বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 14 August 2019, 06:00 PM
Updated : 17 Dec 2014, 07:25 AM

আমি আশাবাদী মানুষ। বিজয়ের এই মাসে হতাশার কথা লিখতে চাই না। বয়সের ভারে ন্যূব্জ ক্লান্ত অতীতমুখী রাজনীতিবিদরাই এদেশের সবকিছু নন। যাঁরা আজীবন এক কথা এক কাজ এক চিন্তা আর একই বৃত্তে ঘুরে বেড়ান, তাদের মনোটোনাস জীবন ও জীবনবোধের ক্লান্তি যেন আমাদের স্পর্শ না করে।

পঞ্চাশ পেরিয়েছি আমি, বয়স নিতান্ত কম নয়। এ জীবনে কম কিছু দেখিনি। এমন মানুষ তো আমাদের ইতিহাসেও আছেন যাঁরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের চিন্তা-চেতনা ঝালিয়ে আরও শাণিত ও দীপ্তিময় হয়ে উঠেছেন। পাশের দেশের রাজনীতিবিদরা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতাকেও নিজেদের মতো আত্মস্থ করে নেন। আমাদের নেতারা তা করেন না। আর করেন না বলেই এক ধরনের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামির শিকার তারা।

কে কবে একখানা ভালো বই পড়েছেন বা ভালো মুভি দেখেছেন? শেষ কবে কার কথায় আমরা এমন রেফারেন্স পেয়েছি যে চমকে উঠব? সরকারি দলের তথ্যমন্ত্রী ভদ্রলোক বাম দল থেকে আগত অতিথি। বাম মানেই তো লাল বইয়ের পোকা। বিপ্লব সমাজতন্ত্র আশাবাদের জয়জয়কার। একসময় জানলে বা পড়লেও এখন আর তার ধারেকাছে আছেন বলেও মনে হয় না। যাবতীয় পাঠবিদ্যা, ধ্যান, সব কেবল খালেদা জিয়াকে ঘিরে আবর্তিত। বিগত দু' বছরে তাঁর কথার সালতামামি করলে দেখা যাবে, বেগম জিয়াই আরাধ্য।

মীর্জা ফখরুলকে দেখলে মনে হয় নিপাট ভদ্রমানুষ। কথাবার্তাও মন্দ বলেন না। কিন্তু তাঁর কথা বা ভাষণ-বিবৃতির সারমর্ম কী? কখনও মৌলবাদের ধামা ধরা, কখনও তারেকের মতো রাজনৈতিক শিশুর গুণকীর্তন। এর নাম রাজনীতি? এদের কাছে আমরা পাব বাংলাদেশ গড়ার দিকনির্দেশনা?

বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরি না কেন। জেলজীবনে অভ্যস্ত বঙ্গবন্ধু দার্শনিক রাসেলের বই পড়ে বিমোহিত হবার কারণে শেষ সন্তানের নাম রাসেল রেখেছিলেন। উত্তরণটা খেয়াল করার মতো। কোনদিকে কোন চিন্তায় ধাবিত হচ্ছিল গতিপথ? তাজউদ্দীন আহমেদর ডায়েরি এখন জীবন্ত ইতিহাস। দেশ স্বাধীন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতির সঙ্গে এঁরা পড়াশোনা বা লেখালেখির কাজ করতে ভুলতেন না।

আজকের রাজনীতিবিদরা সময় ব্যয় করে বাজার ফর্দ বা হিসেব লেখেন কিনা তাও সন্দেহের বিষয়। পেশাগতভাবে রাজনীতি লাভজনক আর ধান্দায় পরিণত হবার কারণে এদের হাতে সময় নেই। যেটুকু সময় সব কথা আর টকশোতে উগড়ে দেবার, তাতে বিদ্বেষ আর ঝগড়া ছাড়া তেমন কিছু নেই।

আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমাদের জনক নেতা ও যুদ্ধরত মানুষদের কারও বয়সই পঞ্চাশের বাইরে ছিল না। অল্প কজন বাদে বাকিরা ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক। যে কারণে হয়তো তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারতেন। একটা বয়সে মানুষের চিন্তা-চেতনা আর মনোসংযোগে শৈথিল্য চলে আসে। তাছাড়া আমাদের জীবন বা সমাজ বড় অদ্ভুত। এর একদিকে যেমন আবেগ-বৈচিত্র্য আর ভালোবাসা, আরেক দিকে অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি।

আজকাল মানুষের চেতনাবোধও ভোঁতা প্রায়। সত্যবাদী হলে বলতে হবে জীবনে ধর্মের নামে এমন মাতম আগে কখনও দেখিনি। এখন যা দেখছি তার পুরোটাই আফিমের মতো, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা। ইহকাল পরকালের এমন ব্যালেন্স আগে কোনোদিন শুনিনি। 'সাচ্চা' বামরাও এখন বদলে যান। ধর্মের কোনো বিষয়ে কথা বলা মানুষ খুন করার চেয়েও বড় অপরাধ। সামাজিকভাবে দেখুন, বিজয় মিছিলে শহীদ মিনারে যাওয়া বা কোনো আনন্দ উৎসবে অংশ নেওয়া বাঙালি বাসায় এসে তওবা করে শুদ্ধ হবার চেষ্টা করছে। আনন্দ উৎসব দেশ ও জাতির ব্যাপারে যেমন সে নিরব থাকতে পারছে না, তেমনি ধর্মের নামে এক ধরনের মৌলবাদও তাকে ছেড়ে কথা বলছে না।

পরিচিত এক তরুণী আমাকে তার জীবনের এক নির্মম গল্প শুনিয়েছিলেন। যখন বিয়ে হয় তখন তাদের দুজনের বিশ্বাস ও মতামত ছিল এক ধরনের। বরং যুবকটিই অধিক মুখর ও প্রগতিশীল। সময়ের স্রোতে তার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পারিপার্শ্বিক রাজনীতি, বন্ধু-বান্ধব মিলে যুবকটির মনোজগতে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। তরুণী বুঝতেও পারেননি কোথায় কী ঘটে চলেছিল।

একদিন দেখে বাড়িতে লাগানো তার সাধের একটি পোস্টার উধাও। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচলিত ঘরে ঘরে জনপ্রিয় 'বাঙ্গলার হিন্দু বাঙ্গলার মুসলিম বাঙ্গলার বৌদ্ধ বাংলার খ্রিস্টান' শ্লোগান সম্বলিত পোস্টারটি যত্ন করে রেখেছিলেন। দেখতে না পেয়ে যখন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তখন স্বামীই জানালেন, ওই পোস্টাটার ঘরে রাখা চলবে না। তাই তিনি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলেছেন।

বলতে বলতে তরুণীর বাস্পরুদ্ধ কন্ঠ। আমি সান্তনা দিয়ে বলেছিলাম, "ঠিক হবে যাবে"। আসলে কোনোদিনও ঠিক হবে না। এর উত্তর একটাই, বাঙালি আজ আর বাঙালি নেই। হয়সে মুসলমান, নয়তো হিন্দু বা অন্য কিছু। রাজনীতির বেলাব হয় পাকি, নয় ভারতীয় বা আমেরিকান।

এর চেয়েও কঠিন গল্প আছে জীবনের। সে সব কথা থাক। বিজয় দিবসের এই লেখায় আমি মনখারাপের কথা বলতে চাই না। কিন্তু বদলে যাওয়া যে মানুষ স্ত্রীর হারমোনিয়াম আছড়ে ভেঙে ফেলেন, যিনি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে বাড়িতে এসে বলেন, "তোমার বেপর্দার কারণে আজ এই দশা"– তার কাছে এই বিজয় দিবসের তাৎপর্য কী? আজ তার জীবনে এর মূল্যই-বা কতটুকু?

একসময় রাজনীতি এগুলোর মোকাবেলা করত। কারণ যার যা আদর্শ, তাই তো তার শক্তি। এখন যেহেতু আদর্শ বলতে আসলে কিছু আর নেই, তাই ঠেকানোরও দায়-দায়িত্ব নেই কারও।

আমাদের দেশের মিডিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে যারা আনন্দিত তাদের এটাও মনে রাখতে হবে নেগেটিভিটি কোনোভাবেই মাপকাঠি হতে পারে না। বাংলাদেশের যে কোনো ট্র্যাজেডি বা দুঃখজনক ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা দেখুন। রানা প্লাজার সময় কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা লাশের জন্য বেপোরায়াভাবে অধীর আগ্রহে সময় পার করছেন। আহত মানুষকে উদ্ধার করার পরিবর্তে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে পাথরচাপায় তার অনুভূতির কথা জানতে চাওয়ার মতো অপরাধে অপরাধী আমরা।

মানবিক গুণ হারিয়ে ফেলা জাতির মিডিয়ার আরও কাণ্ড দেখুন। আমাদের দেশ ও জাতির জন্মলগ্নে বিরোধিতাকারী শত্রু দেশ আমেরিকা। এখন তার অবস্থান যাই হোক না কেন, একাত্তরে নিক্সন কিসিঞ্জার ছিলেন আমাদের ঘোর বিরোধী। সে দেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে থাকলেও প্রশাসন ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। অথচ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত মিডিয়া আমাদের হেদায়েত করেন তাদের নথি দিয়ে! এটা তো একজন শিশুও বোঝে যে, তারা আর যাই লিখুক, আমাদের ইতিহাসের আসল দিক বা সত্য লিখবে না। তারপরও অতীত খুঁড়ে এগুলো নিয়ে আসার মানে কী? মানে নতুন নতুন কাদের সিদ্দিকী আর এ কে খন্দকারের জন্ম দেওয়া?

যে সব দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তাদের শত্রুরা মার্জনা চাইলেও আমাদের দেশে তা হয়নি। হতে দেওয়া হয়নি। অন্তর্কলহ আর বিবাদ না থাকলে বাঙালির সঙ্গে রাজাকারদের পারার কোনো কারণ নেই। তারা পারছে জামাত-হেফাজতের জন্য নয়, বিএনপি, প্রথম আলো বা মানবজমিনের জন্য। পারছে নব্য রাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কমিউনিস্টদের জন্য। পারছে মোশতাকের দোসর আওয়ামী লীগারদের জন্য।

আজকের রাজনীতি এগুলো ঠেকাতে পারছে না। কী আওয়ামী লীগ কী বিএনপি, সবার একটাই উদ্দেশ্য, যেনতেন প্রকারে গদিতে থাকা। বহু বছর আগে আমি বিলেতে শয্যাশায়ী সাংবাদিক বূউস উইলসনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি বিজয়ের সন্ধ্যায় রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন। অষ্ট্রেলীয় সাংবাদিক ব্রুস আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জিতেছে, তবে যেভাবে তার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে তাতে এর আদল পাল্টে গেলেও তিনি অবাক হবেন না।

বঙ্গবন্ধু বা জাতীয় নেতাদের মতো বীর-হারানো বিজয়ের এই দিনে কী মনে হয়? আমরা কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আছি? না বদলে যাওয়া কোনো দেশে? তবু আমি আশাবাদী। কারণ আমদের জন্ম হয়েছিল রক্তধারায়। রক্তের ধারা কখনও পেছনে গড়ায় না।

তারুণ্যের হাত ধরে একদিন হয়তো এর জবাব দিতেই উঠে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।