সুন্দরবনে ভাসমান তেল ও অতিবিশ্লেষণী প্রতিক্রিয়া

দানেশ মিয়া
Published : 2 Jan 2015, 09:55 AM
Updated : 2 Jan 2015, 09:55 AM

বাংলাদেশ ও ভারতের ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত এমন একটানা একটি একক বন পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এর শতকরা প্রায় ষাট ভাগ বাংলাদেশের সীমানায় পড়েছে। সুন্দরবন বলতে বাংলাদেশের বন বলেই পৃথিবীর অনেকে জানে। এই সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারই বাংলাদেশের ক্ষীপ্রতার প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বে বহুল পরিচিত।

ইউনেসকো ঘোষিত ৫২২ তম 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' হিসেবে সুন্দরবনের ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার, যেখানে তিনটি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য আছে, ১৯৯৭ সাল থেকে সমাদৃত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ সুন্দরবনের হিরন পয়েন্টে নিজে বিশ্ব ঐতিহ্যের পতাকা উত্তোলন করেন। জীববৈচিত্র্যের হিসেবে আমাজন বনের পরই বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে এটি খ্যাত। উদ্ভিদ, মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের মতো প্রজাতি সুন্দরবনে রয়েছে।

সদ্যবিগত হওয়া ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত শ্যালা নদীতে দুর্ঘটনায় পতিত হয় একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার। পরে এ থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল শ্যালা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে– যা সুন্দরবনের মোট এলাকার শতকরা ছয় থেকে সাত ভাগ। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের যেমন টনক নড়েছে, দেশের পরিবেশবাদী সংগঠন ও আমজনতা পর্যন্ত প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কোনো ঘটনায় বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর এত গুরুত্ব এর আগে আর কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। খোদ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা এখন এই বিপর্যয় পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

২০১১ সালের আগে মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরের নৌ-পরিবহন এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহনের জন্য ঘষিয়াখালী চ্যানেল ব্যবহৃত হচ্ছিল। এই চ্যানেল পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়াতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্যালা নদীর মাধ্যমে মংলা বন্দরের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ হচ্ছে। ঘষিয়াখালী চ্যানেল বন্ধ করে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌ-যোগাযোগ শুরু করার সময় পরিবেশবাদী অনেক সংগঠনই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এর ফলে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে– এ রকম একটি শংকা ছিল মূখ্য। তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় এ রকম ভয়াবহ রকম বিপর্যয়ের মধ্যে সুন্দরবন পড়তে পারে তা খুব জোরালোভাবে কেউ ভাবেনি। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি ভয়াবহ।

তবে যতটুকু না ভয়াবহ তার চেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছি আমরা। এই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে নানা কারণে। ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রভাবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় কিছুটা অতিরঞ্জন, অতিউৎসাহী সমালোচনা এবং আতঙ্ক তৈরির প্রচেষ্টা এর অন্যতম। ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালু রাখার চেষ্টা না করে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌ-পরিবহনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং কার্যাবলীর জন্য সরকারের সমালোচনা যথার্থ হয়েছে। কিন্তু, তেল নিঃসরণের ফলে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণির উপর যে প্রতিক্রিয়া হবে বলে অতিবিশ্লেষণ করা হয়েছে, তা অনেকটাই সরলরৈখিক।

আক্ষরিক অর্থে সুন্দরবনের পানিতে ভাসমান তেলের আস্তরণ পানিতে অক্সিজেন পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যার প্রতিক্রিয়ায় পানির ক্ষুদ্র উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের খাদ্য-শৃঙ্খলে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার কথা। পানিতে অক্সিজেনের স্বল্পতার সরাসরি কারণে অনেক জলজ প্রাণির বেঁচে থাকতে সমস্যা হবে। তাছাড়া শ্বাসমূলের ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলোতে তেল লেগে যাওয়াতে শ্বাসমূলীয় গাছের শ্বাস নিতে সাময়িক সমস্যা হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রভাব ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই প্রভাবগুলো বাস্তবে ঘটবে কিনা, তা নির্ভর করবে আরও অসংখ্য জানা এবং না-জানা কারণের উপর– যে কারণগুলো সম্মিলিতভাবে একই সময়ে কাজ করে।

সুন্দরবনের ভাসমান তেলের প্রভাব বিবেচনায় আমরা এতে সুন্দরবনের কত শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা ভেবে দেখিনি। বিপদ-বিপত্তিতে সুন্দরবনের টিকে থাকার যে ক্ষমতা (জবংরষরবহপব) তাও বিবেচনায় নিইনি। কত শতাংশ বনে তেল ছড়িয়ে পড়েছে? শতকরা ছয় থেকে সাত ভাগের বেশি নয়। অক্সিজেন ও সূর্যালোকের অভাবে ডলফিনগুলো হয়তো শ্যালা নদী থেকে অন্য কোথাও সরে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিতাড়িত হলেও সুন্দরবনের মধ্যেই সরে যাওয়ার জায়গা আছে। কয়েকটি ভোঁদড় মারা গেলেও, অন্য কোনো প্রাণির ব্যাপকভাবে মারা যাওয়ার প্রমাণ মিলেনি।

ক্ষুদ্র ও বড় উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও গণপ্রতিক্রিয়া সত্যি হত, যদি তেলের কনসেনট্রেশান একই মাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক হত। কৃত্রিমভাবে তেল উঠিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা যদি নাও হত, প্রাকৃতিকভাবে ও জোয়ার-ভাটার কারণে তেলের কনসেনট্রেশান কমতে বাধ্য। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ১৩১ বছরের ইতিহাসে ভয়ানকতম সাইক্লোন সিডর ঠেকাতে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল। তখন গণপ্রতিক্রিয়া ছিল, সুন্দরবন আগামী একশ' বছরেও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কত বছরে এটি আবার পুনরুজ্জ্বীবিত হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি।

সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুসের মতো। সাইক্লোন-হারিকেনে সে নিজের বুক পেতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের রক্ষা করে। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শুষে নিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিবৃত্তিতেও এই বন ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয়, কয়েক লাখ বনজীবী এই বনের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই সুন্দরবনকে যত্ন করে আগলে রাখার গুরুত্ব অনেক বেশি।

সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌ-পরিবহনের সিদ্ধান্তে সরকার সুন্দরবনের সংবেদনশীলতা অবহেলা করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তেল ট্যাঙ্কারটি ডুবে যেয়ে নিঃসরিত তেল পানি থেকে তুলে আনার ব্যাপারে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে বলা যাবে না।

গরিব সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে, তাদের একটি আর্থিক প্রক্রিয়ায় ধাবিত করে অত্যন্ত সনাতন পদ্ধতিতে তেল তুলে আনার প্রচেষ্টা আরও একটি অপরিণামদর্শিতা। জানা যাচ্ছে, সুন্দরবনের পাশে মংলাতে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য ফার্নেস অয়েলের ২ কোটি লিটারের একটি রিজার্ভার সব সময় রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সরকারকে ভাবতে হবে, কীভাবে সুন্দরবন ব্যবহার না করে এই ফার্নেস অয়েল উক্ত রিজার্ভারে আনা যায়। রামপালে পশুর নদীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও সরকারকে সতর্ক ভূমিকা নিতে হবে।

প্রভাব নিরূপণে কার্য-কারণের সমন্বিত অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে সুন্দরবনের উপর একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য প্রভাব-বিশ্লেষণ আমরা জানতে চাই। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌ-পরিবহন চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। তার আগে হয়তো ঘষিয়াখালী চ্যানেল পুনরুদ্ধার করতে হবে। তার জন্য চিংড়ি ঘেরের মালিকদের কাছ থেকে অসংখ্য খাল উদ্ধার করার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। মোট কথা, সুন্দরবন আগলে রাখার বিষয়ে সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

পাশাপাশি, জনগণের সজাগ দৃষ্টিও সুন্দরবন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

ড. দানেশ মিয়া: অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।