সরকারি কর্মচারিদের নিরপেক্ষতা সুশাসনের প্রতীক

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 19 July 2019, 05:30 PM
Updated : 12 Dec 2014, 06:37 AM

সুশাসন হচ্ছে কৌশল, পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান পরিবেষ্টন করে এমন এক পরিবেশ ও পরিস্থিতির উদ্ভাবন, যেখানে সকল স্তরের নাগরিক ও জনগোষ্ঠী তাদের আইনগত অধিকার প্রয়োগ করবে, জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব হবে এবং আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সন্ধানলাভ সহজ হবে। সুশাসনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সক্রিয়তা ও প্রতিবেদনশীলতা। শাসন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার অভাব হলে অথবা জনপ্রশাসন দলীয় ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে পক্ষপাতিত্ব করতে থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলতার উদ্ভব ঘটে এবং পারস্পরিক সংঘাতের সূচনা করে, যা দেশ ও জাতির প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান ধারক ও বাহক আমলাতন্ত্রকে অবশ্যই নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে এবং জনগণকে পক্ষপাতহীন প্রশাসন উপহার দিতে হবে।

বাংলাদেশের জনগণের বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে, জনপ্রশাসন থাকবে একটি নিরপেক্ষ, ন্যায়বিচার-ভিত্তিক অঙ্গন এবং সকল প্রকার বৈষম্য-বিবর্জিত প্রতিষ্ঠান যেখানে সকলের জন্য সুযোগের সমান অধিকার বিরাজ করবে। বাংলাদেশের জনগণের এ হচ্ছে দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও অভিব্যক্তি। তাই যখনই কোনো প্রকার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়, তখন তারা দ্বিধাহীন চিত্তে তার প্রতিবাদ করে। গণমাধ্যম জনগণের এই নিরব প্রতিবাদ প্রকাশ করে বিভিন্নভাবে।

অনেকেই মনে করেন, কোনো সরকারি কর্মচারি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা প্রকাশ করলে তা হচ্ছে 'অসদাচরণ'– 'কোড অব কন্ডাক্ট'এর পরিপন্থী, সুশাসনের ব্যত্যয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমন একটি ভাবনা থেকেই বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সরকার গণকর্মচারি (আচরণ), ১৯৭৯ বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন। তাতে সম্পত্তির মালিকানা থেকে শুরু করে নানাবিধ আচরণের বিধি-নিষেধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধিমালার ২৫ নং অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয় যে, কোনো সরকারি কর্মচারি কোনো প্রকার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে না এবং তার উপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি রাজনীতি বা সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে দিতে পারবে না। আবার ৩০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, তার কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবে না। এছাড়াও পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয় যে, কোনো কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্যের সমীপে তার চাকরির ব্যাপারে অভিগমন করতে পারবে না। তাছাড়া, পত্রপত্রিকায় তার কোনো অভিযোগ প্রকাশ করতে পারবে না বা তার দ্প্তর সর্ম্পকে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন বা পরিবেশন করতে পারবে না।

সংক্ষেপে বলা যায়, সরকারি কর্মচারির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সরকার আইনত নিষিদ্ধ করেছেন এবং অসদাচরণ হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৮৫ সালে সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুসারে 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ' হিসেবে গণ্য করেছেন। এসব নিয়ম-কানুন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারির অজানা নয়। তারপরও লক্ষ্য করা যায়, 'জনতার মঞ্চ' হয়েছে যেখানে সরকারি কর্মচারিরা যোগ দিয়েছেন, 'উত্তরা-কাণ্ড' ও 'পাণ্ডা-গার্ডেন' ঘটনা নিয়ে তদন্ত হয়েছে। অনেকে ওএসডি বা পদায়ন ও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার সরকার পরিবর্তনের ফলে ফিরে এসেছেন সব পদমর্যাদা নিয়ে।

সরকার শুদ্ধাচার কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছেন, দুর্নীতি দূর করবেন বলে। কিন্তু ফলাফল কি দৃশ্যমান হয়েছে? সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫ সরকার প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেছেন। এই বিধিমালা অনুসারে অসদাচরণের জন্য গুরুদণ্ড পেয়েছেন এমন সংখ্যা বিরল। লঘুদণ্ড কিছু হয়েছে, তবে তাও মাপ পেয়েছেন অনেকে। সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন করবেন, কিন্তু কবে হবে কেউ ভালোভাবে জানে না।

এসবের কারণ কী? বাস্তবে রাজনৈতিক দল চায়, আমলাগণ তাদের আজ্ঞাবাহী হবে। তারা নিরপেক্ষ হলে, ক্ষমতাসীন দল কীভাবে তাদের সুবিধা ভোগ করবে? অথবা তাদের দলের কর্মীরা কীভাবে চাকরি বা পদোন্নতি পাবে? তাই তারা চায় সেই আমলাকে যারা তদের সঙ্গে সঙ্গে চলবে, প্রয়োজনে আইন বদলাবে বা নিয়মের এমন ব্যাখ্যা দিবে যা দিয়ে দলের সুবিধা হয়।

এমন পদ্ধতি বিরল নয় যা দৃশ্যমান আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসীন হলে, তাদের দলের লোকেরা সব বড় বড় পদ দখল করে। তবে একবারে সব নয় বা সকল স্তরে নয়। আবার চলেও যায় ঐ দলের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে। একই ঘটনা ঘটে ডেমোক্রেটদের বেলায়ও।

আমাদের সঙ্গে ওদের পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের শাসন ব্যবস্থা বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক এবং আমলাতন্ত্র হচ্ছে স্থায়ী কর্মচারির সমষ্টি। অন্যান্য দেশে চাকরির কাঠামো হচ্ছে অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক বা আউটসোর্সিংএর মাধ্যমে নিম্নপদস্থ সেবাদানকারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। অবসরগ্রহণের পর, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে পেনশনের অর্থ দেওয়ার বিধান খুব কম দেশেই আছে।

এখানেই হচ্ছে একটি বির্তক বা ভাবনার বিষয়। অনেকেই মনে করেন, জনপ্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে থাকতে হবে নিবিড় সম্পর্ক। রাজনৈতিক নেতারা তাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে ঠিক করবেন কেমন প্রশাসন চলবে বা কোন ভাবাদর্শের কর্মকর্তাকে তার সহযোগী করতে হবে। তাই কাউকে করা হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আবার কাউকে দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয় দলীয় প্রয়োজনে।

কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', সক্রেটিসের ছাত্র প্লাটোর 'দ্য রিপাবলিক', অ্যারিস্টটলের 'পলিটিক্স' এবং মেকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' ইত্যাদি ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহের মধ্যে রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়কদের মতাদর্শের বিকাশ বা ক্ষমতা সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রশাসন পরিচালনার যোগসূত্র থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশাসন ও রাজনীতি এক এবং অভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ না করলে প্রগতির পথ মন্থর হবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হবে।

তবে, ১৮৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন প্রথমবারের মতো প্রচার করলেন যে, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও সুশাসন সুনিশ্চিত করতে হলে রাজনীতি ও প্রশাসন পৃথক হতে হবে। ক্ষমতাসীন দল এবং দেশ এক নয়। তার অভিমত হচ্ছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেধাবী সন্তানদের দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে, দলবাজদের দিয়ে নয়। প্রজাতন্ত্রের মেধাবী কর্মকর্তাদের দিয়েই রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।

লুথার গুলিক অপর একজন প্রখ্যাত জনপ্রশাসন বিশারদ, যিনি জনপ্রশাসনকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করে আমলাতন্ত্রের পুনর্বিন্যাস ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ক্যাডার করার পক্ষে কথা বলেছেন। বিশিষ্ট জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, আমলাতন্ত্র নাগরিকের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং সমান সুযোগের দুয়ার উন্মুক্ত করা। তিনি মনে করেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিরা হচ্ছে বিশ্বস্ত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ যারা মূল্যবোধের মাত্রা সঠিক রাখতে সক্ষম।

এখানেই বিতর্কের সূচনা ও ভাবনার ব্যতিক্রম। আমাদের দেশে আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ থাকতে দেওয়া হচ্ছে না বলেই বেশিরভাগ জনগণের ধারণা। সাম্প্রতিককালে অভিযোগ উঠেছে, নির্বাহী বিভাগের অনুরূপ বিচার বিভাগও দলীয়করণ করা হচ্ছে। এমনটি যদি হয়ে থাকে তাহলে মানুষ কোথায় নিরপেক্ষ সুবিচার পাবে? কার কাছে যাবে? বিরোধী দলের কাছে? তা কি অনভিপ্রেত হবে না? এমন সব ভাবনা সুশীল সমাজকে দারুণ সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। আশা করি এসবের সুরাহা হবে।

রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি, অর্থনীতি হচ্ছে প্রেরণা এবং নিরপেক্ষতা ও সদাচরণ হচ্ছে মৌলিক ভিত্তি। আধুনিক রাজনীতি অর্থনৈতিক বুদ্ধিমত্তার উপর প্রতিষ্ঠিত যা বুঝতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন সর্বাধিক। তাই এ জন্যে প্রয়োজন দক্ষ ও মেধাবী আমলার সমষ্টি। দলের পরিচয় বড় নয় বা ভালো বক্তৃতা দেওয়ার দক্ষতা কাজে আসবে না।

দেশের কল্যাণে জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতা থাকলে দক্ষ ও সদগুণাবলীসম্পন্ন কর্মচারি থাকলে ক্ষমতাসীন সরকার তাদের পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। অসদাচরণে আবিষ্ট ও দুর্বত্তায়নে নিমজ্জিত কর্মকর্তা দলীয় হলেও সরকারের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে, ভাবমূর্তি বিকাশ বা উন্নয়ন সাধনে সাফল্য আসবে না।

প্রশাসনে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ দিতে হবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।


ধীরাজ কুমার নাথ:
প্রাক্তন সচিব।