ঘন ঘন গণতন্ত্রের লড়াই

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Jan 2015, 04:19 AM
Updated : 8 Jan 2015, 04:19 AM

ইংরেজিতে Blessing of ignorance বলে একটা কথা চালু আছে। একচেটিয়া ভোগের পর অজ্ঞতার আশীর্বাদপুষ্ট আমাদের রাজনীতিবিদরা এখন তা হারাতে শুরু করেছেন। আগের 'জুজুবুড়ি' যেমন বাচ্চাদের আর টানে না, ভয় লাগাতে পারে না– তেমনি রাজনীতিতে কল্পিত শত্রুও আর কাজ করছে না।

একসময় ধর্ম-অধর্ম, জাতীয়তা আর ভারত-বিদ্বেষের কথা বলে রাজনীতি করা বিএনপির সে রমরমা ভাবটা আর নেই। সে কারণেই মার খাচ্ছে তারা। 'প্রান্তিক মানুষ' নামে পরিচিত সাধারণ মানুষের সমর্থনের বিষয়টা এখনও ধোঁয়াশা হলেও তারা তো নিয়ন্ত্রণ করে না। নিয়ন্ত্রণ মধ্যবিত্তের হাতে। তাছাড়া তেমন কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি ছাড়া চাইলেই মানুষ রক্ত দিতে রাস্তায় নেমে আসবে এই ভাবনার পেছনেও আসলে এক ধরনের অজ্ঞতা কাজ করে।

৫ জানুয়ারি ঘিরে যে উত্তপ্ত আর অসহনীয় বাস্তবতার কথা শুনে আসছি, এ পর্যন্ত তার ফলাফল আসলে 'অশ্বডিম্ব'। এটা ঠিক, মানুষ সরকারি দলের ওপরও নাখোশ। সরকারে থাকলে মানুষের মন জয় করা যেমন কঠিন, তেমনি জনপ্রিয়তা ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী-মিনিস্টার বা নেতারা সেটা বোঝেন না। তাদের খুঁটিও যে নড়তে শুরু করছে সেটা তারা অচিরে টের পাবেন। কিন্তু এটার মানে এই নয় যে, আরেক দল মানুষ জোর-জবরদস্তি করে দেশের গদি দখল করে নিয়ে বলবেন: "ইউরেকা, ইউরেকা, বিপ্লব হো গ্যায়া।''

গত এক দশকে দুনিয়াজুড়ে যে পরিবর্তন, বিবর্তন– তার সঙ্গে চলতে না পারার কারণে বিএনপির মতো দলের মেধা ও মননে শান পড়েনি। সে কারণে তারা এটাও বুঝতে পারেন না যে, বাংলাদেশে গণ্ডায় গণ্ডায় ফাঁসির ঘোষণা হবার পরও মানুষ বাজার করছে, অফিসে যাচ্ছে, বাচ্চাদের নিয়ে পিকনিক করছে, পরিবার-পরিজন নিয়ে টেকনাফ বা কুয়াকাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী থেকে রাস্তায় লাশ হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ, কোনো ঘটনাই দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারছে না জনজীবনে।

এর কারণ কী? কেন মানুষের মনে এমন পরিবর্তন? এর ব্যাখ্যা আপনি কোনো রাজনীতিবিদের কাছে পাবেন না। কারণ, তাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাদের ধারণা, নিজ নিজ দলের 'টপমোস্ট'দের খুশি রেখে চলে আর ভোটের সময় টাকা ছড়িয়ে জিতে আসতে পারলেই হল। এই যে প্রবণতা, এর কুফলে বাংলাদেশের রাজনীতি তার আসল জায়গা ভুলে এখন মারামারি আর হুংকারের দিকে ধাবিত হয়েছে। গতকাল থেকে আজ অব্দি আমরা যা দেখলাম, তাতে কোন দলের আচরণে গণতন্ত্র বা সহিষ্ণুতা আছে? অথচ লড়াইটা কিন্তু গণতন্ত্রের নামে!

একটা সময় ছিল যখন খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণেই এক ধরনের ক্যারিশমা কাজ করত। কিন্তু সেটা কি চিরকালীন? বুঝলাম রাজনীতিতে বয়স ফ্যাক্টর নয়, কিন্তু ইমেজ ফ্যাক্টর। যদি সে ইমেজ নির্ভর করে মেধা বা নেতৃত্বের পরিবর্তে অন্য কিছুর ওপর, তখন এটাই স্বাভাবিক যে, একসময় তার স্রোত নিম্নগামী হবেই। আমি এ কথা কেবল খালেদা জিয়ার বেলাতেই বলছি না, এটা রাজনীতিকদের সবার বেলায় প্রযোজ্য।

ঢলের পাশাপাশি, অঢেল মেধা, শ্রম আর বিদ্যার দৌড় এখন অপরিহার্য। যে ছেলে বা মেয়েটি গত দু'দশকে বড় হয়েছে, তার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত আমাদের কাছে গাঁধী বা জিন্নাহ যেমন ঠিক তেমন, আধো অন্ধকার– কিছু জানে কিছু বোঝে, বাকিটা ধোঁয়াশা। এটুকুতে ভর করে কেউ জান দিতে ছুটে যায় না। বিগত বছরগুলোতে, বিশেষত সিংহাসন হারাবার পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের কাছে যাবার পরিবর্তে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে ধর্না দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা এখন বিএনপিকে প্রায় এতিম করে ফেলেছে।

আমাদের দেশের মানুষের পালস বা নাড়ির স্পন্দন বুঝতে না পারলে জনগণের দল হয় কীভাবে? প্রতিবেশি বঙ্গের সঙ্গে আমাদের তফাৎটা আসলে কী, এটাও তারা বোঝেননি। আমরা কোনোভাবেই পরাধীনতা বা জোর-জবরদস্তি মানি না। আমরা পাকিস্তানকে প্রথম জবাব দিই ভাষার কারণে। তখন থেকে এখন অব্দি লড়াকু, স্বাধীনচেতা আর আপন অধিকারে সরব আমরা। সে দেশের মানুষকে পাকি দাওয়াই, আমেরিকান বড়ি আর জাতীয়তাবাদের ট্যাবলেট গেলালে বদহজম তো হবেই।

বিএনপি যখন কঠোর হবার কথা বলছিল, আমি তখন তাদের দুয়েকজন প্রবীণ নেতার কাজকর্মের ওপর চোখ রাখছিলাম। আমি পঞ্চাম পেরুনো মানুষ, আমার দিলে তেমন উত্তেজনা নেই। আমার ধমনীর রক্তপ্রবাহও আর আগের মতো টগবগ করে না। আমি দেখছিলাম, যাদের কথা আর চাপে বিএনপি একসময় এদেশে ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়াত, তারা এখন কী করছে? তাছাড়া, যা কিছু সামান্য পড়াশোনা করেছি, তাতে এখনও চাণক্য হেন পণ্ডিতের সন্ধান পাইনি।

উপমহাদেশের খল ও ধূর্ত রাজনীতির এমন সমঝদার তুলনা বিরল। তিনি মনে করতেন, পেঁচা আর বাদুড় আছে বলেই আমরা ভয়-ভীতি বা অকল্যাণ বিষয়ে অবগত হতে পারি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাদের বেলাতেই এই উপমা সত্য। তারা আছেন বলেই আমরা জানি বা বুঝি, কোন আন্দোলন বা কোন কাজ কতটা গড়াতে পারে। বিএনপির 'দুধের মাছিরা' এখন আর কেউ কথা বলে না। খবরে দেখলাম, মওদুদ আহমেদ এমন জবরদস্ত কর্মসূচি ও নেতার পার্টি অফিসে অন্তরীণ থাকার সময় বহাল তবিয়তে বাসায় ভোজন করছিলেন। তাকে নাকি কথা বলার জন্যও পাওয়া যায়নি। জানানো হয়েছে, তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন!

ঘটনা তো এখানেই পরিস্কার। তিনি কি আগামীতে মন্ত্রী বা দেশের শাসনে থাকতে চান না? এক হাজার বার চান। সে সম্ভাবনা নেই বলেই এখন বিশ্রামে আছেন। এ জাতীয় নেতাদের ভিড়ে যে দল পরিপূর্ণ, তাদের জন্য মানুষ কেন রাস্তায় নামবে?

অপরদিকে দেখুন, খালেদা জিয়াকে সমানে উস্কানি দিয়ে যাওয়া এককালের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী এখন বলছেন, ষাঁড়ের লড়াই দেখতে চাই না। নিজে যে এক দলের বাছুর হবার জন্য জান কোরবান দিচ্ছিলেন, সেখান থেকে সরে এলেন কোন দুঃখে? কেন বলছেন, মানুষ শান্তি চায়, সংঘাত নয়? এ জাতীয় শান্তির ললিত বাণীই যদি মনের কথা হয়, মাঝখানে এত নাটকের কী দরকার ছিল?

মাঝে মাঝে তাকে উস্কে দেওয়া মিডিয়া আর ড. কামাল হোসেনরা কোথায়? জাতীয় ঐক্যের কঠিন ডাক দেওয়া ইব্রাহীম সাহেব, কর্নেল অলি বা বি. চৌধুরীরা আসলে কতটা পারঙ্গম বা আজ তারা কতটা দুর্বল সেটাই দেখলাম আমরা।

এ যাত্রা খালেদা জিয়ার ব্যর্থতা প্রমাণ করল, বিএনপি এখন প্রায় মৃত ঘোড়া। তার সহিস যদি থাকে, বিলেতে। বঙ্গদেশে ঘোড়া দৌড়াবে কি গায়েবি আওয়াজে? বিগত সময়ে সেই সহিসের প্রগলভতা আর জাতির জনককে নিয়ে তামাশার ব্যাপারটা মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তার জন্য তিনি লন্ডনের কতিপয় বাঙালি বা মুষ্টিমেয়র বাহবা পেলেও আখেরে পায়ের নিচের জমিন 'টলে' গেছে।

যেভাবেই আলোচনা করি, 'গণতন্ত্র' নয়, ঘুরে ফিরে পরিবার, গদি আর নানা ধরনের সংঘাতের কথাই উঠে আসছে। এ জায়গাতেই আটকে আছি আমরা। আওয়ামী লীগ সামাল দিয়েছে বটে, তবে এভাবে খুব বেশিদিন চলা যায় না। ছেলেবেলায় পড়া 'হারাধনের দশটি ছেলে' শীর্ষক ছড়াটি মনে আছে। সে পরিণতি আর যাই হোক, কল্যাণের হতে পারে না।

গণতন্ত্রের নামে যে হাঙ্গামা আর ঝামেলা, তাকে একটা বিষয় দিয়ে পরখ করলেই উত্তর মিলে যাবে। ঘরে-বাইরে, দলে-মাঠে, জীবনে-আচরণে যাদের গণতন্ত্র নেই, তারাই এর জন্যে লড়ছেন। এটা কি মানা যায়? যারা গণতন্ত্রের হেফাজত করছেন তাদের অবস্থাও তথৈবচ।

আর কোনো দেশে কিছুদিন পর পর নিয়ম করে এমন নৈরাজ্য সৃষ্টির নজির নেই। বিএনপির এবারের আস্ফালন বন্ধ করে সরকার ঠিক কাজ করলেও সভা করার কাজটি বন্ধ না করলেই মঙ্গল হত। কোনোটাই হয়নি। হবেও না। বাংলাদেশের আর্থিক প্রগতি, স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা, মানুষের জীবনের চেয়েও গদি বড় করে দেখার রাজনীতি যতদিন চলবে, ততদিন 'গণতন্ত্র' বলে আসলেই কিছু পাওয়া যাবে না। ঘন ঘন গণতন্ত্রের লড়াইয়ে আমরাই শুধু রক্তাক্ত হতে থাকব।

এ জন্যে এই দেশের জন্ম হয়নি, সেটাও যেন প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা।

সিডনি; ৬ জানুয়ারি, ২০১৫