হলোকাস্ট, একাত্তরের গণহত্যা ও ইতিহাস বিকৃতিরোধে আইন

শওগাত আলী সাগর
Published : 5 Dec 2014, 08:27 PM
Updated : 5 Dec 2014, 08:27 PM

প্রফেসর বার্নার্ড লুইস আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একজন বিখ্যাত মানুষ। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করেন তা নয়, পশ্চিমের বিদগ্ধ সমাজে তাঁকে নেতৃস্থানীয় ইতিহাসবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশও তাঁর নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপকের পরামর্শ চেয়ে বসতেন যখন তখন।

তো, এই লুইস একবার ফরাসী পত্রিকা Le Monde তে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আর্মেনিয়ার গণহত্যা নিয়ে কিছু মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, আর্মেনিয়ায় যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, সেটি গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না। কাজেই সেখানে গণহত্যা হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। পশ্চিমের একজন শীর্ষ ইতিহাসবিদ, গবেষক হিসেবে লুইস তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় আর্মেনিয়ানদের মধ্যে। সেই প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে একটি ফরাসী আদালত তাঁকে এক ফ্রাঙ্ক জরিমানা করে।

ঘটনাটা ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসের। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান অধ্যাপক বার্নার্ড লুইস নানাভাবে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খোদ পশ্চিমের ইতিহাসবিদ-গবেষকরাও তাঁর কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। বরং তাঁর মন্তব্যটি সেখানেও সমালোচিত হয়েছে।

বার্নার্ড লুইসের শাস্তি মাত্র এক ফ্রাঙ্ক জরিমানার মধ্যে সীমিত থাকলেও, ডেভিড আর্ভিংএর ভাগ্য অত প্রসন্ন ছিল না। পশ্চিমের খ্যাতনামা এই ইতিহাসবিদকে ১৩ মাস জেল খাটতে হয়েছে। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি হলোকাস্ট অস্বীকার করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাজি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তাঁকে ঠিক 'গণহত্যা' হিসেবে অভিহিত করতে চাননি ইতিহাসের এই গবেষক। ভিয়েনার একটি আদালত তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। তের মাস জেল খাটার পর অবশ্য তিনি ছাড়া পান।

আর মার্কিন অধ্যাপক পিটার আর্লিন্ডারকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল রুয়ান্ডার একটি আদালত। আইনজীবী এবং আইনের এই অধ্যাপক খোদ জাতিসংঘে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘসময়। কিন্তু রুয়ান্ডার গণহত্যাকে তিনি ঠিক 'গণহত্যা' হিসেবে মানতে চাননি। তিনি বলে ফেলেছিলেন, ১৯৯৫ সালে ১.৫ মিলিয়ন অটোম্যানের হত্যাকাণ্ড ঠিক গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না। এটি যুদ্ধের একটি বাই প্রোডাক্ট মাত্র।

এই মন্তব্যের কারণে রুয়ান্ডার আদালত তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। অধ্যাপক আর্লিন্ডার তখন রুয়ান্ডায় গণহত্যা বিষয়ক মামলায় একটি পক্ষের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু বেফাঁস এই মন্তব্যের কারণে তাকে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করতে হয়।

বার্নার্ড লুইস, ডেভিড আর্ভিং এবং পিটার আর্লিন্ডারের সঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে কোনোভাবেই তুলনা করা চলে না। নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা তিন ব্যক্তিই ইতিহাসের গবেষক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ইতিহাসের গতিপ্রবাহ নিয়ে তাঁরা হরহামেশাই মন্তব্য করেন এবং করতে পারেন বলেই ধরে নেওয়া হয়। সেই তুলনায় ডেভিড বার্গম্যান আসলে আলোচনায় আসার মতো কোনো ব্যক্তিত্ব নন। হলোকাস্ট বা গণহত্যা নিয়ে এই তিন ইতিহাসবিদের মন্তব্য ও শাস্তিভোগ আর বার্গম্যানের দণ্ডভোগের প্রেক্ষাপট মোটেও এক নয়। বার্গম্যান শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির হয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তবে ডেভিড বার্গম্যানের দণ্ডিত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে এই তিন ইতিহাসবিদের শাস্তিভোগের তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। দুটি ক্ষেত্রেই বিষয় হল, ইতিহাসের সত্য অস্বীকার কিংবা বিকৃত করার চেষ্টা এবং সে জন্য শাস্তি পাওয়া।

ইউরোপীয় দেশগুলোতে 'ল অ্যাগেইনস্ট ডিনায়াল অব হলোকাস্ট' বলে একটা আইন আছে। রীতিমতো সংসদে পাশ করা আইন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাজি বাহিনী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তাকে অস্বীকার করার চেষ্টা, এমনকি গণহত্যার তীব্রতা লঘু করে দেখার প্রচেষ্টাও এই আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, হলোকাস্টের তীব্রতা নিয়ে, মৃতদের সংখ্যা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা প্রশ্ন তোলা 'ক্রিমিনাল অফেন্স' হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। 'হলোকাস্ট' নিয়ে যারা ভিন্নমত পোষণ করেন তারা শব্দের মারপ্যাঁচে 'ডিনায়াল' বা অস্বীকৃতিকে 'রিভিশনিজম' দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হলোকাস্ট নিয়ে ইউরোপীয় আইন সেটিকেও 'ক্রিমিনাল অফেন্স' হিসেবে আমলে নেওয়ার বিধান করেছে।

অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা হয়েছে এবং নাজি বাহিনী সেই গণহত্যা চালিয়েছে– এটা সত্য বলে ধরে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো তত্ত্বের কচকচানি বা পাণ্ডিত্য দিয়ে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করা যাবে না।

হলোকাস্টের জন্য যাদের দায়ী করা হয়, সেই জার্মানদেরও তো প্রভাব আছে। তারা তো তাদের মতো করেই ইতিহাস দেখতে চাইবে। সেখানেও বাধ সেধেছে খোদ জাতিসংঘ। গত সপ্তাহেই 'নাজিইজম'কে মহৎভাবে চিত্রিত করা কিংবা জার্মান নাজি যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করার বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের প্রস্তাবে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, নাজি যুদ্ধাপরাধী বা তাদের সহযোগীদের 'জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে প্রতিরোধের সৈনিক' জাতীয় অভিধায় ভূষিত করে তাদের অপকর্ম আড়াল করা যাবে না।

যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার যে কলঙ্কতিলক নাজি বাহিনীর কপালে একেঁ দিয়েছে ইতিহাস, তা নিয়ে কোনো ধরনের ঘষামাঝার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোতে। ওসব দেশে যদি গণহত্যার ইতিহাস অবিকৃত রাখতে এমন আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে সেটি নিয়ে ভাবা হবে না কেন? বাংলাদেশে তো বরং আরও বেশি দরকার এ ধরনের একটি আইনের।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কত লোক মারা গিয়েছিলো, তার কি একটি একটি করে কেউ লাশ গুনেছে? বিশ্বের কোনো যুদ্ধেই কি গুনে গুনে মৃতদেহের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাংলাদেশে যেন মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও কতজন মারা গিয়েছে সেই সংখ্যাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েও কেউ কেউ এই তর্কটা করেন, মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা তো করেনই। ত্রিশ লাখ নয়, মাত্র তিন লাখ লোকের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ– এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠায় তাদের কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!

আচ্ছা, গণহত্যার জন্য সংখ্যাটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কেনই-বা 'তিন লাখ' সংখ্যাটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া চেষ্টা?

এটা সত্য যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। কেন পায়নি সেটা নিয়ে আলাদা বিশ্লেষণ দাবি রাখে। যদিও এ নিয়ে সেই কোনো বিশ্লেষণ হয়েছে কি না জানা নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যাটাকে তিন লাখে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন, সেই চেষ্টার মধ্যে আবার নিজের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার বিবরণও দিচ্ছেন, তারা কি কখনও বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কোনো চেষ্টা করেছেন? রুয়ান্ডার গণহত্যাও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যাটি কেন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত নয়– তা নিয়ে কি তারা কখনও কলম ধরেছেন?

আসলে হলোকাস্ট ডিনায়ালের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ডিনায়ালের একটি প্রবণতা যুদ্ধকালীন সময় থেকেই চলে আসছে। 'জেনোসাইড ডিনায়ালের' এই গোষ্ঠীই বিভিন্ন সময় গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, বিতর্ক তুলে একে আড়াল করে ফেলতে চায়। কিন্তু যারা তিন লাখের তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করেন, তারা এই সংখ্যা কোথায় পেলেন? তারা কি লাশ গুণে গুণে তিন লাখের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন?

আমি তো বিস্মিত হই, তারা কেন ২৬ হাজার সংখ্যাটা ব্যবহার করছেন না! কেননা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তান সরকার একটি কমিশন গঠন করে যুদ্ধ নিয়ে পর্যালোচনা করেছিল। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৭১এর যুদ্ধে ২৬ হাজার বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন। পাকিস্তানিদের মতো যারা একাত্তরের গণহত্যা আড়াল করতে চান, তাদের তো ২৬ হাজার সংখ্যাই গুরুত্বসহকারে প্রচার করার কথা।

পশ্চিমের ইতিহাসবিদরা যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পৈশাচিক গণহত্যাকে 'চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া' বা বিস্মৃত গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে বর্বরোচিত গণহত্যাটি বিশ্বদরবারে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, আমরা তখন সংখ্যাতত্ত্বের বিতর্ক করে গণহত্যার বীভৎসতা খেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা যখন 'তিন লাখ' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বরতাকে সহনশীলতার অবয়ব দেওয়ার চেষ্টায় মেধার সর্বস্ব নিয়োগের চেষ্টা করছি, তখন মার্কিন গবেষক আর জে রুমেল বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বলছেন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ কিংবা ১৫ লাখ লোক খুন হয়েছেন। তিনি কিন্তু বলছেন:

Whatever the final figure, tens of thousands of those killed died as cruel and appalling deaths as anyone has ever devised.

আর ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খানের নির্দেশই তো ছিল:

"ওদের ত্রিশ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।"

এই সব তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও যারা সংখ্যার বিতর্ক তুলে, তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। সেই অসৎ উদ্দেশ্য দমন করার অধিকার অবশ্যই রাষ্ট্র রাখে। হলোকাস্টের ইতিহাস অবিকৃত রাখতে ইউরোপের দেশে দেশে যদি আইন থাকতে পারে, সে আইনে বাঘা বাঘা ব্যক্তিদের শাস্তি হতে পারে, খোদ জাতিসংঘ যদি ইতিহাস-বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রস্তাব নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন সেই সুযোগগুলো নেবে না?

'ল অ্যাগেইনস্ট ডিনায়াল অব হলোকাস্ট'এর মতো মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-বিকৃতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি আইনি কাঠামো থাকা সম্ভবত জরুরি হয়ে পড়েছে।

শওগাত আলী সাগর: প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট।