বিএনপি কি পানিতে পড়েছে

প্রণব সাহা
Published : 2 Dec 2014, 08:25 PM
Updated : 2 Dec 2014, 08:25 PM

খুবই মনখারাপের বিষয়। শেষ পযর্ন্ত কিনা বি চৌধুরী পর্যন্ত বিএনপিকে তার দল বিকল্প ধারায় যোগ দিতে বললেন। এর আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তাহলে তো এই প্রশ্ন করতেই হয়, বিএনপি কি পানিতে পড়েছে?

এক সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় উল্টো তার মন্তব্য, পানিতে নয়, সমুদ্রে পড়েছে বিএনপি। মাত্র একটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় কি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল সত্যিই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে? দেশের মানুষ যদি তুলনা করে গত বছর আর এ বছরের নভেম্বর মাসের মধ্যে, তাহলে তো আপাতদৃষ্টিতে এখন অনেক শান্তিই মনে হবে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, বিএনপিকে দিয়ে আর আন্দোলন সম্ভব নয়? কারণ গত নভেম্বর মাসে দৈনিক পত্রিকায় এমন শিরোনামও ছিল, "আগামী সপ্তাহে আবার হরতাল"। এখন হরতাল নেই, কিন্তু সম্প্রতি ২০ দলের বৈঠকে আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা। তাহলে কি এবারের শীতে রাজপথ গরম হবে গত বছরের মতো?

পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, ১৯ নভেম্বর সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বিএনপির পক্ষ থেকে তখন সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানানো হয়েছিল। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদল গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু এর আগে আবদুল হামিদ যেদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, বঙ্গভবনের সেই শপথ অনুষ্ঠানে যাননি বেগম জিয়া। যদিও বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে স্পিকার আবদুল হামিদের ব্যাপারে বিএনপির কোনো আপত্তি ছিল না।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার আগে অক্টোবর-নভেম্বরে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের সহিংস আন্দোলনে উত্তাল করে দেশে একটি অস্থিতিশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। ২০১৩ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল হয়েছে। ৭ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরের সপ্তাহেও হরতাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত বছর ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল বিরোধী দল। মহাজোট সরকার সেই দাবি মানেনি। বরং নির্বাচনকালীন সরকার করে বিএনপিকে ছাড়াই দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। যদিও নজিরবিহীনভাবে সেই ভোটে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে।

তবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সম্মানজনক কিছু ছিল না। তাই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন দেশবাসী গ্রহণ করেছিল। এর পিছনে একটি বড় কারণ ছিল, দেশবাসীর পক্ষে তখনকার রাজনৈতিক হানাহানি আর মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। একটি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দফা হরতালে সহিসংতায় সারাদেশে ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। বিরোধী দলের আন্দোলনে তখন যানবাহনে আগুন দেওয়ায় বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের ড্রাইভার, হেলপার এবং যাত্রীসহ প্রায় ৮০ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। ৪৯০টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের কারণে।

বিএনপির আন্দোলন সফল হয়নি। সরকার যে কোনোভাবেই হোক, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচন করে ১৯৯০ সালের দুই যুগ পর খালেদা জিয়ার গাড়ি থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে তা তুলে দিয়েছেন রওশন এরশাদের গাড়িতে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পুরস্কার হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়েছে মন্ত্রীর মর্যাদায়। বোধকরি বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিক দম্পতি হচ্ছেন এরশাদ ও রওশন এরশাদ, যারা দুজনই একই সময় জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরছেন।

সেই এরশাদই গত জুন মাসে দলীয় সমাবেশের বিএনপিকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, "দুঃশাসনে অতীষ্ঠ মানুষ এখন নতুন দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। জাতীয় পার্টি খুব শিগগিরই বিএনপির স্থান দখল করবে।"

গত জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর থেকেই আন্দোলনের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচনের আগের ১৮ দল এখন সংখ্যায় বেড়ে ২০ দল হয়েছে। তবে ঈদের পরে আন্দোলন করার কথা বললেও, রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ, দুটোই চলে গেলেও আন্দোলন জোরদার হয়নি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একাই ৪৮ ঘণ্টা হরতালের মহড়া দিয়েছে, না পেরে বিএনপিও একটি হরতাল করেছে।

কিন্তু ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে ঢাকার আরেক সাবেক মেয়র মীর্জা আব্বাসকে মহানগরের দায়িত্ব দেওয়ার পরও রাজধানীতে বিএনপির সংগঠন যে চাঙ্গা হয়নি, বিগত হরতাল আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় খালেদা জিয়ার উপস্থিত না হওয়ার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। যদিও আমরা দেখেছি, হরতালের দিনের চেয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিতে বাদপড়াদের বিক্ষোভে বেশি সংখ্যক বিক্ষুদ্ধ কর্মী নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে।

সেদিন এক অনুষ্ঠানে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পাশে ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব নোয়াখালীর মোহাম্মদ শাজাহান। তাকে উদ্দেশ্য করেই বিএনপির সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেছেন বিকল্প ধারার রাজনীতিতে চলে আসার জন্য। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, কুলা দিয়ে ঝেড়ে চিটা ধান ফেলে দিতে হবে। টেলিভিশনে নিউজ দেখে তো অবাক, বলেন কী এই চিকিৎসক রাজনীতিক! যিনি একবারই শুধু সাহসের সঙ্গে বঙ্গভবন ছেড়ে, পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে, রেললাইন দিয়ে দৌড়ে পালিয়েও বিএনপিরই শাসনামলে বিকল্প ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সেই দলের 'কুলা' প্রতীক নিয়ে মাহি বি চৌধুরী বিএনপির ধানের শীষকে পরাজিত করেছিলেন মুন্সিগঞ্জ উপনির্বাচনে। যদিও ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া ২২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিকল্প ধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভালো ফল পায়নি। ফলে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা পিছিয়েই পড়েছে সন্ত্রাস আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অঙ্গীকার দিয়ে রাজপথে আসা দলটি।

বিকল্প ধারা যদিও কোনো কিংস পার্টি ছিল না, তথাপি তারা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে বিএনপিকে বিকল্প ধারার রাজনীতিতে যোগ দেবার কথাটি একটু কি দুঃসাহস হয়ে গেল না? একটু পরিস্কার হতে ফোন করেছিলাম বিকল্প ধারার মুখপাত্র মাহি বি চৌধুরীকে। নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন তিনি। আসলে বিকল্প ধারা যে সংস্কারমুখী পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক আদর্শ, সেই আদর্শ অনুসরণে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছেন বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট।

খুব মনে পড়ে, বিকল্প ধারার প্রতিষ্ঠালগ্নের দিনগুলোতে খুবই কাছ থেকে একটি দলের জন্মপ্রক্রিয়া দেখেছি। মুন্সিগঞ্জের উপনির্বাচনে মাহির বিজয়ে একটি বড় ভূমিকা ছিল গণমাধ্যমের সতর্ক নজরদারির। কিন্তু এখন দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, বিকল্প ধারা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

আবারও ফিরে যাই বিএনপি প্রসঙ্গেই। গত এক বছরেও আন্দোলনের সকল হুমকি-ধামকি ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বিএনপির নেতারা বলে থাকেন যে, দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা আর পুলিশি হামলায় তারা মাঠে নামতে পারছেন না। এমনকি সমাবেশের অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। যদিও আমরা দেখছি, ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় বিএনপির জনসভায় যোগ দিচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। এসব জনসভায় জনাসমাগমও ভালোই হচ্ছে। তাহলে কি সরকার এমন কৌশল নিয়েছে যে রাজধানীতে বিএনপিকে সংগঠিত হতে দেওয়া হবে না? নাকি রাজধানীর আন্দোলন জোরদার না হওয়ার পেছনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দলের শীর্ষনেতাদের অনৈক্যই মূল ব্যাপার?

গত কয়েক দিনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের শীর্ষনেতা এবং ২০ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে তিনি আন্দোলন জোরদার করার পক্ষেই নিজের জোরালো অবস্থান যেমন জানিয়েছেন, তেমনি দলের নেতাদের সমালোচনাও করেছেন আন্দোলনে সক্রিয় না হওয়ার জন্য। দলের নেতারা জানাচ্ছেন, অবিলম্বেই আন্দোলন জোরদার করা হবে। কর্মসূচিও ঘোষণা হবে। আসলে বিএনপির নেতাদের এখন আন্দোলন করেই এবং তার জন্য জেলজুলুমের ঝুঁকি নিয়েই রাজপথে নামতে হবে।

তবে অবশ্যই জনগণকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি ছাড়া জ্বালাও-পোড়াও করলে তা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।