খাদ্যে ভেজাল: কোমল পানীয় ও ফুড অ্যাডিটিভস সমাচার

মুনীরউদ্দিন আহমদ
Published : 27 Dec 2014, 04:29 PM
Updated : 27 Dec 2014, 04:29 PM

ঘটনার সূত্রপাত ২০০৩ সালের ৫ আগস্ট। দিল্লিতে অবস্থিত সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালক তাদের গবেষণার মাধ্যমে জনসমক্ষে জানালেন, ভারতে কোকাকোলা এবং পেপসিসহ বিভিন্ন কোমল পানীয়তে বিষাক্ত লিন্ডেন (Lindane), ডিডিটি (DDT), ম্যালাথিয়ন (Malathion) এবং ক্লোরপাইরিফস (Chlorpyrifos) জাতীয় বিভিন্ন কীটনাশক রয়েছে। এসব কীটনাশক ক্যান্সার সৃষ্টিসহ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধবংস করতে সক্ষম।

গবেষণায় সিএসই দেখতে পেল, ভারতে তৈরি পেপসি কোমল পানীয়তে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রার ৩৬ গুণ বেশি কীটনাশক রয়েছে। কোকাকোলায় পাওয়া গেল ৩০ গুণ বেশি মাত্রার কীটনাশক। সিএসই আরও ঘোষণা করল, তাদের গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত এই একই কোমল পানীয়তে কোনো কীটনাশকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতের পত্রপত্রিকা এবং প্রচার মাধ্যমে সিএসইএর এই অভিযোগের কারণে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এই ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতে কোকাকোলার বিক্রি ১৫ শতাংশ কমে যায়।

তারপর তিন বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু সিএসইএর কাজ বন্ধ থাকল না। ভারতে কোক-পেপসি নিয়ে আবার তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সিএসই বলেছে, এই তিন বছরে কোক-পেপসিতে কীটনাশকের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের ২ আগম্ট বুধবার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সিএসই প্রধান সুনীতা নারায়ণ ঘোষণা করলেন: কোকাকোলা ও পেপসিতে মারাত্মক কীটনাশক তো রয়েছেই, গত তিন বছরে কীটনাশকের মাত্রা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন সমীক্ষার জন্য সিএসই ভারতের ১২ রাজ্যের কোক-পেপসির বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নেওয়া হয়েছিল ১১টি ব্রান্ডের ৫৭টি নমুনা। সব নমুনাতেই তিন থেকে ছয় ধরনের কীটনাশক পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।

লিন্ডেন (হেকসাক্লোরসাইক্লোহেক্রোন) হল ক্যান্সার সৃষ্টিকারী একটি কীটনাশক। এটি পরীক্ষিত শতভাগ নমুনাতেই পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে পাওয়া গেছে বিআইএসএর মাত্রা থেকে ২৪ গুণ বেশি কীটনাশক। এর মধ্যে রয়েছে ভারতে নিষিদ্ধ কীটনাশক হেপটাক্লোর বিআইএসএর মাত্রার চেয়ে ৪ গুণ বেশি। থানের প্ল্যান্টে উৎপাদিত কোকাকোলায় মিলেছে নিউরোটক্সিন-ক্লোরপাইরিফস কীটনাশক, ২০০ গুণ বেশি মাত্রায়। সিএসইএর পরিচালক সুনীতা নারায়ণ জানান, তিন বছর আগে কোক-পেপসিতে চার ধরনের কীটনাশকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বর্তমানে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। সিএসই দাবি করে, এসব কোমল পানীয়তে ক্ষতিকর উপকরণ রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

কী আছে এসব পানীয়তে? এতে রয়েছে ফসফোরিক অ্যাসিড, বিপুল পরিমাণ চিনি, ক্যাফেইন, ক্যারামেল রং, কার্বোনেটেড পানি, প্রিজারভেটিভ্স এবং আরও অনেক ধরনের পদার্থ যার সংখ্যা এবং পরিমাণ কোনো সময় প্রকাশ করা হয় না। পুষ্টিবিদদের মতে, এসব পানীয়তে যেসব উপকরণ রয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়। ফসফোরিক অ্যাসিডের কথাই ধরা যাক। উপকরণটি যোগ করার ফলে পানীয়ের অম্লতা (পিএইচ ২.৮) মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফসফোরিক অ্যাসিড দাঁতের ক্যালসিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্ষয়সাধনসহ দাঁত ধ্বংস করতে পারে, যার শেষ পরিণতি অস্টিওপোরেসিস নামের রোগ সৃষ্টি। কোমল পানীয়তে বাচ্চাদের একটি দাঁত রেখে দিলে তা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গলে যাবে।

দুশ্চিন্তার আরও কারণ রয়েছে। দাম কমানোর জন্য ১৯৮০ সালে থেকে কোকাকোলায় সুগারের পরিবর্তে উচ্চমাত্রায় ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি প্রস্তুতের জন্য যে কর্ন ব্যবহার করা হয় তা আসে পরিবর্তিত প্রজনন গাছ থেকে (Genetically modified plants)।

পরিবর্তিত প্রজনন খাদ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। এছাড়াও এসব পানীয়ের মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় কর্ন ফ্রুকটোজ সিরাপ গ্রহণের ফলে বিশ্বজুড়ে মানুষের ওজন বেড়ে যাচ্ছে এবং অধিক হারে মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছে। মিষ্টি বাড়ানোর জন্য কোমল পানীয়তে অধিক মাত্রায় চিনি ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়। এই চিনিযুক্ত কোমল পানীয় পান করে আমরা প্রায়শই মুখ পরিস্কার করি না। ফলে মুখে চিনির উপস্থিতিতে বিভিন্ন রকমের জীবাণু উৎপন্ন হয় এবং আমাদের সমূহ ক্ষতির কারণ হয়।

বেশি মাত্রায় কোক পানের আরও স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। কোকাকোলায় ব্যবহৃত ক্যাফেইন এক ধরনের উওেজক (Stimulant)। বেশি পরিমাণে কোক-পেপসি পান করা মানে বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন গ্রহণ। বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন শরীরের সংবেদনশীলতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া ক্যাফেইন এডিক্শন বাড়ায়। যারা আলসারে ভোগেন বা যাদের হাইপার-অ্যাসিডিটি আছে, তাদের জন্য কোকাকোলা পান ক্ষতিকর। কারণ কোকাকোলায় ব্যবহৃত ফসফোরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি পেটে হাইপার-অ্যাসিডিটি এবং আলসারের অবনতি ঘটায়।

আগেই বলা হয়েছে, কোক-পেপসির মতো কোমল পানীয়তে প্রাপ্ত কীটনাশক শরীরে মারাত্বক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এসব কীটনাশক ক্যান্সার সৃষ্টি থেকে শুরু করে গর্ভজাত শিশুর অঙ্গবিকৃতি, অঙ্গহানির কারণ হতে পারে।

যাদের চিনির ভয় রয়েছে বা ডায়বেটিস ভুগছেন, তারা সাধারণ চিনিমুক্ত ডায়েট কোমল পানীয় পান করে থাকেন। এসব ডায়েট কোমল পানীয়তে থাকে এসপার্টেম নামের এক কৃত্রিম পদার্থ যা চিনির চেয়ে একশ থেকে দু'শ গুণ বেশি মিষ্টি। এসপার্টেমে রয়েছে ফিনাইল এলানিন নামের একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড। কিছু মানুষের শরীরে এই ফিনাইল এলানিনের রাসায়নিক পরিবর্তন (মেটাবোলিজম) হয় না বলে ফিনাইল কিটোন ইউরিয়া নামের এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা শিশুদের মস্তিস্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, যদি না ঠিকমতো তার প্রতিকার হয়। যেসব মানুষ ফিনাইল কিটোন ইউরিয়াতে ভোগেন, তাদের এসপার্টেমযুক্ত কোমল পানীয় বর্জন বাঞ্ছনীয়।

ভারতে পেপসি ও কোকাকোলার তৈরি কোমল পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট বহুজাতিক কোম্পানি দুটির ওপর নোটিশ জারি করে। নোটিশে ৪ সপ্তাহের মধ্যে তাদের পানীয়ের উপাদান এবং এসব উপাদানের মাত্রা জানাতে বলা হয়েছে। এসব পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতির কারণে ভারতের কেরালা রাজ্যে কোকাকোলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এছাড়াও অন্য পাঁচটি রাজ্যের স্কুল-কলেজ এবং হাসপাতালে কোকাকোলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ভারতের সিএসই কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষার ফলাফল বাংলাদেশের জন্যও শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, পাশের দেশ ভারতে কোকাকোলা ও পেপসিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর কীটনাশক থাকলে বাংলাদেশের কোকাকোলা ও পেপসি কতটুকু নিরাপদ?

দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন শত-সহস্র লিটার কোক-পেপসি পান করছে। এসব পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী কিনা এবং এতে কীটনাশকসহ ক্ষতিকর কোনো উপকরণ রয়েছে কিনা, থাকলে তা কী পরিমাণে আছে তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এসব পানীয় সাধারণত গভীর নলকূপের পানি থেকে তৈরি করা হয়। যেহেতু আমাদের কৃষিজমিতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তাই এখানকার পানিতেও কীটনাশক পাওয়া গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। সাধারণত এসব পানীয়তে ব্যবহৃত সুগারসহ অন্যান্য উপকরণের সংখ্যা এবং মাত্রার উল্লেখ থাকে না। যা পণ্যের গুণগত মানের যথার্থতা প্রমাণে বাধ্যতামূলক বলে আমি মনে করি।

আগেই বলা হয়েছে, পেপসি ও কোকাকোলায় প্রাপ্ত কীটনাশক মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে। এগুলোর কারণে ক্যান্সার, মাতৃগর্ভে শিশুর অঙ্গহানি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, এলার্জি এবং হৃদরোগসহ নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু শিশুরা অধিক পরিমাণে এসব পানীয় পান করে, সেহেতু শিশুদের জন্য তা অধিক মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমি এও মনে করি, শুধু পেপসি বা কোকাকোলা নয়, সব কোমল পানীয়, এমনকি বোতলজাত পানিতেও এ ধরনের কীটনাশক থাকতে পারে। তাই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যহানি থেকে রক্ষা করতে সরকারকে অবিলম্বে এসব পানীয় পরীক্ষা করে তার ফলাফল দেশবাসীকে জানানো দরকার। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অনীহা এবং নিস্ক্রিয়তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এবার বিতর্কিত কিছু খাদ্যে সংযোজন দ্রব্য (ফুড অ্যাডিটিভস) নিয়ে একটু পর্যালোচনা করি।

আমরা প্রতিনিয়তই বহু জিনিস খাই যার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্যের গন্ধ, স্বাদ বা বিভিন্নভাবে আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য অল্প পরিমাণে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বা ফুড অ্যাডিটিভস ব্যবহার করে থাকি। এসব ফুড অ্যাডিটিভসের অধিকাংশই আজকাল বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্যের বর্ণ, সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকম রং ব্যবহার করা হয়। সব ধরনের রং-ই রাসায়নিক পদার্থ যার মেটাবলিজমের জন্য শরীরের যকৃতকে কাজ করতে হয়।

খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত অনুমোদিত রংগুলো ক্ষতিকর নয় বলে দাবি করা হলেও আমি মনে করি অযথা এসব রং ব্যবহারের যৌক্তিকতা নেই। কারণ কোন রং কার জন্য সংবেদনশীল হবে তা কেউ বলতে পারে না। বিশেষ করে কোনো কোনো রং শিশুদের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে। অনুমোদিত হোক বা অননুমোদিত হোক, সব ধরনের রং কারও কারও শরীরে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকগুলো রং বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

সব রাসায়নিক পদার্থই শরীরের জন্য বহিরাগত পদার্থ। শরীর থেকে এসব অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবে, ততই মঙ্গল। বিশেষত, যে সব রাসায়নিক অসার এবং শরীরে যার উপযোগিতা নেই, সেসব যৌগ শুধু খাবারের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য ব্যবহারের যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং খাবারে সব ধরনের রং ব্যবহার বর্জন বাঞ্ছনীয়।

কোনো কোনো খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ ও মিষ্টতা বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম চিনি ব্যবহার আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে ডায়বেটিক রোগীদের জন্য বিভিন্ন পানীয় ও খাদ্যদ্রব্যে কৃত্রিম চিনি ব্যবহার এখন সর্বজনীন। অনেকে আবার ক্যালরি বর্জনের জন্যও চিনির পরিবর্তে বিভিন্ন কৃত্রিম মিষ্টতাবর্ধনকারী গ্রহণ করে থাকেন। এসব কৃত্রিম চিনি ও স্বাদবর্ধনকারী সংশ্লেষিত যৌগের মধ্যে রয়েছে স্যাকারিন, সাইক্লামেট, অ্যাসপার্টেম, অ্যাসিসালফেম-কে, মনসোডিয়াম গ্লুটামেট, নাইট্রেস, নাইট্রাইটস এবং সালফাইটস ইত্যাদি। একমাত্র এসিসালফেম-কে ছাড়া আর অন্যসব কৃত্রিম বস্তুুর ব্যবহারের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে ইদানিং জোরালো বিতর্ক চলছে।

১৯৬৫ সালে অ্যাসপার্টেম আবিস্কৃত হয়। এটি সাধারণ চিনির চেয়ে ১৮০ গুণ বেশি মিষ্টি। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অ্যাসপার্টেম ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে যদিও এর পরপরই এই কৃত্রিম মিষ্টিবর্ধকের নিরাপওা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। বিশ্বজুড়ে প্রায় বিশ কোটি মানুষ অ্যাসপার্টেম গ্রহণ করে এবং প্রায় ৬ হাজার তৈরি খাবারে এটি ব্যবহৃত হয়।

এক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, এক অসম্পূর্ণ উত্তেজনাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্যে দাবি করা হয়েছে, অ্যাসপার্টেম ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ইতালির ইউরোপিয়ান রামাজিনি ফাউন্ডেশনে পরিচালিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়, ইঁদুরে দীর্ঘকালীন অ্যাসপার্টেম প্রদানের ফলে লিমফোমা, লিউকেমিয়াসহ অন্যান্য ক্যান্সার সৃষ্টি করে। পত্রিকাটি মন্তব্য করে, এই ফলাফল সত্যি হলে,অ্যাসপার্টেমকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। পত্রিকাটিতে এ-ও সুপারিশ করা হয়, গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত ভোক্তারা অ্যাসপার্টেম ব্যবহার বদ্ধ করে অপেক্ষা করতে পারেন অথবা সুক্রালোজ জাতীয় অন্য কোনো কৃত্রিম চিনি ব্যবহার শুরু করতে পারেন।

সোডিয়াম সাইক্লামেট চিনির চেয়ে ৩০ গুণ বেশি মিষ্টি। ১৯৩৭ সালে এই কৃত্রিম চিনি আবিস্কৃত হয়। ইঁদুরে ক্যান্সার তৈরি করার বৈজ্ঞানিক ফলাফলের ওপর ভিওি করে এফডিএ ১৯৭০ সালে সোডিয়াম সাইক্লামেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু সাম্প্রতিকর গবেষণায় দেখা যায়, সোডিয়াম সাইক্লামেট ব্যবহার শরীরের জন্য ক্ষতিকারক নয়। এফডিএ সোডিয়াম সাইক্লামেট পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিওিতে পুনর্মূল্যায়নপূর্বক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যায় কিনা তার সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছে।

স্যাকারিন বহুল পরিচিত পুরনো কৃত্রিম চিনি। ১৮৭৯ সালে স্যাকারিন আবিস্কৃত হয়। চিনির চেয়ে স্যাকারিন ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। ব্লাডারে টিউমার সৃষ্টির কারণে ১৯৭৭ সনে এফডিএ স্যাকারিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন অন্য কোনো বিকল্প কৃত্রিম চিনি ছিল না বলে মানুষ এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ শুরু করে। এই প্রতিবাদের মুখে কংগ্রেস ১৮ মাসের জন্য স্যাকারিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখে যাতে আরও গবেষণা চালিয়ে এর নিরাপত্তা সম্পর্কে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়। সেই স্থগিতাদেশ একের পর এক বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো আরও বহুবার স্থগিত করা হবে।

এরই প্রেক্ষিতে এখনও মানুষ স্যাকারিন ব্যবহার করছে। তবে এর ব্যবহারের জন্য স্যাকারিনের সঙ্গে একটি সতর্কবাণী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সতর্কবাণীতে বলা হয়েছে:

"এই দ্রব্যটি আপনার শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই দ্রব্যে স্যাকারিন রয়েছে যা ল্যাবরেটরি জন্তুুতে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।"

পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে সোডিয়াম সাইক্লামেট ও স্যাকারিনের প্রচলন রয়েছে। বছর কয়েক আগে আমি নিজেই বার্লিন থেকে সোডিয়াম সাইক্লামেট ও স্যাকারিন সোডিয়ামের সমন্বয়ে তৈরি সুয়েসলি বাণিজ্যিক নামের প্রতিটিতে ১২০০ ট্যাবলেটের পাঁচটি ফাইল কিনে এনেছিলাম।

খাদ্যের স্বাদ-গন্ধ বাড়ানোর জন্য টেস্টিং সল্ট হিসেবে পরিচিত মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেটের ব্যবহার সর্বজনবিদিত। স্যুপ, ব্রথ এবং রেস্টুরেন্টের খাবারে ব্যাপকভাবে মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহৃত হয়। খাবারের স্বাদ-গন্ধ বৃদ্ধি করাই মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেটের একমাত্র কাজ। বয়স্কদের ক্ষেত্রে মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট নিরাপদ হিসেবে বিরোচিত হলেও, কারও কারও ক্ষেত্রে এই টেস্টিং সল্টের কারণে মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, বুকে ব্যথা এবং মুখমণ্ডল রক্তিমাভ হওয়ার মতো অনেকগুলো উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়।

এফডিএর তথ্য মোতাবেক, কিছু লোক এই সল্টের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, সামান্য মাত্রায় মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট মানবদেহে মারাত্মক ও বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সতর্কতা গ্রহণের লক্ষ্যে শিশুখাদ্যে মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার অনুমোদিত নয়।

পরিশেষে একটি কথা বলব। অনুমোদিত বা নিরাপদ হোক বা না হোক, কোনো বিশেষ খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ কার জন্য উপযোগী বা কার জন্য ক্ষতির কারণ হবে তা অনেক সময় কেউ বলতে পারে না। শরীরের খাদ্য, খাদ্য উপকরণ এবং ওষুধের প্রভাব মানুষ ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। কারণ প্রত্যেক মানুষের শরীরের সংবেদনশীলতা ও প্রতিক্রিয়া এক নয়। কোনো খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ একজনের জন্য নিরাপদ হলেও অন্যের জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তেমনি, ওষুধ সামগ্রী নিয়ে একই বক্তব্য প্রযোজ্য। কারও কারও শরীরে কোনো বিশেষ ওষুধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও অন্যের জন্য একই ওষুধ বিপজ্জনক হতে দেখা যায়।

তারপরও, সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য সতর্ক ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের বিকল্প নেই। বিশ্বজুড়ে সচেতন মানুষের ইদানিং একটি মাত্র শ্লোগান, 'কৃত্রিম নয়, প্রকৃতিতেই সমাধান'। তাই সব ধরনের কৃত্রিম বস্তু, অপ্রাকৃতিক এবং অস্বাভাবিক জীবন পরিহার করে মানব সভ্যতার জন্য প্রকৃতিক জগতেই ফিরে আসা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।


ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ:
অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।