মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনা এবং নিউইয়র্কের সভায় আমার বক্তব্য

শারমিন আহমদ
Published : 18 Nov 2014, 10:17 AM
Updated : 18 Nov 2014, 10:17 AM

সম্প্রতি, ৮ নভেম্বর, ২০১৪ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত প্রোগ্রেসিভ ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে আমি যে কথাগুলি বলেছিলাম তা প্রায় সকল সংবাদ মাধ্যমে খণ্ডিত ও কোনো কোনো মাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় এই লেখার অবতারণা।

জেল হত্যাকাণ্ডের বিবরণে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে জেলে হত্যা, একই ধারাবাহিকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধর চেতনা বিনষ্ট করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে অর্ডিন্যান্স জারি করেন যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না। জেনারেল জিয়াউর রহমান মোশতাককে অপসারণ করে প্রেসিডেন্ট হবার পর, ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই অবৈধ অর্ডিন্যান্সকে বৈধতা দিয়ে স্থায়ী করে নেন। এর ফলে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

১৯৮৭ সালে আমি যখন বাংলাদেশে জেলহত্যার উপর তথ্য যোগাড় করছি তখন, এরশাদ সরকারের আমলে, হত্যাকারীদের দুজন, ফারুক ও রশীদ দেশে ফিরে রাজনৈতিক দল গঠন করার অনুমতি লাভ করে। তাই জেলহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ সে সময় সহজ ব্যাপার ছিল না। সেই ১৯৮৭ সালে আমি আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, জেলহত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি কে এম সোবহান, মহসীন বুলবুল, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক বীর উত্তম প্রমুখের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সংগৃহীত সব সাক্ষাৎকার ও তথ্যের ভিত্তিতে জেলহত্যা সম্পর্কে রচনাটি খুব সম্ভবত ছিল ঐ বিষয়ে প্রথম গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ।

২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তাহেরউদ্দিন ঠাকুরসহ জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত বিএনপির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রথম বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়।

আশ্চর্যের ব্যাপার যে, অধিকাংশ মিডিয়ায় ফলাও করে জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমার বক্তব্যের যেসব খবর প্রচারিত হল তার মধ্যে বিএনপির সময়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করবার বিষয়টি একেবারেই অনুল্লিখিত। এতে করে মনে হতে পারে যে, কোনো বিশেষ কারণে বিএনপিকে আড়ালে রেখে আমি কথাগুলি বলেছি। কিন্তু তা তো নয়। আমি শ্রোতাদের কাছে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান ও দলের বিচারের পথ অবৈধভাবে রুদ্ধ করার ধারাবাহিক একটি চিত্রই তথ্যের আলোকে তুলে ধরেছিলাম। কোনো অজ্ঞাত কারণে মিডিয়ায় তা খণ্ডিতভাবে প্রচারিত হয়।

কোনো কোনো পত্রিকায় "আমি বঙ্গবন্ধুকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই, দেবতা নয়" আমার বক্তব্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। আমি এ কথা বলিনি। আমি বলেছিলাম, "আমরা খুব এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমরা মানুষকে দেবতার পর্যায়ে তুলে দিয়েছি। এটার ফল হচ্ছে কী? আমি কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। কারণ তার মনুষ্যত্বের বিচারে, তার দোষ-ত্রুটি নিয়েও সে যখন মহাকাশটা ছুঁতে যায় তখুনি সে পরিণত হয়– ফেরেশতা নয়, দেবতা নয়, মহামানবে।"

টিভি নিউজে সম্প্রচারিত আমার বক্তব্যের ভিডিও লিংকটি তুলে ধরা হল:

আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দল-মতের উর্ধ্বে উঠে যুক্তিনিষ্ঠভাবে মুক্ত আলোচনাচর্চার ক্ষেত্রটি অতি দুর্বল হওয়ায় যে কোনো আলোচনাকেই খণ্ডিত ও অতিরঞ্জিত করে কোনো বিশেষ দলভুক্ত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

"তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা" গ্রন্থটি, যার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, পাক-মার্কিন এবং গণহত্যাকারী মৌলবাদী চক্রের বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের নিরন্তর সংগ্রামের কথা, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের পরিপূরক সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার প্রেরণা ও তাজউদ্দীনের বাস্তবায়ক ভূমিকার কথা– সে বিষয়গুলো না পড়েই অনেকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। বইটি যথাসম্ভব নির্মোহ ও যুক্তি-তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হলেও তার কোনো কোনো অংশ পছন্দ না হওয়ায় মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়।

মতের সঙ্গে না মিললেই বা অপ্রিয় সত্য বললে তার বিপরীতে যুক্তিবুদ্ধির অবতারণা না ঘটিয়ে মিথ্যা অপপ্রচারণার ভয়াবহ ধারা থেকে জাতীয় স্বার্থেই বেরিয়ে এসে সত্যের সাধনা ও মুক্তচিন্তার চর্চা অব্যাহত রাখার কথা আমি বলেছিলাম। সমাজের দিকনির্দেশক বুদ্ধিজীবীরা যাদের এক বড় অংশ দলীয় হয়ে গিয়েছেন, তারা দলের উর্ধ্বে উঠে জাতি ও বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেন, সে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলাম। আরও বলেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করে জাতীয় কল্যাণে দলমতনির্বিশেষে আমরা যেন রঙধনুর মতো বৈচিত্র্যময় নানা রঙের সমাহারে একটি একতার সেতু গড়ে তুলতে পারি।

আমাদের দেশে প্রকট রাজনৈতিক বিভাজন, অন্ধ পক্ষপাতিত্ব, সত্যের অন্বেষার চাইতে স্বার্থ ও সুবিধার দৃষ্টিকোণ থেকে খণ্ডিতভাবে ঐতিহাসিক বিষয়গুলিকে উপস্থাপন করার যে দুঃখজনক রীতি দীর্ঘকাল ধরেই চালু হয়েছে তার থেকে উত্তরণের জন্য নির্মোহ বিশ্লেষণ, মুক্তচিন্তা এবং যুক্তি-বুদ্ধির চর্চার বিকল্প নেই। সেই কাঙ্ক্ষিত, সুন্দর এবং সবল গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন, এই প্রত্যাশা হতেই আজকের এই প্রত্যুত্তরটি বিশেষ করে দেওয়া হল।

শারমিন আহমদ: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা।