি গণতান্ত্রিক দেশ' হিসেবে আমেরিকা আর জাপানের নাম আছে বলে রক্ষা, এই দেশগুলোতে মোটামুটি মানুষের সংখ্যা বেশি, তা না হলে 'খাঁটি গণতন্ত্র' উপভোগকারী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের থেকেও কম হত! আমেরিকা-জাপানকে নিয়ে সংখ্যাটা দশ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে অবশ্য আমার খুবই সন্দেহ। 'প্যালেস্টাইন' নামক ভূখণ্ডে মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার দূরে থাকুক, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার তারা যেভাবে দলিত করে বেড়ায়, তখন গণতন্ত্রের নিজের দেশে গণতন্ত্র উপভোগ করার বিষয়টুকুকে এক ধরনের উৎকট রসিকতা মনে হয়! বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রজেক্ট হাতে নেওয়ার কারণে সেই দেশগুলোর এখন যা অবস্থা, তাতে গণতন্ত্র শব্দটাকে রীতিমতো ভীতিকর বলে মনে হয়। বাইরে থেকে রফতানি করা এই গণতন্ত্রের কারণে শুধু ইরাকেই প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কতটুকু ভেতরে আমরা যেতে পেরেছি আমি জানি না, বলা যেতে পারে বড়জোর কয়েকবার নির্বাচন করেছি। মজার কথা হল, নির্বাচনের পরে সব সময়েই যে দল হেরে গেছে তারা ঘোষণা দিয়েছে এই নির্বাচনে 'কারচুপি' হয়েছে এবং এই নির্বাচনের ফলাফল তারা মানে না। আরও মজার কথা হল, শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়া দল যদি বা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে, তারা কিন্তু কখনওই সংসদে যায় না। ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি ছাড়া সংসদে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। সংসদে হাজির না থাকলে 'সাংসদ' পদ বাতিল হয়ে যাবে বলে দল বেঁধে একদিন সংসদে হাজির হয়েছে, কিন্তু তার বেশি তাদের কাউকে কিছু করতে দেখিনি।

তাই আমাদের দেশে কেউ যখন 'গণতন্ত্র গণতন্ত্র' বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তখন আমার খুব জানার ইচ্ছে করে, তারা কোন ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলছেন। সাংসদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কি গণতন্ত্র? নাকি সাংসদ পদ টিকিয়ে রাখার জন্যে একদিন সংসদে হাজির হওয়া গণতন্ত্র? এইটুকুতেই আমরা খুশি থাকব?

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা নির্বাচনে ভোট দিতে খুব পছন্দ করেন। বেশি ভোট পেয়ে একজন নির্বাচিত হন। যিনি হেরে যান তিনিও কম ভোট পান না। তাই নির্বাচিত সাংসদেরা যখন একেবারেই সংসদে যান না, তারা কিন্তু এই দেশের মানুষের সঙ্গে রীতিমতো বেঈমানি করেন। আমাদের দেশে নির্বাচন, ভোট, গণতন্ত্র এইসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে একদিনও সংসদে না গিয়ে পুরো গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়, সেটা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয় না। কাজেই যখন সবাই গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তখন আমার জানার কৌতূহল হয়, এটা কি শুধু নির্বাচন করে সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া, নাকি তার চাইতে বেশি কিছু?

যদি এটা শুধু সরকার গঠন করা হয়, তখন হঠাৎ করে এই পুরো ব্যাপারটাতে আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। যারা সরকার গঠন করেন তারা কিন্তু দেশ চালানোর 'দায়িত্ব' গ্রহণ করেন না, 'ক্ষমতা' গ্রহণ করেন? আমার মনে হয় শব্দটা যে 'দায়িত্ব', মোটেও 'ক্ষমতা' নয়– সেটা সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

যদি ধরে নিই আমাদের দেশে নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্র, এর থেকে বেশি আশা করা আহাম্মকি, তাহলেও আমার একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এই নির্বাচনে অংশ নেবে কারা?

আমি এক চক্ষু হরিণের মতো, এই দেশের সবকিছুকে আমি একবার হলেও মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার দিয়ে পাঠিয়ে দেখি। বাংলাদেশটা তো এমন নয় যে, এটা গাছে ধরেছিল, একদিন পেকে টুপ করে নিচে পড়েছে আর আমরা তুলে এনেছি। ভয়ংকর একটা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। সেই যুদ্ধে এই দেশের একটি পরিবারও ছিল না যাদের কোনো না কোনো আপনজন হারিয়ে যায়নি। এই যুদ্ধে আমরা টিকে গিয়েছিলাম; কারণ, একাত্তরে আমরা একসাথে ছিলাম, আমরা স্বাধীন একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম।

কেউ কল্পনাও করতে পারবে না আমরা কত বড় সৌভাগ্যবান জাতি যে, মাত্র নয় মাসে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করে এই পৃথিবীতে কত জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কত জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম রিফিউজি ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে, আমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছি?

আমদের এই দেশটির জন্যে এককভাবে অবদান রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের মতো সবাই যারা একাত্তরকে নিজের চোখে দেখেছে তারা সবাই জানে, সেই উত্তাল সময়ে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু আসলে সমার্থক ছিলেন। তিনি হঠাৎ করে উঠে আসেননি। এই দেশে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, কষ্ট করেছেন। আমি সুযোগ পেলেই সবাইকে বলি তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটা একবার পড়ে দেখতে। দেশের জন্যে রাজনীতি করতে হলে একজনকে কত বড় আত্মত্যাগ করতে হয় সেটি এই বইটি পড়লে বোঝা যায়।

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। বাংলাদেশের মাটিতে বাস বাংলাদেশকে অস্বীকার করে যেমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া যায় না, ঠিক সে রকম বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেও এই দেশের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের জন্যে জান কোরবান করে দেওয়া যায় না। খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে শুধু অস্বীকার করেনি, তাঁকে অসম্মান করার জন্যে এমন আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছে যেটি আমার পক্ষে কাগজেও লেখা সম্ভব নয়। যে কোনো রাজনৈতিক দলই ছোট বড় ভুল করে থাকে; কাজেই বিএনপিও যে ভুল করবে না তা নয়। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্য মেনে নিয়ে কিংবা তার পক্ষে সাফাই গেয়ে তারা সম্ভবত রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুলটি করে বসেছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জামাতের সাথে রাজনীতি করে বিএনপি এই দেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে তারা সম্ভবত তাদের কফিন এখন পাকাপাকিভাবে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। এই দলটি এখন কি এই দেশের মানুষের কাছে কোনো সমবেদনা খুঁজে পাবে?

২.

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন দেশের অনির্দিষ্টকালের জন্য 'অবরোধ' চলছে। 'হরতাল' বলতে কী বোঝায় আমরা সেটা মোটামুটি জানি। 'অবরোধ' শব্দটির অর্থ আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু এই দেশের বেলায় 'অবরোধ' বলতে কী বোঝায় সেটা আমি জানি না। শুধু আমি না, আমার ধারণা কেউই জানে না; যারা অবরোধের ডাক দিয়েছে তারাও জানে না। হরতালের আগের রাতে গাড়ি পোড়ানোর, কিছু মানুষ মারার রেওয়াজ আছে। অবরোধের সময় কখন গাড়ি পোড়ানো হবে? হরতাল ডাকতে হয়, যারা হরতালকে সমর্থন করেন তারা ঘর থেকে তখন বের হবেন না, দোকান-পাট খুলবেন না। কিন্তু হরতালের মতো অবরোধ 'ডাকা' যায় না– 'অবরোধ 'করতে' হয়।

এখানে কে 'অবরোধ' করবে ব্যাপারটি পরিস্কার নয়। বিএনপি দেশবাসীকে 'অবরোধ' করতে বলছে। কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত, দেশবাসী গায়ে পড়ে এই দেশের রেলগাড়ি, স্টিমার, লঞ্চ অবরোধ করার জন্যে এগিয়ে যাবে না। কখনও যায় না। অবরোধের কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হবে।

তারা নিজেরা সেই কাজটি কেমন করছে? এখন পর্যন্ত বার থেকে তের জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক শত মানুষ। অসংখ্য গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। ট্রেনলাইনের ফিস প্লেট খুলে ট্রেন ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমার খুবই অবাক লাগে যে, একটি রাজনৈতিক দল ভেবেচিন্তে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় এই কাজগুলো করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে? খবরে দেখেছি, বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে এই কষ্ট সহ্য করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে; দেশের মানুষকে পথে নেমে আসতে বলা হয়েছে; জানানো হয়েছে, সরকার উৎখাত না করা পর্যন্ত এই অবরোধ চলতে থাকবে।

সত্যিই কি এইভাবে একটা সরকার উৎখাত করা সম্ভব? চরম অরাজক একটা অবস্থা তৈরি করার পর দেশে সামরিক বাহিনী নেমে গিয়ে সবকিছু ওলট পালট করে দেওয়া ছাড়া আর কী সম্ভব হতে পারে আমি ভেবে পাই না।

৩.

আমি চুরানব্বই সালে দেশে ফিরে এসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম। যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে ছাত্রদলের ছেলেরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা অনুষ্ঠান, নানা প্রতিযোগিতা, রাজাকারদের দুষ্কর্ম নিয়ে বক্তৃতা-বিতর্ক। ছাত্র শিবির বেঁকে গিয়ে ছাত্রদলের একজনের পায়ের রগ কেটে দিল, একজনের পিঠে চাকু মেরে দিল– আমি নিজে সেই তদন্ত করেছি।

এখন সেই রাজনৈতিক সংগঠন জামাতের সাথে হাত মিলিয়েছে সেই রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে! আমি এই রাজনৈতিক দলের ভেতরের কাউকে চিনি না, কিন্তু তারপরেও আমি বলতে পারি, এই রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধী দলের সহযোগী দল পরিচয়ে বিন্দুমাত্র গৌরব অনুভব করে না। আমি সব সময়েই স্বপ্ন দেখি, এই দেশের সরকারি দল আর বিরোধী দল দুটিই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। দুটি দলই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নেবে। যতদিন সেটি না হচ্ছে ততদিন গণতন্ত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখার কোনো সুযোগ নেই।

৪.

জানুয়ারী ৫ তারিখ এই দেশে সবকিছু নিয়ে এক ধরনের শংকা ছিল। আমি তখন ঢাকায় খবরে নানা ধরনের প্রস্তুতির খবর দেখছি। বালু-ইট বোঝাই ট্রাক, পুলিশ, মিটিং-মিছিলের প্রস্তুতি, দেশের মানুষকে পথে নেমে আমার আহ্বান। বাসে আগুন। ঝটিকা মিছিল।

আমি যেখানে থাকি, তার ঠিক পাশে একটা বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। শ্রমিকেরা কাজ করছিল, সকাল থেকে সেখানে তারা কিছু একটা করছে, ঠক ঠক শব্দে কান ঝালাপালা! কানের কাছে এই বিকট শব্দে আমার বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি বিরক্ত অনুভব করছিলাম না। আমি জানি, এই শ্রমিক সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যেবেলা তার পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, তার স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবে। আমার বিরক্ত হবার অধিকার নেই।

আমার খুব ইচ্ছে করছিল সেই শ্রমিকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, পুরো দেশের এই অবস্থায় তার মনের ভাবনাটি কী?

আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি সে কী উত্তর দেবে। শ্রমিকটি বলবে, আপনাদের দোহাই লাগে, আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন। কীভাবে দেবেন আমার জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমরা শান্তিতে থাকতে চাই।

এই মুহূর্তে এই দেশের মানুষের মনের কথা সম্ভবত একটাই, আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। কীভাবে সেই শান্তি আসবে আমরা জানি না কিন্তু এই দেশের মানুষ হিসেবে এইটুকু চাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আছে।