ধর্মের নামে সৃষ্ট পাকিস্তানকে ধর্মান্ধরাই ধ্বংস করছে

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 21 Dec 2014, 07:48 PM
Updated : 21 Dec 2014, 07:48 PM

গত ১৬ ডিসেম্বর আমরা যখন বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে বিজয় দিবস উদযাপন করছি, তখন পাকিস্তানের পেশাওয়ার শহরের একটি স্কুলে মোট ১৪২ জন নিহতের মধ্যে ১৩২ জন শিশুর হত্যার খবর আমাদের আনন্দ ম্লান করে দেয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ১৯৭১ সালের এই দিন বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমাদের মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে, আর আমাদের বাংলাদেশে পাকিস্তানের দখলদার এবং তাদের দোসর– রাজাকার-আলবদর বাহিনীর গণহত্যার অবসানও ঘটে এই দিন।

বিয়াল্লিশ বছর আগে সংঘটিত এই গণহত্যার ক্ষত আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষকে এত বছর পরও যথার্থ কারণেই বিচলিত করেছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, ইসলামের নামে এই নিষ্পাপ, পবিত্র শিশুদের হত্যা করা– আমাদের কেউই সমর্থন করবে না। কারণ, একাত্তরে আমাদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তা-ও ইসলামরক্ষার নামেই করা হয়েছিল। আমাদের এই শান্তির ধর্মটি কতভাবে অপব্যাখ্যা-অপব্যবহার করা হয়েছে, তার ভুক্তভোগী ছিলাম আমরা, পাকিস্তানের তেইশ বছরের অপশাসনকালে। বাংলাদেশের এই বিয়াল্লিশ বছর কালেও ইসলামের অপব্যাখ্যা, অপব্যবহার করেছে আমাদের দেশের কিছু মোল্লা, মৌলভী, মালানা উপাধিধারী ধর্মব্যবসায়ী।

যে কোনো শিশুর চোখের পানি আমাকে বিচলিত করে, হোক না সে কোনো নোংরা বস্তির শিশু। আমাদের বাসাবাড়ির কাজের শিশুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং বিরুদ্ধে আমি অন্তত দশটি কলাম লিখেছি।

এই প্রসঙ্গে আমার খুবই মনে পড়ছে, মুফতি ফজলুল হক আমিনী এবং আবদুল মান্নান মালানা নামের দুই লোকের কথা। ফজলুল হক আমিনীর একটি শ্লোগান ছিল, ''আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান''। আর আবদুল মান্নান মালানা তার ইনকিলাব নামের একটি পত্রিকায়, প্রকৃত চরিত্রে একটি জঙ্গি সংগঠন– এই আমিনীকে সাপোর্ট, সমর্থন দিয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর।

বাংলাদেশকে মুফতি আমিনী ও মান্নান মালানারা আফগানিস্তান বানাতে পারেনি; তবে পাকিস্তানকে অনেকটুকুই আফগানিস্তান বানিয়ে ছেড়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মুফতি আমিনী ও মান্নান মালানারা। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর মান্নান মালানার সাগরেদরা তার বুৃদ্ধি-পরামর্শে হত্যা করেছিল ডা. আলীম চৌধুরীকে। তার কতগুলো মাদ্রাসায় সৃষ্ট জঙ্গিরা এখনও তার দীক্ষায় দীক্ষিত, উদ্দীপিত, অনুপ্রাণিত।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে– বেগম খালেদা জিয়ার সমর্খনেই এই মুফতি আমিনী ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর মালানা মান্নানকে যেমন জিয়াউর রহমান বানিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী; এরশাদ বানালেন পুরো মন্ত্রী। এই জেনারেল এরশাদের দোয়া-দরুদ নিয়েই মালানা মান্নান চালু করলে 'ইনকিলাব', ১৯৮৫তে। দুই জেনারেলই বাংলাদেশে ধর্মান্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গিয়েছেন; যেমন দিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের আরেক জেনারেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, তার অপশাসনের এগার বছরে। বাংলাদেশের এক জেনারেল-পত্নী বেগম খালেদা জিয়াও এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না।

– দুই –

দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক, লন্ডন থেকে প্রকাশিত 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকাটির চলতি সংখ্যায় পাকিস্তানের এই সর্বসাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞের ওপর দুটি আইটেম আছে– একটি সম্পাদকীয়– শিরোনাম ''Massacre in Pakistan: The blood of innocents" (পাকিস্তানে গণহত্যা: নির্দোষ নিরপরাধদের রক্ত); অন্যটি একটি প্রতিবেদন, শিরোনাম, ''Pakistan: From the graveyard'' প্রতিবেদনটির শুরুতেই পাকিস্তানের একজন সামরিক অফিসারের একটি উক্তি:

I am not sure if Pakistan was created in the name of religion. But it is surely being destroyed in the name of religion.

[ধর্মের নামে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল কিনা আমি নিশ্চিত নই, তবে আমি নিশ্চিত যে, ধর্মের নামে পাকিস্তানকে ধ্বংস করা হচ্ছে।]

এই সামরিক কর্মকর্তার ক্ষোভ, আক্ষেপের যথার্থ কারণ আছে। 'ইকোনমিস্ট'এর এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রতি বছর এই ধর্মান্ধ তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ২,০০০ জন; আর ২০১২ এবং ২০১৩ তে ৪,০০০ জন করে। তালেবানদের এইসব হামলায় প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, টিভি স্টেশন, রেডিও স্টেশন, দোকানপাট, করাচিতে নেভাল হেডকোয়ার্টার, রাওয়ালপিণ্ডিতে আর্মি হেডকোয়ার্টার– কিছুই বাদ পড়েনি। স্কুল বাসে কিশোরী মালালা ইউসুফজায়ীকে তার মাথা টার্গেট করে গুলি করে দুই বছর আগে প্রায় মেরেই ফেলেছিল দানব চরিত্রের এই জঙ্গিগুলো।

মেয়েদের শিক্ষার ঘোর বিরোধী তারা। ঘোর বিরোধী তারা গান-বাজনা, রেডিও, টিভি স্টেশন, ডিভিডি, মিউজিক-ক্যাসেট প্লেয়ারেরও। কয়েকশ' বছর আগে দুনিয়া যেমন ছিল, তারা সেই জগতেই নিয়ে যেতে চায় আমাদের সকল মুমিন মুসলমানদের। সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, গণতন্ত্র, ইলেকশন, ভোটাভুটি– এসব তাদের দারুণ অপছন্দ।

তারা সেই মধ্যযুগে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তারা মনে রাখে না যে, বিবি খাদিজা সেই জমানায়, বলতে গেলে হাল আমলের– একটি মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন চালাতেন। তাঁর উটের কাফেলা পণ্য-সামগ্রী নিয়ে দক্ষিণের ইয়েমেন থেকে উত্তরের সিরিয়া পর্যন্ত চলাচল করত; মক্কা শরীফে এই কাফেলা জমজমের পাশে আসা-যাওয়ার পথে বিশ্রাম নিত। আর আমাদের রসুল (স.) এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বিবি খাদিজার একজন কর্মকর্তা ছিলেন।

ষাট বছর আগে আমাদের ছাত্রজীবনে, আমাদের এস এম হলের হাউস টিউটর, পরে শেষ জীবনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের এক অধ্যাপক মরহুম ড. সিরাজুল ইসলাম আমাদের এই ইতিহাস পড়িয়েছেন, বলেছেন শেষ জীবনেও তাঁর ধানমণ্ডির বাসায়ও অনেকবার। ইসলামের উদারতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি এই কথাগুলো বলতেন। সঙ্গে তিনি আরও বলতেন, সেই চৌদ্দশ' বছর আগের বিপরীতে এখন কিন্তু সৌদি আরবে কোনো মহিলাকে একটি ছোট পান দোকানও খুলতে অনুমোদন দেওয়া হয় না। স্যারের বলার ভঙ্গি ছিল খুবই আকর্ষণীয়; শুনতাম গভীর আগ্রহ নিয়ে, গিলতাম গোগ্রাসে।

চৌদ্দশ' বছর পর, মহিলাদের বিরুদ্ধে কেমন আনুষ্ঠানিক বৈষম্য চলছে, তাদের কেমন আটকে রাখা হয়েছে, তার উদাহরণ দেখলাম পরবর্তীকালে চাকরিজীবনে, জেদ্দায়। সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে অবস্থিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা, ওআইসিতে মহিলাদের কোনো রকম চাকরির কোনো ব্যবস্থাই নেই। এই সংস্থায় চাকরির জন্য মহিলারা অযোগ্য, তারা দরখাস্তই করতে পারে না।

– তিন –

পাকিস্তানের ধর্মান্ধরা যে দেশটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তার শুরু আমার যতটুকু মনে পড়ে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলা দিয়ে, ১৯৫৩তে, লাহোরে। মওলানা মওদুদীরা দাবি তুলল, আহমদিয়াদের 'অমুসলমান' ঘোষণা করতে হবে। তাদের দাবির পক্ষে তারা যখন ওই বছরের মার্চ মাসে লাহোরে দাঙ্গা শুরু করে দিল, তখন সেখানে সামরিক বাহিনী নামিয়ে, মার্শাল ল' ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। খাজা নাজিমউদ্দিন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, করাচিতে, পাকিস্তানের তখনকার রাজধানীতে।

মিয়া মমতাজ দওলাতানা তখন পাঞ্জাব প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী। দওলাতানা যখন আপোস করতে চাইলেন জঙ্গিদের সঙ্গে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব (পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারির পর পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত) মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জার সুপারিশ এবং হস্তক্ষেপে তখন মেজর জেনারেল আজম খানকে (পরে ষাটের দশকের প্রথম দিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, আইউব খানের মার্শাল শাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের দারুণ জনপ্রিয় গভর্নর এবং বাঙালিদের মধ্যে এই জনপ্রিয়তার অপরাধে গভর্নর পদ থেকে আইউব খান কর্তৃক অপসারিত) লাহোরের জঙ্গিদের দমন করার দায়িত্ব দেন।

আজম খান সফলভাবেই মওদুদী এবং তার অনুসারীদের পিটিয়ে, গুলি করে, কারফিউ জারি করে, আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন লাহোরে। বিচারপতি মুনীরের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়– সেই কমিশনের বিশাল রিপোর্টে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে। মুনীর লিখেছেন, তদন্তকালে তিনি অনেক ইসলাম বিশেষজ্ঞকে ইসলাম সম্পর্কে কী বোঝেন, জিজ্ঞাসা করেছেন; কিন্তু কোনো দুই বিশেষজ্ঞ একমত হতে পারেননি ইসলামের 'ডেফিনিশন' দিতে গিয়ে।

তবে আমাদের জন্য এই প্রসঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে এই দাঙ্গায় সরাসরি উস্কানির ভূমিকার অপরাধে মওলানা মওদুদীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা যায়নি; কারণ, কতগুলো দেশের চাপে এই আদেশ মওকুফ করে তাকে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুই বছর কারাদণ্ড ভোগের পর তার বাকি দণ্ডও মাফ করে দেওয়া হয়।

আহমদিয়াদের 'অমুসলমান' ঘোষণার দাবি সত্তর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা গেল। ঠেকিয়ে রাখতে পারল পঞ্চাশের দশকের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ইসমাইল ইব্রাহিম চন্দ্রিগড় এবং ফিরোজ খান নূনের সিভিলিয়ান এবং পরে আইউব খান, ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারগুলোও। কিন্তু পারল না জুলফিকার আলী ভুট্টোর গণতান্ত্রিক সরকার! ভুট্টো আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করলেন ১৯৭৪এ। জেনারেল জিয়াউল হক তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা আরও খর্ব করলেন ১৯৮৪তে আবার।

কিন্তু তাতেও তো পাকিস্তানের ইসলামি জঙ্গিরা শান্ত হল না। এইবার শুরু হল শিয়া-সুন্নির খুনোখনি। খুনোখুনি চলতে থাকল মসজিদেও। দেখা গেল, সুন্নিরা যখন মসজিদে নামাজরত অবস্থায় সেজদায় আছেন, তখন বন্দুক হামলা করল শিয়ারা; আর শিয়ারা যখন নামাজরত অবস্থায় রুকুতে, তখন শিয়াদের লক্ষ্য করে সুন্নিদের গ্রেনেড-বোমা হামলা মসজিদেই। মুসল্লিরা যখন আল্লাহতা'আলার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এবাদত-বন্দেগিতে আচ্ছন্ন, যখন আরত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা চিন্তাতেও নেই, তখনই, মুসল্লিদের দুর্বলতম মুহূর্তেই হামলা চালানো হয়েছে বারবার, পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নিদের অনেকগুলো মসজিদে।

সেই সব সিরিজ হামলার এখন আরও বিস্তার ঘটিয়ে সর্বশেষ হামলা চালানো হল পেশাওয়ারের স্কুলটিতে। যে স্কুলে শিশুরা ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, তারা তখন ব্যস্ত ছিল লেখাপড়া বা পরীক্ষা দিতে, ব্যস্ত ছিল তারা হয়তো তখন দৌড়াদৌড়ি বা দুষ্টুমিতে, যা এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য স্বাভাবিক। ইসলামের নামে মসজিদেও হামলা-গ্রেনেড আক্রমণ ছাড়ছে না তারা, ছাড়ছে না তারা শিশুদের স্কুলও।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের আহমদিয়া জামাতের নির্বিরোধ মানুষজন সম্পর্কেও একটু উল্লেখ করতে চাই। জীবনের বিভ্ন্নি সময়ে যে আহমদিয়াদের আমি দেখেছি, তাদের সকলকে আমি শান্তিপ্রিয়, আইন-কানুন মান্যকারী নাগরিক হিসেবেই দেখেছি। তারপরও এই বাংলাদেশে তাদের বিরুদ্ধে হুমকি-হামলা চলেছে। তবে শেখ হাসিনা সরকারের গত ছয় বছরে এমন কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।

বিএনপি-জামাতিদের অপশাসনকালে, সাত-আট বছর আগে তেজগাঁওতে আহমদিয়াদের মসজিদে খতমে নবুওয়াতের দুই জঙ্গি– নুরানি এবং মমতাজিদের নেতৃত্বে পূর্বঘোষিত হামলা রুখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরস্ত্র রাষ্ট্রদূতরা মসজিদের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। কারণ, খালেদা জিয়া-মতিউর রহমান নিজামীদের সরকার তাদের 'প্রটেকশন' দিতে চায়নি। কিন্তু 'প্রটেকশন' দিতে সফল হয়েছিলেন এ রাষ্ট্রদূতরা।

পাকিস্তানের এইসব উদাহরণ থেকে আমাদের দেশের সরকার এবং দেশপ্রেমিক, সচেতন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনকেও 'সিরিয়াস' শিক্ষা নিতে হবে।

– চার –

নিষ্পাপ, নিরপরাধ, ফুলের মতো পবিত্র শিশুরাও দুষ্টুমিতে কেমন দক্ষ হতে পারে এখন তার দুটো উদাহরণ:

আমাদের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেলে কিছুদিন ধরে একটি পাউডার সাবানের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায়, আট-দশ বছর বয়সী কয়েকজন শিশু একটি মাঠে একটি ফুটবল দিয়ে খেলেছে। হঠাৎ ফুটবলটি মাঠের বাইরে চলে যায়; ফুটবলটি উদ্ধার করা যায় না, মাঠের বেড়ার ধারালো একটি খুঁটির ওপর পড়ে ফুটবলটির বাতাস বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু খেলা তো আর বন্ধ রাখা যায় না। পরের দৃশ্যে দেখা যায়, তারা গোল হয়ে মাথা নিচু করে কিছু একটা পরামর্শ করছে, যেমন দেখি কখনও কখনও আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলায়। তারপরের দৃশ্যে দেখা যায়, শিশুরা আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের খেলোায়াড়দের জার্সির হালকা নীল-সাদা রঙয়ে বানানো তাদের গায়ের ছোট ছোট জার্সিগুলো খুলে একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া লাগিয়ে একটি ফুটবল বানিয়ে ফেলেছে এবং সেই জার্সিগুলো দিয়ে গোল করে বানানো ফুটবল দিয়েই খেলতে শুরু করে। গায়ে তাদের তখন শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি।

বলটি তাদের কোনো একজনের লাথিতে বারান্দায় দাঁড়ানো তরুণী এক মা'র কাছে গিয়ে পড়ে। শিশুরা ও্ই মা'র প্রতিক্রিয়া দেখতে কয়েক সেকেন্ড ভয়ভীতি নিয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু মা হঠাৎ হেসে ফেলেন এবং শিশুদেের দিকে তাদের জার্সি দিয়ে তৈরি বলটি ছুঁড়ে ফিরিয়ে দেন। শিশুরা আবার দারুণ খুশিতে বলটির দিকে ছুটতে থাকে। তারপর দেখা যায়, ঐ মা ঐ গুঁড়া সাবান দিয়ে জার্সি ধুচ্ছেন।

হারানো বলটির পরিবর্তে তাদের পরনের জার্সি দিয়ে আরেকটি বল বানানোর দুষ্টুমি বুদ্ধি আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে।

অন্য উদাহরণটি আমার নিজের দেখা, বছর পনের আগের। শীতকাল, বিকাল বেলা, গ্রামের বাড়িতে চাচাতো ভাই সাদেকসহ রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাশের গ্রাম বশিকপুরের বকশী শাহ হাই স্কুলে গেলাম। স্কুল মাঠে দেখি, নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছিল দুই কিশোর। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, একজনের ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেটটি ভেঙে গেল, অন্যজনেরটিরও কী কারণে যেন অকেজো হয়ে পড়ল। তাই বলে খেলা তো আর বন্ধ থাকতে পারে না। মাগরেবের আজানের আরও কয়েক মিনিট বাকি। সুতরাং তারা আবার শুরু করল খেলা, এইবার তাদের পায়ের স্পঞ্জ স্যান্ডেল দিয়ে। তাদের উদ্ভাবনী-শক্তি দেখে আমি মুগ্ধ। স্মৃতিটি এখনও মনে পড়লে একাকী হেসে উঠি।

শিশুরা যে মানসিকভাবে কত দুর্বল ও সংবেদনশীল হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলগুলোতে সেই পঞ্চাশ বছর আগে একটি নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে দেখেছি– শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রস্তুত করা কোনো অনুষ্ঠানে কোনো পোষা প্রাণি– যেমন, কুকুর, বেড়াল, পাখি– এদের মৃত্যু বা কষ্ট দেখানো যাবে না। কারণ, পোষা প্রাণির কষ্ট এই বয়সী ছেলেমেয়েদের মনে অনেক বেশি দাগ কাটে। ষাট বছর পর এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আব্বার পালিত খাসিটি যখন এক কোরবানির ঈদে জবাই করা হল, তখন আমরা সব ভাইবোন বিভিন্ন ঘরে গিয়ে কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলেন সেদিন আমাদের মা-ও। খাসিটি খুব আদরের ছিল আমাদের। কখনও কখনও আমাদের সঙ্গেই ঘুমাত।

সেই যে পঞ্চাশ বছর আগে সত্যজিত রায়ের 'পথের পাঁচালি' ছবিটিতে দুই শিশু ভাইবোন– অপু ও দুর্গাকে দেখেছিলাম– দুর্গার মৃত্যুতে অপু কেমন নিরবে ভেঙে পড়ল, সাথীহারা হয়ে গেল, দৃশ্যগুলো মনে পড়লে আমার চোখ এখনও ছলছল করে।

পেশাওয়ারের যে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, তারাও তো বিজ্ঞাপনের সেই খেলোয়াড় শিশুদের মতো, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কিশোরদের মতো বা আমাদের মতো খাসি, ছাগল, ছাগলছানা, মুরগি, মুরগিছানা, বাছুরপ্রেমিক শিশু-কিশোর-কিশোরীর মতোই ছিল। কোনো পাপ তাদের স্পর্শ করেনি. কিন্তু তারপরও তাদের মেরে ফেলল, কিছু ধর্মান্ধ, ধর্মের নামে।

– পাঁচ –

তালেবান ধর্মান্ধরা কেমন ভয়ঙ্কর ভয়াবহ হতে পারে, তা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও এখন মনে হয় বুঝতে পারছে। তবে, এদের সৃষ্টি এবং উত্থানের পেছনেও পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, 'আইএসআই'এর প্রবল ভূমিকা ছিল। এখন অবশ্য 'আইএসআই'এর সেই ভূমিকার বিপরীতে শনিবারের সকল পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল রাহেল শরীফ আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন হাজার তালেবান জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে স্থগিত রাখা এমন দণ্ডপ্রাপ্তদের দুজনকে গতকাল ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, এদের দমনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও খুব এক শক্ত অবস্থান নিয়েছে।

সামনে আমাদের বিশ্ব তাবলিগ জামাত। গতকাল টিভির খবরে দেখলাম, এই বিশ্ব ইজতেমায় এমন ধর্মান্ধ জঙ্গিদের সম্ভাব্য হামলার মোকাবেলায় আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী এইসব জঙ্গিদের চরিত্র এবং সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে দেশের মানুষজনকে তিন দিনব্যাপী বয়ানের অন্তত কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সতর্ক করে দেওয়ার একটি বড় সুযোগ এই ইজতেমা। তাবলিগ জামাতের আমীর এবং আর সব বয়ানকারীর কাছে প্রস্তাবটি বিবেচনা করার জন্য সবিনয়ে অনুরোধ করি।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪।


মহিউদ্দিন আহমদ:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।