বাংলা ভাষার শত্রু মিত্র

মোস্তাফা জব্বার
Published : 22 Feb 2011, 04:24 PM
Updated : 22 Feb 2011, 04:24 PM

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনা করবো না-এমনটা হতেই পারে না। টেলিভিশনের পর্দার এক কোণে শহীদ মিনারের ছবি থাকবে, পত্রিকার পাতায় একটি কলাম থাকবে-এসব সাধারণ রীতি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমির বইমেলা এবং তার বিবিধ আলোচনাসমূহ এখন রীতিমতো একটি ঐতিহ্যের বিষয়। বলা যায়, ভাষা আমাদের জাতীয় বিষয়। একুশের প্রভাতে যারা শহীদ মিনারে যান কেবল তারাই দেখতে পারেন বাঙালি তার ভাষাকে কতোটা আবেগ দিয়ে ভালোবাসে। তার কাছে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা কতোটা সম্মানের সেটিও সেদিন আমরা অনুভব করি। ভাষার দাবি থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার দেশে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক।

কাগজের পত্রিকায়, টিভি মিডিয়ায়, অনলাইন পত্রিকায়, ইন্টারনেটে বা সভা সমাবেশে এই বিষয়টি পুরো মাস জুড়েই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে বসবাস করে। সারা বছর চুপচাপ থাকলেও এই সময়ে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ফোকাস স্পষ্ট থাকে। এগারো মাস জুড়ে বাংলা ভাষার ভালো-মন্দ আমরা দেখি আর না দেখি, এই ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা যতোভাবে পারি তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই ছাড়ি। যারা সারা বছর কোনভাবেই বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন না, বা বাংলার বিপরীতে ইংরেজীকেই কেবলমাত্র মুক্তির পথ বলে মনে করেন, তারাও জনমতের চাপে এই মাসে বাংলার প্রতি দরদ দেখিয়ে থাকেন। চলনে- বলনে আচার-আচরণে বাংলা ভাষাকে সুমহান মর্যাদা দেবার চেষ্টার কমতি থাকে না। যাদের অফিসে একটি বাংলা বর্ণমালা ব্যবহৃত হয় না তারা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাষা শহীদ ও বাংলা ভাষার প্রতি দরদ দেখিয়ে থাকেন।

এমনকি যারা অন্য সময়ে বাংলা ভাষার তীব্র সমালোচনা করতে পিছপা হননা তারাও ফেব্রুয়ারি মাসে সমঝে কথা বলেন। আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয় যখন দেখি যে, বাংলা ভাষার পক্ষের কাজটি কী সেটি চিনতেও আমরা সব সময়ে সচেতন থাকতে পারি না। আরও একটি কষ্ট হয় যে, বিশ্বের একমাত্র দেশ যার একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সেই দেশে বাংলা প্রচলনের, বাংলার গবেষণার, বাংলা শেখার বা শেখানোর কাজে সরকারের আগ্রহ সবচেয়ে কম। বরং হুজুগে জাতি বলে আমাদের যে সুনাম আছে তাতে আমরা সব সময়েই বাংলা ভাষার শত্রু মিত্র চিনতে পারি না। বিভিন্ন সময়ে আমরা বাংলা ভাষার প্রতি দরদের আধিক্য দেখিয়ে এমনসব প্রস্তাবনা পেশ হতে দেখেছি বা বিভিন্ন সময়ে এমন সব বিষয়কে আমরা মাথায় তুলে নাচতে দেখেছি যা প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার পক্ষে হয়তো যায় না। আবার এমন অনেক সময় দেখেছি যে হুজুগের মাথায় বাংলা ভাষার জন্য অপরিহার্য কাজটিকে আমরা অবলীলায় পা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। যিনি বাংলা ভাষার জন্য অসাধারণ কাজ করেছেন তাকেই হয়তো গালাগালি দিচ্ছি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিভাস্বর একুশের বয়স যখন ষাটের কাছাকাছি এবং ভাষার নামে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রের বয়স যখন চল্লিশের মতো তখন খুব সংক্ষেপে হলেও বাংলা ভাষার শত্রু মিত্র চেনার কিছুটা চেষ্টা করা দরকার।

প্রথমত যে বিষয়টি ভাষা আন্দোলন নিয়ে যারা আলোচনা করেন তাদের জন্য বলা দরকার সেটি হলো ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নয়। ভাষা আন্দোলন ভাষার পাশাপাশি সেই ভাষা লেখার হরফ নিয়েও। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এবং সেটি বাংলা হরফের বদলে অন্য হরফে লেখা হবে সেটি আমরা গ্রহণ করি নি। আমাদেরকে দুটি বিষয় নিয়েই একসাথে আন্দোলন করতে হয়েছে। যেমন করে আমরা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছি তেমন করে বাংলা ভাষা লেখার হরফকেও রক্ষা করেছি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে আমাদের ওপর আক্রমণটা দুদিক থেকেই হয়েছে। আমাদের ভাষাকে হত্যা করার পাশাপাশি হরফকেও খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের সার্থকতা এখানেই যে আমরা উভয় ষড়যন্ত্রকেই একসাথে মোকাবেলা করেছি এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি।

যদি একেবারে পেছনে ফিরে তাকাই তবে আমরা স্মরণ করতে পারবো, এক সময়ে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব এসেছিলো। আমরা মুসলমান এবং আরবি হরফ মুসলমানদের হরফ এমন সব কথা বলে বাংলা হরফ বদল করে আরবি হরফ দিয়ে বাংলা লেখার প্রস্তাবনা আমাদের সামনে পেশ করা হয়েছিলো। সেদিন তারা ভাবেনি যে, ভাষার সাথে হরফের সম্পর্কটা মা ও সন্তানের মতো। একটিকে বাদ দিলে অন্যটির কোন অস্তিত্ব থাকে না। যেসব ভাষা হরফ বিসর্জন দিয়েছে এখন তারা সন্তানহারা মাতা।

পাকিস্তানের জন্মের পর আমাদের মাথায় যখন দুনিয়ার সকল চেতনার চাইতে ধর্মীয় চেতনাই বেশি কাজ করতো তখন ধর্মীয় আবেগকে সামনে রেখে আরবি হরফ দিয়ে বাংলা লেখার প্রস্তাব করাটা অস্বাভাবিক ছিলো না। এর পরপরই ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ পূর্ববঙ্গ লেখক সম্মেলনে ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্পষ্টভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবিকে জোরদারভাবে তুলে ধরেন।

মুসলিম জাতীয়তা এবং চরম ধর্মীয় উন্মাদনায় জন্ম নেয়া পাকিস্তানে জন্মের দেড় বছরের মাঝে আরবি হরফের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া সত্যি সত্যি একটি দুঃসাহসী কাজ ছিলো। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো যারা বাংলার পক্ষে কথা বলেছিলেন তাদেরকে ভারতের দালাল, হিন্দু ইত্যাদিতে আখ্যা দেয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিলো না। পাকিস্তানিরা একাত্তর সালেও আমাদেরকে হিন্দু বলে প্রচার করেছিলো। আমরা বাংলা হরফ ও বাংলা ভাষা ব্যবহার করি এটি আমাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব প্রমাণের একটি কারণ ছিলো।

কপাল ভালো আমাদের পূর্ব পুরুষেরা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবে রাজী হন নি। যদি তেমনটা হতো তবে এখন আমাদেরকে আবার বাংলা হরফের জন্য লড়াই করতে হতো।

পাকিস্তানের অপর অংশ পশ্চিম পাকিস্তান যার অন্যতম রাষ্ট্রভাষা উর্দু, তারা কিন্তু তাদের হরফ বিসর্জন দিয়ে আরবি হরফ গ্রহণ করেছিলো-আমরা যেটি করি নি। এর সবচেয়ে বড় কুফল যেটি হয়েছে সেটি হলো উর্দুর অনেক উচ্চারণ এখন বিকৃত হয়ে গেছে। আরবি হরফ দিয়ে উর্দুর সকল উচ্চারণ প্রকাশ করা যায় না। অনেকেই জানেন না যে, উর্দু আসলে হিন্দী বা দেবনাগরীর বোন। ফলে এর শব্দগুলোও দেবনাগরির মতো। এর ধ্বনিগুলো কেবল বঙ্গলিপি বা দেবনাগরি হরফ দিয়েই সঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব-আরবি দিয়ে নয়। পাকিস্তানিরা যদি বঙ্গলিপি দিয়ে উর্দু লিখতো তবে সম্ভবত তারাও উপকৃত হতো। পাকিস্তানের জন্য বঙ্গলিপিকে রাষ্ট্রীয় বর্ণমালা ঘোষণা করাটাই সবচেয়ে উত্তম কাজ হতো। কারণ এই লিপি দিয়েই উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবিসহ পাকিস্তানের সকল ভাষা অতি সুন্দরভাবে লেখা যেতো। আমরা ভাগ্যবান যে, মালদ্বীপের মতোও আমরা আমাদের হরফ বিসর্জন দিইনি। ওরাও আরবি হরফে তাদের ভাষাকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে তাদের ঐতিহ্যগত অনেক শব্দের উচ্চারণ এরই মাঝে বিকৃত হয়ে গেছে।

যদি অন্য প্রেক্ষিত দিয়ে দেখি তবে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব আমাদের সামনে দীর্ঘদিন যাবতই ছিলো এবং আমার কাছে মনে হয় সেটি এখনও প্রবলভাবে বিরাজমান রয়েছে। সুগারকোটেড তিতে ক্যাপসুলের মতো আমরা এখনও আনন্দের সাথে সেই ক্যাপসুল গলাধকরণ করছি। শুরুতে যখন রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার প্রস্তাব আসে তখন কেউ কেউ এমন কথা বলেছিলেন যে, কী দরকার আরেকটা ঝামেলা বাধিয়ে। বাংলা হরফকে যন্ত্রে প্রয়োগ করার চাইতে যন্ত্রে প্রয়োগ করা আছে এমন রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখলে কী হয়। বেহুদা বাংলা টাইপরাইটার বা কম্পিউটারে বাংলা ভাষা এসব ঝামেলা করার দরকার কী? ভাষা না হয় বাংলা থাকলো-হরফটা ইংরেজী হলে কী হবে? সাদামাটাভাবে এমন প্রস্তাবকে খুব নিরীহ মনে হয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই প্রস্তাবের মাঝেই ভাষার আত্মাটাকে খুন করে ফেলা হয়। যে ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই সেই ভাষা অন্তত বিকলাঙ্গ এই বিষয়টি অনেকেই অনুভব করতে পারি না। পাকিস্তান-মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ এই ফাঁদে পা দিয়ে তাদের হরফকে হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশের আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে রোমান হরফ দিয়ে লিখে সেগুলোর বর্ণমালাকেও খুন করার চেষ্টা হচ্ছে। কোন কোন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারক ও এনজিও এই অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। তাদের মুখোশটা এখনও উন্মোচিত হয়নি। আমরা জানিনা যে এদের দ্বারাই দুনিয়ার বহু দেশে এই রোমান হরফের সাম্রাজ্যবাদ বিস্তৃত হয়েছে। এর ফলে দুনিয়ার অনেক ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। অনেক লিপি গেছে হারিয়ে। ধর্ম প্রচারের মতো ভালো কাজের সাথে এই ধরনের অপকর্ম যুক্ত করাটা মোটেই উচিত নয়।

আমরা সাধারণভাবে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবনাটি প্রত্যাখ্যান করেছি। তবে বিগত কয়েক দশকে এটি বারবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমাদের সামনে এসেছে। আমি একথা বলতে পারবোনা যে, রোমান হরফে বাংলা লেখার বিষয়টি আমরা বর্জন করেছি। বরং রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা আমাদের দিনে দিনে বাড়ছে। যন্ত্রের প্রয়োজনতো আছেই, মানসিকতার জন্যও আমাদের মাঝে বাংলা হরফের প্রতি সেই দরদ আমি দেখছিনা, যেটি আমাদের থাকা উচিত ছিলো। ইংরেজীর সার্বজনীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং ইংরেজী শেখার বা ব্যবহার করার দক্ষতাকে সম্মান দেখিয়েও আমি একথা বলতে পারি যে, রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার প্রবণতা তীব্রভাবে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দুঃখজনকভাবে আমরা কেউ কেউ খাঁটি বাংলা ভাষাভাষী হয়েও রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার মাঝে দোষের কিছু পাচ্ছি না। এমনকি আমি রোমান হরফে বাংলা লিখলাম এবং সেটি বাংলা হরফে বদলে গেলো তেমনটাকেই বাংলা লেখার সহজ উপায় বলে মনে করছি। কাজটা সহজ হলেও আমি যে আমার নিজের বর্ণমালা লেখাটা ভুলে যাচ্ছি সেটি আমার কাছে কষ্টের মনে হচ্ছেনা। আজকাল এসব কাজে সহায়তা করলে হাত তালি পাওয়া যায়। গলায় ফুলের মালা জোটে। যদি এর বিরোধিতা করা হয় তবে জোটে জুতার মালা।

খুব স্পষ্টভাবে এটি আলোচিত হওয়া উচিত যে বাংলা ভাষা রোমান হরফ দিয়ে লেখা উচিত কিনা। এ বিষয়ে ভাষা নিয়ে যারা খুব উদারতার পথে চলেন আমি নিজে সেই দলের মানুষ নই। আমি আসলে চীনাদের মতো। চীন সম্প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নির্দেশ দিয়েছে যে চীনা ভাষায় ইংরেজী বা অন্য বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তাদের মতে এর ফলে চীনা ভাষা কলুষিত হচ্ছে। আমি বাংলা ভাষায় ইংরেজী বা বিদেশী শব্দ ব্যবহারের বিপক্ষে নই। ভাষার প্রয়োজনে যতেটা বিদেশী শব্দ বাংলায় আসা দরকার ততোটা আসবেই। তবে বিদেশী হোক আর বাংলা শব্দই হোক আমি ঘোরতরভাবে রোমান হরফ দিয়ে লেখার বিপক্ষে। এমনকি আমি ইংরেজী শব্দও বাংলা হরফ দিয়ে লেখার পক্ষে। দৃনিয়ার কোন শক্তিশালী ভাষা তার লিপিকে বাদ দিয়ে সামনে যায় না। আমরাও আমাদের লিপিকে বাদ দিয়ে সামনে যেতে চাই না। কোন কোন সময়ে আমরা রোমান হরফে বাংলা লিখতে বাধ্য হই-যেমন মোবাইল ফোনে। ঐ যন্ত্রটিতে বাংলা লেখার অপশন যখন থাকেনা তখন এসএমএস বা মেইল রোমান হরফ দিয়েই লিখতে হয়। ফোন সেটে বাংলা হরফ লেখার ব্যবস্থা না থাকায় এর কোন বিকল্প আমাদের নেই। কিন্তু এই কাজটি নিমিষে সহজ করে ফেলা যায়। সরকার যদি মোবাইল আমদানীর ক্ষেত্রে ছোট্ট একটি বিধান রাখে যে বাংলা হরফ ব্যবহার করা যায়না এমন মোবাইল ফোন এই দেশে আমদানী করা যাবেনা, তবে সকল মোবাইল ফোনেই বাংলা লেখার ব্যবস্থা থাকতে পারে। প্রযুক্তিগতভাবে এটি কোন চ্যালেঞ্জের বিষয় নয় বা এর জন্য বাড়তি টাকাও গুণতে হবে না।

পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সেই দেশের ভাষা মোবাইলে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং বাংলাদেশেও এই কাজটি করা সম্ভব। এরই মাঝে মোবাইলের জন্য কীবোর্ড প্রমিত করা হয়েছে এবং বাংলা ভাষা মোবাইলে প্রয়োগও করা হয়েছে। এমনকি খুব কমদামী মোবাইল সেটেও বাংলা অপশন রয়েছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে এমন অঙ্গীকার নেয়া সরকার এখন পর্যন্ত দুটি বছরেও এমন একটি নির্দেশ মোবাইল আমদানীকারকদেরকে দিতে পারে নি, সেটি হতাশাব্যঞ্জক। আমার জানা মতে, বিএসটিআই এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল মোবাইল কীপ্যাড ও ইউনিকোড প্রমিতকরণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন কাজটি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। সরকারের টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন বা টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ের যে বাংলা ভাষার প্রতি দরদ নেই সেটি তাদের অবহেলা থেকেই বোঝা যায়। বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেয়া এই দেশে এই অবহেলা একটি অমার্জনীয় অপরাধ।

রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে মানসিকতার দিক থেকে আমরা কতোটা হীনমন্য তারও কিছু পরিচয় আমাদের জানা আছে। আমি যখন প্রথম বাংলা হরফের জন্য একটি কীবোর্ড প্রণয়নের চিন্তা করি তখন আমাকে বলা হয়ছিলো, কেন আমি রোমান বি হরফে ব রাখতে পারিনা। তারা মনে করেন এর ফলে পুরো বিষয়টা সহজ হয়। এর আগে কম্পিউটারে বাংলা কীবোর্ড যারা তৈরি করেছিলেন তারা রোমান হরফকে অনুসরণ করেই বাংলা কীবোর্ড প্রণয়ন করেছিলেন। তারা এমনকি শহীদ মুনির চৌধুরী উদ্ভাবিত মুনির কীবোর্ডকেও অনুসরণ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। তাদের তখন বক্তব্য ছিলো যে, মুনির কীবোর্ড যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত নয়। আমি রোমান হরফের সাথে বাংলা কীবোর্ডের মিল রাখার সেই যুক্তিটা মানি নি। কারণ ইংরেজী বি বোতামে ব রাখলে সেই মানুষটির জন্য উচ্চারণগত সুবিধা হবার কথা যার মাতৃভাষা ইংরেজী। কিন্তু যে লোকটির মাতৃভাষা বাংলা তার ক্ষেত্রে বাংলা আগে শেখার কথা এবং তারপরে দুনিয়ার অন্য ভাষা শেখার কথা। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে বহুজনকে এই সাধারণ ধারণাটির ব্যবহার করতে দেখি। অনেকেই এই যুক্তিতে বাংলা কীবোর্ডকে সাজিয়েছেন। শহীদ মুনির চৌধূরী ছিলেন এই ধারনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ করার মানুষ। এর ফলে তিনি টাইপরাইটারের বাংলা কীবোর্ড তৈরি করার সময় রোমান হরফের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন এবং বাংলা বর্ণ ব্যবহারের পৌনঃপুনিকতা বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি তার কীবোর্ড প্রণয়ন করেছিলেন। সেটি ছিলো একজন বাংলা ভাষাভাষী বিজ্ঞানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা।

অথচ এখন আমাদের বাংলা ভাষাকে যারা কম্পিউটারে প্রয়োগ করেন তাদের প্রায় অনেকেই রোমান হরফের সাথে বাংলা বর্ণকে মিলিয়ে ফেলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কারও কারও মাঝে এমন ধারণাও কাজ করে যে, আসলে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা টাইপ করার পর যদি সেটি বাংলা শব্দে পরিণত হয় তবে কাজটি আরও সহজ হয়ে যায়। অথচ আমরা কখনও এটি বিচার করে দেখি না যে, রোমান হরফ দিয়ে বাংলা ধ্বনির প্রকাশ ঘটানো মোটেই সম্ভব নয়। আমরা বাংলা ত, ণ, য়, ঃ, ৎ, শ, ষ, অ, ঈ, ঊ, ঋসহ শত শত ধ্বনি রোমান হরফ দিয়ে লিখতে পারি না। কখনও কখনও বাংলা ধ্বনির পাশাপাশি বা বিকৃত কোন ধ্বনিকে রোমান হরফ দিয়ে হয়তো প্রকাশ করি কিন্তু এতে না থাকে ব্যাকরণ, না থাকে শুদ্ধ বানান বা বাক্য গঠন। বস্তুত দুনিয়ার বহু ভাষারই হরফ সমষ্টির অন্যতম দুর্বলতা হলো সকল ধ্বনি অবিকৃতভাবে প্রকাশ করতে না পারা। রোমান হরফ এদিক থেকে সবচেয়ে দুর্বল। মানুষের ভাষার সবচেয়ে কম ধ্বনি রোমান হরফ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। বাংলায় যখন ধ্বনির রূপান্তর হয় বা যুক্তাক্ষর হয় তখন তার জন্য ভিন্ন অক্ষর ব্যবহার করা হয়-এটি বাংলা হরফের সবলতা। অনেকেই বাংলার যুক্তাক্ষরের সমালোচনা করার সময় বিজ্ঞানসম্মত এই হরফমালার সবলতাকে দুর্বলতা বলে মনে করে থাকেন। বাংলা ভাষা ভারতীয় ভাষা পরিবারের সেই সক্ষমতাসমৃদ্ধ ভাষা যার মাঝে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রায় সকল উচ্চারণই অবিকৃত রাখার ক্ষমতা রয়েছে। বাংলা লিপি বা বঙ্গলিপি যা ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত সকল লিপির বিজ্ঞানসম্মত ক্ষমতা বিশ্বের অনেক ভাষার চাইতে বেশি। রোমান হরফের চাইতে বাংলা হরফের ক্ষমতা যে শত শত গুণ বেশি সেটি একটু তূলনা করলেই দেখা যাবে। যদিও আমি টাইপরাইটারের মুনির কীবোর্ডটিকেই কম্পিউটারের জন্য গ্রহণ করতে পারি নি তবুও বাংলাকে বাংলার মতো দেখার জন্য মুনির চৌধুরীর যে ধারণা, সেটিকেই আমি গ্রহণ করেছিলাম। কম্পিউটারের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আমি নতুন একটি আবিষ্কার করেছি মাত্র, যেটি ডিজিটাল যন্ত্রের উপযোগী।

যদি আরও একটু গভীরে তাকাই তবে আমরা বাংলা ভাষা ও হরফকে নিয়ে আরও অনেক ষড়যন্ত্র দেখতে পাবো। বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন, যুক্তাক্ষর বাদ দেয়া। অক্ষরের আকৃতি বদলানো, মূল বর্ণের কয়েকটিকে বাদ দেয়া, বানান ও ব্যাকরণ সংস্কার বা লেখন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাবও দেখেছি। এমনকি যুক্তাক্ষর বর্জন করার প্রস্তাবও আমরা দেখেছি। যন্ত্রে প্রয়োগ করার নামে, ভাষাকে সহজ করার নামে, ব্যবহারের সুলভ পথ খুঁজে বের করার নামে এসব নানা প্রসঙ্গ বহুদিন ধরে বহুভাবেই আলোচিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এসব প্রস্তাবের পক্ষের ও বিপক্ষের মানুষদের নাম-ধাম সবই পাওয়া যাবে। আমি সেই মহামানবদের নাম পুনরায় স্মরণ করাতে চাই না। তবে কষ্ট হয় যখন দেখি আমাদের কাছে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও এসব অপকর্মের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে সুখের বিষয়টি হলো এতসব প্রস্তাবনার পরেও বাংলা ভাষাকে কেউ এখন পর্যন্ত তার মূল ধারা থেকে সরাতে পারে নি। এখনও বাংলা ভাষার হরফমালা অবিকৃত রয়েছে। কেউ কোন হরফকে বাদ দিতে পারে নি বা নতুন কোন পদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে নি। এখনও বাংলা ভাষার বানানে বৈচিত্র রয়েছে এবং নানাভাবে নানা শব্দে বাংলা ভাষা প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে। বরং নানা আক্রমনে, নানা বিবর্তনে বাংলা ভাষা তার অকৃত্রিমতা হারায় নি।

কিন্তু বাংলা ভাষার সংকট রয়ে গেছে। এই ভাষার সবচেয়ে বড় সংকটটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এটি বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেয়া দেশে সেই ভাষার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা যথাযথ নয়। সরকারের প্রথম বড় দুর্বলতা হলো, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করতে না পারা। সরকারী অফিসে বাংলা ব্যবহার হয়, কিন্তু সর্বত্র হয় না। উচ্চ আদালতে ইংরেজী ব্যবহার একরকম বাধ্যতামূলক। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে সেই শেকলটা আমরা ভাঙ্গতে পারি নি। এটি কি আমরা ভাবতে পারি যে, সরকার ৪০ বছরে একটি বিধি সংশোধন করতে পারেনা? অন্যদিকে, সরকার যে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সিরিয়াস নয় তার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। সরকারের নীতিমালাগুলো ইংরেজীতে খসড়া হয়। সরকার যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও ইংরেজীতেই তাদের উপস্থাপনা প্রস্তুত করে। এমনকি যেখানে ইংরেজী বলার প্রয়োজন নেই সেখানেও ইংরেজীতেই কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মোবাইল ফোন কেনার ফরমটা ইংরেজীতেই ছিলো। এখনও প্রতিদিন কম্পিউটার প্রচলনের নামে বাংলা ভাষাকে বিদায় করা হচ্ছে। এক সময়ে ব্যাঙ্কগুলো বাংলায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো।

এখন অনলাইনের নামে সেখান থেকে বাংলা ভাষা বিদায় নিয়েছে। সেটি ডিজিটাল হোক আর অনলাইনে ভর্তি হোক, বাংলা লেখা হলেও তা রোমান হরফে লেখা হয়। অতি সাধারণ কৃষককে যখন আমরা রোমান হরফ চেনানোর চেষ্টা করছি তখন পুরো বিষয়টাকেই দুঃখজনক বলতে হবে। সরকারের বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত একটি আইন আছে। সেই আইনে বাংলা ভাষা সরকারী কাজে ব্যবহার না করা হলে তার জন্য শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু বাংলা ভাষা সরকারী কাজে ব্যবহার না করার জন্য এখন পর্যন্ত কেউ কোন শাস্তিতো দূরের কথা একটি সতর্কবাণীও পায়নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, সরকার সরকারী কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যাপারে আদৌ সিরিয়াস নয়। আমি লক্ষ্য করেছি যে, দিনে দিনে সরকারী কাজ যতো অনলাইনে যাচ্ছে ততোই সেটি বাংলার বদলে ইংরেজীতে হচ্ছে। সরকার ভাষা আন্দোলনের কথা বুক চাপড়ে বললেও তাকে অন্তর দিয়ে বাস্তবায়ন করছে না।

সরকারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অবহেলাটি হলো, বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৫১টির মাঝে মাত্র চারটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয় পড়ানো হয়। সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাষ্ট্রভাষা শেখাতে বাধ্য করেনি–এটি আমাদের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায়। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া একটি জাতির জন্য এটি একটি কলঙ্ক। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বেনিয়াবৃত্তির জন্য তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ায় না তাদেরও উচিত এই কলঙ্কের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ খোলা।

সরকারের বাংলা একাডেমি বা অন্য কোন সংস্থা বিদেশীদেরকে বাংলা শেখানোর কোন ব্যবস্থা করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে বাংলা শেখার জন্য ভর্তি হতে হলে বিদেশীদেরকে আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদেশি মিশনগুলো বাংলা ভাষা শেখানো তো দুরের কথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসও দুনিয়াবাসীকে জানায় না।

বাংলা ভাষার উচ্চতর গবেষণা ও বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল ডিভাইসে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারের যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত ছিলো সেটি সরকার পালন করছে না। অতীতের সরকারগুলো এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরব ছিলো। তবে এই সরকার একটু নড়ে চড়ে বসলেও তেমন কোন কর্মপ্রচেষ্টা এখনও আমি দেখছি না। সরকারের উচিত হবে বাংলা ব্যাকরণ ও বানান শুদ্ধিকরণ সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা, বাংলা টেক্সট টু স্পীচ, স্পীচ টু টেক্সট, অটো ট্রান্সলেশন এবং অপটিক্যাল ক্যারেক্টারের মতো বিষয়গুলোতে যথাযথ বরাদ্দ প্রদান করা এবং সেই কাজগুলো সম্পন্ন করা।

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বটে, কিন্তু দুই বছরে এসব প্রকল্পের কোনটিই আলোর মুখ দেখে নি।

মোস্তাফা জব্বার:  লেখক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট। বিজয় কীবোর্ড ও  কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যার প্রণেতা।