বিএনপির রাজনীতি: সামনে বন্ধুর সময়

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 4 Jan 2015, 03:09 AM
Updated : 4 Jan 2015, 03:09 AM

৫ জানুয়ারি কী ধরনের নির্বাচন দেশে হয়েছিল, তা নিয়ে দলবাজদের বাইরে থাকা মানুষের মধ্যে মতভেদ কম। কী পরিস্থিতিতে ওই নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছিল, সেটিও কমবেশি সবার জানা। নির্বাচনটি নিয়ে সরকারের মধ্যে শুরুতে একটু অস্বস্তি থাকলেও সেটা কেটে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি। এ কথা বলা শুরু করতে তারা খুব সময় নেননি যে, পরবর্তী নির্বাচন হবে যথাসময়ে অর্থাৎ মেয়াদ শেষে। আরেকটি কথা তারা স্পষ্ট করেই বলছেন যে, ওই নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। সে রকম বিধানই আমাদের সংবিধানে রয়েছে– তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর।

বিতর্কিত বা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেমন একটা বাস্তবতা; সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়াটাও একটা বড় সত্য।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং দাপটের সঙ্গেই তারা দেশ চালাচ্ছেন। গত প্রায় এক বছর সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোট কোনো চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দিতে পারেনি তার উদ্দেশ্যে। অর্থনীতি পরিচালনায়ও সরকার বড় কোনো সমস্যা মোকাবেলা করছে না। আইন-শৃঙ্খলায় অবনতির ধারা অবশ্য স্পষ্ট। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। তবে এর সঙ্গে নির্বাচনের মানের সম্পর্ক কম।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না বলে তা বাতিল হয়ে গেছে আদালতে এবং ক্ষমতাসীন মহল সেটা লুফে নিয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনেছে। তারা নিজেরাই একদা এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন– এটা মনে করিয়ে দিয়ে তাদের একটু লজ্জা দেওয়া যেতেই পারে; কিন্তু এখান থেকে আপসে তাদের সরানো যাবে না। কেননা দিনকে দিন আরও পরিষ্কার করে তারা বলছেন যে, বাংলাদেশ আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাবে না।

বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা সত্যিই মনে হয় ভেবেছিল, তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা গেলে ওই ব্যবস্থা বা তেমন ধরনের কিছু ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচন আদায় করা গেলে তাতে ভূমিধ্বস বিজয় পাওয়াও সম্ভব বলে তারা ধরে নেন– অভিজ্ঞতার নিরিখে। যাহোক, সরকারের পতন তারা ঘটাতে পারেননি। বরং সরকার কৌশলে (এবং কোনোমতে) নির্বাচনটি সেরে ফেলার পর বিএনপি নেত্রী আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে এসব বলে নেওয়া ভালো।

৫ জানুয়ারির পরও বিএনপির একটা ধারণা বোধহয় ছিল যে, এ ধরনের নির্বাচন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এলেও নানা কারণে সরকার বাধ্য হবে দ্রুতই আরেকটি নির্বাচন দিতে। 'নানা কারণে'র মধ্যে একটা ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে যাদের বোঝায়, তাদের চাপ। কিন্তু বিএনপি ক্রমেই এটা লক্ষ করল, সে ধরনের কঠিন কোনো চাপ সরকারের ওপর নেই। সরকার বরং একটি শক্তিধর দেশের প্রশাসনকে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না। অবশ্য ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রয়াসী তারা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কের বড় কোনো অবনতি লক্ষণীয় নয়।

এ অবস্থায়ও বিএনপি জোট যদি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনটি বাতিলের দাবিতে নতুন করে শক্ত একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত, তাহলেও কথা ছিল। গত প্রায় এক বছরে তেমন কোনো প্রয়াস তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। যেটুকু মাঝে মাঝে লক্ষ করা গেছে, তা বারবারই ব্যর্থ হয়েছে করুণভাবে। এ অবস্থায় বিএনপি নেত্রীকে এমনটিও বলতে দেখা গেছে– 'সরকারকে পচতে সময় দিচ্ছি'। এদেশে কোনো সরকারই দ্রুত পচে না। জনগণও তাদের দু'তিন বছর দেখতে চায়। এদের সামনে ভালো বিকল্প তুলে ধরা হয় না বলেও অগত্যা ধৈর্য ধরে তারা।

এখন কথা হল, বিএনপির মতো দল কতদিন ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে? একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জামায়াতে ইসলামীও ধৈর্য ধরতে শিখেছে। সরকারের অনুগত প্রশাসনের চাপেও তাদের অবস্থা কাহিল মনে হয়। যে ধরনের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে তারা গিয়েছিল, তাতে ব্যর্থতাও এদের হতাশ করে ফেলেছে বোধহয়। আত্মাহুতি দিয়েও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা বন্ধ করতে পারেনি। এটাকেও একটি বাস্তবতা বলে সবাইকে মানতে হবে।

শিক্ষিত তরুণসহ দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী এসব দুষ্টগ্রহ থেকে মুক্ত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চায়। এ প্রশ্নে তাদের মধ্যে এক ধরনের অসহিষ্ণুতাও লক্ষণীয়। এর তাৎপর্য বিশেষত বিএনপিকে বুঝতে হবে। কিন্তু লন্ডনে অবস্থানরত দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমানের বক্তব্যে কি তার কোনো প্রতিফলন রয়েছে? বিএনপির ভেতরেও একটি বড় অংশ এসবকে প্রয়োজনীয় ভাবছে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায়ও দলনেত্রী পুত্রের বক্তব্য সমর্থন করে যাচ্ছেন কী বুঝে, তা তিনিই জানেন।

এদিকে সরকার পক্ষের অবস্থানটা হল, তারেকের আপত্তিকর বক্তব্যের কারণেও বিএনপিকে তারা কোথাও সমাবেশ করতে দেবেন না। তাকে নাকি ক্ষমা চাইতে হবে। ঠিক এ রকম একটা অবস্থায় খালেদা জিয়া যে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন, সেটাও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে সরকার পক্ষ। এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু অন্যরা নিশ্চয়ই তাঁর মনোভাব বুঝেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন। আমাদের প্রধান দুই দলেই নেত্রীর মনোভাবের বিরুদ্ধে যেয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলেন না।

সংবাদ সম্মেলনে সাত দফা প্রস্তাব পেশের আগে যে দুটি হরতাল পালন করেছে বিএনপি, সেগুলোও ছিল ফ্লপ। এ অবস্থায় ৫ জানুয়ারি তারা বেশি কিছু করতে সক্ষম হবেন বলে মনে হচ্ছে না। রাজধানীতে সমাবেশ করতে দেওয়া হলেও তাতে কি বেশি লোক জড়ো করতে পারবে বিএনপি? দলটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও তার সমর্থক কম নেই। এখন কথা হল, সংঘাতের আশঙ্কা উপেক্ষা করে তারা কি দলে দলে আসবেন সমাবেশ সফল করতে? কী জন্য আসবেন? আশু কিছু পাবেন কি এখান থেকে?

আশু কিছু পাওয়ার কথা বিএনপি নেতারাও বলছেন না। আগামী ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যেও কি তারা মনে করছেন যে, একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করতে পারবেন? আদায় করতে সক্ষম হলেও তো প্রশ্ন উঠবে, নির্বাচনটা সম্পন্ন হবে কী ধরনের সরকারের অধীনে? শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে কি অংশ নেবে বিএনপি? সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দলটির সামনে চ্যালেঞ্জ সুস্পষ্টভাবে দুটি।

সরকার পক্ষের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়, এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ধরনের সংলাপে যেতে রাজি নয়। সত্যি বলতে, সংলাপের কোনো সম্পর্ক নেই দু'দলে। বিএনপি জাতীয় সংসদে থাকাকালেও এ সম্পর্কই বহাল ছিল। সংলাপ বা সে ধরনের কিছু এখানে হয়ে থাকে রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠলে। বিরোধী দলকে তেমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হয় এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপও লাগে। তার আগ পর্যন্ত সরকার রাজি হয় না সংলাপে বসতে।

এটার অভিজ্ঞতা সুখকরও নয় এদেশে। সংলাপের বদলে সংঘাতের মাধ্যমেই তাই পট-পরিবর্তন ঘটছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ঘটছে এতে। পরিবর্তন থেকে টেকসই কিছু অর্জনও করতে পারছি না আমরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেল। এর পক্ষ-বিপক্ষ পাল্টে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেল ব্যবস্থাটি। বিএনপিও এখন ওটার কথা না বলে একটা 'দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার' চাইছে।

এ ধরনের সরকার সংবিধানের সঙ্গে কীভাবে সাযুজ্যপূর্ণ হবে, সেটাও একটা চ্যালেঞ্জ। তার আগে চ্যালেঞ্জ হল সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা। উদ্বুদ্ধ করা তো আর যাবে না, বাধ্য করতে হবে! ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন বিএনপি নেত্রীও করেছিলেন। অতঃপর দ্রুতই বাধ্য হন আরেকটি নির্বাচন দিতে। ১৯৯৬ সালে তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। এখন অনেক পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতিতে বিএনপি কি পারবে সেটা তৈরি করতে?

বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আর সেভাবে নেই এখন। দলটি নিজেও কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। আর বিএনপিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও এমন আওয়াজ এসেছে। এ অবস্থায় আন্দোলনে যেতে চাইলেই বিএনপি সম্পর্কে বলা হচ্ছে– 'তারা তো যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায়'। দেশের বহু লোক এটা বিশ্বাসও করেন। বিএনপি এ অবস্থায় এক রকম বিপাকেই আছে। তার আরেকটা সমস্যা হল, নতুন করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে স্বাগত জানাতে পারছে না ব্যাপক মানুষ।

এ অবস্থায় সরকার একটা তত্ত্ব হাজির করেছে– উন্নয়নের। স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। বলছেন, আন্দোলনের নামে অরাজকতা করতে দেয়া হবে না। তাহলেই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজও তারা শুরু করে দিয়েছেন। রাজধানীতে চলছে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার একটা প্রায় দুর্লভ সুযোগও তারা পেয়ে গেছেন এর মধ্যে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতন বিপুলভাবে বাড়ানোর দিকে এগোচ্ছেন তারা।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জিতে এসে সরকার গঠন করলে তারা কী করতেন, জানি না। তবে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এসে তারা যা করছেন, সেটা দেখতে পাচ্ছি। এতে খুব নতুন কিছু দেখছি বলে মনে হয় না। ঠিকঠাক নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে গেলেও নতুন কী এমন ঘটত? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তারা কি সুশাসন বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার করেছিলেন জনগণের কাছে? যতদূর মনে পড়ে, গ্রহণযোগ্য পরিবেশে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়েই তারা ছিলেন সিরিয়াস।

এখনও তাই, ওটুকুই। গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনায় মধ্যবর্তী একটা নির্বাচনই শুধু চাইছেন তারা, যাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসতে পারেন। ইতোপূর্বে তারা কি ক্ষমতায় ছিলেন না? গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেও তারা কী এমন সুকর্ম করেছিলেন? হ্যাঁ, বর্তমান সরকার হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুকর্ম করছে। কিন্তু তাতে কি নেই অতীতের ধারাবাহিকতা? এমনকি বিএনপি সরকার যা করেছিল, তার? প্রশাসন দলীয়করণে আওয়ামী লীগ নাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে; অর্থাৎ বিএনপিকেও।

খালেদা জিয়ার সামনে এখন দুটি উপায় আছে।

এক. তার ভাষায়, সরকারটিকে 'পচতে দেওয়া'। সে ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

দুই. দল, জোট ও সমর্থকগোষ্ঠী ঠিক করে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে হবে। এ অবস্থায় দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ের একটা লক্ষ্য থাকতে পারে তাদের। সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন, বিশেষত নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা তাদের থাকতে হবে।

আরেকটা উপায় অবশ্য আছে। সেটি হল, শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে না থেকে ন্যূনতম সুশাসন দিতে সক্ষম– আওয়ামী লীগের চেয়ে যোগ্য একটি দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা।

তেমন কোনো লক্ষণ অবশ্য একেবারেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।