একটি টেলিগ্রাম, একটি বই ও গণহত্যার দলিল

শওগাত আলী সাগর
Published : 24 Nov 2014, 01:34 PM
Updated : 24 Nov 2014, 01:34 PM

''আমরা বোধহয় একটা গণহত্যার যুগে বসবাস করতে শুরু করেছি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৫ লাখেরও বেশি টুটসি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হুতোদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। তার পরের বছরই ৫ হাজার বসনিয়ান মুসলিমকে সার্ব সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। সিরিয়ায় ১ লাখেরও বেশি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বুলেট, শেল, বোমা কিংবা বিষাক্ত গ্যাসে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মরছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে ব্যাস ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া আরেক গণহত্যার তথ্য-প্রমাণাদি নিয়ে হাজির হয়েছেন। এক সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে, যেটি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। অন্তত ১০ মিলিয়ন লোক এই নারকীয় গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। গ্যারি জে ব্যাসের 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' বইটি আড়ালে পড়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের এক মর্মন্তুদ দলিল।''

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক নেইল শিহান ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই কথাগুলো লিখেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এ। বইটি নিয়ে আলোচনা হলেও নেইল শিহানের এই লেখাটি 'ওয়াশিংটন পোস্ট' প্রকাশ করেছিল উপসম্পাদকীয় কলাম হিসেবে। কেবল নেইল শিহানই নন, সেই সময় পশ্চিমের প্রভাবশালী সব মিডিয়ারই দৃষ্টি কেড়েছিল গ্যারি জে ব্যাসের বইটি। দ্য ইকোনোমিস্ট , ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল , নিউইয়র্ক টাইমস , ওয়াশিংটন পোস্ট , বিবিসি , সিএনএন সহ গুরুত্বপূর্ণ সব মিডিয়া আর বৈদেশিক নীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সব সাময়িকী একের পর এক আলোচনা ও পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে বইটি নিয়ে। সব ক'টি প্রবন্ধ, নিবন্ধ আর বই আলোচনার শিরোনামেই ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত নির্বিচার গণহত্যা আর নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির সেই গণহত্যায় সমর্থনের বিবরণ।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্ব পেলেও, যে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের প্রেক্ষিত নিয়ে বইটির অবয়ব সেখানেই বইটি কেন যেন অনালোচিত থেকে গেছে।

এক বছর যেতে না যেতেই বাংলাদেশের সেই পৈশাচিক গণহত্যার বিষয়টি পশ্চিমা ইতিহাসবিদ আর পণ্ডিতদের আলোচনায় আবারও উঠে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যা আর তাতে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রেক্ষিত নিয়ে লেখা গ্যারি জে ব্যাসের বইটি ইতিহাস বিষয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হিসেবে পরিচিত 'কান্ডিল প্রাইজ অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছে এ বছর। সেই অ্যাওয়ার্ডের খবর দিতে গিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া আবারও শিরোনাম করেছে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি।

২০ নভেম্বর, ২০১৪, সন্ধ্যায় টরন্টোর একটি হোটেলে পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এর অর্থমূল্য ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার। কানাডার অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি এই অ্যাওয়ার্ড পরিচালনা করে। গত মার্চেই বইটি ইতিহাস বিষয়ে আরেক সম্মানজনক পুরস্কার 'লিওনেল গ্যালবার প্রাইজ' এর জন্য মনোনীত হয়েছিল। সেবার বইটি রানার্স আপের পুরস্কার পায়।

পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বইটির লেখক গ্যারি জে ব্যাস বলেছেন, ''১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল, তার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ তৈরির অসাধারণ একটি সুযোগ তৈরি হল। তিনি বলেন, এই পুরস্কার বইটির প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে। আর ইতিহাসের গবেষক, পণ্ডিত ব্যক্তিদের আড়ালে চাপা পড়া বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারেও আগ্রহী করবে।''

সাধারণ বিবেচনায় 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' বইটি একজন বিদেশি গবেষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিংবা 'বাংলাদেশ' নামের দেশটির জন্মের দীর্ঘ সংগ্রাম নিয়ে অনেক বিদেশি সাংবাদিক, কূটনীতিক বই লিখেছেন। কিন্তু এই বইটি অন্য যে কোনো বইয়ের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র। কারণ, সম্ভবত এই বইয়েই প্রথম কোনো পশ্চিমা গবেষক ১৯৭১এ সংঘটিত বাংলাদেশের গণহত্যাকে 'প্রমাণিত গণহত্যা' হিসেবে বিশ্বের সামনে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্যারি জে ব্যাস তাঁর বইয়ে স্পষ্টতই দাবি করছেন যে, ১৯৭১এ বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের চালানো সেই গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, আর গণহত্যাকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ গ্যারি ব্যাস তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন; সেটি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বেছে বেছে হিন্দু সংখ্যালঘুদের হত্যা। ধর্মপরিচয়ের কারণে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন বা খুন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিচারে ঘৃণ্য অপরাধ। তিনি দাবি করছেন, ১৯৭১এ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে তার দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও নিতে হবে।

গ্যারি জে ব্যাস তাঁর বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার প্রেক্ষিত তুলে ধরতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ১৯৭০এর সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুশ জয়লাভের জবাব দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালায়। সেই সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের প্রধান আর্চার ব্লাড গণহত্যার বিবরণ দিয়ে একের পর এক টেলিগ্রাম পাঠান। ওই সব টেলিগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানে 'জেনোসাইড' হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

পাকিস্তানি গণহত্যা আর নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভূমিকার প্রামাণ্য দলিল খুঁজতে গ্যারি ব্যাস ছুটে গিয়েছেন দিল্লিতে; এসেছিলেন বাংলাদেশেও। দিনের পর দিন হোয়াইট হাউজের নানা গোপনীয় দলিল হাতড়ে উদ্ধার করে এনেছেন সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, অডিও বার্তা, এমনকি বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার একান্ত সংলাপগুচ্ছও। কিসিঞ্জার যখন ইন্দিরা গান্ধীকে 'ডাইনি' বলে উল্লেখ করছেন, ভারতীয়দের 'বাস্টার্ড' বলে গালি দিয়ে সেখানে একটি 'দুর্ভিক্ষ' কামনা করছেন– সেই সংলাপও তিনি তুলে এনেছেন বইটিতে।

গ্যারি জে ব্যাস জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট অফিস একের পর টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার বিবরণ তুলে ধরেছে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন সেগুলো পাত্তাই দেয়নি। কনস্যুলেটের পাঠানো সব বার্তাই উপেক্ষা করেছে মার্কিন প্রশাসন। তারা বরং সরাসরি অস্ত্র দিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে। সেই অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পাকসেনারা। শুধুই তাই নয়, 'এটি নিতান্তই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার, সেখানে বহির্বিশ্বের করণীয় কিছু নেই' বলেও মার্কিন প্রশাসন থেকে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট আর্চার ব্লাড এক পর্যায়ে কনস্যুলেটের ২৯ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে নিয়ে যৌথভাবে মার্কিন সরকারের অবস্থানের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। ওই টেলিগ্রোমে পূর্ব পাকিস্তানে 'জেনোসাইড' এবং 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' (বাছাই করে হিন্দুদের হত্যা করা)এর কথা উল্লেখ করা হয়। মার্কিন কূটনীতির ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা 'বিরল' বলে ব্যাস মন্তব্য করেন। যৌথ টেলিগ্রামের পরই হোয়াইট হাউজ ক্ষুব্ধ হয়ে আর্চার ব্লাডকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়।

ব্লাডের এই টেলিগ্রাম তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় কিসিঞ্জার চীনকে 'লিয়াজোঁ' হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইয়াহিয়াকেও পরামর্শ দেন সরাসরি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ না করে চীনের সঙ্গে করতে। অস্ত্রের যোগানও চীনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।

এ তো গেল মার্কিনিদের কথা। পাকিস্তানি জেনারেলদের মনোভাব কী ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতি? সেনা কর্মকর্তাদের জবানিতেই গ্যারি জে ব্যাস তুলে এনেছেন পাকিস্তানি সেনাদের পৈশাচিক মনোভাব। 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' বইয়ে আমরা পাই, জেনারেল টিক্কা খান বলছেন:

''পূর্ব পাকিস্তান ভারতের দাস হয়ে গেছে। বৃহত্তর আত্মত্যাগের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলমানদের বসতভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আমাদের দেশকে আওয়ামী লীগের দৃর্বৃত্তরা ধ্বংস করে দেবে।''

গ্যারি ব্যাস তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ প্রায় প্রতিদিনই জানতে চাইতেন, কত জন হিন্দুকে আজ হত্যা করা হয়েছে। একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বইয়ে বলা হয়েছে, সাধারণভাবেই সৈনিকদের মধ্যে বাঙালিদের প্রতি ছিল তীব্র ঘৃণা। তাই হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকা থেকে আর্চার ব্লাডই যে কেবল 'জেনোসাইড' হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন, তা নয়। সেই সময়কার নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও হোয়াইট হাউজ এবং ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছিলেন, পাকিস্তান গণহত্যা করছে। পাকিস্তানিরা হিন্দুদের মেরে ফেলছে বলে গড়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্যেও কোনো মন্তব্য করেননি প্রেসিডেন্ট নিক্সন বা কিসিঞ্জার। বরং কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছেন, এত সংখ্যক হিন্দুকে বের করে দিয়ে ইয়াহিয়া 'স্টুপিডের মতো' কাজ করেছে।

আগেও বলেছি 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' বইটি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের উপাখ্যান মাত্র নয়। একাত্তরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন লেখক। সুনির্দিষ্টভাবে কত সংখ্যক লোক গণহত্যার শিকার হয়েছে তার কোনো হিসাব দেননি গ্যারি জে ব্যাস। হাজার হাজার লোকের প্রাণহানির কথা বলেছেন তিনি তাঁর বইয়ে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নথিতে ২০০,০০০ লোক নিহত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিন্তার পাঠক-গবেষকদের জন্য বইটির আলাদা গুরুত্ব আছে। যদিও ঢাকার যে মিডিয়াগুলো মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারী বই থেকে ধারাবাহিকভাবে দিনের পর দিন প্রকাশ করে, তারা কিন্তু
'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি বাংলাদেশের গণহত্যার প্রেক্ষিত নিয়ে লেখা একটি বইয়ের আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার খবরটিও তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। অথচ এই বইটি নিয়ে, বইয়ের লেখককে নিয়ে আমাদের উৎসাহ দেখানোর যুক্তিসঙ্গত অনেক কারণই রয়েছে।

কিছুদিন আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর এসেছিলেন টরন্টোতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলছিলেন, আমরা যখন বিদেশিদের একাত্তরের গণহত্যার কথা বলি, তারা তখন তার প্রমাণ চায়। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার কোনো ডকুমেন্টেশন নেই বলে বিদেশিরা অনেক সময় আমাদের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা যে বিবৃতি দেয় তার কারণও কিন্তু গণহত্যার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ডকুমেন্টশন না থাকা।

অথচ পশ্চিমা একজন গবেষক এক বছর আগেই গণহত্যার ডকুমেন্টেশনসহ একটি বই প্রকাশ করেছেন। সেই এক বছরের মাথায় ইতিহাস গবেষণায় সবচেয়ে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার দিয়ে সেই ডকুমেন্টেশনের গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে। একজন পশ্চিমা ইতিহাসবিদ যখন বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে বলে দাবি করেন, তখন পশ্চিমা পণ্ডিতরা সেটি উড়িয়ে দিতে পারেন না। আর পণ্ডিতরা যখন একে আলোচনায় নিয়ে আসেন তখন রাষ্ট্র সংস্থার উপরও তার একটি প্রভাব তৈরি হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার দলিল হিসেবে গ্যারি জে ব্যাসের 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড' বইটি আমরা কতটা ব্যবহার করতে পারব সেটাই দেখার বিষয়।

আমাদের গণহত্যার এই প্রামাণ্য ইতিহাস তুলে ধরার জন্য গবেষক, লেখক গ্যারি জে ব্যাসকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

শওগাত আলী সাগর: দৈনিক 'প্রথম আলো'র সাবেক বিজনেস এডিটর; টরন্টো থেকে প্রকাশিত 'নতুনদেশ ডটকম'এর প্রধান সম্পাদক।