ইবসেনের বুনো হাঁস ও সুন্দরবনের টিকে থাকা

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 21 Dec 2014, 07:56 AM
Updated : 21 Dec 2014, 07:56 AM

'ওয়াইল্ড ডাক' হেনরিক ইবসেনের আলোচিত একটি নাটক। নাটকের আহত বুনো হাঁসটিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে দেখা যায় সত্যের বিবিধ বাস্তবতা সত্যায়িত করতে। ঠিক তেমনি গত কয়েক দিনের সবগুলো জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতা জুড়ে তেল-কাদায় জড়ানো কাঁকড়া, নিজ বর্ণ হারিয়ে তেল চুপচুপে পাখি, নদী ও খালগুলোতে কালো জলের রেখা যেন সেই আহত বুনো হাঁসের সমকালীন সংস্করণ। আমাদের নিদারুণ উদাসীনতায় সুন্দরবন আজ ক্ষতবিক্ষত।

সুন্দরবনসহ দক্ষিণবঙ্গের যেসব অরণ্য আছে, তা বাঁচানোর যথেষ্ট উদ্যোগ না থাকায় অন্যান্য মহলের মতো ভারতের জাতীয় পরিবেশ আদালতও উদ্বিগ্ন। এতটাই যে, এই মুহূর্তে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ কী অবস্থায় রয়েছে, স্যাটেলাইট ইমেজ পেশ করে তা জানানোর জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে তারা। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে, এই আশঙ্কা করে ভারতের জাতীয় পরিবেশ আদালতের কোলকাতা বেঞ্চ সেপ্টেম্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের চেহারা কী রকম, নদী বা খাঁড়িতে দূষিত ডিজেল ব্যবহার করা হয় কি না, সেখানে বেআইনি ইটভাটা চলে কি না অথবা সুন্দরবন এলাকায় অবৈধ হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান জানতে চেয়েছে পরিবেশ আদালত। ওই আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় এবং পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে উপগ্রহ-মানচিত্র অবশ্যই থাকতে হবে।

আরও জানা যায় যে, সুন্দরবনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে অ্যামিকাস কিউরি বা আদালত-বান্ধব নিযুক্ত করা হয়েছে। আদালতে তিনি জানান, রাজ্য সরকার সম্প্রতি সুন্দরবনে বিভিন্ন শিল্পপতিদের নিয়ে গিয়ে সেখানে 'ইকো-ট্যুরিজম' বা পরিবেশ-পর্যটন চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে। আদালতে সুভাষের আবেদন, সুন্দরবন এলাকায় ইকো-ট্যুরিজম চালু করার আগে যেন নিয়ম মেনে পরিবেশ ও বন-সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আগে অনেক ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

ভারতে সুন্দরবন সংক্রান্ত এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করে। আরও প্রাণিত হওয়া যেত যদি তা বাংলাদেশের আদালতেরও হত। এ নির্দেশনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আদালতের। বাংলাদেশের আদালতে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র সংক্রান্ত তিনটি রিট মামলা অনিষ্পন্ন থাকলেও থেমে নেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের কাজ।

ঘটনাচক্রে ভারত সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের পর দিনই আমরা দেখতে পাই আমাদের দেশের অন্যতম গর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলভর্তি জাহাজ ডুবে বিপর্যয়কর অবস্থা। সুন্দরবনের মধ্যে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কার থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবন এলাকার নদী-খালসহ ৭০ কিলোমিটার এলাকায়। জোয়ারের সঙ্গে এই তেল মিশেছে খুলনা নগরী সংলগ্ন রূপসা নদীতেও। এভাবে তেল ছড়িয়ে পড়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথের ব্যাপারে ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছে। নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের গোচরেই বন আইন, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি), ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিশনের নিয়ম লঙ্ঘন করে বনের ভেতর দিয়ে চলছে বিভিন্ন তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ। শুরুর দিকে ১০ থেকে ২০টি পণ্যবাহী জাহাজ এবং তেলবাহী ট্যাঙ্কার চললেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ পর্যন্ত।

এসব নৌযান চলার শব্দ এবং হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করায় পশু-পাখি একদিকে যেমন ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের প্রজননক্রিয়াও বিঘ্নিত হচ্ছে। রাতে চলাচলকারী নৌযানের সার্চলাইটের তীব্র আলোয় আকর্ষিত হয়ে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুমির, ডলফিনসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণি। সুশাসন না আছে জলে-জঙ্গলে, না জনপদে। আর সুশাসনের অভাবই বিপদাপন্ন করে তুলেছে সুন্দরবনের টিকে থাকা।

প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসায় তিনি ১ মে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে নৌপথটি বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে অব্যাহত আছে নৌযানের চলাচল। আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্বের সম্পদ, বিশ্বের বিস্ময় সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য নেই আমাদের কার্যকর উদ্যোগ।

সুন্দরবনের আয়তন অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। মানবসৃষ্ট পরিবেশবিরোধী অনাচার আর বৈরি জলবায়ুর প্রভাবে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটারে যার ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের অংশে। যতই দিন যাচ্ছে, সুন্দরবনের আয়তন ততই কমে যাচ্ছে। UNDP ও FAO এর সমীক্ষার দেখা গেছে যে, শুধু সুন্দরবনে বাস করে ৪২০ টি বাঘ, ১ লাখ ২০ হাজার হরিণ, ৪০ হাজার বানর, ৪৩ হাজার বন্য শূকর, ৩ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এছাড়া ভাল্লুক, সাপ, কুমির, কাঠবিড়ালি, বিলুপ্তপ্রায় গুই সাপ ও হাজার রকমের কীটপতঙ্গের বসবাস এই সুন্দরবনে। মিঠে পানির ডলফিনেরও অভয়ারণ্য সুন্দরবনের নদীগুলো।

আমাদের এই সুন্দরবন জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের বড় একটি আধার। অযুত উদ্ভিদ-প্রাণি, অণুজীব ও এদের দেহের জিন-সমষ্টি একে দিয়েছে অনন্যতা। যে কোনো এলাকার জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে বনভূমির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন ধ্বংস করার ফলে নানা ধরনের উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়। ফলে খাদ্য-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। এর ফলে জীবের বা প্রাণির বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেয়।

জীববৈচিত্র্য তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে: স্পিসিস ডাইভারসিটি, জেনেটিক ডাইভারসিটি ও ইকোসিস্টেম ডাইভারসিটি। এদের আন্তঃসম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে পুরো ব্যবস্থা। যেমন, এর মধ্যে ইকোসিস্টেম ডাইভারসিটির ওপরই অন্য দুটি নির্ভরশীল। ইকোসিস্টেম হল এমন এক আদর্শ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে জৈব-অজৈব শর্তাবলীর ভারসাম্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠে ও টিকে থাকে। জৈব শর্ত হল, উদ্ভিদ ও প্রাণি। আর অজৈব শর্তগুলো হল, তাপ, আলো, বাতাস, আর্দ্রতা ও বিভিন্ন ধরনের অজৈব রাসায়নিক উপাদান। এগুলোর সম্মিলিত অবস্থানই জীববৈচিত্র্য।

তাই যদি কোনো অস্বাভাবিক প্রভাব এদের ওপর পড়ে, তবে সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যেতে পারে। অনিবার্যভাবে এ অবস্থায় জীবজগতের অন্যান্য প্রাণিকূলের মধ্যে মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবার আগে।

তেলবাহী জাহাজডুবির পর এরই মধ্যে সুন্দরবন এলাকার কয়েকটি স্থানে নদীতে মরা মাছ ভাসতে দেখা গেছে, ডলফিন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দীর্ঘমেয়াদে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণি খাদ্যসংকটে পড়বে। জলজ প্রাণির প্রজননের সময় হওয়ার কারণে ক্ষতির অংক হবে আরও বেশি। বন বিভাগ ১০০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা উল্লেখ করে মংলা থানায় মামলা করেছে। যেন দুর্ঘটনার দুদিনের মধ্যেই ক্ষতির অংক জেনে গেছে ওরা!

বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বারবার বলে আসছে যে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক নৌযান চালানো যাবে না; কারণ, তাতে যে কোনো সময় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এমনকি বন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও এ দাবি তোলা হয়েছে। কিন্তু নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কথায় তো নয়ই, বন অধিদপ্তরের আবেদনেও কান দেয়নি। আগে সুন্দরবনের যে চ্যানেলটি দিয়ে জাহাজ চলাচল করত, সেটা দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ড্রেজিং করে নৌ-চ্যানেল চালু রাখা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাজ। এরপর 'কে দায়ী' জাতীয় প্রশ্ন উঠলে, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দিকে আঙুল তোলা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

দুর্ঘটনাটির অন্য কারণও আছে। আমরা জানি, সুন্দরবনের অদূরেই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ওই প্রকল্পের জন্য কয়লা ও অন্যান্য সরঞ্জামবাহী জাহাজগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ক্ষতি তো হবেই। তেলবাহী জাহাজডুবি তো ক্ষয়ক্ষতির শুরু মাত্র।

সুন্দরবনে জাহাজ ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ার পর যে কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল তা করা হয়নি– হয় জ্ঞানের অভাব না হয় সরঞ্জামের অভাব। প্রথমত, নদীতে ফ্লোটিং বুমের সাহায্যে ভাসমান তেল না ছড়ানোর ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, ভাসমান তেল নদী থেকে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ জন্য বিশেষ প্রযুক্তির প্রয়োজন। ফার্নেস তেল ও অন্যান্য রাসায়নিক 'হ্যাজম্যাট'এর (হ্যাজারডাস ম্যাটেরিয়াল বা ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ) পরিবহনে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া হয় না বলেই মনে করা হয়। মন্ত্রণালয় এই রীতি পালনে সচেতন নয়। সুন্দরবনের জাহাজডুবি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি সংশ্লিষ্টদের নেই।

এ দেশে প্রচলিত নিয়ম-বিধি তো মানা হয়ই না, আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের প্রতিও ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই অনেকের। সুন্দরবনের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জীববৈচিত্র্যের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ ওয়েটল্যান্ড ও বনাঞ্চলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দায়িত্ব পালন করে রামসার কনভেনশন। রামপালে, সুন্দরবনের কাছে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারেও তারা উদ্বিগ্ন। কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটির ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী, সুন্দরবনের মতো অনন্যসাধারণ ইকোসিস্টেম রক্ষার বাধ্যবাধকতা আছে, কিন্তু কারও তা মানতে যেন বয়ে গেছে।


Once more into the fray
Into the last good fight I'll ever know
Live and die on this day …
Live and die on this day …

'দ্য গ্রে' সিনেমার প্রধান চরিত্র রূপদানকারী যখন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও হিংস্র বাঘকে মোকাবেলা করতে যাচ্ছিল, তখন এই প্রেরণাদায়ী কথাগুলো আওড়াচ্ছিল। কারণ, সে জানে, বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায় নয়, বরং লড়াই তাকে শেষ জীবনের সংবাদ দিবে। তেমন আমরাও আশা রাখি, আমাদের সমূহ অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ে শেষ পর্যন্ত সুন্দরবন জয়ী হবেই। প্রাণের স্পন্দনই তো জীবন।


এম এম খালেকুজ্জামান:
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।