বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণও সুশাসনেরই অঙ্গ

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 29 Nov 2014, 01:56 PM
Updated : 29 Nov 2014, 01:56 PM

বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে অতি দ্রুতগতিতে। ঢাকা শহরে যেখানে দু'বছর আগে বাড়িভাড়া ছিল প্রতি মাসে মাত্র ২,০০০ টাকা, এখন তা হয়েছে প্রায় ৪,০০০ টাকা। আবার সম্প্রতি খবর বের হয়েছে যে, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হতে পারে। এমন খবরে স্বল্পআয়ের জনগণ অত্যন্ত বিব্রত ও বেসামাল হয়ে পড়েছে। অনেকে ভাবছে, পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কোথাও মেসে গিয়ে থাকবে। কিন্তু ব্যাচেলর বা পরিবার ছাড়া বিবাহিতদের ভাড়া পাওয়া আরও কঠিন। শহরের নির্দিষ্ট আয়ের লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অল্প ভাড়ায় কোথায় থাকা যায় তা ইতোমধ্যে খুঁজতে শুরু করেছে।

ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহরে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ বেশি। অনেকের উপার্জনের প্রায় অর্ধেক চলে যায় বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে। বাড়িভাড়া সম্পর্কিত আইন ও বিধিমালা কার্যত সঠিকভাবে প্রয়োগযোগ্য না থাকায় বা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তদারকির দায়িত্ব পালনে দৃশ্যমান কোনো দফতর না থাকার কারণে, বর্তমানে সমগ্র দেশে, বিশেষত ঢাকা মহানগরীতে বাড়িভাড়ার সমস্যা প্রকারান্তরে একটি বিশাল নাগরিক সমস্যা হয়ে উঠেছে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকজন যাদের নিজস্ব কোনো আবাসিক গৃহ নির্মাণের সক্ষমতা বা নিজস্ব নিবাস নেই, তাদের জীবনযাত্রা দুঃসহ হয়ে পড়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদায়ের ব্যাপারে জনস্বার্থে একটি রিট মামলা হয়েছিল এবং ওই রিটের শুনানি শেষ হয় ২৯ নভেম্বর, ২০১২, অর্থাৎ দু'বছর গত হল। শোনা যায়, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান আছে। শুনানির পর অনেক দিন চলে গেল, কিন্তু চূড়ান্ত হয়নি এখনও। দুষ্ট লোকদের ধারণা, মালিকেরা সংখ্যায় বেশি বলে ভাড়াটিয়ারা অসহায়।

প্রচলিত আইন হচ্ছে 'প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১' যার অধীনে একটি স্ট্যান্ডার্ড রেন্ট নির্ধারণের নিয়ম প্রচলিত আছে। কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ তা নির্ধারণ করবে বা কীভাবে এ জাতীয় বিরোধ মীমাংসায় উপনীত হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার দারুণ অভাব রয়েছে।

অনেকে মনে করেন, বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়াবলী হচ্ছে জেলা প্রশাসনের কাজ। যদি তাই হয়, তবে এ আইন প্রয়োগ করা দুরুহ। জেলা প্রশাসনের কাছে এ মহানগরীতে এ জাতীয় বিশাল অধিক্ষেত্র বিস্তৃত একটি আইন বলবৎ করা বা তার নিয়মিত তদারকি করা অথবা এ আইনের আওতায় অভিযোগ গ্রহণ করে তার সুরাহা করা এক জটিল কর্মকাণ্ড। তদুপরি, মেট্রোপলিটন সিটি হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের এখতিয়ার কতটুকু আছে মহানগরীতে তাও বিবেচ্য। এ জন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর দায়ী থাকলে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যত উল্লেখ নেই।

অনেকগুলো বিষয় এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য; তা হচ্ছে কোনো ভাড়াটিয়া যদি ভাড়া দিতে না চায় অথবা কোনো মালিক যদি কোনো সুপ্ত কারণে ভাড়া গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে অথবা কিছু ভাড়া ব্যাংক অথবা কিছু ভাড়া নগদ নিতে চায় তখন কীভাবে সুরাহা হবে? ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে বের হওয়া বা চলাচলের পথ সুগম না হয় এবং এ নিয়ে যদি বিরোধ বাঁধে, তবে এ বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি কী হবে? এ ব্যাপারে আইনে উল্লেখ আছে, কিন্তু প্রয়োগের বিষয়টি আরও স্পষ্টতার দাবি রাখে।

বাড়ির মালিক যদি প্রিমিয়াম বা সালামি দাবি করে অথবা অনেক বছরের ভাড়া অগ্রিম দাবি করে অথবা ভাড়ার চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে জোর করে এবং বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে, তখন কী হবে? এছাড়া বিলম্বে ভাড়া পরিশোধ করলে বা অনাবশ্যকভাবে বিলম্ব করলে, জরিমানা দিতে হবে কিনা, যদি দিতে হয় তবে কী হারে তা হবে, এ জাতীয় বিষয়াবলীর সুরাহার পথ ও পন্থা বলতে হবে।

মাত্র কয়েক দিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে 'জাতীয় ভাড়াটিয়া পর্ষদ' নামক একটি সংগঠন অনেক লোকের স্বাক্ষর নিতে শুরু করে। তারা এ ব্যাপারে ১৫টি দাবিও সরকারের কাছে উত্থাপন করে। দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাড়িভাড়া আইন সহজতর ও অধিক গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের অভিমত, বিষয়টি এখন আর সামাজিক সমস্যা নয়, জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যে একটি বিষয় তারা উল্লেখ করেছে; তা হচ্ছে প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে।

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি জড়িত। তদুপরি, বাড়ির মালিক এ জন্য আয়কর পরিশোধ করেন কিনা অথবা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ অর্থের উৎস জড়িত আছে কিনা এর সঙ্গে তা দেখার প্রয়োজন আছে। তদুপরি যিনি বাড়ির ভাড়া গ্রহণ করছেন তিনিই বাড়ির মালিক কিনা এ বিষয়টিও সম্পৃক্ত আছে। তবে আইনের ১৩ নং অনুচ্ছেদে বাড়িভাড়ার রসিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই তা সব ক্ষেত্রে প্রতিপালন করছে না বলেই এ বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করছে দিনের পর দিন।

এছাড়াও প্রচলিত আইনে রেন্ট কন্ট্রোলারের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রত্যেক ওয়ার্ডে রেন্ট কন্ট্রোলার আছে কিনা, থাকলে কোথায় তার অবস্থান তা অনেকেই জানেন না। মূলত সরকার বা কর্তৃপক্ষ জনগণকে অবহিত না করলে জনগণ জানবে কেমন করে? ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রেভিনিউ অফিসার একবার এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে জানান যে, সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি সঠিক বলেছেন।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং যোগাযোগের সুবিধাজনক অবস্থানে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কোনো হিসাব নেই, দরাদরিও নেই। ছেলেমেয়েদের স্কুল বা কর্মস্থলের কাছাকাছি হলে দরকষাকষির সুযোগও গ্রহণ করে না আগ্রহী ভাড়াটিয়া। অবস্থার শিকার হয়ে বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া অধিক মূল্য দিতেও রাজি থাকে। অন্যতম কারণ হচ্ছে, চলাচলের দুর্যোগ ও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া। কিন্তু কী হারে বাড়িভাড়া বাড়তে পারে এবং কোন স্থানে কত ভাড়া হতে পারে, এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে সরকারকে।

বাড়ির মালিকরা বলছে, বাড়ি তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক। রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্বও ব্যয়বহুল, কোনো প্রকার মেরামতের প্রয়োজন হলে অনেক খরচ। ভাড়াটিয়ারা ভুলেও বাড়ির যত্ন নেয় না। পক্ষান্তরে ভাড়াটিয়ারা বলছে, বাড়ির মালিক নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত সর্ভিস চার্জ গ্রহণ করে, কিন্তু কোনো সার্ভিস দেয় না। অনেক সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির প্রতিও সঠিক নজর দেয় না বাড়ির মালিক।

তারপর আছে আপিল আদালত, মামলা-মোকদ্দমার বিষয়। বলা আছে, ৬ মাসের মধ্যে কোনো অভিযোগ দাখিল করতে না পারলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বিষয়টিও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। তাছাড়া আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মামলা করার অর্থ এমন এক ঝামেলা গ্রহণ করা, যার ফলাফল অর্থদণ্ড, বিড়ম্বনা ও দীর্ঘসূত্রতা।

খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমানে প্রচলিত 'প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১' জারি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তেইশ বছর আগে। এ আইন প্রণীত হয়েছে যখন কোনো গণমুখী সরকার এ দেশের শাসন ব্যবস্থায় আসীন ছিল না। জনগণের ভাষা বা তাদের অভিমত এ আইনে স্থান পেয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তদুপরি, কাদের স্বার্থে বা তদবিরে এ আইন তখন প্রণীত হয়েছিল তাও বোঝা যাচ্ছে না সঠিকভাবে।

এছাড়া গত তেইশ বছরে নাগরিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, নগরমুখী অভিবাসন বেড়েছে ব্যাপক হারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, বসবাসের স্থান নির্ধারণে নতুন চাহিদা ও পদ্ধতির জন্ম নিয়েছে। তাই এখন আর বিলম্ব নয়, বিষয়টি দেখতে হবে নগরজীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবনায় রেখে, সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে। বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বর্তমান আইনের পরিবর্তন করতে হবে অবশ্যই। আধুনিকতা ও সুশাসনের অঙ্গ হিসেবে বাড়িভাড়া বিষয়ক আইন ও বিধিমালার পুনর্বিন্যাস করে জবাবদিহিতার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে জরুরিভাবে।

মনে রাখা দরকার, সুশাসনের অর্থ শুধু আইন-শৃঙ্খলা নয়, যে সকল বিষয় সমাজে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম, তাকেই সুশাসনের অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে দিনবদলের কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হবে; তবেই দৃশ্যমান হবে গণকল্যাণমুখী সরকারের প্রতিবিম্ব।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।