সৈয়দ আশরাফ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ কঠিন করে দিলেন

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 9 Dec 2014, 05:19 PM
Updated : 9 Dec 2014, 05:19 PM

শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের স্থানীয়, সরকার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্পর্কে গত কয়েক বছর অনেক রকমের ক্রিটিক্যাল খবর পড়েছি, টিভিতেও দেখেছি। তিনি আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তাঁর বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত (অস্থায়ী) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। '৭১এ তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে কোথাও কোনো ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা শুনিনি, কোনো ক্রিটিক্যাল খবর কোথাও পড়িনি। স্বাধীনতার পর সৈয়দ নজরুল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫এর ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বস্ত সহচর আরও এমন তিনজন জাতীয় নেতার সঙ্গে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিহত হন নৃশংসভাবে।

প্রথম জীবনে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে সৈয়দ নজরুল ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। রুচিশীল, ভদ্র এবং মার্জিত চরিত্রের একজন মানুষ হিসেবে তাঁর একটি ব্যক্তিপরিচিতি এবং সুনাম ছিল। বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামের বিপরীতে পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্পর্কে অভিযোগগুলো হচ্ছে, তিনি বছরের বড় একটা সময় দেশেই থাকেন না। তিনি প্রায়ই লন্ডনে উড়াল দেন; কারণ লন্ডনে থাকেন তাঁর পরিবার। তারপর যে কিছুদিন তিনি দেশে থাকেন, তিনি তাঁর সচিবালয়ের অফিস বা পার্টি অফিসে কখনও কখনও গিয়ে থাকেন, তিনি গিয়ে থাকেন দুপুরের পর। কারণ তিনি দুপুরের আগে ঘুম থেকেই উঠতে পারেন না।

তাঁর এমন অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর মন্ত্রণালয় চালায় মন্ত্রণালয়ের আমলারা। অথচ তাঁর এই মন্ত্রণালয় দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর একটি। বিএনপি-আওয়ামী লীগের গত ৪টি সরকারে পার্টির মহাসচিবরাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বিএনপির দুই মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার এবং আবদুল মান্নান ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের দুই জেনারেল সেক্রেটারি মরহুম জনাব জিল্লুর রহমান এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখন এই দায়িত্বে আছেন। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখা যায়, এই হচ্ছে দুই প্রধান দলের হিসাব।

দায়িত্বপালনে সৈয়দ আশরাফের এতসব কেয়ারলেসনেস সত্ত্বেও, আমি তাঁকে প্রবল সমর্থন দিলাম গত বছরের ৪ মে সন্ধ্যায়, যখন তিনি ঢাকার শাপলা চত্বরের হেফাজতিদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন– ''এই হেফাজতিদের কোনোভাবেই ওখানে থাকতে দেওয়া হবে না, তেঁতুল হুজুর আহমদ শফী সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের ওখান থেকে উচ্ছেদ, উৎখাত করা হবেই।''

হলও তাই। ২০১৩ সালের ৫ মে ভোররাত থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপারেশন চালিয়ে জঙ্গিদের উৎখাত করল, দেশের শান্তিকামী মানুষজন সাধুবাদ জানাল সরকারকে, বিশেষ করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। আমিও তাঁর তারিফ করে কলাম লিখলাম।

দুই

গত ৩০ নভেম্বর শনিবার মহানগর প্রভাতী ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। সকাল সাড়ে ১০টা, ১১টার দিকে ভৈরব ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। পাশেই বাস ট্রাক কার চলাচলের জন্য নির্মিত সড়ক ব্রিজটি, ১৯৯৬-২০০১ এর আওয়ামী লীগ সরকার এর নাম দিয়েছিল 'সৈয়দ নজরুল ইসলাম ব্রিজ'। যথার্থই নামকরণ, মুক্তিযুদ্ধের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং স্মৃতিতে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি এখনকার কিশোরগঞ্জ জেলায়; আর ভৈরবও এই কিশোরগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা।

কিন্তু পরে বিএনপি-জামাত জোট যখন ক্ষমতায় এল ২০০১ সালে, তখন খালেদা জিয়ার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এই সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এবং তাঁর নামে উৎসর্গ করা ব্রিজটি নিয়ে উপহাস করে বললেন, কোথাকার কোন এক নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। সাইফুর রহমানের এই রুচিহীন উপহাসের নিন্দা জানিয়েও তখন আমি কলাম লিখেছিলাম।

কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে যখন নিশা দেশাই বিসওয়ালকে নিয়ে রুচিহীন মন্তব্য, উপহাস করেন, বিশ্বাস করতে পারি না। সেদিন, ৩০ নভেম্বর, আমার ভৈরব ব্রিজ পার হওয়ার আগের দিন, খুলনা আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল সম্পর্কে আক্রমণাত্মক ভাষায় এমন চরিত্রহনন কীভাবে তিনি করতে পারলেন, তার নিন্দা দেখতে পাচ্ছি পত্রপত্রিকা এবং টিভিতে।

সৈয়দ আশরাফের ক্ষোভ, নিশা দেশাই দুই আনার মন্ত্রী– চার আনারও নন, কেন তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন! খালেদা জিয়াও কেন এমন অল্পবয়স্ক এক মহিলার সামনে এমন নত হয়ে কথা বললেন! সৈয়দ আশরাফের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞানের ঘাটতি এখানে প্রকটভাবেই ধরা পড়ল। সৈয়দ আশরাফের কি মনে আছে, আমেরিকান সরকারের এক ষোল-আনা মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ২০১২ সালের ৫ মে? হিলারি ক্লিনটন এর আগেও একবার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ১৯৯৫ তে। কিন্তু তখন তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী, এসেছিলেন ফার্স্ট লেডি হিসেবে।

২০১২ এর ৫-৬ মে তে হিলারি ক্লিনটন এসেছিলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রথম টার্মের 'ষোল-আনা' পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় টার্মে তিনি আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজেই থাকতে চাইলেন না; কারণ তিনি ২০১৬ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে 'নমিনেশন' চাইবেন। হিলারি ক্লিনটন তো তখন, দু'বছর পরের, ২০১৪এর জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে আরও কঠোর কঠিন কথাবার্তা বলে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনিকে। বিসওয়াল তার এই সফরকালে কিন্তু বলেননি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন 'ইনক্লুসিভ' ছিল না, এই নির্বাচনে খুঁত ছিল, সুতরাং আমেরিকার কাছে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের তুলনায় বিসওয়ালের কথাগুলো বরং নমনীয়ই মনে হয়েছে।

বিসওয়াল অবিবাহিতা এখনও, তা সৈয়দ আশরাফের কাছে আক্রমনণর জন্য কেন প্রাসঙ্গিক মনে হল কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর দলেও তো অবিবাহিতা নেত্রী আছেন এবং তিনি অবিবাহিতা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন। 'ম্যারিটাল স্ট্যাটাস' যে মন্ত্রী হওয়ার জন্য যোগ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদেরই একজন দায়িত্বশীল লোকের মুখে এই প্রথম শুনলাম।

তারপর, সৈয়দ আশরাফ বোধহয় জানেন না, ২০০৪-২০০৮ মেয়াদকালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রের যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কন্ডোলিৎসা রাইস, তিনিও ছিলেন অবিবাহিতা। প্রতিবেশি দেশ ভারতের কংগ্রেস পাটির দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি রাহুল গান্ধীও তো অবিবাহিত এখনও, এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও। মিস বিসওয়াল ভারতীয় বংশোভূত, তাও সৈয়দ আশরাফের পছন্দ নয়। তো খবর পাচ্ছি, ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসছেন রিচার্ড রাহুল ভার্মা। ক্লিনটন জামানায় তিনিও বিসওয়ালের মতোই একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এই রিচার্ড, রাহুল ভার্মাকেও তো একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মনে হচ্ছে।

তারপর, সৈয়দ সাহেব কি খেয়াল করেছেন, তারেক রহমান দুই আনা, দুই পয়সার মন্ত্রী না হয়েও কীভাবে সারা দেশের উপর ছড়ি ঘুরাল? একটি প্যারালাল সরকার চালাল হাওয়া ভবন থেকেই?

তিন

বাংলাদেশ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকেও সৈয়দ আশরাফ তাঁর বাসার কাজের বুয়া 'মর্জিনা'র সঙ্গে নামের মিলের তুলনা করে উপহাস করেছেন। তো, কাজের মেয়ে মর্জিনারা এত উপহাস টিট্কারির বিষয় হয়ে উঠলেন কেন সৈয়দ আশরাফের কাছে? তারা কি এতই নিকৃষ্ট জাতের মানুষ? তারাও তো খেটে খাওয়া মানুষ, ভোর রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের শ্রমঘণ্টা, তাদের তো প্রতিটি পয়সা হালাল রুজি।

আমাদের দেশের বাসাবাড়ির কাজের ছেলেমেয়েদের উপর বাসাবাড়ির কর্তা-কর্ত্রীদের কেউ কেউ কেমন অত্যাচার-নির্যাতন চালায়, সৈয়দ আশরাফের কি এই বিষয়ে কোনো ধারণা আছে? তাদের কারও প্রতি তাঁর এতটুকু সহানুভূতি কোনো দিন কি প্রকাশ পেয়েছে? গত বছর সেপ্টেম্বরে আদুরী নামের এক শিশু মেয়েকে অত্যাচার-নির্যাতনে মরে গেছে মনে করে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেল গৃহকর্ত্রী নওরীন আক্তার নদী। তখন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে আদুরীকে কিছু ফলমূলসহ দেখতে গিয়েছিলেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ। আর অক্টোবরে নিউইয়র্ক সফরকালে আমি গিয়েছিলাম ইউনিসেফ সদর দপ্তরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সুসান বিসেলের সঙ্গে দেখা করতে, এই অসহায় নিরীহ শিশু, যাদের আমি 'গৃহদাসী' হিসেবে বর্ণনা করি, তাদের রক্ষায় ইউনিসেফ কিছু করতে পারে কিনা জানতে। কিন্তু যাননি এমন সব মেয়েদের দেখতে সৈয়দ আশরাফ বা তার দলের কোনো নেতা, মন্ত্রী। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মেজর রফিক বীরোত্তম, ১৯৯৬-২০০১এ শেখ হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে পত্রিকায় বা মিডিয়ায় এমন খবর দেখলে তিনি ছুটে যেতেন।

কাজের মেয়ে 'মর্জিনা'দের প্রতি এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্যে সৈয়দ আশরাফের সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে; তাঁর দল যে এখন আর গরীববান্ধর, শ্রমিকবান্ধব নয়, তাও আবার ফুটে উঠেছে।

হিলারি ক্লিনটন, নিশা দেশাই বিসওয়াল বা রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনার কথাবার্তা সৈয়দ আশরাফদের পছন্দ না হলে, প্রতিক্রিয়া জানানোর ডিপ্ল্যোম্যাটিক তরিকাও তো আছে।

'৭১এ মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রবলভাবেই আমাদের সমর্থন দিয়ে গিয়েছে সেই এপ্রিল থেকে। এপ্রিল মাসের ৩ তারিখেই সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি চিঠি লিখলেন ইয়াহিয়া খানকে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে, উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের উপদেশ দিয়ে। তখন মস্কোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জামশেদ মার্কার বারবার সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন সোভিয়েত নীতি নমনীয় করতে। কিন্তু তিনি বার বার ব্যর্থও হয়েছেন। তাঁর এইসব ব্যর্থতার বর্ণনা আছে, 'কোয়াইট ডিপ্লোমেসি: মেমোয়ার্স অব অ্যান অ্যামবেসেডর অব পাকিস্তান' বইটিতে। প্রায় একই রকমের অভিজ্ঞতা পাকিস্তানের অন্যসব রাষ্ট্রদূতের, একাত্তরে। কিন্তু কোথাও তাঁরা ঝগড়া করেননি।

'৭১এর নভেম্বর মাসে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মস্কো সফরে গেলেন ভারতীয় আর্মির প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ'। তাদের দু'জনের দেখা হয়ে গেল মস্কোতে এক সন্ধ্যায়, ব্যালে দেখতে গিয়ে। দুজনই একই পার্সি সম্প্রদায়ের; কিন্তু দুই ভিন্ন দেশের নাগরিক। তারপরও তারা কোলাকুলি করলেন, কুশল বিনিময়ও করলেন। কোনোই তিক্ততা ছিল না তাদের এই সাক্ষাতকালে।

'৭১এর ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির উপর যখন বির্তক চলছে, তখন এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সদ্যনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংকে 'ইন্ডিয়ান ডগস' বলে অশ্লীলতা দেখালেন। পরে লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শুনেছিলাম, শরন সিং চোখ তুলে একবারের জন্যও ভুট্টোর দিকে তাকাননি। তিনি কিছু একটা 'নোট' নিচ্ছিলেন, তিনি তাই নিতে থাকলেন। সর্দার শরণ সিং কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েও ভুট্টোকে যে 'কনটেম্পট' দেখালেন, তাই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সিকিউরিটি কাউন্সিল চেম্বারে সেদিন, বলেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সিকিউরিটি কাউসিলের ভিজিটর গ্যালারিতে সেদিনও তিনি উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান এবং চীনের বিরোধিতায় তাকে সেদিন মূল চেম্বারে আসন গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি, যদিও সোভিয়েত ও ভারতীয় প্রতিনিধিরা তা চেয়েছিলেন।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিতর্ককালে ভুট্টো হাতের যুদ্ধবিরতির পোলিশ খসড়া প্রস্তাবটিও টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এক উন্মাদের কূটনীতি-বিগর্হিত আচরণ। তখন যুগোশ্লাভিয়াতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইকবাল আখুন্দ (আমাদের ড. হামিদা হোসেনের বড় ভাই, ১৯৪৯ ব্যাচের পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস অফিসার), তিনিও 'মেমোয়ার্স অব আ বাইস্ট্যান্ডার: আ লাইফ ইন ডিপ্লোম্যাসি' বইতে লিখেছেন, ভুট্টো যে এই ড্রামাটি সেদিন সিকিউরিটি কাউন্সিলে করলেন, তিনি আগে প্রস্তুতি নিয়েই এমনটি করেছিলেন; ভুট্টো তার হোটেল রুমে একটি লাইফ-সাইজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিহার্সেল দিয়ে তবেই সিকিউরিটি কাউন্সিলে গিয়েছিলেন।

মানে, ভুট্টোর এমন আচরণ প্রফেশনাল ডিপ্ল্যোম্যাট ইকবাল আখুন্দও পছন্দ করেননি। কোনো প্রফেশনাল কূটনীতিবিদ এমন আচরণ সমর্থন করতে পারেন না।

সৈয়দ আশরাফের অশালীন কথাবার্তা, উপহাস, টিটকারি আমরাও সমর্থন করতে পারছি না। সৈয়দ আশরাফ বোধহয় জানেন না– তাঁর জানার কথাও নয় যে, চীন, রাশিয়া, জাপান, ইসরায়েল, আফগানিস্তান ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন এসব দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি দেখভাল করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজে বা তাঁর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দেখাশুনা করেন ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। যে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যত গুরুত্বপূর্ণ বা যে দেশে সংকট যত গভীর, সিদ্ধান্ত তত উপর থেকে হয় এই দেশে।

আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য নিশা দেশাই বিসওয়ালই যথেষ্ট। বাংলাদেশে যদি আল কায়েদার প্রাদুর্ভাব ঘটে (নাউজুবিল্লাহ), বা বাংলাদেশ থেকে যদি 'ইসলামিক স্টেট'এর পক্ষে লড়াই করার জন্য এদেশের লোক ইরাক-সিরিয়ায় যেতে থাকে, তাহলে বিষয়টি গুরুতর হয়ে দেখা দেবে, মার্কিন প্রশাসনও তখন উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন চাইছে 'জিএসপি' সুবিধা, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে চাইছে 'ইনক্লুসিভ' নির্বাচন। এই ইস্যু দু'টিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিশা দেশাই বিসওয়ালই যথেষ্ট ক্ষমতাবান। উচ্চ পর্যায়ে তিনি যে সুপারিশ পাঠাবেন বা যে পর্যবেক্ষণ দেবেন, তাই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। সুতরাং বিসওয়ালকে খাটো করে দেখবেন না কোনো 'প্রফেশনাল ডিপ্লোম্যাট'।

প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা জানাই।

এই যে সৈয়দ আশরাফ খুলনার সভায় এমনভাবে বিসওয়াল এবং মোজেনাকে আক্রমণ করলেন, ড্যান মোজেনা কিন্তু ফরেন মিনিস্টার বা ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করে তার ব্যাখ্যা চাইতে পারেন, চাইতে পারেন সৈয়দ আশরাফ কী বলেছেন তার একটি অফিসিয়াল ভার্সনও। তো আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বা পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক যদি দিতে টালবাহানা করেন, তখন ওয়াশিংটনে যে আমাদের রাষ্ট্রদূত আছেন সেই জিয়াউদ্দিনকে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই বিসওয়ালই অফিসিয়েল ভার্সন চাইতে পারেন। তবে আমার ধারণা, তারা চাইবে না। কারণ তারা বাংলাদেশকে এত গুরুত্ব দেয় না। তবে কোনো আরব দেশ বা চীন হলে অবশ্য অবশ্যই চাইত।

আমাদের দুই দেশের মধ্যে আরও কিছু আমোদজনক বিষয় লক্ষ্য করার মতো। তারা আমাদের দেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায় এক মোজেনাকে, যাকে 'মর্জিনা' বলে সৈয়দ সাহেব উপহাস করেছেন। কিন্তু আমরা ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে। রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিনের আগের রাষ্ট্রদূতের মর্যাদাও প্রতিমন্ত্রীর ছিল। তো এখানে মাজেজা, মাহাত্ম্যটা কী? ওয়াশিংটনে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে আর কোন দেশের রাষ্ট্রদূত কাজ করছেন?

তারপর এত বছর পর আমাদের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়াশিংটনে একটি দ্বিপাক্ষিক সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে শুনছি। আমেরিকাকে যদি এতই অপছন্দ, তার লোকজনকেও যদি এত অপছন্দ, তাহলে ঐ দেশে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যাওয়ার দরকারটাই-বা কী?

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আত্মজীবনী (ইন দ্য লাইন অব ফায়ার) সেদিন পড়ছিলাম। ২০০১ এর নাইন-ইলেভেনের পর তখনকার গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল কলিন পাওয়েল তাকে টেলিফোন করেন। করাচিতে জেনারেল মোশাররফ একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংএ ছিলেন তখন। তিনি তার মিলিটারি সেক্রেটারিকে বললেন, ''জেনারেল কলিন পাওয়েলকে বল আমি পরে তাকে টেলিফোন করব।''

পাওয়েল বললেন মিলিটারি সেক্রেটারিকে, ''না, এখনই তোমার প্রেসিডেন্টকে বল টেলিফোনটি ধরতে।''

পারভেজ মোশাররফ ধরলেন টেলিফোন, আর কলিন পাওয়েল বললেন, ''ইউ আর আইদার উইদ আস আর অ্যাগেইনস্ট আস?''

পারভেজ মোশাররফ লিখছেন, ''দিস ওয়জ আা ব্ল্যাটেন্ট আল্টিমেটাম।''

ওয়াদা করলেন পারভেজ মোশাররফ, ''আমরা তোমাদের সঙ্গেই থাকব।''

কিন্তু পরদিন, তখন ওয়াশিংটন সফররত তাদের 'আইএসআই'এর ডাইরেক্টর-জেনারেলকে মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড আরমিটেজ স্টেট ডিপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে হুমকি দেন, পাকিস্তান যদি আল কায়েদা সন্ত্রাসীদের পক্ষ নেয়, তাহলে আমেরিকার বোমাবর্ষণে পাকিস্তানকে 'স্টোন এজ', মানে, প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়ার প্রস্ততি নিতে হবে। পারভেজ মোশাররফ কলিন পাওয়েল এবং রিচার্ড আরমিটেজের হুমকি খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। তবে এই দুই মার্কিন মন্ত্রী, কলিন পাওয়েল ও রিচার্ড আরমিটেজ 'আন-ডিপ্লোমেটিক্যলি' কথা বলেছিলেন, লিখেছেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তার আত্মজীবনীতে।

দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো সংকট দেখা দিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই তা সামাল দিতে হয়। এই সংকট আরও জটিল করে তোলা কারও উচিত নয়, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের তো মোটেও নয়।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪।