ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ অর্থনীতির দুর্দশা

গৌতম দাস
Published : 13 March 2011, 03:49 PM
Updated : 13 March 2011, 03:49 PM

বাংলাদেশের কৃষি বা সেই অর্থে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী পুরানো যেসব উৎপাদন সম্পর্কে আটকে গিয়ে খাবি খাচ্ছে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন এর বৈপ্লবিক পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো। সেটা কমবেশি সবারই কথা। কিন্তু কীভাবে ঘটবে সে এক অমীমাংসিত রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্দাররা এ'পর্যন্ত নানান ধরণের "উন্নয়ন নীতি" খাটিয়েছে—বিশ্বব্যাংক গ্রামীণ অবকাঠামো মায় প্রশাসনিক সংস্কারের নামে উপজেলা প্রবর্তন করেছে। তা সত্ত্বেও অভীষ্ঠ সাফল্য প্রমাণে তারা নিদারুণ ব্যর্থ। অর্থনীতির প্রধান ধারায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশকে সামিল করতে পারেনি। রাষ্ট্রের অর্থনীতি বড় অংশের জীবন ছুঁতে সক্ষম হয়নি, ফলে বদলাবার প্রশ্নও নাই। এটাই এই ধরণের অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা। এই ফাঁকা জায়গা পুরণের সুযোগে ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ কেরামতির সুবিধা নিয়ে হাজির হন। সন্দেহ নাই তাঁর আইডিয়া বন্ধক-ছাড়া ঋণ একেবারে নতুন, তবে গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার বিচারে এটা নিতান্তই স্থানীয় উদ্যোগ। আর মনে রাখতে হবে, কোন অর্থেই তিনি বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী নন, চ্যালেঞ্জ করছেন না, কেবল পরিপূরক হওয়া যায় কি না তা পরীক্ষা করতে চাইছেন। গ্লোবাল অর্ডারের দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করে আঘাত করা নয়, বরং একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পেরেছিলেন কি? আজ ২৭ বছর পরে এর ফলাফল কী?

মেঘ যত গর্জায় সে অনুপাতে বর্ষাবে এমন কোন কথা নাই। হয়েছেও তাই। ক্ষুদ্র ঋণের কারবার থেকে ঋণ ভোক্তার মাসিক ব্যয়ের বড়জোর এক তৃতীয়াংশ আসে। ঋণ নিয়ে পরিবারসহ একটা ছোট কারবার সে করে বটে কিন্তু এটা তার মূল পেশা নয়। মূল পেশা প্রচলিত অর্থনীতির 'ইনফরমাল' সেক্টর, রিক্সা চালানো, কামলা দেয়া, ধান কুটে দেওয়া, মুড়ি ভাজা, এক হাট থেকে অপর হাটে বেচাকেনা, পশু পেলে মোটাতাজা বড় করে বেচে দেওয়া ইত্যাদি। এই মাইক্রোক্রেডিট নিজেই বলছে সে মাইক্রো, ক্ষুদ্র। এতই ক্ষুদ্র তার উপর আবার সুদের হারের দিক থেকে এতই বড়সড় যে প্রচলিত অর্থনীতির 'ইনফরমাল' সেক্টর থেকে কারও পেশা বদলে দেয়া যায় এমন পেশা তাকে দিতে পারেনি, পারার কথাও না। আর শ্রমদক্ষতা? শ্রমকে দক্ষ করে তোলা, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়ে উঠা? বাজার, টেকনোলজি? "মাইক্রোক্রেডিট" চিন্তা-সীমার ভিতরে এসবের জবাব চাওয়া নিরর্থক, আর পাওয়াও অসম্ভব। এটাকে বলে ধুঁকে ধুঁকে মরার জীবন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ছেচড়ে ছেচড়ে চলা। কৃষিতে দ্রুত পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ এটা নয়, বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথ তো কোনোভাবেই নয়।

বন্ধক-ছাড়া ঋণ কীভাবে দেয়া যায় এনিয়ে কেউ নতুন চিন্তাভাবনা, মাঠের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই পারেন। ডঃ ইউনূস একাডেমিক ডক্টরেট ও শিক্ষক মানুষ; পুঁজির কোন রূপটা কৃষিকে গতিশীল পুজিঁতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের দিকে নিয়ে যায় এটা তিনি জানেন না বলা অসমীচীন। কিন্তু ডঃ ইউনূস সম্ভবত কোলাটেরাল আর ক্ষুদে ঋণ নিয়ে একধরণের অবসেশনের জায়গায় চলে গিয়েছেন। ফলে তাঁর ভাবনা এবং কাজে গ্রামীণ অর্থনীতিক উন্নয়নের একমাত্র মন্ত্র হয়ে গেছে সুদী বা ব্যাংক-পুঁজি। কিন্তু পুঁজিতন্ত্রের অআকখ বলে, পুঁজির সবচেয়ে অগ্রসর ও সম্ভাবনার দিক যেটা উৎপাদক পুঁজি, সেই উৎপাদক পুঁজির জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক হলো সুদী-পুঁজি। মাইক্রোক্রেডিট বা সেই অর্থে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে পলিসি থেকে খাতক পর্যন্ত কোথাও উৎপাদন কোন ইস্যু নয়। পুঁজি প্রডাকশন বা উৎপাদন পুঁজি হলো কি হলো না, কী শর্তে হওয়া সম্ভব সেসব মাইক্রোক্রেডিটের চোখে কোন আলোচ্য বিষয় নয়, সমস্যাও নয়। কারণ, এটা সবটাই সুদী পুঁজির এক কারবার। সুদীপুঁজির কাছে ক্ষুদে খাতককে দেয়া টাকা মোটা সুদসহ ফেরত আসছে কী না এটাই সাফল্য মাপার মাপকাঠি।

আর এই পথে বিদেশী মাঙনা অনুদান বা নামমাত্র সুদে পাওয়া টাকা খাটিয়ে ৩৫-৪৫% সুদের ন্যায্যতা কী? বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়েও দেড়-দুই গুণ লাভে এই কারবার চলছে। কৃষি বা গ্রামীণ জনজীবনকে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে অগ্রসর করার বদলে এটা স্রেফ লুটপাটই হয়ে উঠার কথা। আর তাই আমরা দেখছি। এভাবে লুটপাট এতটাই লোভনীয় হয়ে উঠেছে যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কারবারী পুঁজি মাইক্রোক্রেডিট ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ভারতের এক বাণিজ্যিক কোম্পানী (SKS Microfinance) এই ব্যবসা-মডেলে ঝাপিয়ে পড়েছে। সবচেয়ে মজার এক তথ্য হলো, আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটের হেজ ফান্ড লুটেরা JP Morgan Chase, Morgan Stanley, ও ভারতের ICICI Prudential and Reliance Mutual Fund ইত্যাদি বিনিয়োগ ব্যবসায়ীরা SKS এর আইপিও কেনার জন্য নড়েচড়ে বসেছে। এই তথ্যের বিপরীত তথ্য হলো, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ঋণগ্রস্থ কৃষকের আত্মহত্যার মহামারী। এসব দেখে শুনে ড. ইউনূস নিজেকে আলাদা করে বাঁচাতে এক আর্টিকেল লিখেছেন। শিরোনামে নিজেই ক্ষুদেঋণের হাঙর হয়ে যাওয়া স্বভাবের কথা স্বীকার করেছেন।

http://muhammadyunus.org/Yunus-Centre-Highlights/from-microcredit-to-loan-shark/
তবে ভিতরে দিব্যি দিয়ে লিখছেন তাঁর মডেলের পুর্বশর্ত হলো—এটা গ্রামীণ ব্যাংক বা এনজিও চেহারায় রেখে চালালে সেটা শুদ্ধ হবে। আর দাবী করেছেন ২০-২৫% এর বেশি সুদ হওয়া উচিত না। কিন্তু ২০-২৫% সুদই বা কীভাবে গ্রহণযোগ্য এর কোন ব্যাখ্যা আমরা দেখিনি। আর মাঠের অভিযোগ বলছে সুদ ২০-২৫% এ সীমিত নয়। আগেই বলেছি উৎপাদক পুঁজির জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক সুদী-পুঁজি বা ব্যাংক পুঁজি। ফলে কোন অর্থনীতিতে সুদীপুঁজির সুদের হার বা লাভ যদি কারখানা বা উৎপাদক পুঁজির চেয়ে বেশি ও লোভনীয় হয় তবে সবাই সেদিকেই ছুটবে; এই অবস্থায় পুঁজি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের রূপ নিতে সহজে সক্ষম হবে না, অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় প্রাধান্য পাবে সুদী বা মহাজনী পুঁজি। পুঁজিতান্ত্রিক যাত্রাপথ ছেঁচড়িয়ে কষ্টদায়ক দীর্ঘ হামাগুড়ি দিয়ে চলায় আবর্তিত হবে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ৩৫-৪৫% সুদের রীতিমত মচ্ছব চলছে। খুঁজলে দেখা যায় গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও আশা, প্রশিকা, টিএমএসএস টাইপের যেসব মাইক্রোক্রেডিট ব্যবসায়ী আছে এদের হাতে ২০-৫০ হাজার কোটি টাকার মত নিজস্ব বিনিয়োগ তহবিল তৈরি হয়েছে। এখন অন্যান্য ব্যবসায়ও তারা নামছে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জগতে কোন ব্যবসায়ী সারা জীবন ব্যবসা করে এমন সম্পদের মালিক বা বিনিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন নি। কিন্তু মাইক্রোক্রেডিটের মহিমা এমনই। উৎপাদনে যাবার চেয়ে এদেশে মাইক্রোক্রেডিটের ব্যবসা লোভনীয়। ফলে জাতীয় উৎপাদন বাড়তে সহায়ক উৎপাদক পুঁজির প্রাধান্যশীল হবার কোন কারণ ঘটছে না। মজার ব্যাপার হল, আবার মাইক্রোক্রেডিটের ব্যবসায়ীরা হাতে গচ্ছিত এই বিপুল কাঁচা টাকা কোথায় বিনিয়োগ করে সম্পদ ধরে রাখবে সেই চিন্তায় অস্থির। বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি খুলেও তাদের শান্তি হচ্ছে না। এদের এই অর্থ স্বভাবতই নিজেই এক কোটারী সামাজিক ক্ষমতা তৈরি করেছে। এই ক্ষমতা খাটিয়ে সব এনজিও মালিকানা ব্যবসা ট্যাক্স মওকুফ সুবিধার ব্যবস্থা করে নিয়েছে । সাইফুর রহমান অনেক হুমকি ধামকি দিয়ে বাজার গরম করেছিলেন কিন্তু কিছু করতে পারেন নি। হাসিনা মাইক্রোক্রেডিটের সুদের হার নির্ধারণ করে দিবেন বলে কমিটি করেছিলেন দুবছর আগে।

মাইক্রোক্রেডিটের ব্যবসায়ীদের সাথে দীর্ঘ দরকষাকষির পর গত সপ্তাহে এই সুদের হার ২৭% বলে রফামূলক সিদ্ধান্তে তিনি এসেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাপিয়ে এক স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছে মাইক্রোক্রেডিট দৈত্য। শেখ হাসিনার নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধ দেখা দিলেও এই দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ কিম্বা মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাঁর কতটুকু?

বিশ্বব্যবস্থার মুখরক্ষা ও নোবেল বর্ষণের রাজনীতি
দুনিয়াব্যাপী ছেয়ে বসা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের শেষ নাই। এই সঙ্কট মাঝে মাঝে ঘন হয়ে আসে কিন্তু কখনই কমে না। এই সঙ্কটের সমাধানে কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক খাটাখাটনি করতে এগিয়ে আসলে, ছোটখাট সাময়িক সমাধান বাতলাতে পারলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার রথী মহারথীরা তাঁর বৈশ্বিক কদরের ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লাগে। এছাড়া দুনিয়ার আর কোন ধরণের বুদ্ধিবৃত্তি এদের কাছে কদর পায় না। এই হলো সাধারণ নীতি। নোবেল কমিটিও এই নীতি অনুসরণ করে। নোবেল সাহেবের ইচ্ছা ছিল মানবকল্যাণে কারও উল্লেখযোগ্য অবদানকে পুরস্কৃত করা; আর সে লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল নোবেল ফান্ড। অথচ পুঁজিতন্ত্রের সঙ্কট-স্বার্থে কে অবদান রাখতে পেরেছে তাকেই বরমাল্য দেয়ার রেওয়াজ চালু করে ফেলেছে নোবেল কমিটি। আর মানবকল্যাণ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এখানেই থেমে নাই, নোবেল 'শান্তি পুরস্কার' নামে নতুন এক ক্যাটাগরি চালু করেছে যেটা আরও ভয়ঙ্কর। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থে যে ভূমিকা রাখে তার ভাগ্যে 'শান্তি পুরস্কারে'র বরমাল্য জোটে। এটা রাজনৈতিক বিবেচনার পুরস্কার। ফিলিস্তিনকে ক্যাম্প ডেভিডে দাসখত চুক্তি করাতে সক্ষম হওয়ায় ইসরাইলের কুখ্যাত প্রধানমন্ত্রী মেনাখিম বেগিন 'শান্তি পুরস্কারে' মনোনীত হন। আজতক ফিলিস্তিনবাসী শান্তির ছিটেফোটাও দেখেনি, ইসরাইলের হত্যালীলাও থামেনি। আরব জনগণসহ দুনিয়ার কেউ ঐ চুক্তিতে শান্তি এসেছে মনে করতে পারে না। বাস্তবতার সাথে 'শান্তি পুরস্কার' মনোনয়ন সবসময় এরকম বিপরীত অবস্থানে থাকে।

ক্লিনটন দম্পত্তি ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিটকে জাতে তুলতে নোবেল কমিটিতে সুপারিশ পাঠিয়েছিল। মাইক্রোক্রেডিটের ভূমিকা বিবেচনায় ইউনূস সাহেবকে যদি মনোনীত করতেই হয় তবে তা হতে পারতো অর্থনীতিতে নোবেল। কিন্তু ইউনূস সাহেবের ভাগ্যে উঠেছে সান্ত্বনার 'শান্তি পুরস্কার' । পুঁজিতন্ত্র সবসময় যেসব গভীর সঙ্কটে থাকে সেই মহীরুহ সমস্যা বিচারে মাইক্রোক্রেডিটকে কোন "কাজের জিনিষ" তারা মনে করেনি। কিন্তু মহারথীদের চাপাচাপির কারণে রাজনৈতিক বিবেচনার শান্তি পুরস্কারটাই ইউনূস সাহেবের জুটেছে। তো, মাইক্রোক্রেডিটের সাথে শান্তির সম্পর্ক কী? এর জবাব নাই। ক্যাম্প ডেভিড দাসখত চুক্তির মত কবরের শান্তির ঘটনাও এটা নয়। বিশ্বজনমত বা বাস্তবতার সাথে 'শান্তি পুরস্কার' মনোনয়ন এখানেও সম্পর্কহীন। মাইক্রোক্রেডিট বাংলাদেশে শান্তি এনেছে এমন কোন জনমত মাঠে নাই। থাকার কথাও না।

'নতুন দক্ষিণ এশিয়া নীতি এবং আঞ্চলিক বিন্যাস
সুশীল চিন্তার লক্ষ্য রাষ্ট্রের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তার বিলয় ঘটিয়ে একে পৌরসভা বানানো। সমাজে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দল ছেড়ে সুশীল ক্ষমতা তৈরি করা। সম্প্রতি এই ভাবনাকে গুছিয়ে বলতে হিলারী ক্লিনটন আমেরিকার ফরেন পলিসি জার্নালে বিভিন্ন দেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতদের নতুন কর্তব্য করণীয় নিয়ে লিখেছেন – রাজনৈতিক সংগঠন নয়, ওসব সমাজের সামাজিক সংগঠন, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল উদ্যোগগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া ও সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করার দিকে মনোযোগ দেয়া তাদের কাজ। (দেখুন, "Leading Through Civilian Power" by Hilary R. Clinton in Foreign Affairs, Volume 89, Number 6, November/December 2010.) কাজেই ১/১১ ধরণের সরকার যে তাদের প্রধান পছন্দ সে নীতির কথা পতাকা উড়িয়ে ঘোষণা করা হয়েছে, এটাই বর্তমানে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি।

কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যের বিপদের শেষ নাই,সাম্রাজ্য চালানো সহজ কথাও নয়। ২০০৭ সালে ১/১১ কায়েম করা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ঐ একই বছর আমেরিকান ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিল (NIC) পুর্ণাঙ্গ রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। ২০০১ সাল থেকেই বাতাসে শোনা যেতে শুরু করে যে বিশ্বক্ষমতার কাঠামোয় ওলটপালট আসন্ন হয়ে উঠছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমে অর্থনৈতিক এবং তার পিছুপিছু হাত ধরাধরি করে সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কয়েকটা শক্তি। বাতাসে ভাসা অনুমান না, সেসবের সরেজমিন অনুসন্ধানে নিয়োজিত হয় আমেরিকান ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিল। এই প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে কী কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন দেয়। (আগ্রহীরা দেখুন, http://www.dni.gov/nic/PDF_2025/2025_Global_Trends_Final_Report.pdf) মার্কিন সাম্রাজ্যের জন্য বিপজ্জনক সব ফলাফল বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। পশ্চিম থেকে বিনিয়োগ পুঁজি ছুটছে এশিয়ার দিকে, যার মোড় ফেরানো অসম্ভব। সস্তা শ্রমের দরকারে; বিশেষত চীন ও ভারতের দিকে, ওদিকে ব্রাজিল ও ভিয়েতনামের দিকেও। আগামী দিনের গ্লোবাল অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে যাচ্ছে এরা। যার শীর্ষে রয়েছে চীন। মার্কিন সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের হলো চীনের উত্থান। এটা আবার দুমুখী। একদিকে আমেরিকান বিনিয়োগ পুঁজির ভরসাস্থল ও জীবিত থাকার উপায় চীন। আবার এই ফুলে-ফলে ভরা উত্থিত চীন আমেরিকার জন্য দুনিয়ায় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ভাগীদার ও সামরিক বিপদও বটে। এই পরিস্থিতিতে চীনের লাগাম টেনে ধরা যায় কি না, কীভাবে – সে আয়োজন চূড়ান্ত করতে নীতিনির্ধারকরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে লেগে পড়ে। হাতের কাছে অতি-উৎসাহী ভারতকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতা-ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ আবার পররাষ্ট্রনীতিতে এই সিদ্ধান্তের উপাদান যুক্ত করে নতুন আকার দেবার কাজ। ফরেন এফেয়ার্সের তৎকালীন আন্ডার-সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস এর কারিগর হয়ে উঠেছিলেন। গুরুত্ব বিচারে তিনি রাষ্ট্রের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত প্রতিবেশী অঞ্চলকে যেভাবে নিজের অনুকূলে সাজাতে চায় সেভাবে ভারতের চোখ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গেই নিজের স্বার্থ এক করে দেখবার নীতি গ্রহণ করে। ফলে, আমাদের মত দেশকে চ্যাপ্টা করে কাজ করিয়ে নেবার যে লিভার বা যাঁতাকাঠি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে তাকে ভারতের অনুকূলে ব্যবহার করবে। এসব শর্তে তাদের রফা হয়। একাজগুলো লুকিয়ে ঘটে নাই। থিঙ্কট্যাঙ্ক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের আয়োজনে নীতি বিষয়ক আলোচনায় এগুলোর বনিবনা হয়।

এখন বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে করিডর, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি এককথায় ভারতের উঠতি অর্থনীতির বিস্তারের যা কিছু খিদা তা বাংলাদেশকে পূরণ করতে হবে কোন বিনিময় ছাড়াই। ওদিকে ভারতের সাউথ ব্লকের আবার সুশীল সরকার ঠিক পছন্দের না, বিশেষ করে ইউনূসকে। বন্দরসহ বিবিধ বিষয়ে তিনি মার্কিন স্বার্থের ঘেঁটু হয়ে আছেন। সেটা সরবে প্রচারও করেছিলেন। এসব মিলিয়ে তখন যা দাঁড়ায় তাতে রাজনৈতিক দল-নির্ভর বিবেচনা আবারও হালে পানি পায়— সেইসূত্রে আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের রফা, ও শেখ হাসিনা সরকারে আসীন। আসলে ভারতের চাহিদার রফা হতে যাচ্ছিল হাসিনা বাদে এক আওয়ামী লীগের সাথে, শেষ মুহূর্তে হাসিনার উদ্যমী চেষ্টায় তা হয়ে দাঁড়ায় হাসিনার কর্তৃত্বে এক আওয়ামী লীগ কিন্তু শর্ত একই, ভারতের চাহিদাপত্র যা ছিল তাই পূরণ করতে হবে।

উপরের এসব ঘটনা ঘটে বুশের শেষ আমলে ওবামা আসার আগে। ওবামা আমলে এসে প্রধান এজেন্ডা হয় কাহিল অর্থনীতি, ইরাক আফগানিস্তানের যুদ্ধের ধাক্কা মিটানো ইত্যাদি বিপদ থেকে উঠে দাঁড়ানো। ফলে সাব্যস্ত হয়, গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হল "এখন সহনীয় তালেবান" খুঁজে আফগানিস্তানকে তাদের হাতে দিয়ে পালানোর রাস্তা বের করা। একাজে পাকিস্তানের চেয়ে ভাল অবলম্বন দ্বিতীয় নাই। ফলে যেই যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল কিয়ানীকে গুরুত্ব দিয়ে কাছে টেনে নিতে কদম ফেলায় ভারত রেগে আগুন হয়ে যায়। সাধারণত পাকিস্তানী নেতাদের ওয়াশিংটনে ডেকে নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু এবার সামরিক চীফ কিয়ানীর বেলায় ঘটে উল্টা। সরাসরি পাকিস্তানের কাছাকাছি ঘাটে যুদ্ধজাহাজ ভিড়িয়ে সেখান থেকে নিজেরা পাকিস্তান উড়ে গিয়ে কথা বলা। এছাড়া ভারতের রাগার বড় একটা কারণ, ইরাক-আফগানিস্তান থেকে বের হবার ফর্মুলা ঠিক করার সময় যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে রাখে নাই; আগাম শলাপরামর্শও করে নাই। সরাসরি এবং কেবল পাকিস্তানকে নেয়া, সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় নিরাপত্তা নীতি ভারতের চোখ দিয়ে দেখার কবুলিয়তনামার এটা বড়সড় বরখেলাপ। এতে এখনই সব ভেঙে গেল–ব্যাপারটা ঠিক তেমনও না। তবে, ভারতের দিক থেকে "দেখি ওবামা তুমি কীভাবে কী কর, আমি কিন্তু অসন্তুষ্ট"—এরকম হয়ে আপাতত ঝুলে আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে রাজনৈতিক দল বাদ, সুশীল হলো আসল ভরসার জিনিষ—এই মৌলিক লাইনে কোন বদল হয় নাই। ভারতের স্বার্থকে জায়গা করে দিতে গিয়ে মাঝে সাময়িক কিছু অদলবদল ঘটাতে হয়েছিল মাত্র। হিলারীর লিখে বলা কথা সে ইঙ্গিত দেয়। হাসিনার ইউনূসকে বের করে দেয়া দেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিক্রিয়াও সেই ইঙ্গিতকে জোরালো করেছে।

এক বনে দুই বাঘ থাকলে অসুবিধা। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের মনে কোন পরিকল্পনা থাক বা না থাক, বেস্ট ক্যান্ডিডেট ইউনূসের মাজা ভেঙে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।

এখন বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য এটা নেহায়েতই নোবেল বিতর্ক না যে নোবেল হাসিনার পাওয়ার কথা আর ইউনূস কেন পেল! এটা মাইক্রোক্রেডিট হ্যাঁ আর ইউনূস না—এমন সরল বিচারও না। তবু পাঠক যার যেমন পছন্দ: কেউ ইউনূসকে বের করে দেয়া সমর্থন করবেন, কেউ মনে করবেন ঠিক হয় নাই। হতে পারে কারো কাছে কারণটা নৈতিক কারো কাছে কৌশলগত। কিন্তু এর ফলে আমাদের রাজনীতি কোনদিকে গড়াবে আমরা এখনই তা বলতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ একটা অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তির বিদ্যমান যে সমাবেশ তা বদলে নতুন কোন মেরুকরণ ঘটবে কিনা সেটাই এখন দেখার পালা।

গৌতম দাস: অনুবাদক,  প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।