উন্নয়ন সূচক ও কিছু কথা

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 13 Nov 2014, 05:10 AM
Updated : 13 Nov 2014, 05:10 AM

বিশ্ব ব্যাংকের নতুন ব্যবসা শুরুর সহায়ক পরিবেশ বিষয়ক সূচকে বাংলাদেশের বারো ধাপ উন্নয়ন ঘটেছে। সম্প্রতি এই সূচকটি প্রকাশিত হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত বছর আমাদের অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত গতিশীলতা আসেনি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি, যদিও মোটামুটি ৬.১৮ ছিল। সে তুলনায় এবারকার অগ্রগতি তাৎপর্যপূর্ণ।

এই অর্থনৈতিক অগ্রসরমানতা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে সাফল্য দিচ্ছে বলেই মনে করি। অর্থনীতির সূচকসমূহে দেশের উন্নয়ন নির্দেশ করে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে গবেষণা করে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাফল্যের মূল্যায়ন করতে হলে সঠিক পরিসংখ্যানটি জানা জরুরি।

এদেশে পরিসংখ্যান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লুকোচুরি খেলা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একবার বলে বসলেন যে, দেশে বেকার নেই। উনি যে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছিলেন তা সত্যি দুঃখজনক। এটি ছিল পরিসংখ্যানগত ক্রটির অন্যতম ফলাফল। সে সংজ্ঞায় কর্মসংস্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের সুবিধাজনক করে। যেমন, কোনো ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই তার কর্মসংস্থান হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হত। এর ফলে তখন লেবার সেনসাসে দেশের বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ।

সাইফুর রহমান ছিলেন একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। উনি ডেবিট-ক্রেডিট বুঝতেন, তাই এসব ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। তিনি ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করার জন্যে আর্থিক খাতে উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিল্পের উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সময়কালে ন্যূনতম প্রটেকশন তুলে নেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়। বিদেশি ও দাতাগোষ্ঠীর সিলমোহর পেয়ে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সাইফুর রহমান তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন।

অর্থনীতির নিয়ম হচ্ছে, কোনো ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে সেটি বুঝতে পারা যায় না– এটি দীর্ঘমেয়াদে অনুভূত হয়। আমাদের অর্থনীতিতে সত্যিকারের গতিময়তা এসেছে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়ার আমলে, ১৯৯৬ সালের পর। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবার পর তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলে, 'জনকল্যাণের লক্ষ্যে অর্থনীতি' তত্ত্বটির ব্যবহার শুরু হয়।

এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারায়, বর্তমানে দেশ সামাজিক সূচকসমূহে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২১ সালে, যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হবে সে সময়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলেই অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। কারণ গত ছয় বছরে দেশের অনেক বেশি অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে মোট জাতীয় উৎপাদন ৭ শতাংশে উন্নীত হওয়া কোনো সমস্যা নয়।

বর্তমানে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সড়কসমূহের উন্নতির পাশাপাশি রেলপথের উন্নয়নে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। রেলওয়ের উন্নয়নের জন্যে ভারত থেকে প্রাপ্ত ক্রেডিট ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে নৌপথের উন্নয়নে একটি হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ প্রয়োজন। নদীর নাব্যতা সংস্কার; নদীপথ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা, যা দখল হয়ে যাচ্ছে তা উদ্ধার করা এবং গত তেইশ বছরে যে সমস্ত নৌপথ বন্ধ হয়েছে সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে চালুর পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আসলে নৌপথে পণ্য পরিবহন করা গেলে পণ্য পরিবহনের খরচ কম হয় এবং সড়কপথের যানজটও হ্রাস পায়।

এদিকে সস্তায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০০৯ সালে এ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মহাসংকট থেকে উত্তরণের জন্যে কুইক রেন্টাল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। পদ্ধতিটি সে সময়ের জন্যে যথাযথ ছিল। তবে বর্তমানে সরকার কয়লানির্ভর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে পদক্ষেপ নিয়েছেন। পদক্ষেপ দুটো সফল হোক এটাই প্রত্যাশা; কারণ তা না হলে দেশের অন্ধকার কাটবে না।

সরকার মূল্যস্ফীতি হ্রাসে সচেষ্ট রয়েছে, এটিও একটি ভালো পদক্ষেপ। কেননা অধিক হারে মূল্যস্ফীতি ঘটলে, সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশ হবে বলে আশা করা যায়। এটি যদি আগামী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে ৪ শতাংশে রাখা যায়, তবে অর্থনীতির জন্য ভালো। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, পণ্যের দাম বাড়ে ও চাহিদা কমে; সরবরাহ প্রথমে বাড়লেও গড়ে কমে যায়। এসবের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় এবং কর্মসংস্থান কমে যায়।

বস্তুত অনুৎপাদনশীল খাতে যে অধিক ব্যয় হচ্ছে তার সংকোচনে প্রয়াস গ্রহণ জরুরি। মূল্যস্ফীতি হ্রাসের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবার কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।

শিক্ষা মানুষকে সুন্দর করে। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীশিক্ষা গ্রহণের হার বাড়ছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। সুখের বিষয়, গ্রাম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন-থানা-জেলা সর্বত্র তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে গ্রামীণ এলাকাতেও ছাত্রছাত্রীরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধার সদ্ব্যব্যহারে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে, মনে রাখতে হবে, উন্নয়নের নিয়মই হচ্ছে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চোরাবালির মতো কিছু অপসংস্কৃতি ঢুকে যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ শক্ত হাতে দমন করতে হলে কেবল সরকার নয়, বরং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। কেননা কোমলমতি তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ঘটালে তা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং দেশের অগ্রগতি বিনষ্ট করে।

বাংলাদেশের উন্নয়নে পোশাক শিল্প খাতের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। নারীর ক্ষমতায়নে এ খাতের অবদান অপরিসীম। পোশাক খাতে কর্মরত ৮০ শতাংশই হচ্ছে নারী শ্রমিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো অব বাংলাদেশ, ইপিবি তাদের ওয়েবসাইটে পোশাক ফ্যাক্টরি ও মোট কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা গত চার বছর ধরে অপরির্বতনীয় রয়েছে দেখাচ্ছে। ইপিবি যে এ ধরনের ভুল তথ্য দিচ্ছে তা দুঃখজনক। তারা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিজিএমইকে। বিজিএমই অফিসে যোগাযোগ করলে দেখা যায় যে, পোশাক ফ্যাক্টরির সংখ্যা এই সময়ে বেড়েছে এবং তাদের অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সদস্য সংখ্যাও বেড়েছে। অন্যদিকে মোট পোশাক শ্রমিকের সংখ্যাও এ সময়ে বেড়েছে।

'যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ'। এ প্রবাদ বাক্যের মতোই ইপিবি কি সরকারের অগ্রগতি ও সাফল্য বহির্বিশ্বে পরিচিত করতে চায় না বলেই ভুল উপাত্ত তাদের ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছে? অথচ যেভাবে সরকার রানা প্লাজার সমস্যা সামাল দিয়েছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও বর্তমানে পোশাক খাতের কমপ্লায়েন্সের জন্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছে তা থেকে সরকারের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠে। আশা করব, অনতিবিলম্বে ইপিবি তার ওয়েবসাইট ঠিক করে পরিসংখ্যান যথাযথভাবে প্রদর্শন করবে।

এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে নানাভাবে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্যে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ২৬ কর্মকর্তাকে আনন্দ শিপইয়ার্ডের জন্যে তলব করা হয়েছে দুদকে। আবার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। ওই ব্যাংকে চেয়ারম্যান থাকাকালীন এক ব্যক্তি সিএসআর-এর আওতায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নাম করে দু'কোটি টাকা নিয়েছিলেন যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে। এ ধরনের 'পুকুর চুরি' রোধ করা উচিত।

নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক একযোগে কাজ করে চলেছে। এটি দেশের জন্যে ইতিবাচক দিক। তবে দেশে মোট কতজন উদ্যোক্তা রয়েছেন, তাদের প্রকৃতি, নারী-পুরুষ, বয়স ও ব্যবসার ধরন অনুযায়ী সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অথচ উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্যে এসএমই ফাউন্ডেশন, মিডাসসহ অনেকেই কাজ করছেন। সরকারের সদিচ্ছা তখনই পূর্ণতা লাভ করবে যখন দায়িত্বপ্রাপ্তরা সততার পাশাপাশি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উচিত অবিলম্বে মোট উদ্যোক্তার তালিকা প্রস্তুত করে তাদের প্রকৃতি, নারী-পুরুষ বয়স ও ব্যবসার ধরন অনুযায়ী সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা।

প্রায় বছর ছয় ধরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মানুষের মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসছে। সামাজিক কল্যাণের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই এগিয়ে চলা যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয়, সে জন্যে প্রত্যেকে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সচেষ্ট হতে পারেন।

মোট কথা, অর্থনীতির উন্নয়নে যে গতিময়তা সঞ্চারিত হচ্ছে তা যেন কাঁদা-ছোঁড়াছুড়ি বা অহেতুক রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্বারা বিনষ্ট না হয় সেদিকে কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি।