তরুণ রাজনীতিকরা কী শিখছেন

রণেশ মৈত্র
Published : 19 Nov 2014, 11:56 AM
Updated : 19 Nov 2014, 11:56 AM

বাংলাদেশের বা যে কোনো দেশের উন্নতি, অগ্রগতির প্রধান বাহন হল রাজনীতি। যে রাজনীতি গণতান্ত্রিক, যে রাজনীতি গণস্বার্থ সংরক্ষক, যে রাজনীতি সভ্য ও সুরুচিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ, দেশ ও দশের স্বার্থে নিবেদিত, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী, সততার প্রশ্নে আপোষহীন ও দেশপ্রেমে নিবেদিত– সেই রাজনীতির কথা বলছি। সকল ধরনের সংকীর্ণতামুক্ত, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও হবে সেই রাজনীতি। যা করেছেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ সর্বজননন্দিত নেতৃবৃন্দ।

অপর পক্ষে, এই রাজনীতি যারা করবেন এবং যাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় উক্তরূপ মূল্যবোধে দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত, সংগঠিত হবেন– দেশের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন ও দেখাবেন– তাঁদের অবশ্যই হতে হবে তরুণ। এর অর্থ এ নয় যে, এরপর প্রবীণরা আর রাজনীতি করবেন না, অবশ্যই করবেন। তবে তাঁরা যত শীঘ্র তাঁদের অতীত গৌরবদীপ্ত অভিজ্ঞতায় তরুণ-তরুণীদের সমৃদ্ধ করে রাজনীতির বিশাল অঙ্গনে 'নতুনেরে স্থান' করে দেবেন ততই দ্রুত দেশটা সার্বিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারবে।

আমরা ভাষা আন্দোলন করেছি; তখন ছিলাম তরুণ-কিশোর। যুক্তফ্রন্ট গঠনের দাবিতে আন্দোলন করেছি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য লড়েছি। পূর্ব বাংলাসহ সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেও ছিলাম সোচ্চার। ছয় দফা, এগার দফা কর্মসূচি পূরণের দাবি নিয়ে রাজপথে থেকেছি। রাজবন্দিদের বিনাশর্তে মুক্তির দাবিতে রাজনীতির মাঠে ঝড় উঠেছে আমাদের মতো তরুণদের অংশগ্রহণে। মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ হরণের বিরুদ্ধে এবং সকল কালাকানুন বাতিল ও সংবাদপত্রের ও সাংবাাদিকতায় স্বাধীনতার দাবিতে তখনকার তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয়তা ছিল ব্যাপক।

এভাবে, প্রবীণদের সঙ্গে তরুণদের তিলে তিলে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হল। ১৯৭০এর নির্বাচনী সংগ্রাম আমরাই গড়ে তুলেছি। সর্বোপরি, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরাই– যারা সবই তরুণ বয়সের অথবা ভরা যৌবনের।

ইতিহাস যাঁরা জানেন, যাঁরা এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলিকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন, তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, বাঙালি জাতির গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী সকল আন্দোলনেরই মূল শক্তি ছিল তরুণ-তরুণীরা। তারা ঐক্যবদ্ধও ছিল। নানা জাতীয় প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ছিল। দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নে ছিল বিরাট মতানৈক্যও। কিন্তু তা কখনও তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের অবনতি ঘটায়নি বা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কোনো কমতি ঘটেনি তাতে। বরং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তরুণরা ছিল পরস্পর পরস্পরের প্রধান সহায়ক।

এ কথা অনস্বীকার্য যে অজস্র রক্ত, ঘাম, জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে বিজয়গুলি অর্জিত হয়েছিল, দেশের গৌরব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক শ্রদ্ধার সম্ভার অর্জন করতে পেরেছিল। কিন্তু আমাদের জন্য, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক (এবং কলঙ্কজনকও) যে, আমরা আমাদের ইতিহাসখ্যাত সংগ্রাম, লাখো মানুষের আত্মদান ও ত্যাগ-তিতীক্ষা সেই মর্যাদার আসনে ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যার দ্বারা নেতৃত্বের যে শূণ্যতার সৃষ্টি হল, তাতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রচলন যে মাঝপথে কোথায় হারিয়ে গেল চোরাবালির মতো, তা ভাবলেও আঁতকে উঠতে হয়।

ঐ শূণ্যতা সৃষ্টির পরে আজও প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হল, শূণ্যতা আর কাটে না। হাজার বছরে বাঙালির ইতিহাসে এমনটি বোধহয় কদাপি ঘটে না। রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন কত কম বয়সে, নানা কারণে তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কিন্তু কবিতায়। সাহিত্যের অপরাপর ক্ষেত্রে তাঁর সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে তো বহু আগেই। খুদিরাম থেকে আরও যে সকল বিপ্লবী শ্রদ্ধেয় নারী-পুরুষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় সংগ্রাম করতে করতে আত্মদান পর্যন্ত করে বিশ্ববাসীর কাছে তাঁদের ও বাঙালির বীরত্বগাথা তুলে ধরেছিলেন, তাঁরাও ছিলেন তরুণ-তরুণী।

আমি বলতে চাইছি, ১৯৭৫পরবর্তী এই প্রায় চল্লিশ বছরেও সেই তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের দৃপ্ত পদে বাঙালি জাতির জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থানে বিকশিত হতে দেখা যায় না কেন? কেন পথ দেখাতে পারছি না দেশ-জাাতির মহামূল্যবান সম্পদ আমাদের অগণিত তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের?

একটি মুহূর্তের জন্যে আমরা যেন বিস্মৃত না হই যে, তারুণ্যের জাগরণ, তারুণ্যের উত্থান, তারুণ্যের জাতীয় ঐক্যই হল বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি– তারাই হল আমাদের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ। তাদের সচেতন, দায়িত্বশীল, ইতিহাসনিষ্ঠ, প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের পূজারী, দলীয় সংকীর্ণতামুক্ত ও পরস্পরের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের জাতীয় অগ্রগতির সার্বিক চাবিকাঠি।

যে তরুণেরা পাকিস্তানের পরাধীন আমলে বা তারও আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘ শাসনামলে অতি গৌরবদীপ্ত আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল– যতসব বড় বড় এবং সম্মানজনক বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল– তখন বাঙালির সংখ্যা কত ছিল? অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যাই ছিল সাত কোটি। পাকিস্তান আমলে তা দেশবিভাগের কারণে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে চার কোটিতে। আবার তার চব্বিশ বছর পরে, যখন বাঙালি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল পুনরায় সাত কোটিতে।

তাহলে যখন আমরা সর্বনিম্ন জনসংখ্যায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই ১৯৪৭ সালে, মাত্র সাড়ে চার কোটিতে– তখনই গৌরবদীপ্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠনের আন্দোলন, মুসলিম লীগের সমূলে উৎখাত, বন্দিমুক্তি আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনী সংগ্রাম, তার আগের ঐতিহাসিক ছয় দফা, এগার দফা আন্দোলন ও সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সময়ে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক। এর মধ্যে তরুণের সংখ্যা যে নিদারুণ স্বল্প ছিল তা বলাই বাহুল্য। এতদসত্ত্বেও, ঐ যুব সমাজ কী অসম্ভবকেই না সম্ভব করে তুলেছিল, আজ তা ভাবলে অনেকটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

তখন তো আজকের মতো বড় বড় রাজনৈতিক দলও গড়ে ওঠেনি, শক্তিশালী রাজনৈতিক দল তো দূরের কথা। ছাত্ররা মূলত সংগঠিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ)। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে উঠেছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে। পরবর্তীতে, শামসুল হকের মৃত্যুর পর, তাঁর স্থলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন শেখ মুজিবর রহমান। দেশব্যাপী আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক শক্তি গড়ে উঠতে উঠতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল।

১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কতিপয় নীতিগত ভুল বা আত্মসমর্পণ ঘটায়, তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীন লড়াই করতে করতে মওলানা ভাসানীসহ বহু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিন্তান তথা সমগ্র পাকিস্তানের বাম-গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল নেতা-কর্মীদের নিয়ে অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যানুসারী দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গড়ে তোলেন।

এই নিয়ে বলা চলে দুটি রাজনৈতিক দলের নামেই আন্দোলনগুলি চলছিল। কিন্তু কর্মী কোথায়? আওয়ামী লীগের পুঁজি ছিল ছাত্রলীগ; তেমনি ন্যাপ চলত ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীবাহিনীর দ্বারা। তাছাড়া ছাত্রত্ব শেষ হলেও ছাত্রলীগ থেকে নেতারা চলে যেত আওয়ামী লীগে, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ন্যাপে বা কমিউনিস্ট পার্টিতে। এভাবেই রাজনৈতিক দলগুলি গড়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে।

মোদ্দা কথা দাঁড়ায়, এইভাবে তরুণরাই গড়ে তোলে বাংলাদেশ ও তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু আজ ১৯৭৫এর পর, দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে যখন দেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটিতে, তখন তো তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতীর সংখ্যাও হয়েছে বিপুল। শিক্ষার প্রসার সেদিনের তুলনায় ঘটেছে অনেক বেশি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। নারীরা আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে আজ আর গৃহবন্দি না থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কমবেশি অবস্থানও তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে। তবু কেন তারুণ্য কোনো দৃশ্যমান দায়িত্বশীল ভূমিকায় জাতীয় রাজনীতিতে দাঁড়াতে পারছে না?

ছাত্রলীগ আছে, ছাত্রদল আছে, কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বামপন্থী ছাত্র সংগঠনও আছে কিন্তু ছাত্র আন্দোলন নেই। যা আছে তা বলতে লজ্জা বোধ হয়। ছাত্র সংগঠনগুলির– ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কথা বলছি- বিশাল বাহিনী আছে দেশের সর্বত্র। তাদের নেটওয়ার্কও যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের মূল দল দফায় দফায় নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন কোথায়? কোথায় ছাত্রদের ভর্তি-সংকট দূর করার দাবিতে, সন্ত্রাসী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে, মানসম্মত শিক্ষা ও সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম চালুর দাবিতে, সন্ত্রাস-দুর্নীতি-সম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন?

বরং দেখা যায় এই সংগঠন দুটিও সন্ত্রাসী বাহিনী পুষছে। চরদখলের মতো হল দখল করছে। শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে তাদের অপমান করছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারীধর্ষণ প্রভৃতি তাবৎ অপকর্মে লিপ্ত। তারা আইন মানে না, পুলিশ চেনে না। বহুবিধ অপকর্মে লিপ্ত, কিন্তু কণ্ঠে শ্লোগান 'জয় বাংলা, 'জয় বঙ্গবন্ধু'। আবার ছাত্রদলের শ্লোগান 'শহীদ জিয়া জিন্দাবাদ'। কিন্তু তাদের কাজের সঙ্গে শ্লোগান কি সঙ্গতিপূর্ণ?

তাহলে তাদের মূল দলগুলি এবং তার নেতৃবৃন্দ কি শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের? আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো দলগুলি তাদের কর্মী বা অঙ্গ সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলির কর্মীদেরকে কদাচি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেননি; দিয়েছেন এমন কথা আজ পর্যন্ত শুনিনি। ফলে কর্মীরা তাদের মূল দলগুলির প্রদত্ত ভাষণ এবং নানাবিধ আচরণ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেন বলে সবার ধারণা।

এ ক্ষেত্রে বিএনপি তাদের তরুণ নেতা হিসেবে তারেক জিয়াকে মেনে নিয়েছে অবলীলায়। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বা তাদের অনুকূলে হলেই তারেক জিয়াকে যে বিএনপির সভাপতি বা চেয়ারপারসন পদে তার মা খালেদা জিয়াই আগ্রহের সঙ্গে বসাবেন, সকল আলামত তাই প্রমাণ করে।

প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে লন্ডনে বসে তারেক জিয়া যে সকল চরম বিতর্কিত এবং ইতিহাস-বিকৃতিমূলক ভাষণ দিচ্ছেন অন্ধের মতো– সেগুলির প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন দেশে অবস্থাকারী সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। তারেক যখন 'বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি দেওয়া উচিত' বলে বক্তব্য দেন বা বঙ্গবন্ধু 'স্বাধীনতাবিরোধী' বা 'স্বাধীনতার ঘোষক' বলে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন– তখন তাকেও নিঃশর্ত সমর্থনই তারা দিয়ে যাচ্ছেন। এই অশ্রদ্ধাসূচক, অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমগ্রভাবে বিএনপির সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে যাচ্ছে এবং ফলে দলটির তরুণ সাধারণ কর্মীরাও ঐ ধরনের অশ্রদ্ধাসূচক বক্তব্য ও আচরণে অভ্যন্ত হয়ে উঠছে। জাতীয় রাজনীতিও সংঘাত-সংঘর্ষমূলক হয়ে উঠছে। ফলে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাও যে বিঘ্নিত হচ্ছে তা দুই দলের কেউই সামান্যতম ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না।

অপরপক্ষে, হাসিনাপুত্র জয় যদিও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, তিনি আওয়ামী লীগে এখনও যোগদান করেছেন আনুষ্ঠানিকভাবে, এমন কথা আজও শুনিনি। সহসা নির্বাচনে দাঁড়াবেন এমনটাও কেউ বলছেন না। কিন্তু তার বক্তৃতায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে কোনো কথাই পাওয়া না গেলেও, 'বিএনপি সন্ত্রাসী দল', 'স্বাধীনতাবিরোধী রাজকারের দল' প্রভৃতি দিব্যি বলে চলছেন। তিনি তরুণ, বঙ্গবন্ধুর নাতি। তা নিয়ে তার গর্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু যে রাজনৈতিক কথাগুলি বিএনপির বিরুদ্ধে তিনি প্রচার করে চলেছেন, তা কি তিনি বললে শোভা পায়? এসব নিয়ে সিনিয়র নেতারা ভাববেন বা বলবেন। তার উচিত তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে দলের তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষিত করে তোলা। নিজের বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সহায়তা করা।

তা না করে প্রকাশ্যে তিনি যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা তার সমালোচনা তো দূরের কথা, হাততালি ও বাহবা দেওয়া নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত। ফলে এক অসহনশীলতা– অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের সংস্কৃতি সমগ্র তরুণ সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে।

প্রধানমন্ত্রীর আর এক উপদেষ্টা এইচ টি এমাম সম্প্রতি 'লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেই মৌখিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরি দেওয়ার দায়িত্ব' নিজ কাঁধেই নিয়েছেন। তাহলে এই তরুণ সমাজ কী করে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? কী করে তারা মৌলবাদবিরোধী, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলবে?

বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রধান নেত্রী একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। সংসদে বসেনও না। রাজনৈতিক সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিয়ে পাশাপাশি আসন গ্রহণ করলেও পরস্পরের মধ্যে কুশল বিনিময়ও করেন না। বক্তৃতায় ভাষণে দেশের খারাপ সকল কিছুর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করাই হয় তাঁদের ভাষণের প্রধান মর্মবস্তু। এ থেকেই তো কর্মীরা পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা ও অসহনশীলতার শিক্ষা নিয়ে থাকেন। যে শিক্ষা নিয়েছেন তারেক জিয়া ও সজীব ওয়াজেদ জয় উভয়েই। আর তা থেকেই তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র।

তরুণদের এভাবে অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হয়ে উঠতে দিলে অমিত সম্ভাবনায় ভরপুর তারুণ্যের অপচয় রোধ করা যাবে না।

রণেশ মৈত্র: লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।