পাবলিক পরীক্ষা ও ‘মাকাল ফল’

মোহাম্মদ মাহবুব হাসান
Published : 29 May 2019, 08:25 AM
Updated : 28 Nov 2014, 04:14 AM

দেশের বিশিষ্টজন ও শিক্ষাবিদদের একটি অংশ পাবলিক পরীক্ষার ফল এবং শিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনামুখর। তারা মনে করছেন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনুষ্ঠিত বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ায় এ সমালোচনা আরও বেড়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং 'টক শো'তে পাবলিক পরীক্ষার ফল নিয়ে যারা আলোচনা ও সমালোচনা করছেন তাদের অধিকাংশ গত পাঁচ-ছ' বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান, পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির যে সংস্কার হয়েছে সে বিষয়ে অবহিত নন। বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এর আলোকে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিয়েছে ।

এই সরকারের নেওয়া শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, ১৭ বছর পর মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়ন। ১৯৯৫ সালের পর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। সংযোজন হয়েছে নতুন ধারণা, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিকট অজ্ঞাত ছিল। প্রায় ৫৫০ জন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রায় দুই বছর পরিশ্রম করে যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেছেন। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী লেখা হয়েছে ১১১টি নতুন বই।

অপর যে কাজটি হয়েছে তা হল, দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের পরামর্শে প্রায় ২০০ বছর চলে আসা মুখস্তনির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে 'সৃজনশীল পদ্ধতি' প্রচলন। পাবলিক পরীক্ষার মান নিয়ে সমালোচনার পূর্বে নতুন ধরনের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সংযোজিত হওয়ার প্রেক্ষাপট এবং অনুসৃত পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর 'সৃজনশীল প্রশ্ন কী, কেন এবং কেমন' শীর্ষক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন:

''পৌনে ২০০ বছর ধরে আমাদের দেশে যে পরীক্ষা-পদ্ধতি চালু আছে, তা কমবেশি মুখস্তনির্ভর। এই পরীক্ষা-পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা গোটা পাঠ্যবই পড়ে না। তারা জানে, প্রশ্ন পুরো বই থেকে হয় না, হয় বিশেষ কিছু চিহ্নিত প্রশ্নের ভেতর থেকে। তাই সেই প্রশ্নগুলো থেকে গোটা কয়েক মুখস্ত করেই তারা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে। কষ্টকর শ্রমে প্রশ্নের উত্তরগুলো মুখস্ত করতে হয় বলে কোনো পাঠ্যবইয়ের ১০০ ভাগের ১০ ভাগের বেশি তাদের পক্ষে পড়া অধিকাংশ সময় সম্ভব হয় না। ফলে, যে ছাত্র ১০০০ নম্বরের পরীক্ষায় পাস কর , সে খুব জোর পাঠ্যবইয়ের শ'খানেক নম্বরের উত্তরই শুধু পড়তে পারে, পাঠ্যবইয়ের বাকি ৯০০ নম্বর সম্বন্ধে সে পুরো অন্ধকারে থেকে যায়। এতে তার জ্ঞান হয়ে পড়ে একেবারেই সীমিত, জ্ঞানের যে ব্যাপক আহরণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, তা ব্যাহত হয়।''

[সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা-১৩]

মূলত শিক্ষার্থীদের মেধার জড়ত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে চিন্তা, বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে 'সৃজনশীল পদ্ধতি' চালু করার বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।

২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম দুটি বিষয় (বাংলা ও ধর্ম শিক্ষা) সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয় । বর্তমানে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সকল বিষয়ে এবং এইচএসসিতে আংশিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে অভিভাবক, শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এই কারণে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান,পরীক্ষা-পদ্ধতি, পাবলিক পরীক্ষার ফল এবং পাস করা শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়ে সহজে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাচ্ছে।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে ৩ ঘণ্টার একটি প্রশ্নপত্রের দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশে সৃজনশীলে ৬০ নম্বর এবং দ্বিতীয় অংশে বহুনির্বাচনীতে ৪০ নম্বর। প্রশ্নের উভয় অংশে শুধু মুখস্ত করে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্র সীমিত। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে ভালো করতে হলে পুরো পাঠ্যবই পড়তে হবে এবং বিষয়বস্তু বুঝতে হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীকে চিন্তা করতে হবে বেশি, লিখতে হবে কম ।

সুজনশীল অংশে ৯ টির মধ্যে ৬টি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রতিটি প্রশ্নের আবার ৪ টি অংশ।

ক) শিক্ষার্থীর স্মরণশক্তি যাচাইয়ের জন্য 'জ্ঞানমূলক' প্রশ্ন থাকে। মান-১।

খ) শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ের কোনো তথ্য ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে কী না, তা যাচাইয়ের জন্য 'অনুধাবনমূলক' প্রশ্ন থাকে। মান-২।

গ) 'প্রয়োগ'-এটি সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যাখ্যামূলক অংশ। এতে শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা উদ্দীপকের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। মান -৩।

ঘ) 'উচ্চতর দক্ষতা'– এ অংশে শিক্ষার্থী উদ্দীপকের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের মূল বিষয়বস্তুতে প্রবেশ করবে এবং পাঠ্য বইয়ের একাধিক তথ্য ব্যবহার করে নিজস্ব বিশ্লেষণ উপস্হাপন করবে। মান-৪।

প্রশ্নের প্রথম দুটি (ক ও খ) অংশ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই থেকে লিখতে পারে। পরের দুটি (গ ও ঘ) অংশের উত্তর নিজের চিন্তা থেকে লিখতে হয়।

একজন শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়গুলো যথাযথভাবে পাঠ করলে সহজে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে। বহুনির্বাচনী নৈর্ব্যাক্তিক অংশে যে যতটি উত্তর শুদ্ধ করতে পারবে সে তত নম্বর পাবে। উত্তরপত্র মূল্যায়নকারী যদি মনে করেন পরীক্ষার্থী প্রতিটি স্তর যথার্থভাবে লিখতে পেরেছে, তাহলে পরীক্ষার্থী পূর্ণ নম্বর পাবে। মূল্যায়নকারীর নিকট উত্তর যথার্থ মনে না হলে আংশিক নম্বর পাবে। উল্লেখ্য, এ কারণে এখন শিক্ষার্থীরা আগের মুখস্ত-নির্ভর পরীক্ষার চাইতে বেশি নম্বর পাচ্ছে এবং বেশি পাস করছে।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপ্রণেতা প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে মডেল উত্তরপত্র জমা দিয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে তিনি নির্দেশিকা প্রদান করেন কোন প্রশ্নের নম্বর কীভাবে দেওয়া হবে। প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া মডেল উত্তরপত্র এবং নম্বর বিষয়ক নির্দেশিকা বিষয় বিশেষজ্ঞগণ যাচাই-বাছাই করে ঠিক করে দেন। পরীক্ষার পর নমুনা উত্তরপত্র এবং নম্বর সংক্রান্ত নির্দেশিকা ব্যবহার করে প্রধান পরীক্ষকের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষকগণ কিছু নমুনা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। প্রত্যেক পরীক্ষক তার বিষয়ে ১০ থেকে ২০ টি উত্তরপত্র মূল্যায়নের মহড়া অংশ নিয়ে নিজের ভুলগুলো শুধরে নেন। এ মূল্যায়ন স্ট্যান্ডার্ড বা মান ধরে পরীক্ষক তার উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়ন করে থাকেন।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে উক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় মূল্যায়নে পুরো কার্যক্রমটি স্বচ্ছ এবং নির্ভরযোগ্য হতে বাধ্য। বর্তমান পদ্ধতি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পরীক্ষক নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, সৃজনশীল পদ্ধতিতে একজন পরীক্ষার্থী জ্ঞানমূলক এবং অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তর সহজে দিতে পারে বলে পাশের হার বেড়েছে। অন্যদিকে যারা প্রয়োগ এবং উচ্চতর দক্ষতা বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর যথাযথ লিখতে পারে তারা ভালো ফল করতে পারে।

স্বাভাবিকভাবে মেধাবীরাই পরের দুটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে দিতে পারে বলেই তারা ভালো করে। পদ্ধতিগত কারণে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের পুরো প্রক্রিয়ায় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের চাইতে শিক্ষকদের অধিক সৃজনশীল হতে হয়। যেহেতু সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকের মান, দক্ষতা এবং মেধা সমমানের নয়,সে কারণে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক।

সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর 'এসইএসডিপি' প্রকল্পের আওতায় ৪,৫৩,৮৬৩ জন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। টিকিউআই ও এসইপি আএর মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকসহ শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ৫,৪৩,৭৮৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে । এটা সত্য, উল্লিখিত প্রশিক্ষণের উপর ভিত্তি করে সৃজনশীল পদ্ধতির পূর্ণ সফলতা পাওয়া যাবে না । সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং যথার্থভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য দক্ষ শিক্ষক প্রস্তুত করতে হলে আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগ, মানুষের সচেতনতা এবং প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পাওয়া, সর্বোপরি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা। দেশের শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শিক্ষার্থীদের এ ফল স্বাভাবিক মনে করছেন না। এদের কেউ কেউ জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের 'মাকাল ফল' বলে অপমান করছেন। সম্ভবত তারা পাবলিক পরীক্ষার ফলের পরিসংখ্যান গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাস করা শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।

দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রতিযোগিতায় ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরাই সর্বাধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে বলে, উক্ত শিক্ষা বোর্ডসমূহের গত দুই বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল নিয়ে আলোচনা করা হল।

২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার-৯২.৬৭%। মোট পরীক্ষার্থী ১০,৮৭,৮৭০জন; পাস করেছে-১০,০৮,১৭৪। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১,২২,৩১৩ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা বেশি মনে হলেও এরা মোট পাস করা পরীক্ষার্থীর মাত্র-১২.১৩ %। ২০১৪ সালে এসএসসিতে ভালো ফল করার মূল কারণ হল, এরা ২০১১ সালে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা অর্থাৎ জেএসসি পাস করে এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। ২০১১ সালের জেএসসি পরীক্ষার পাসের হার ছিল-প্রায় ৭২%। এই ৭২ শতাংশ পরীক্ষার্থীর ৯২.৬৭% ২০১৪ সালের এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।

২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৮৯.৭২%। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৯,৮৭,৪১৭ জন এবং পাস করেছিল ৮,৮৫,৮৯১ জন। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৭৭,৩৮১ জন। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা পাস করা পরীক্ষার্থীর মাত্র ৮.৭৩%।২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ২০১০ সালে জেএসসি পাস করা প্রথম ব্যাচ। জেএসসি পাস করা এই দুই ব্যাচের পরীক্ষার্থীদের এসএসসির ফল সন্তোষজনক বলা যায় না। তাদের আরও ভালো ফল করা উচিত ছিল।

২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ৮ টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষা দিয়েছে ৯,১৪,৬০৩ জন এবং পাস করেছে ৬,৯২,৬৯০ জন। পাসের হার ৭৫.৭৪%। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৭,৭৮৯ জন। সংখ্যায় বেশি মনে হলেও জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট পাস করা পরীক্ষার্থীর মাত্র-৮.৩৪ %। ২০১৩ সালে ৮ টি শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষা দিয়েছে ৮,১৪,৪৬৯ জন,; পাস করেছে ৫,৭৯,২৯৭ জন। পাসের হার ৭১.১৩ %। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৬,৭৩৬ জন। অর্থাৎ মোট পাস করা পরীক্ষার্থীর ৮.০৬ %। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ১,১৩,৩৯৩ জন পরীক্ষার্থী বেশি পাস করেছে। অথচ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ০.২৮ %।

২০১৩ ও ২০১৪ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পাসের হার বেড়েছে প্রায় ৪%। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতি বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়লেও, শতাংশের বিচারে এ বৃদ্ধি একেবারে নগণ্য। সংখ্যায় হাজার হাজার মনে হলেও গত দু'বছরে জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮% এ স্থির রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় বেশি বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে বলে যারা বিক্ষুদ্ধ, উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে তাদের বক্তব্যের সত্যতা মেলে না।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাস করা শিক্ষার্থীদের যারা অযোগ্য, মেধাহীন এবং 'মাকাল ফল' বলে হেয় করছেন, তারা সৃজনশীল এবং মুখস্তবিদ্যা-নির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে এ ধরনের অপমানজনক মন্তব্য করছেন। মুখস্তবিদ্যা-নির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে একই রকম প্রশ্ন ও মুখস্তের জাতাকলে পিষ্ট হয়ে চিন্তার স্ফূর্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলে। সংকুচিত হয়ে যায় মেধা ও কল্পনাশক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের ধারা।

অপরদিকে, শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে মেধার জড়ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। তারা মুক্তি পেয়েছে মুখস্ত করার মতো নির্মম পরিশ্রম থেকে। এখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় উত্তর লিখে নিজের মেধা ও চিন্তাশক্তি উদ্দীপ্তভাবে ব্যবহার করতে পারছে। এ কারণে বলা যায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাস করা শিক্ষার্থীরা অতীতের চেয়ে অনেক মেধাবী এবং সৃষ্টিক্ষম।

অনেক শিক্ষাবিদ উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার ফলকে শিক্ষার মান নির্ধারণের একমাত্র পরিমাপক বিবেচনা করে পাবলিক পরীক্ষা এবং শিক্ষার্থীর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাবলিক পরীক্ষা এবং ভর্তির জন্য বাছাই পরীক্ষার প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং মূল্যায়ন-পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাবলিক পরীক্ষায়, অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসিতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রায় ৮০ ঘণ্টা পরীক্ষা নেওয়ার পর তা মূল্যায়ন করে পরীক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা হয়।

অপরদিকে, ভর্তিপরীক্ষা নেওয়া হয় নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের জন্য সীমিত সংখ্যক প্রতিযোগী বাছাই করার জন্য। এখানে পাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত দেওয়া থাকে। মূল্যায়ন পদ্ধতিও ভিন্ন। শুদ্ধ উত্তরের জন্য নম্বর প্রদানের পাশাপাশি ভুল উত্তরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নম্বর কেটে নেওয়া হয়। এ ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতিতে কোনো শিক্ষার্থী একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য যোগ্য নির্বাচিত না হলে অন্য প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হবেন না এটা বলা যাবে না। এবার যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অযোগ্য বিবেচিত্ হয়েছে তাদের অনেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যোগ্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ জন্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ বা ৯০ মিনিটের বাছাই পরীক্ষার ফলের সঙ্গে প্রায় ৮০ ঘণ্টার পাবলিক পরীক্ষার ফল তুলনা করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন:

"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা পাস-ফেলের বিষয় নয়। ভর্তিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নটা বড়।''

(প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর, ২০১৪)

ইউজিসির তথ্য মতে, ৩৪ টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা প্রায় ৯০,০০০। বিগত পাঁচ বছর যারা সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাস করেছে তারাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ আসনগুলো পূরণ করেছে। ২০১৪ সালেও এই ৯০,০০০ আসন এরাই পূর্ণ করবে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষায় পাস না করলে তাকে মেধাহীন এবং অযোগ্য বলে হেয় করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি?

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন করেছে। মুখস্ত-নির্ভর পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন করে সৃজনশীল পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করাসহ দেশের সর্বত্র সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল এবং নকলমুক্ত পরিবেশে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা অর্জনের কৌশল হিসেবে কঠিন বিষয়গুলোতে 'সেকায়েপ' প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে ১১,২৫,৬২৫ টি অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়েছে।

এখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আনন্দদায়ক এবং আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে সরকারি সহায়তায় প্রায় ২০,৫০০ টি স্কুল-কলেজে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের জন্য দক্ষ শিক্ষকদের মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির কার্যক্রম চলছে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু হয়ে গেছে। এসব পদক্ষেপের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেলেও তা কাঙ্খিত পর্যায়ে এখনও যায়নি।

মানের বিষয়টি আপেক্ষিক। এটা সত্য, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সর্বত্র শিক্ষার মান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। Academic Ranking of World University (ARWU) -2013 অনুয়ায়ী বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এমনকি পৃথিবীর সেরা ২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো পবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সম্মানিত শিক্ষক তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান নিয়ে সর্বাধিক উদ্বিগ্ন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনে ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত না হওয়ায় তারা প্রতিনিয়ত কর্কশ ভাষায় সমালোচনা করছেন তরুণ শিক্ষার্থীদের।

দেশের বিশিষ্টজনরা মানসম্পন্ন শিক্ষা চান, কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্; বাড়ানোর জন্য সোচ্চার হন না। উপরন্তু, এসএসসি এবং এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের অর্জিত ফল 'শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত' বলে ব্যঙ্গ করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১২-'১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ১৯,২০৮, কলেজ ৩৫৪৭, মাদ্রাসা ৯৪৪১ এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩৩২৭। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৯৮% বেসরকারি।

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত ' প্রাতিষ্ঠানিক স্বমুল্যায়ন' প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে:

'সারা দেশে ১৮,৪২৫ টি বিদ্যালয়ের মধ্যে 'এ' শ্রেণির বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১০২০ টি; তার মধ্যে সরকারি-৯৫ টি। 'বি' শ্রেণির বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯০৯৮ টি; 'সি' শ্রেণির ৭৩১৯টি এবং 'ডি' শ্রেণির ৯৫৭ টি।''

(প্রথম আলো, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪)

অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং মেধাবী শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। ইউনেসকোর ২০১৪ সালের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে যে সব দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিমাণ ৭৫% এর কম, সে রকম ৩০ দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪ তম।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তাতে কোনো মেধাবী ব্যক্তি শিক্ষকতায় পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না। ন্যূনতম বেতন-ভাতায় দায়িত্ব পালনকারী স্বল্প মেধাসম্পন্ন অদক্ষ শিক্ষকদের নিকট হতে শিক্ষাবিদ, বিশিষ্টজন এবং সমাজসচেতন ব্যক্তিবর্গ কীভাবে মান সম্পন্ন শিক্ষা আশা করেন তা বোধগম্য নয়।

আমরা সকলে জানি বাংলাদেশে শিক্ষার মান উন্ননয়নের প্রধান বাধা হল সম্পদের স্বল্পতা। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা আমরা চাই (?) তবে ন্যূনতম বিনিয়োগে আগ্রহী নই। বিশ্বমানের শিক্ষার কথা শিক্ষাবিদ থেকে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত অনেককেই হরহামেশাই বলেন কিন্তু আঞ্চলিক মানের ব্যয় নির্বাহ করতে তারা কুণ্ঠিত। বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচাইতে কম (জাতীয় আয়ের মাত্র-২.২%)।

অনেকে হয়তো জানেন না যে, বরাদ্দকৃত অর্থ তিন মন্ত্রণালয়ে (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) ভাগ হয়ে যায়। অথচ শিক্ষা খাতে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে জাতীয় আয়ের ৫%-৬ % অর্থ ব্যয় করা হয়। কেনিয়ায় শিক্ষায় ব্যয় করা হয় জাতীয় বাজেটের ৩১% এবং সেনেগালে ৪০% ।

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভিকারুন নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নটেরডেম কলেজের মানে উন্নীত করা গেলে বিশিষ্টজনরা আমাদের শিক্ষার্থীদের অর্জিত ফল নিয়ে বিদ্রুপ করতে পারতেন না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার সুণ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বাস্তব সমস্যাসমূহ সমাধান না করে তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত 'অযোগ্য'এবং 'মাকাল ফল' বলে হেয় করে বা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের গালমন্দ করে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

মোহাম্মদ মাহবুব হাসান: উপ-সচিব, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।