বাংলা ভাষা কি টিকবে?

হাসান আজিজুল হক
Published : 15 April 2009, 01:23 AM
Updated : 19 Feb 2011, 03:05 PM

একেবারে চাঁছাছোলা একটি প্রশ্ন যদি করি যে বাংলা ভাষা টিকবে কি না। আবেগ ভালোবাসা মিলিয়ে হয়তো বললাম টিকবে। কিন্তু কোনো ভাষাই কেবল আবেগ আর ভালোবাসার উপর টিকে থাকে না। আবার পুরোপুরি শক্তিমত্তার ওপরও তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়। পৃথিবীতে কত গুরুত্বপূর্ণ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষা মেসোডোনিয়ায় আজ ক'জন বলেন? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার একজন যীশু যে-ভাষায় কথা বলতেন সেই ভূমধ্যসাগরীয় আরামাইক তখন ওই অঞ্চলের প্রধান ভাষাগুলোর একটি–আজ প্রায় বিলুপ্ত। কিংবা আরেক দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী, বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষায় একেবারেই সামান্য কিছু লোক কথা বলেন। হয়তো অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ঐতিহাসিক এইসব তথ্য মাথায় রেখেই বলবো যে বাংলা ভাষা টিকবে। সভ্যতা তো নানান ভাবে এদিক-ওদিক যায়। কিছুটা তো আন্দাজ করা যায়।

পঁচিশ কোটি লোক আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলে। এই পঁচিশ কোটি লোকের ভাষা বাংলা টিকবে না–এ কথা বলা যায় না। আর ইতোমধ্যে এই ভাষার মধ্যে যা তৈরি হয়ে আছে, যা কিছু এই ভাষার ভাণ্ডারে আছে তা এত তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হবে বলে মনে হয় না। এবং এর যে পরিমাণ ও মান তাও কিন্তু কম নয়। ব্যাপারটা যে নিছক আবেগের বশে বলছি তা মোটেই নয়। বাঙালির নানা দুর্দশা আছে, অনেকে মনেও করতে পারেন এই দেশ আদৌ টিকবে কি না–এসব আমার মাথায় আছে। সেদিন কেউ একজন বলছিল, বাড়িঘর করে কী হবে, বাংলাদেশ একদিন ডুবে যাবে। সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম ২০৩৬ সালে বাংলাদেশের উপর একটা গ্রহাণু এসে পড়বে। তাতে করে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এসব বাস্তব হয়ে ওঠার আগেই মানুষ প্রতিরোধ ও বিকল্প ব্যবস্থাও গড়ে তুলবে। আর বাংলাদেশ ডুবে যাওয়া মানে কিন্তু ভাষার মৃত্যু নয়। বাংলাদেশ ধবংস হয়ে যাওয়া মানে ভাষার বিলুপ্তি নয়। কারণ ভাষাটা কোনো ভৌগলিক সীমার মধ্যে থাকে না, থাকে মানুষের মধ্যে। মানুষ যদি থাকে তাহলে তার ভাষাও থাকবে।

এখন কেউ হয়তো বলবেন বাংলা ভাষার কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই, কোনো অর্থনৈতিক শক্তি নেই। এগুলো ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও বিস্তারের জন্য সহায়ক–এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকাল অনেকেই বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষা শিখছেন। কারণ চীন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আগে কেবল পণ্ডিতরা শিখতেন, এখন অনেক সাধারণ মানুষও শিখছে। কিন্তু আজকে জাপানের কি রাজনৈতিক শক্তি আছে? জাপানের মতো অনেক দেশই আছে যাদের রাজনৈতিক শক্তি নেই, কিন্তু তাদের ভাষা টিকে আছে। এদের কারুর কারুর হয়তো অর্থনৈতিক শক্তি আছে। এখন হয়তো আমরা বলবো আমাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তি নেই, এটা সত্যি। কিন্তু এই না-থাকার জন্য তো দায়ী আমরাই। তবে অর্থনৈতিক শক্তি বা রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করা যাবে না–এটা তো চূড়ান্ত হতাশাবাদীদের কথা। আমাদের বাংলাদেশের বয়সই আর কত?

চল্লিশ বছর। এই অল্প সময়ের মধ্যে সে যে নিজের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারলো–এটা কি তার শক্তি ও সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে না? অ্যারিস্টটল বলতেন ফর্ম বা আকাবের কথা। ফর্ম এবং ম্যাটার রিয়েলাইজ না-হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যায় না, কিন্তু সম্ভাবনাটা তো থাকে। আর সম্ভাবনা যদি থাকে তাহলে আমাদের আশা করার অধিকার আছে।

এখন কেউ কেউ বলবেন বাংলাদেশে এত মানুষ; হাঁটতে গেলে একজনের সাথে আরেক জনের ধাক্কা লাগে। এটা একটা সমস্যা। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষকে আমরা যদি শক্তিতে রূপান্তর করতে পারি তাহলে এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। এত মানুষের খাবারই বা কোত্থেকে আসবে? কিন্তু আসছে তো, না-পেলে আমরা সমুদ্রের পেট থেকে নিয়ে আসবো। সমুদ্র তো বিশাল ভাণ্ডার। আমরা সূর্য থেকে জ্বালানি নিয়ে আসবো, সে প্রক্রিয়া তো শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং সম্ভাবনার মৃত্যু নেই। বাংলাদেশ অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে ডুবে যাবে–এটা মনে করার কোনো কারণ আমি দেখি না।

আমাদের কতগুলো সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে বাধ্য করা উচিৎ সমাধানের ব্যাপারে। যেমন ধরা যাক, সবার জন্য একমুখী শিক্ষা মুখে মুখে বলছি, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলগুলোতে বাংলা বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো হয়। বলা হচ্ছে সবাইকে একই সিলেবাস পড়তে হবে। এ দেশের বড়লোক, এ দেশের ধান্ধাবাজ, এ দেশের আমলারা দেশটাকে বিদেশীদের বাজার বানাবার জন্য উঠে- পড়ে লেগেছে। এদের মধ্যে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। তারা লুটপাটে ব্যস্ত। আমরা তাদের মনঃতুষ্টির একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলছি। রাষ্ট্রটি যে সাধারণ মানুষের নয় তা ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। এই বুদ্ধিজীবীদের কখনোই বোঝানো যাচ্ছে না যে যে-কোনো জ্ঞান, যে-কোনো সত্য, যে-কোনো উপদেশ, যে-কোনো ভালো কথা যদি কর্মের দ্বারা অনুসৃত না হয় তাহলে মানুষের মধ্যে বিবেক জাগানোর চেষ্টা বৃথা যাবে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে বলা যেতে পারে বাক্যবাগীশ। চমৎকার চমৎকার সব কথা বলে, ইংরেজি লেখে খুব ভালো, কথা বললে মূর্ছা যেতে হয়। তারা খুব সংস্কৃতিবান, রুচিশীল মানুষ, খুব ভালো গান শোনেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু ওনারা এটা বোঝেন না যে এগুলো দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কাজটা হাতে মাটি লাগিয়ে করতে হবে। এভরি থট শ্যুড বি ফলোড বাই অ্যাকশন। এ পর্যন্ত যা বললাম তা নিশ্চয়ই হতাশার। এর মধ্যে কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একটা তরুণ প্রজন্ম আসবে যারা বলবে, "আমরা আপনাদেরকে মানি না।" এবং এটা ঘটবেই।

বাংলা ভাষা টিকবে কিনা এর প্রেক্ষিত হিসেবে সরাসরি ভাষার সাথে জড়িত নয় এমন অনেক কথাই আমি বললাম। তবে এসব ঘটনার ফলাফল ভাষার উপর কোনো না কোনোভাবে পড়বে বলেই এসব কথা বলা।

আবার ভাষাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে এমন ঘটনাও আছে। যেমন ভারতীয় চ্যানেলের মাধ্যমে হিন্দি সংস্কৃতির আধিপত্য। এটা বাংলা ভাষাকে নিশ্চয়ই প্রভাবিত করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এটা আমরা ঘটতে দিচ্ছি কারা এবং কেন? যাদের পরামর্শে এটা হচ্ছে তারা 'না' করতে পারছে না, 'না' বলাটা শিখতে হবে।

আমি ইদানীং ভাষা নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করছি। আমি দেখতে চাইছি ভাষার স্বভাবটা কী? আধুনিক ভাষা দর্শনের মধ্যে নানা রকম কথাবার্তা আসছে। ভাষার কাজটা কী, ভাষার সাথে কর্মজগতের সম্পর্কটা কী–এসব নিয়ে ভাবনাগুলো। যেমন মানুষ অজস্র ভাষা সৃষ্টি করতে পারে, অসংখ্য বাক্য গঠনের ক্ষমতা মানুষের আছে–চমস্কির এই কথা আমি মেনে নিয়েছি। অথচ শব্দসংখ্যা সীমিত। এমন কি মানুষ অভিধানের খুব কম শব্দই ব্যবহার করতে পারে। আমি খুব ভালো করে দেখতে চাইছি ভিটগেনস্টাইনের সেই বক্তব্য: ভাষার সীমানা ততটুকুই যতটুকু ভাষা পৌঁছুতে পারে। যেখানে ভাষা পৌঁছাতে পারে না সেটা আনস্পিকেবল। কিন্তু উনি যেটা করলেন তা হলো একটা আনরিচেবল জায়গায় যেতে। দেখলেন যে ওটা হয় না। তিনি রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটক পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ভাষা নিয়ে নানান রকম খেলাধুলা করলেন। এসবই কিন্তু আনরিচেবলকে অ্যাড্রেস করা। অর্থাৎ উনি যে সীমানাটা তুলে দিয়েছিলেন সেই সীমানাকে অতিক্রমের চেষ্টা করেছিলেন। এটা দিয়েই আমি ভাষার সম্ভাবনা বিচার করতে পারি ।

ভাষা নিয়ে আমরা কী করেছি? আমরা মুখে মুখে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু ভাষা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই করতে পারি নি। যেমন কিছুটা স্ববিরোধী ভঙ্গিতেই আমি বলবো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে মাধ্যম করাটাই ভুল হয়েছে। এ কথা বললে লোকে আমাকে দেশদ্রোহী বলবে। বাংলাকে মাধ্যম করার আগে বোঝা দরকার ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী পড়াই। দর্শন এবং ইতিহাস পড়তে গিয়ে একজন বাংলায় যে বইগুলো পড়ে তা কি পাঠযোগ্য? বাংলায় দর্শনের উপরে কোনো ভালো বই নেই। একজন ছাত্র যখন বাংলা বইয়ের মাধ্যমে দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করে তখন সেটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সে ইংরেজি না জানার কারণে দর্শন ভালো করে বোঝে না অথবা অপরদিকে অগোছালো বাংলায় দর্শনকে ভুলভাবে বোঝে। বাংলায় ফিলোসফির কোনো বই পড়া যায়? কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাংলায় দর্শনচর্চা সম্ভব নয়, বা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়। যত্ন নিয়ে, শ্রম দিয়ে এসবই সম্ভব। আমরা এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো। বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা। আমি মুষ্টিমেয় কিছু পণ্ডিতের ওপর অনাস্থা আনতে পারি, কিন্তু ২৫ কোটি মানুষের ভাষার উপর আমার আস্থা গভীর।

এখন সেই আদি প্রশ্নে ফিরে যাই। বলেছিলাম বাংলা ভাষা টিকবে কিনা। যেমন ধরা যাক, ইংরেজি কেন টিকে এবং প্রতিপত্তি বিস্তার করে আছে। সে তো তার জাতপাত খুইয়েছে। কোনো বিশুদ্ধ চেহারা নিয়ে সে টিকে নেই। বাংলা ভাষারও হয়তো তাই হবে। সে হয়তো নানান রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে। আর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে শক্তির কথা বলা হয়েছিলো তা যে কোনো কালে অর্জন করতে পারবো না–তা তো  বাইবেল বা কোরানে নেই। আমি আশাবাদের জিকির তুলবো না কিন্তু বাঙালির সম্ভাবনায় আমি বিশ্বাসী। সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সঠিক পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার।