প্রাণঘাতী কর্মসূচি আত্মঘাতী রাজনীতি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 9 Jan 2015, 09:26 PM
Updated : 9 Jan 2015, 09:26 PM

রাজনীতিতে চলছে ব্লকেজ-অবরোধ, হরতাল; জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর; লাঠি-গুলি, টিয়ার গ্যাস; মৃত্যু, রক্তপাত; হানাহানি, সংঘাত। জাতীয় রাজনীতিতে বড় দুই দল জনগণকে জিম্মি করে একে অপরের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধ চালাচ্ছে। এই খেয়োখেয়ির শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট একের পর এক মারমুখী কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। সরকারও শক্তিপ্রয়োগ আর দমন-পীড়ন নীতি অনুসরণ করছে। সাধারণ মানুষ বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হচ্ছে, কিন্তু কোনো পক্ষকেই সমর্থন করছে না। কেননা, দু'দলের রাজনৈতিক বিবাদে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। সরকার হঠানোর ইস্যু তাদের মোটেও স্পর্শ করতে পারছে না। তারা বুঝে গেছে, রাজনীতির রাস্তা তাদের ঘর থেকে অনেক দূরে। তারা কীভাবে বেঁচে আছে তা নিয়ে কেউ ভাবে না। দু'বেলা দুটো ভাত আর মাথার ওপর একটা ছাদ, এইটুকুই তো চাই। কিন্তু চাইলেই বা দিচ্ছে কে?

রাজনীতিকরা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাইছে, মানুষের পাশে নয়। মানুষও তাই রাজনীতিকে অবজ্ঞা করছে। দলের দলাদলি, যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা দখলে রাখা ও ক্ষমতা দখলের মরিয়া চেষ্টা, নির্লজ্জতা দেখে মানুষ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। হরতাল-অবরোধে খেটে খাওয়া অনেক মানুষের কাজকর্ম, উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। আর উপার্জন বন্ধ হওয়া মানে তো সংসার নিয়ে পথে বসা। শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাই সরকার পতনের আন্দোলন অর্থহীন।

মানুষের ভাবনায় চলমান এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তারা ব্যারিকেড, ব্লকেজই শুধু ডাউনলোড করছে। আপলোডের বেলায় অষ্টরম্ভা! রাজনৈতিক হানাহানি কবলিত জীবন বর্তমানে যন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে। বুদ্ধিও ধার করছে যন্ত্রের কাছে, ছিটেফোঁটা মৌলিকতা নেই। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং একে বলেছেন, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, সংক্ষেপে 'এ আই'৷ তাঁর বক্তব্য: ''দ্য ডেভেলপমেন্ট অব ফুল আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স কুড স্পেস দ্য অ্যান্ড অব দ্য হিউম্যান রেস।''

অর্থাৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তি মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। নৈকট্যের জায়গায় তৈরি করছে দূরত্ব। যাদের আছে, তারা খুশি হচ্ছে 'নেইদের' দিকে তাকিয়ে। রাজনীতিকরা তাই নিজেদের বাঁচাতে মানুষকে বাঁচানোর কথা ভুলছে।

আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে এখন যা করছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে একই কাণ্ড বিএনপি করেছিল যখন তারা ক্ষমতায় ছিল। ফাউ হিসেবে ছিল বোমা-গ্রেনেড-গুলি-জঙ্গি ব্যবহার করে আওয়ামী নেতাদের হত্যা করার চেষ্টা! বেগম জিয়ার কার্যালয়ে বালুর-ট্রাক ফেলে রাখা, গেটে তালা দেওয়া অবশ্যই ঘৃণ্য– তবে শেখ হাসিনাকে প্রাণে মেরে ফেলার বিএনপির যে চেষ্টা ছিল, তার চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো!

বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি পুরোটাই শক্তি ও কৌশল নির্ভর। শক্তি ও কৌশল দিয়ে কোনো মতে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করা, অন্যকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য আবারও শক্তি ও কৌশলের ব্যবহার– এসবই চলছে। জনগণ, দাতাগোষ্ঠী, জনমত– আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে এগুলোর পাঁচ পয়সার মূল্য নেই। শক্তি ও কৌশল দুদিক থেকেই বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এগিয়ে। ভীরু, মেরুদণ্ডহীন, সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি গ্রহণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ বিরোধী দলের নেতৃত্ব যতই অবরোধ-হরতাল দিক, লাভ হবে বলে মনে হয় না।

৫ জানুয়ারি সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। প্র্রতিদিন যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে, পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হচ্ছে, পুলিশের ওপর হামলা চলছে। পুলিশও আন্দোলনকারীদের প্রতি সহিংস হচ্ছে। দেশজুড়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি নৈরাজ্যপ্রবণ। বিরোধী দলের আন্দোলন মানেই হচ্ছে নৈরাজ্য। তা সে জনসভা, অবরোধ কিংবা হরতাল যা-ই হোক। এই আন্দোলন কর্মসূচিতে ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াও-বোমাবাজি মানুষ খুন নিয়মিত ঘটনা।

এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও চণ্ড এবং সুবিধাবাদীর। যখন যাকে ধরা 'প্রয়োজন' ধরা হচ্ছে, আবার 'প্রয়োজন' না হলে ধরা হচ্ছে না। প্রকৃত বোমাবাজ হামলাকারীকে ধরা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া– এসব ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা বা আগ্রহ দেখা যায়নি। ছোটখাট ঘটনাগুলোর কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল, ২০১২ সালে যখন জামায়াত-বিএনপি জোট আন্দোলনের নামে পাইকারি হারে জ্বালাও-পোড়াও-পেট্রোল বোমা হামলা, খুনের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল, সেই ঘটনাগুলোর নেপথ্য নায়কদের কয়জনকেই বা ধরা হয়েছে? বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে?

দেশবাসীকে জিম্মি করে প্রাণঘাতী এই হরতাল-অবরোধ ডাকার অধিকার নিয়েও গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ আছে। মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক দলের অধিকারেরও একটা সীমা থাকা দরকার। যার খুশি যখন খুশি কারণে-অকারণে হরতাল ডাকবে, আমরা দুর্ভোগ পোহাব, বোমায় ঝলসে যাব, মারা পড়ব– এমন নচ্ছার 'অধিকার' আমরা আর কতকাল সহ্য করব? এত ক্ষত আর ক্ষতির পরও আমরা এই আত্মঘাতী রাজনৈতিক কর্মসূচি মেনে নিই কীভাবে?

অবরোধ-হরতালের নামে নাশকতার দায় অবশ্যই অবরোধ-হরতাল আহবানকারীদের। ওদের খুনের আসামি করে বিচারের মুখে আনা হোক। যুক্তির নিরিখে আমরা মানতে বাধ্য যে, হরতাল ডাকা রাজনীতির ভাষা। কিন্তু মানুষ খুন, পেট্রোল বোমা মারা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ– এগুলো কোন ভাষা? নৈরাজ্য সৃষ্টি ও খুনের বিচার চাওয়া ন্যায়বিচার ও সুশাসনের দাবি। প্রয়োজনে অবরোধ-হরতাল আহবানকারী দলের প্রধানকে প্রধান আসামি এবং অন্যদের খুনের সহযোগী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা হোক।

আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। পাশাপাশি বিরোধী দলের প্রতি সরকারপক্ষের আচরণও সমর্থনযোগ্য নয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যখন গাজীপুরে সমাবেশ করতে চাইল, সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সেই সমাবেশ প্রতিরোধের ডাক দিয়ে একই স্থানে পালটা সমাবেশ আহবান করল কেন? বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানই বা কেন লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন অশালীন বাক্যপ্রয়োগ চালিয়ে যাচ্ছেন? তাকে নিষেধ করার মতো সুস্থ, সাহসী মানুষ বিএনপিতে একজনও নেই?

শক্তিমত্তা আর কৌশলে বিএনপি এখন অনেকটাই দুর্বল। গত তিন বছরে রাজপথের আন্দোলনে তাদের শোচনীয় ব্যর্থতা দল হিসেবে তাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। মুখে তর্জন-গর্জন করলেও তাদের শক্তি আর সাহস সম্পর্কে ক্ষমতাসীনরা ধারণা পেয়ে গেছে। তাই তো ক্ষমতাসীনরা সুযোগ পেলেই ওদের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির দরকার ছিল ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও সৃজনশীল উদ্যোগ। কিন্তু তারা 'ঘরে বসে পালন করার কর্মসূচি' হরতাল-অবরোধ ডেকে নিজেদের বীরত্ব জাহির করছে! এতে কি বিএনপির বীরত্ব বাড়ছে, নাকি দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে?

তবে বিরোধী দলের নৈরাজ্যমুখী হওয়ার দায় সরকারি দলও এড়াতে পারে না। গাজীপুরে সমাবেশ করতে দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? সরকার পতন হত?খালেদা জিয়াকেই বা অমন হাস্যকর নাটকীয় কায়দায় পুলিশ, ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে ঘিরে রাখা হল? আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকেই বা আটক করা হল কেন?

আমাদের দেশে এক অদ্ভূত নিয়ম চালু হয়েছে। সরকারি দল কখনও বিরোধী দলের দাবি ও অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। পারলে বিরোধী দলের নাম-নিশানা মুছে দেয়! এর আগে জামায়াত-বিএনপি জোটের শাসনামলেও তাই হয়েছে। সারাক্ষণ বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত। এক সময় কানু বা শ্যাম ছাড়া যেমন কোনো গীত বা কীর্ত্তন হত না, এখন বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত ছাড়া তেমনি সরকারি দলের কোনো নেতার কোনো বক্তব্য নেই!

আমাদের নেতারা কি ঠিক করেছেন যে, তারা কার চেয়ে কে বেশি খারাপ হবেন, এই প্রতিযোগিতা করেই শতাব্দী পার করে দেবেন? জগণের জন্য ভালো কিছু করার দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা তারা কোনোদিনই কি করবেন না?


চিররঞ্জন সরকার:
কলামিস্ট।