সংলাপ নয়, দরকার মনোজগতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 11 Jan 2015, 05:32 AM
Updated : 11 Jan 2015, 05:32 AM

'দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনার বিকল্প নেই', 'বড় দু'দলকেই ছাড় দিতে হবে', 'সমঝোতায় আসতেই হবে'– এ জাতীয় আহ্বান জানাচ্ছে সবাই। বিশেষ করে সুশীল সমাজ নামে নাগরিকদের একটি অংশ সুযোগ পেলেই আলোচনার কথা বলে। আলোচনা কেন? কাদের মধ্যে সমঝোতা? সবাই বলছে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে আলোচনা। কারণ এ দুটি দল দেশের পঁচাত্তর ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। তারাই দেশের মালিক। তারা বসেই ঠিক করবে জনগণের ভাগ্য।

অতীতে বহুবার আলোচনা হয়েছে। গত বিশ বছরে আমরা দু'দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য কমনওয়েলথ মহাসচিব ও জাতিসংঘের মহসচিবের দূতের দূতিয়ালি দেখেছি; দু'দলের মহাসচিব পর্যায়ে দিনের পর দিন সংলাপ দেখেছি; সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দূতিয়ালিও দেখেছি। কোনো আলোচনাতেই কাজের কাজ কিছু হয়নি।

যদি খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখি যে, শিগগিরই আওয়ামী লীগ সব ভুলে গিয়ে, 'মহান' হয়ে বিএনপির সঙ্গে নিঃশর্ত আলোচনায় বসছে, শুধু নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য ওই আলোচনা কি আদৌ দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আনবে? এর জবাব 'হ্যাঁ' সূচক হওয়ার কারণ দেখি না। জাতির দুর্ভাগ্য, তেতাল্লিশ বছরেও একটি স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। কারণ রাজনীতিবিদরা তা চাননি। আরও এক ধাপ এগিয়ে যদি ভাবি, আলোচনা করে একটি স্থায়ী নির্বাচন পদ্ধতি বের করা গেল– সেটি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, নির্দলীয় ব্যবস্থা, সর্বদলীয় ব্যবস্থা বা একটি কার্যকর শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অথবা নতুন কোনো পদ্ধতি– কিন্তু এরপর কী?

যেহেতু সমঝোতার মাধ্যমে বের হওয়া একটি পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হবে, আমরা ধরে নিতে পারি যে, সেটি হবে অংশগ্রহণমূলক। সব দল তাতে অংশ নেবে, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতসহ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তার তথাকথিত বাম মিত্র অথবা বিএনপি ও তার ধর্মান্ধ ও যুদ্ধাপরাধী মিত্র অথবা সাবেক সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদের দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি সরকার গঠন করতে পারে। কিন্ত এরপর? সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

যদি ধরে নিই, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিএনপি-জামাত ২০ দলীয় জোট ক্ষমতায় এল। আরও যদি ধরে নিই, ২০০১ সালে তারা ক্ষমতায় এসে যেভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, তা এবার করবে না। তারেক রহমান সুবোধ বালকের মতো আচরণ করবেন। ২১ আগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। জঙ্গিবাদে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দিবে না। আর আওয়ামী লীগও সংসদে গিয়ে গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হবে? যুদ্ধাপরাধীরা তো মন্ত্রী হবে। নিশ্চয়ই তাদের বিচার স্থগিত বা বন্ধ হয়ে যাবে। জামাত ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে এমনটা পাগলও ভাববে না। অন্য সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও, এই এক ইস্যুতেই তো আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে বের হয়ে যাবে। শুরু হয়ে যাবে আন্দোলন। আবারও পুরোনো দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে।

যদি ধরে নিই আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এল। সবগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষভাবে চলল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো কিছুই ব্যবহার করা হল না। ছাত্রলীগের কর্মীরা সবাই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া শুরু করল। শেখ হাসিনা কি ১৫ আগস্টের ক্ষত ভুলে যাবেন? ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা মনে রাখবেন না? তিনি কি বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে গালি না দিয়ে থাকতে পারবেন? সব কিছু সুস্থিরভাবে চললেও বিএনপি কি নিয়মিত সংসদে যাবে? ইতিহাস অন্তত সেই সাক্ষ্য দেয় না।

এক নজরে দেখে নেওয়া যাক আমাদের জাতীয় সংসদ আর তা বয়কটের ইতিহাস। প্রথম সংসদ নির্বাচন হল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে সে সংসদের যাত্রা থামানো হল। সামরিক শাসনের মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হল ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আবারও সামরিক শাসন জারি করে দ্বিতীয় সংসদ বাতিল করা হল।

সামরিক শাসনের মধ্যে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন হল ১৯৮৬ সালের ৭ মে। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করল। বিরোধী দল, আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন হল ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। বড় কোনো দলই তাতে অংশ নেয়নি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হল ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করল। ১৯৯৫এর ২৪ নভেম্বর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি ছাড়া কোনো দলই তাতে অংশ নিল না। দেড় মাসের মাথায় ওই সংসদও ভেঙে দিতে হল।

তার মানে, ১৯৯৫ পর্যন্ত ছয়টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। কিন্তু, এরপর সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ পূর্ণ মেয়াদে ছিল। বর্তমান দশম সংসদ বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট বয়কট করেছে।

লক্ষ্য করার বিষয় হল, দশটি সংসদের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে শুধু পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ গঠনের সময়। এই চারটি সংসদ নির্বাচনই হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর এই চারটি সংসদ ছিল কমবেশি সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হল– সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রার মাধ্যমে। প্রশ্ন হল, এই গণতন্ত্রের চেহারা কি খুব সুখকর?

আমরা দেখলাম স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়েছে, ১৯৯৪ সাল থেকে সেভাবেই আবারও আন্দোলন হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ আর মানুষের মৃত্যু চলছেই– বিশ বছর আগে যে রকম ছিল এখনও সে রকমই চলছে।

আর যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হয় সেই নির্বাচনের পরবর্তী অবস্থাটা কী রূপ?

পঞ্চম জাতীয় সংসদের কার্যদিবস ছিল ৪০০ দিন। আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। এর মধ্যে তারা সংসদ বর্জন করেছে ১৩৫ দিন। শতকরা হিসাবে তা ৩৪ শতাংশ। সপ্তম জাতীয় সংসদের ৩৮২ কার্যদিবসে বিরোধী দল বিএনপি বয়কট করেছে ১৮৩ দিন। অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ। অষ্টম জাতীয় সংসদে ৩৭৩ কার্যদিবসে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে বয়কট করেছে ২২৩ দিন যা ৬০ শতাংশ। আর নবম সংসদে ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৩৪২ দিনই বিরোধী দল বিএনপি সংসদে যায়নি যা ৮২ শতাংশ। নবম সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংসদে গিয়েছিলেন মাত্র ১০ দিন।

এই ধারা এতটাই উর্ধ্বমুখী যে সংসদ বয়কট ১০০ ভাগে পৌঁছাতে আর বাকি নেই। যে সংসদে ৮২ ভাগ দিনই বিরোধী দল বর্জন করে– শতকরা হিসাবে ২ দিন বিরোধী দলীয় নেতা সংসদে যান– সেই সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই কী আর না হলেই বা কী? এতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসার কারণ নেই। ওই রকম একটা নির্বাচনের জন্য গত বছর ৫০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে। আগুনে পুড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।

শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থাই নয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে জাতীয় ইস্যুগুলোতে শুধু একমত হলেই হবে না তাদেরকে এমন একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কথা দিয়ে কথা না রাখলে শাস্তি নিশ্চিত হবে। জেনারেল এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় কিছু ইস্যুতে একমত হয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করেছিল, যা 'তিন জোটের রূপরেখা' নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর এটা ঘোষণা করার দু'সপ্তাহের মধ্যে এরশাদকে বিদায় নিতে হয়েছে। এরপর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে রূপরেখার কথা মনে রাখেনি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিন জোটের রূপরেখা হয়ে গেছে 'ইতিহাস'!

তাই শুধু আংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই নয়, নির্বাচন পরবর্তী সরকারের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে সেটির রূপরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা না গেলে যত আলোচনা বা সমঝোতাই হোক না কেন, রাষ্ট্রের চেহারায় পরিবর্তন আসবে না।

গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে অবাধ নির্বাচনের পাশাপাশি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে থাকতে হবে সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে। দুর্নীতি দমন কমিশন আগের সরকারের দুর্নীতিই শুধু নয়, বর্তমান সরকারের দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধান করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করবে। বিচার বিভাগে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এমন কাউকে বসানো যাবে না; বিচারক নিয়োগ নীতিমালা থাকতে হবে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন হবে নিরপেক্ষ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। প্রশাসনে দলীয়করণ বলতে কিছু থাকবে না; পুলিশ চলবে স্বাধীন কমিশনের অধীনে যা জবাবদিহি করবে সংসদের কাছে, আসামি ধরার সময় তারা রাজনৈতিক পরিচয় দেখবে না, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।

এ রকম আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক, যুদ্ধাপরাধ, জাতির ইতিহাস ইত্যাদি ইস্যুতে কোনো রকম বিতর্ক চলবে না।

উল্লিখিত ইস্যুগুলোতে একমত না হতে পারলে কোনো নির্বাচনেরই মানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো একটা বৈধ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে পারবে, কিন্তু রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা প্রান্তিকই থেকে যাবেন।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এত সব ইস্যুতে কি একমত হওয়া আদৌ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষে সম্ভব? দেশের অধিকাংশ মানুষই বলবেন, সম্ভব নয়। তাহলে এ সংকটের সমাধান কি নেই? আমি অন্তত অদূর ভবিষ্যতে সমাধান দেখছি না। বিএনপির দাবির প্রেক্ষিতেই হোক অথবা দেশি-বিদেশি চাপে বা সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হোক– এখন সংলাপে সমঝোতা হলে সেটি হবে আপাতত সমাধান। এতে কল্যাণ রাষ্ট্র হবে না।

যত দিন আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মনোজগতে বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন না আসবে তত দিন অন্তত এই মানুষ-মারার রাজনীতি বন্ধ হবে না। আর তা চাইলেও একদিনে হবে না। তত দিন ধরে পেট্রোলের আগুনে আমরা পুড়তেই থাকব।

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।