মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এত বৈপরীত্য, বিভ্রান্ত হতে হয়

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 1 June 2019, 07:35 AM
Updated : 30 Nov 2014, 08:07 PM

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটি হচ্ছে মিসৌরি; আর এই অঙ্গরাজ্যের একটি কাউন্টি– আমাদের উপজেলা সাইজের একটি হচ্ছে 'সেন্ট লুইস'। এই সেন্ট লুইস কাউন্টির একটি অতি ছোট শহর হচ্ছে 'ফার্গুসন'; আয়তন মাত্র ৬.২০ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা মাত্র ২১,১৩৫। এদের মাথাপিছু আয় ১৯,৭৭৫ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় হচ্ছে ৫৩ হাজার ডলারের মতো। আমাদের মাথাপিছু আয় কয়েক বছর ধরে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১,২০০ ডলারে।

ফার্গুসনের লোকসংখ্যার ৬৭ শতাংশ কালো রংএর, তাদের এখন কয়েক দশক ধরে পরিচিতি আফ্রিকান-আমেরিকান; আমাদের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভূটানের লোকদের আমেরিকায় যেমন পরিচিতি দক্ষিণ এশীয়-আমেরিকান হিসেবে। লোকসংখ্যার বাকি ৩৩ শতাংশ সাদা রংএর, এদের সাধারণত বলা হয়ে থাকে ইউরোপীয়-আমেরিকান।

ফার্গুসন এত ছোট একটি আমেরিকান শহর, কিন্তু শহরটি কয়েক দিন ধরে সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কাঁপাচ্ছে; কাঁপাচ্ছে দুনিয়ার আরও কতগুলো শহরও। দুনিয়ার সকল কিসিমের গণমাধ্যমে গত কয়েক দিন ধরে এই ফার্গুসন শহরটি শীর্ষ খবরগুলোর একটি।

এত সব খবরের কেন্দ্রবিন্দুতে দু'জন মানুষ– একজন মাইকেল ব্রাউন নামের এক ১৮ বছর বয়সী আফ্রিকান-আমেরিকান। অন্যজন, ডারেন উইলসন নামের সাদা চামড়ার, ২৪ বছর বয়সী এক পুলিশ অফিসার। এই বছরের ৯ আগস্ট, পুলিশ অফিসার ডারেন উইলসন গুলি করে মেরে ফেলে নিরস্ত্র মাইকেল ব্রাউনকে, এ ফার্গুসন শহরে তার বাড়ির কাছে। প্রতিবাদে মানুষজন ব্যাপক বিক্ষোভে রাস্তায় নামে, তারা ভাঙচুর করে, লুটপাট করে দোকান-পাটও। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী, ন্যাশনাল গার্ডস মোতায়েন করা হয়, জারি করা হয় কারফিউও।

এই মারদাঙ্গা বিক্ষোভ, লুটপাটও প্রত্যাশিতভাবে একসময় থেমে যায়। কিন্তু অনেক বড় আকারে, অনেক ব্যাপকভাবে এই বিক্ষোভ আবার ছড়িয়ে পড়ে ফার্গুসনের বাইরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো শহরে, যখন গত ২৪ নভেম্বর ওখানকার এক গ্র্যান্ড জুরি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যে, পুলিশ অফিসার ডারেন উইলসনের কোনো বিচার হবে না, মাইকেল ব্রাউনকে হত্যার অভিযোগে।

এলাকার বিভিন্ন পেশার এবং সাবালক বয়সের মানুষজনকে নিয়ে গঠিত হয় গ্র্যান্ড জুরি। আমেরিকায় বিচার চলাকালীন সময়ে আর এক ধরনের জুরি বিচারকাজে বিচারককে সাহায্য করে থাকেন। এদের বলা হয় ট্রায়াল জুরি। সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনে ট্রায়াল জুরি বিচারককে সিদ্ধান্ত জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী না নির্দোষ। ট্রায়াল জুরির সকল সদস্যকে তাদের সিদ্ধান্তে একমত হতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা একমত হন ততদিন তাদের ঘরে আটকে রাখা হয়, আলোচনা চালিয়ে যেতে বলা হয়। জুরিদের সিদ্ধান্তে যদি অভিযুক্ত দোষী বিবেচিত হয়ে থাকে, শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার কিন্তু শুধুমাত্র বিচারকের। জুরি বোর্ড সিদ্ধান্ত জানানোর পর তাদের ছেড়ে দেন বিচারক। তখন তারা তাদের বাড়িঘর, অফিসে, আদালতে যেতে পারেন।

আমাদের দেশেও ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে এমন জুরির বিচার ছিল। জুরির বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ, মূল কথা, অভিযুক্ত ব্যক্তির এলাকার লোকজন তাকে দোষী বা নির্দোষ বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষের চাপ বা প্রভাব ছাড়া।

ট্রায়াল জুরির বিপরীতে গ্র্যান্ড জুরির কাজ হচ্ছে বিচার শুরুর আগের পর্যায়ে। একজন প্রসিকিউটর জুরি বোর্ডের সদস্যদের কাছে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে জানতে চাইবেন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে চালানোর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি, কাগজপত্র আছে বলে প্রতীয়মান হয় কিনা। গ্র্যান্ড জুরির সংখ্যা সাধারণত ২৩ হয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ, কমপক্ষে ১২ জনের ভোটে।

যেমন, উইলসনের ক্ষেত্রে গ্র্যান্ড জুরি মনে করেন যে, মাইকেল ব্রাউনকে গুলি করে মেরে ফেলায় কোনো অপরাধ হয়নি। কারণ ব্রাউন পুলিশ কর্মকর্তা উইলসনের অস্ত্র্রটি জোর করে কেড়ে নিয়ে আক্রমণ করতে চেয়েছিল তাকে। সুতরাং ডারেন উইলসন আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার্থে মাইকেল ব্রাউনকে আগেই গুলি করে মেরে ফেলে কোনো অন্যায়কাজ করেনি। মানে, তাহলে ডারেন উইলসনকে ফৌজদারি বিচারে আর দাঁড়াতে হবে না। তবে তার বিরুদ্ধে সিভিল মামলা হতে পারে। সে আর এক ভিন্ন বিচার পদ্ধতি। এই সিভিল বিচারে ডারেন দোষী প্রমাণিত হলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণের অংক মিলিয়ন ডলারও হতে পারে।

দুই

গ্র্যান্ড জুরির এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে আমেরিকার ন্যায়বিচার-প্রত্যাশী মানুষ। অনেক, অনেক বেশি ক্ষুব্ধ, আক্রোশে ফুঁসছে বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকানরা। তারা মনে করে, তারা কালো রংএর বলেই তাদের বিরুদ্ধে এমন বৈষম্য। নিহত মাইকেল ব্রাউন যদি সাদা রংএর এক তরুণ হত, নিশ্চয়ই গ্র্যান্ড জুরি এমন সিদ্ধান্ত দিত না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাদা রংএর চাইতে কালো রংএর আমেরিকান নাগরিকদের পুলিশের হাতে হয়রান, অপদস্ত হওয়ার, গ্রেপ্তার হওয়ার, গুলিতে মারা পড়ার পারসেন্টেজটা অনেক বেশি।

তবে এই কথাটিও প্রমাণিত যে, কালো রংএর মানুষজনের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বেশি। আবার এদের মধ্যে দরিদ্র, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষজনও বেশি। তারা দরিদ্র বলেই অপরাধেও বেশি বেশি জড়িয়ে পড়ে এই কথাটিও ঠিক। কয়েক দিন আগে সিএনএনে দেখলাম, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর ছেলে মার্টিন লুথার কিং থ্রি বলছেন, আমেরিকায় প্রায় ৫ কোটি লোক দরিদ্র এবং এদের বেশিরভাগই কালো এবং এই দেশটিতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যটাও দিন দিন বাড়ছে।

তবে ডারেন উইলসনকে আক্রমণ করেছিল যে মাইকেল ব্রাউন, তার অস্ত্র কেড়ে নিতে চেয়েছিল এই ব্ল্যাক তরুণ। আগাগোড়া ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে বেশিরভাগ মানুষই তা বিশ্বাস করবে না, যেমনটি করছে না আমেরিকার এতসব জায়গায়। বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না আমার কাছেও। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ফার্গুসনের এই ঘটনাপ্রবাহে বিচলিত। ইতোমধ্যে তাঁকে দু'দফা কথা বলতে শুনেছি টেলিভিশনে এই বিষয়ের উপর। ফার্গুসনকে তিনি আমেরিকার একটি সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একে তিনি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহার করে সাদা-কালোদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ব্রাউনের বাবা-মা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামাও ব্রাউনের বাবা-মার এ আহবানের উল্লেখ করে বিক্ষুব্ধদের শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ করেছেন। আফ্রিকান-আমেরিকান বারাক ওবামা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, দুনিয়ার সবচাইতে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, প্রথমবারের মতো এমন একজন কালো মানুষ আমেরিকার ২৪০ বছরের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। কিন্তু তাতেও কালোদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে না।

এমন কয়েকটি উদাহরণে আস্থা-বিশ্বাস বাড়ার কথাও নয়। আমেরিকার মোট ৩১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সাদা চামড়ারা হল প্রায় ৮০ পারসেন্ট, কালোরা প্রায় ১৩ পারসেন্ট এবং এশীয়রা সাড়ে ৪ পারসেন্ট। তো, গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে, ৫০টি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদে, ১০০ জন সিনেটরের মধ্যে বা প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ সদস্যের মধ্যে ব্ল্যাকদের প্রতিনিধি মোট জনসংখ্যার অনুপাতের ১৩ পারসেন্টের ধারেকাছেও তো নেই।

তারপর, ঐতিহাসিকভাবে তাদের উপর যেসব অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা চালানো হয়েছে, তা কি এই লোকগুলো ভুলতে পারে? আফ্রিকার দেশগুলো থেকে গরু-ছাগল-ভেড়ার মতো, গুলি-গোলা বোমার মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাদের ধরে ধরে জাহাজে পুরে, ক্রীতদাস হিসেবে আমেরিকায় আনা হয়, তা কি ভোলা যায়? ভোলা কি যায় তাদের যেমনভাবে আবার গরু-ছাগল-ভেড়ার মতো বাজারে বিক্রি করা হয়েছে, কেনা হয়েছে? ক্রীতদাসটি যদি তরুণ, যুবক, সুস্বাস্থ্যের অধিকার হয়, তার দাম বাজারে বেশি ছিল। কারণ তার ছেলেমেয়ে অনেক হবে, তাদের বিক্রি করে আরও লাভ। যেমন করে আমরা কুরবানির ঈদের বাজারে গরু-ছাগল কিনে থাকি, তেমন ব্যবস্থা চলতে থাকল কয়েকশ বছর।

আব্রাহাম লিংকনই তো এই দাসপ্রথা বিলোপ করলেন ১৮৬০ এর দশকে। সে জন্য এই এক ইস্যুতে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধও একটি হল। আমেরিকার দক্ষিণের কৃষির উপর নির্ভরশীল রাজ্যগুলো ক্রীতদাস দিয়ে কৃষিকাজ করাত। তারা আব্রাহাম লিংকনের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চাচ্ছিল না। সুতরাং গৃহযুদ্ধ। ক্রীতদাসের জীবন থেকে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা এই কালো মানুষগুলো মুক্তি পেল ঠিকই, কিন্তু তারা ভোটাধিকার পেল মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে।

দাসপ্রথা বিলোপকারী এবং ভোটাধিকার দেওয়ার উদ্যোগী দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এবং জন কেনেডিকে আবার গুলি করে মেরে ফেলাও হল। অবশ্য তাদের হত্যার কারণ এবং উপরে বর্ণিত উদ্যোগ দুটির– দাসপ্রথার বিলোপ এবং ব্ল্যাকদের ভোটাধিকার দেওয়ার প্রথম সফল উদ্যোগ– কোনোটিই ছিল না।

তবে আমেরিকাও যে কেমন 'ভায়োলেন্ট' একটি দেশ তা দেখা যায় এই দুইজনসহ মোট চার চারজন প্রেসিডেন্ট হত্যায়। অন্য দু'জন ছিলেন– প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড, যাকে হত্যা করা হয় ১৮৮১ সালের ২ জুলাইতে এবং প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলি, যিনি খুন হন ১৯০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকেও ১৯৮১তে তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দু'মাসের মাথায় গুলি করে প্রায় মেরেই ফেলা হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসির একটি হোটেলের সামনে। এই আক্রমণে তাঁর প্রেস সেক্রেটারি জেমস ব্র্যাডি সেই যে পঙ্গু হলেন, তারপর থেকেই হুইল চেয়ারে।

আমেরিকায় প্রতি বছর খুন-খারাবি, অপরাধ এবং জেলে দণ্ডিত লোকের সংখ্যা আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে। তারপরও কিন্তু আমেরিকায় অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অস্ত্র রাখাটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে তারা বড়াই করে। অস্ত্রশস্ত্রের মালিকদের সংগঠন 'ন্যাশনাল রাইফেলস এসোসিয়েশন'-এনআরএ এত বেশি ক্ষমতাশালী যে, তাদের চটাতে কোনো আইনপ্রণেতা সাহস করে না। এই অস্ত্রশস্ত্রের অপব্যবহারে অনেকগুলি স্কুলে ফুলের মতো নিষ্পাপ ও নির্দোষ শিশুরাও মারা পড়েছে। অথচ এর বিপরীতে যুক্তরাজ্যে কোনো রাজা, রানি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের কাউকে গুলি করে মারা হয়নি। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম, প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারের ওপর বোমা হামলা হয়েছিল তাঁর হোটেলে, ইংল্যান্ডের ব্রাইটন শহরে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা এই হামলাটি করেছিল।

তিন

কিন্তু মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে, মানুষজনের জীবনযাত্রার আধুনিকায়নে এই দেশটির ভূমিকা আমাকে মুগ্ধও করে। সারা দুনিয়ায় এত লাখ লাখ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই দেশের হার্ভার্ড এক নম্বরে। দুনিয়ার শীর্ষের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বোধহয় ৬টিই তাদের। প্রতি বছর বিভিন্ন সাফল্য এবং অর্জনের জন্য যারা নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তাদের মধ্যেও মেজরিটি আমেরিকান বা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় বা ল্যাবরেরটরিগুলোর গবেষকরা। এরোপ্লেন, টেলিফোন আবিস্কার তাদের।

আর হাল আমলের বিল গেটসের মাইক্রোসফ্ট, মার্ক জাকারবর্গের ফেসবুক, স্টিভ জবসের অ্যাপল কম্পিউটার, মোবাইল সেট; কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ড, পিৎজা হার্ট, কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন, হটডগ; জিলস, গোল্ডম্যান স্যাক্স্, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, সিয়ার্স টাওয়ার, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ; তারপর হলিউড, স্টিফেন স্পিলবার্গ, ছবি: আঙ্কেল টমস কেবিন, রুটস, রক হাডসন, মেরিলিন মনরো; নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, স্ট্যাচু অব লিবার্টি; আইনস্টাইন, মার্টিন লুথার কিং, এমন হাজার হাজার ব্যক্তি, স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান সারা দুনিয়ার মানুষের জীবনকে সহজ স্বচ্ছন্দ করে দিয়েছে।

চাঁদেও তারা প্রথম মানুষ পাঠিয়ে তাদের আবার সুস্থদেহে ফিরিয়েও এনেছে। বিজ্ঞানে তারা নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। 'আমেরিকান ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স' এবং আমেরিকার সংবিধান দুনিয়ার অসাধারণ দুটি দলিল, মানুষের অধিকাররক্ষায়, মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে চলেছে।

কিন্তু তারাই আবার জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকি, শহর দু'টিতে আণবিক বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে; আরও লক্ষ লক্ষকে করেছে পঙ্গু। তারাই আবার অতি নির্বোধের মতো ভিয়েতনামে, নিজ দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে গণতন্ত্ররক্ষায়, কমিউনিজম ঠেকাতে সাত লক্ষ সৈন্য পাঠায়। তারা লক্ষ লক্ষ সৈন্য পাঠায় ইরাকে। দেশটিকে তারা তছনছও করে দেয়। জাতিসংঘের কোনো অনুমোদন না নিয়েই তারা 'উয়েপনস অব মাস ডেসট্রাকসন'এর খোঁজে ইরাক দেশটি দখল করে নেয়। কিন্তু তারা এমন কোনো অস্ত্র খুঁজে পায় না। এ জন্য তাদের কোনো লাজ-শরমও হয় না। এত লক্ষ লক্ষ লোককে তারা হত্যা করে, কিন্তু এ জন্য কোনো জবাবদিহিতা আদায় করা যায় না তাদের।

তারা একটির পর একটি মারাত্মক ভুল করে যায়, কিন্তু তাদের ভুলের মাশুল দিতে হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষজনকে। এই দুনিয়াতে তাদের প্রশ্ন করার মতো কেউ নেই বলেই তারা এমন করতে পারে।

প্রতিরক্ষা বাজেটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর যা খরচ, তার পরের শীর্ষ দশটি দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের মোট পরিমাণও তা নয়। আমেরিকার অসাধারণ দু'টি দলিলের কথা একটু আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু এই দলিল দুটোর পুরো সুবিধা পায় না এই দেশের তিন, সাড়ে তিন কোটি কালো মানুষ।

গণমাধ্যমের, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে এই দেশটি আপোসহীন, দেশে এবং বিদেশে। কিন্তু গুরুতর ব্যতিক্রম এক ক্ষেত্রে। ইসরায়েল যত অপরাধই করুক না কেন, ইসরায়েলকে দোষ দেওয়া যাবে না, সব দোষ প্যালেস্টাইনিদের। কারণ তারা 'সন্ত্রাসী', 'বোমাবাজ'; যেমন মাইকেল ব্রাউন। গণতন্ত্র আলবৎ দরকার, দেশে এবং বিদেশে। তবে প্যালেস্টাইনিদের ক্ষেত্রে এই অধিকার প্রযোজ্য নয়। জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনিরা ৯৫ পারসেন্ট ভোট পেলেও– ভেটো, বাতিল। আমেরিকান গণতন্ত্রে প্যালেস্টাইনিয়ানদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা গণতন্ত্র নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়।

বুঝতে পারি না এই দেশটিকে। তারপরও, দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিদের ছিয়াত্তর লক্ষ কয়েক বছর আগে এই আমেরিকায় যাওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছিল ডিভি ভিসা প্রোগ্রামে। এই দেশের নাগরিক হতে পারলে, অন্তত একটি গ্রিন কার্ড যার আছে, তার সামাজিক মান-মর্যাদা মুূহূর্তেই অনেক উচ্চতায় উঠে যায়। প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েক বছর আগে ডিভি ভিসা প্রত্যাখ্যাতদের কয়েক শ' জন অনশন ধর্মঘট করে এই দেশে যাওয়ার প্রার্থনাতে।

দুনিয়ার অনেকগুলো দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচক, অনেকেই বিদ্বেষী। এই সব দেশের প্ল্যাকার্ডের একটি শ্লোগান হচ্ছে, Yankee, go home, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শ্লোগানটির পর আরও একটি বাক্য যোগ হয়েছে, When going take me with you.

এই দেশটিকে বুঝতে পারি না।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪।