বাংলাদেশে বাম রাজনীতি: ব্যর্থ না অসম্ভব

Published : 23 Nov 2014, 12:23 PM
Updated : 23 Nov 2014, 12:23 PM

বাংলাদেশ থেকে বাম রাজনীতি অনেকটাই উঠে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। বস্তুতপক্ষে, ১৯৭৬ সালের পরে বামরা স্বাধীনভাবে কোনো বিষয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে অবতীর্ণ হতে পারেনি। কর্ণেল তাহের কয়েক ঘণ্টার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায় দখল করে ফেলেছিলেন, কিন্তু সেটা আধা বেলাও গড়ায়নি। তাছাড়া তাঁর সমর্থন শ্রেণি-রাজনীতির ভাবনা থেকে আসেনি, এসেছিল জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকে। তাই এর সাফল্য আসেনি।

বর্তমানে বামরা নীতি-ভিত্তিক ও আদর্শগত অবস্থান নিয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর, কিন্তু তারা কোনো ক্ষেত্রে সঞ্চালকের ভূমিকায় নেই, পরিচালক তো নয়ই। অতএব এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, বাম রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে কি এক প্রকার উঠেই গেছে?

লক্ষ্য করা যায় যে, কেবলমাত্র যখন মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা জোট বাঁধে তখনই কোনো অবস্থান নিতে পারে, যেটা রাজনীতিতে গুণাগুণতির ব্যাপার হয়। ১৯৩৭ সালের দিক থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা মুসলিম লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে শুরু করে। পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি বেশ সক্রিয় ভূমিকা নেয়। সেনাবাহিনীর এক অংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে ১৯৫০ সালে। কমিউনিস্ট নেতা সাজ্জাদ জাহির এবং কবি ফেজ আহমেদ ফেজ পাকিস্তানের এক উগ্র ভারতবিরোধী সেনা অধ্যক্ষ জেনারেল আকবরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টা চালান। এটা 'লাহোর ষড়যন্ত্র' হিসেবে পরিচিতি। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদের জেল হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের কাব্য ও সঙ্গীত জগত, তথা সংস্কৃতিচর্চার বাইরের জগতে কমিউনিস্টদের তেমন দেখা যায় না।

১৯৫৭ সালের পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে ওয়ালী খানের নেতৃত্বে ন্যাপ বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেেশর সক্রিয় হয়, যদিও এই অবস্থানে বাম আদর্শের চেয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছিল অনেক বেশি, এটা ছিল পাখতুন জাতীয়তাবাদ।

১৯৪৭ সালের পরে পূর্ব পাকিস্তানে বামদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে সবল ছিল। ১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তখন বামরাও এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। বাম কর্মীরা সক্রিয় ছিল সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে। ভাষা আন্দোলনে তাদের কর্মীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কিছু কর্মী আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হয়। এক অর্থে এটাই ছিল বামদের রমরমা যুগ, তাদের আত্মবিশ্বাসেরও কোনো ঘাটতি ছিল না তখন। সে কারণে, আওয়ামী লীগ যখন কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যায়, বামরাও এক অর্থে ক্ষমতায় সমাসীন হয় আওয়ামী লীগের ডান অংশের সাফল্যের কারণে, যদিও তারা তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

১৯৫৭ সালের কাগমারি সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন ডান অংশকে, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাকে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চ্যালেঞ্জ করে বাম অংশটি। অনেকগুলো বিষয়ে দ্বিমত ছিল এই দুই অংশের মধ্যে, তবে তাঁদের আদর্শগত অবস্থান দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে গিয়েছিল এটা স্বাভাবিক। এতে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব বিজয়ী হন এবং মাওলানা ভাসানী ও তাঁর বামপন্থী সহায়করা পরাজিত হয়ে আলাদা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। কিন্তু এই দল কোনো দিনই সামনে উঠে আসতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হয়। ১৯৬২-'৬৩এর দিকে বামরাই সোভিয়েতপন্থী ও চীনাপন্থীতে বিভক্ত হয়ে যায়। অতএব এই খণ্ডিত বামরা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৯৫৮-'৬৮ সালে পরিচালিত আইয়ুব খানের কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে গ্রামে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয় তাদের অনেকের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এদের মধ্যে থেকে নুতন করে আবার বামরা সবল হতে থাকে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বে অনেক বাম কর্মী সামনে আসেন। কিন্তু আন্দোলনের মূল ভূমিকায় তারা ছিলেন না। আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকারের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল তাকে এক ধরনের শায়েস্তা করার চেষ্টা। কারণ এই ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না।

১৯৬৬ সালের ৬ দফা প্রস্তাবের পরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারও অবস্থান ছিল না, যদিও বামরা এবং বিশেষ করে মাওলানা ভাসানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিসর দখলে ছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা প্রস্তাব ও তার কর্মীদের হাতে। ১৯৭০ সালে যখন নির্বাচন হয় তখন বামরা সুযোগ করে নিতে পারেনি, তারা মোটামুটি মূলধারার বাইরের শক্তি হিসেবেই ছিল। অতএব ১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বামদের মৌলিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা অবস্থানের চিহ্ন তেমন পাওয়া যায় না।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধটা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগ, তারা অন্য কাউকে কাছে ভিড়তে দেয়নি। ভারতে বাংলাদেশি বামদের অবস্থান ছিল বেশ নাজুক। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থক সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও পাত্তা পায়নি। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরিভাবে এই যুদ্ধে জড়িত ছিল, তবু মনি সিংএর দলের সমর্থকদের জন্য আলাদা ট্রেনিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করতে হয়। অতএব আওয়ামী লীগের যুদ্ধে মিত্রদেরও তেমন কোনো যৌথ অংশগ্রহণ ছিল না।

মাওলানা ভাসানী এক প্রকার বন্দি অবস্থায় সময় কাটান ভারতে এবং অন্যদের ভূমিকার তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং দেশের ভেতরে চীনা বামরা একাধিক স্থানে সক্রিয় ছিল; যেমন, সিরাজ সিকদার পেয়ারা বাগানে, মান্নান ভুঁইয়া নংসিংদীর লৌহজং এলাকায়, মতিন, টিপু বিশ্বাস পাবনায় ইত্যাদি। তবে কোনো জাতীয় বামযুদ্ধ হওয়া অসম্ভব ছিল, যেহেতু বামরা ছিল বহুভাগে বিভক্ত।

যে বাম ধারা বেশি সবল ছিল ১৯৭১ সালে, সেটি হচ্ছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বাম কর্মীরা। ১৯৬২'এর দিকে ছাত্রলীগের ভেতর একটি বামগোষ্ঠী সৃষ্টি হয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। এই গ্রুপটি ক্রমে দলের ভেতর সবল হয় এবং আওয়ামী লীগের যতটুকু বামপন্থী ভাবনা বা সাংগঠনিক শক্তি ছিল এটা এই গ্রুপ বা কর্মীদের কারণে হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধর নেতৃত্ব চলে যায় তাজউদ্দিন আহমেদ পরিচালিত মুজিবনগর সরকারের হাতে। বাদ পড়ে যান শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খান। এরপর মনির ডান অংশ ও খানের বাম অংশ যৌথভাবে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়।

অবশ্য এতে বড় ভূমিকা পালন করে ভারত সরকার যারা কেবলমাত্র মুজিব সরকারের উপর নির্ভর করতে চায়নি। বিভিন্ন ক্যাম্পের পরিচালনা এবং প্রণোদনার কাজেও ছাত্রলীগের বামরা সক্রিয় ছিল। বামদের এটাই হচ্ছে বৃহত্তম অংশগ্রহণ জাতীয় রাজনীতিতে এবং এই ধারাটি ইতিহাসের বিচারে সফলতম 'বাম' ধারা। অবশ্য 'বনেদি' বামরা– চীনা হোক অথবা সোভিয়েতপন্থী– এদেরকে কোনো সময় 'বাম' বলতে রাজি নয়।

পরবর্তীতে এই অংশই জাসদ প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে কর্ণেল তাহেরের সহায়তায় ক্ষমতায় যাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। আওয়ামীপন্থী বাম ধারা বা জাসদের পরবর্তীতে তেমন ভূমিকা দেখা যায় না।

সোভিয়েতপন্থী বাম নিজে যেহেতু ক্ষমতায় যাবার ক্ষমতা রাখে না, তাই তারা সব সময় আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে থেকেছে। ১৯৫৭ সালে তারা আলাদা হয় এবং তারপর তাদের দুর্দিন শুরু হয়। ১৯৭১ সালে তারা আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। তাদের পৃষ্ঠপোষক দেশ সোভিয়েত রাশিয়া ছিল ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান সমর্থক দেশও বটে। তাই এই সমর্থন ছিল স্বাভাবিক। ১৯৭২-'৭৫ পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিহীন সমর্থন করে যে কারণে তাদের সবাই 'বি টিম' বলে ডাকত। যখন একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বাকশালের মাধ্যমে, এরা সবার আগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাকশালের পেটে গিয়ে নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণা করে।

১৯৭৫ সালের পরে তাদেরকে আর মাঠে দেখা যায়নি। চীনা বামরা তখন আশ্রয় নেয় বিএনপির ছাতার নিচে। এরাই সঙ্গ দেয় জিয়াউর রহমানকে, যখন তিনি জামায়াতে ইসলামীকে স্থান করে দেন রাজনীতিতে। অতএব, চীনা বাম এবং সোভিয়েত বামের বিলুপ্তি এভাবেই ঘটেছে অন্য দলের সঙ্গে মিশে গিয়ে।

এটা পরিস্কার যে, বড় কোনো দলের ছত্রচ্ছায়ায় না থাকলে বামরা টিকতে পারে না। আর বড় দলের পেটে গেলে তারা হজম হয়ে যায়। যখনই বিচ্ছিন্ন হয়েছে তখনই তাদের যা সামান্য প্রভাব ছিল তা মিটে গেছে। ১৯৫৭ সালের পরে বামরা যখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির শক্তিতে পরিণত হয়।

চীনারা কোনো দিনই মূল শক্তির জায়গায় যেতে পারেনি। তাছাড়া তাদেরও বড় সময় ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন, যেটার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে তারা জিয়াউর রহমানের দলের ভেতর প্রবেশ করে মিলিয়ে যায়, ঠিক যেভাবে বাকশালের ভেতরে সোভিয়েত বাম মিলিয়ে গিয়েছিল।

জাসদ তার যাত্রা শুরু করেছিল আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে। তারা আলাদা দলও গঠন করেছিল বের হয়ে এসে, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি এবং আজ তারা আবার চীনা বামের এক অংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগে ফেরত গেছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ থেকে বেশি দূরে অবস্থান করে বাম রাজনীতি বেশিদূর এগাতে পেরেছে এমন প্রমাণ কম।

রাজনৈতিক সমাজের সবচেয়ে ভালো ছেলেরা বাম রাজনীতি করে, কিন্তু তাদের কোনো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ নেই রাজনীতির ধারার উপর। বর্তমানে যারা বাম রাজনীতি করছেন তাদেরকে কেউ কেউ 'খুচরা বাম' বলে থাকেন। টাকার পাশে খুচরা পয়সার মতো তারা উপেক্ষিত। অতএব যারা একটি স্বাধীন বাম পরিসর গড়ার চেষ্টা করছেন তাদের মনে রাখতে হবে যে, তাদের পূর্বের ইতিহাস হয় ব্যর্থতার না হয় খণ্ডিত হবার। কোন পরিসরে গেলে বামরা কোন ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে সেটা নিয়ে তাদের চিন্তা করা উচিত।

তা না হলে হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের মতো সাদা কাপড় পরে এয়ারপোর্টে বসে থাকার দৃশ্য হজ্জে যাওয়ার লেবাস নয়, বাম রাজনীতির গায়ে 'কাফনের কাপড়ের মোড়ক' বলে মনে হতে পারে।