সন্ত্রাস, হীনম্মন্যতা ও সুশীলদের নোবেল রক্ষা

Published : 9 March 2011, 04:51 PM
Updated : 9 March 2011, 04:51 PM

আমরা যখন ব্যস্ত ড. ইউনূসকে নিয়ে, পুঁজিবাজারের সূচক উন্নয়ন নিয়ে, নারী দিবসে নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে তখন আমাদের ছাত্ররা কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছে তা রয়ে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে | বিষয়টি যেন এমন – আমাদের ছাত্ররা রাজনীতি করে, রাজনীতি মানেই নোংরামী, তো যারা রাজনীতি করবে তারা তো মারামারিই করবে, তারা আহত হলে হবে, তারা নিহত হলেও হবে | এই সমাজ ব্যবস্থায় কতজন সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করে আর কতজন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করে সেই প্রশ্ন হারিয়ে যায় কুৎসিত ও নৃশংস ঘটনার আধিক্যে | ছাত্রদের সাথে বিভিন্ন সময়ে কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে কয়েকটি চরম সত্য | আর তা হলো জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হয় বহু অন্যায় মেনে নিতে | আমাদের ছাত্ররা মাথা নিচু করে থাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হবার ভয়ে | ভোগে হীনম্মন্যতায় | এর মধ্যেও যখন দেখি অকুতোভয় ছাত্র ছাত্রীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় তখন তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আধমরা স্বপ্নগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে | আজকে এরকমই একটি দিন | মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার দিন |

ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুইটা ভাঙ্গা হাত নিয়ে, পায়ে অসংখ্য আঘাত নিয়ে, মাথায় মারাত্মক জখম নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বুয়েট শাখার আহবায়ক গৌতম কুমার দে | আহত হয়ে শুয়ে আছে সাধারণ সম্পাদক মামুন মোর্শেদ | ৩ দিন ধরে প্রতিদিন ছাত্র লীগের কর্মীদের আক্রমণে বিভিন্ন সময়ে আহত হয়েছে মুনিম বিন গনি, জয় ভট্টাচার্য, মেজবাউল হক রাজন, সৈয়দ নাজমুল আহসানসহ আরো অনেকে | রশীদ হল, নজরুল ইসলাম হল, ও সোহরাওয়ার্দি হলের বিভিন্ন রুমে অগ্নি সংযোগ, ভাংচুর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জিনিস লুটপাট করে ত্রাস তৈরি করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা | গুরুতরভাবে আহত হওয়া এই ছাত্রদের অপরাধ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ | অপরাধ সন্ত্রাস বিরোধী দেয়াল লিখন ও লিফলেট বিতরণ|

বসন্তের এই ফাল্গুন মাসে যখন বিশ্ববিদ্যালয় রঙ্গীন হয়ে উঠেছে বসন্ত উৎসবে, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে যখন মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে ভ্যালেন্টাইনস ডে, যখন একুশে উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা উত্সব আকার ধারণ করেছে, তখন নিভৃতে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব মুক্ত ক্যাম্পাসের দাবীতে কাজ করে চলছিল ছাত্রফ্রন্টের ছাত্ররা | কিন্তু কে চায় এই উত্সবমুখর ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ শুনতে | এই প্রতিবাদ তো আনন্দের না | তাহলে এই আনন্দকে বিস্বাদ করে দেয় যেই প্রতিবাদ সেই প্রতিবাদ কে করবে? চারিদিকে অন্যায়, দুর্নীতি, আর ভোগান্তি দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীরা মনের অশান্তি আর নিরানন্দকে জয় করতে দুই দন্ড শান্তির জন্য তাই ভেসে যায় আনন্দের স্রোতে | থাক না এই প্রতিবাদ | ঝামেলা করে লাভ কী ? তার চাইতে বেশি সুবিধা দুইদিনের জন্য সব ভুলে যাওয়া | যেন এই ভুলে যাওয়া সব ভুলিয়ে দিবে | কিন্তু এই আনন্দের মধ্যে আদর্শবাদী কিছু ছাত্র থামিয়ে দেয়নি লড়াই | আর তারা তাই শুয়ে আছে মেডিকেলে |

আমাদের নাগরিক সমাজের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিণতি মানে কয়েকদিন মেডিকেলে শুয়ে থাকা, ব্যথায় কাতরানো, খবরের কাগজে ছোট্ট হেডিং হওয়া, এবং পরবর্তীতে বিস্মৃত হওয়া | এই সংগ্রাম করে কী হবে যেই সংগ্রামে বিস্মৃত হতে সময় লাগে খুব বেশি হলে এক মাস বা তার একটু বেশি ? তাই খুব বেশি মানুষ আর আজকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় না | আমরা গলা শুকিয়ে ফেলছি "মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর শাস্তি চাই" | বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত এদেশের সুশীল সমাজের কেউ কেউ ড. ইউনূসের অপসারণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিচ্ছেন | আমাদের সুশীল সমাজ উঠে দাড়িয়েছে ড. ইউনূস তথা দেশের সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে | যেন নোবেল বিজয়ীর সম্মান এত শস্তা যে তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করলে এক্ষুনি সব সম্মান ধুলিস্যাত হবে | এই জাতি যেন লজ্জায় কাতর – এটা কী হচ্ছে ? এই বিশেষ সময়ে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে যে কেউ কথা বলতে গেলে মৌলিক সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে | কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় কে? কে জবাব দিবে "কেন সন্ত্রাস বিরাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে?" এই সব প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে কেউ দিতে পারে না | বর্তমান সরকারও না, বিরোধী দলীয় সরকারও না | এই প্রশ্নের উত্তর যে দিতে যাবে তাকে যেতে হবে মেডিকেলে |

আর তাই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ড. ইউনূস এবং ভিতরের পাতায় গৌতম ও তার সঙ্গীরা | যেই সব ঘটনার সাথে আমাদের দেশের ছাত্র তথা জনগণের স্বার্থ জড়িত সেই সব ঘটনা তাই খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় গভীর নিঃশ্বাস ফেলে |

একজন ছাত্র আমাকে সেদিন প্রশ্ন করেছিল "আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা বিদেশে যেয়ে কত ভালো রেজাল্ট করে অথচ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাঙ্কিং এর দিক থেকে এত নিচে কেন? " ছাত্রটির প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছিল তার তো এই প্রশ্নটিই করার কথা | কারণ তার তো আসলে প্রয়োজন র্যাঙ্কিং বাড়ছে কিনা সেটা দেখা | তার তো দেখার উদ্দেশ্য নয় কোথায় কোন ছাত্র এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে, ক্যাম্পাসে অরাজকতার শিকার হয়ে মাথা তুলে দাড়াতে পারছে না | যেখানে মৌলিক প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেয়া যাচ্ছে না সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং নিয়ে প্রশ্ন আমাদেরকে কতটা স্পর্শ করে ? যারা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে ব্যর্থ হয়, কোনো দিকনির্দেশনা পায় না তারা র্যাঙ্কিং নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে | আমাদের দেশের সেই সব ছাত্ররা যারা এই হীনম্মন্যতাকে জয় করতে পেরেছে তারা র্যাঙ্কিং এর প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে যেয়ে সন্ত্রাসকে প্রশ্ন করতে শিখেছে | হীনম্মন্যতাকে জয় করতে পেরেছে বলে আজকে তারা মেডিকেলে, সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে লড়াই করে মৃত্যুর সাথে |

যখন আলোচনা সভায় প্রশ্ন ওঠে তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিয়ে তখন সকলেই মনে করে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে ও দখলদারিত্বের রাজনীতি নির্মূল করতে হলে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে | কিন্তু তার জন্য যেই চেষ্টাটুকু করতে হয় সেই চেষ্টাটুকু করতে ভয় পায় বেশিরভাগ ছাত্ররা | আমরা আদর্শবাদী ছাত্র দেখতে চাই, তাদের প্রশংসা করি, কিন্তু আদর্শবাদী ছাত্রদের পাশে দাড়াতে চাই না | এই সব ছেলেদের সম্মান নিয়ে আমরা ভাবি না, ভাবি ড. ইউনূসদের সম্মান নিয়ে | নোবেল বিজয়ের সম্মানে যখন হাত পা ছুঁড়ে উল্লাস করেন দেশের মানুষ তখন এই অকুতোভয় ছাত্ররা বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুঁড়ে ব্যথায় কাতরায় | লোকে বলে দুইটা জায়গায় মানুষকে জীবনের কোনো না কোনো সময় যেতে হয় | একটা হচ্ছে ডাক্তারের কাছে, আরেকটা হচ্ছে উকিলের কাছে | আর তাই বুঝি আমাদের ছাত্ররা সমাজের অসুখ সারাতে যেয়ে নিজেরা পরে থাকে মেডিকেলে | আর আমাদের নোবেল বিজয়ী সমাজের অসুখ না সারিয়ে অসুখী মানুষকে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে সাময়িক অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে গিয়ে পুরস্কৃত হন এবং দাড়ান কাঠ গড়ায়|

শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার জন্য ছাত্রদের এই লড়াইকে সম্মান জানিয়ে আমরা চাই সন্ত্রাসীদের শাস্তি ও বিচার | সারা দেশবাসীর প্রয়োজন এই সব অকুতোভয় ছাত্রদের পাশে দাড়ানো | চার দিন ধরে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান না নিয়ে বুয়েট প্রশাসন যেই নির্লিপ্ততার নমুনা আমাদের সামনে হাজির করেছে তা আবারও প্রমাণ করে আমাদের ছাত্রদের মধ্যে হীনম্মন্যতার বীজ বপণ করার জন্য দায়ী আমাদের প্রশাসন এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা | আমাদের ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব মুক্ত করতে হলে নিষ্ক্রিয় প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করতে হবে | যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে ততদিন সারবে না সমাজের মধ্যেকার এই গভীর অসুখ – হীনম্মন্যতা।