বাংলায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 5 Feb 2011, 12:47 PM
Updated : 5 Feb 2011, 12:47 PM

বিজ্ঞানকে বাংলায় জনপ্রিয়করণ করাটা বেশ দুরূহ ব্যাপার। বিজ্ঞান বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত খটমটে বিষয় হিসেবে গণ্য হত। একথা বিশেষভাবে বিবেচ্য বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের আগে যখন এ দেশে কম্পিউটার এবং বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তখনও শুরু হয় নি। আমাদের দেশের সমাজ সংস্কৃতিও খুব একটা বিজ্ঞান-বান্ধব তা বলা যায় না। এ দেশে কবিতা লেখা যতটা উৎসাহ এবং প্রচার পায়, গণিত উৎসব ততটা পায় না। এবং পত্রিকার পাতায় বুদ্ধিজীবী সমাবেশের যে সব ছবি দেখা যায় তাতে কদাচিৎ কোনো বিজ্ঞানীর ছবি থাকে।

আমাদের দেশে বিজ্ঞান ক্লাব সংস্কৃতিও সম্ভবত খুব পুরোনো নয়। বিজ্ঞান প্রচারে বিজ্ঞান পত্রিকার একটা অনস্বীকার্য ভূমিকা থাকে। আজ পর্যন্ত কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিজ্ঞান পত্রিকা আমাদের দেশে চালু হয় নি। সাহিত্য পত্রিকা "দেশ" এর মত বিজ্ঞানের জন্য তেমন কোনো পত্রিকার নাম পাওয়া যায়না যা তুলনা করা যায়। ড. ইব্রাহীমের সম্পাদনায় "বিজ্ঞান সাময়িকী" এক দশকেরও বেশি সময় ধরে টিমটিম করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এ ছাড়া "মহাকাশ বার্তার" নাম করা যায়। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই সত্তর-পূর্ব সময়ের নয়। বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে "বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান পত্রিকা," বি.সি.এস.আই.আর'এর "পুরোগামী বিজ্ঞান" একসময়ে বিজ্ঞান বিষয়ক উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা ছিল। বর্তমানে কম্পিউটার প্রযুক্তির উপর "কম্পিউটার জগৎ" ও "কম্পিউটার বিচিত্রা" ব্যবসা-সফল প্রযুক্তি পত্রিকা। তবে এগুলো পরিপূর্ণ বিজ্ঞান পত্রিকা নয়, বরঞ্চ বিজ্ঞাপনের ভারে জরজর লাগসই প্রযুক্তি সংবাদই কেবল প্রাধান্য পায়।

সাধারণভাবে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। "অনুসন্ধিৎসু চক্র" দীর্ঘদিন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজে ব্যাপৃত আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেওক্রাডং, নটরডেম কলেজ বিজ্ঞান ক্লাব, হলিক্রস কলেজ বিজ্ঞান ক্লাব, বুয়েটের সত্যেন বোস বিজ্ঞান ক্লাব, ডিসকাশন প্রজেক্ট, বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি করে পথিকৃতের কাজ করেছেন ড. আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। ড. আব্দুল্লাহ আল-মুতী এ জন্য ইউনেস্কোর কলিঙ্গ পুরস্কারও পেয়েছেন। এছাড়া বিজ্ঞান নিয়ে উল্লেখযোগ্য লেখালেখি করেছেন ড. এ.এম. হারুন-অর-রশীদ, ড. আলী আসগর, ড. মুহম্মদ ইব্রাহীম, দ্বীজেন শর্মা, তপন চক্রবর্তী, আব্দুল হক খন্দকার, সুব্রত বড়ুয়া, আব্দুল হালিম, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, ড.কাজী মোতাহার হোসেন, ড. কুদরত-এ-খোদা, ড. জহুরুল হক, ড. শাহজাহান তপন, ডা. শুভাগত চৌধুরী, স্বপন কুমার গায়েন, ভবেশ রায়, মুনির হাসান, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, আলী ইমাম, ড. আবেদ চৌধুরী, আসিফ, মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, জাকারিয়া স্বপন, ড. নওয়াজেশ আহমেদ প্রমুখ। আশার কথা ইদানিং "গণিত উৎসবের" নামে গণিত চর্চার একটা জোরালো আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের ব্রোঞ্জ পদক জয় এই গণিতচর্চার ব্যাপকতার একটা ভালো প্রমাণ। এই কাজের জন্য ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও মুনির হাসানকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞান সংগঠক হিসেবে মুনির হাসানের যোগ্যতা সন্দেহের অতীত। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে এই সব কার্যক্রমে। ভবিষ্যতে এদের মধ্য থেকে অনেকেই উঠে আসবে যারা আলোকবর্তিকা হাতে দেশবাসীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ওপার বাংলার বিজ্ঞান-লেখকদের মধ্যে সমরজিৎ কর, পথিক গুহ, পার্থসারথি চক্রবর্তী, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অরুপ রতন ভট্টাচার্য, অমল দাশ গুপ্ত, নারায়ন সান্যাল, আশীষ লাহিড়ী প্রমুখের নাম করা যায়। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, বিজ্ঞান শিক্ষার গোড়াপত্তন ওপারে হলেও বিজ্ঞান লেখনিতে এপারই এগিয়ে।

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার এবং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রধান শর্ত হলো মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের বই প্রকাশ করা। শুধু মাত্র জনপ্রিয় বিজ্ঞান দিয়ে তো গবেষণা মানের কাজ হয় না ! এর জন্য চাই স্নাতক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞান গ্রন্থ এবং এ ধরনের গ্রন্থের প্রকাশক। সত্যেন বোসের ভাষায়: যারা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয় তারা হয় বিজ্ঞান জানেন না নয়তো বাংলাই জানেন না।

পশ্চিম বঙ্গে এ কাজে সাহিত্য সংসদ, দে'জ পাবলিশার্স ইত্যাদি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পথিকৃতের কাজ করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিশ্বভারতী প্রকাশন সংস্থা যেখান দিয়ে "বিশ্ব-বিদ্যা সংগ্রহ" প্রকাশিত হত। এই সংগ্রহশালার প্রতিটি গ্রন্থই ক্ল্যাসিক পর্যায়ের।

বাংলাদেশে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড এবং পরে বাংলা একাডেমী একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় বহুসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দিকে এই সমস্ত পাঠ্যপুস্তকের একটা বড় অংশ ছিল অনুবাদ গ্রন্থ। সেই সময়ে আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকগুলি রচিত হতো ভারতীয় পুস্তকাদির আদলে। আশির দশক থেকেই বাংলাদেশের নিজস্ব একটি লেখন স্টাইল গড়ে উঠেছে। এর পেছনে কাজ করেছে একাডেমীর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত বিজ্ঞান বিষয়ক পরিভাষা কোষগুলি।

বাংলা ভাষায় সর্বাধিক সংখ্যক (দুই বাংলা মিলে) পাঠ্যপুস্তক রচনার একক কৃতিত্ব বাংলা একাডেমী করতে পারে। বিজ্ঞান বিষয়ক পরিভাষা কোষ, বেশ কয়েকটি শব্দকোষ এবং সর্বোপরি পাঁচ খন্ডের পরিপূর্ণ বিজ্ঞান বিশ্বকোষ বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিজ্ঞান বিশ্বকোষের প্রকাশনা বাংলা ভাষার বিজ্ঞান চর্চায় একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলা একাডেমী থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক অনেকগুলি ক্ল্যাসিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, অনেকের মাঝে প্রফেসর এ.এম. হারুন-অর-রশীদের লেখা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের উপর রচিত "চিরায়ত বলবিজ্ঞান" ধ্রুপদি পর্যায়ের একটি রচনা। এ ছাড়া রবার্ট রেসনিক ও ডেভিড হ্যালিডে রচিত বিশ্ববিখ্যাত ফিজিক্স টেক্সটবুকটি প্রফেসর অজয় রায় এবং তাঁর সহযোগীদের হাতে অনূদিত হয়ে বেরিয়েছে বাংলা একাডেমী থেকে। সাবলীল বাংলা না হলেও এই বইটি পাঠক-প্রিয়তা পেয়েছে। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনের "গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস," ড. মফিজ উদ্দিন সম্পাদিত "জৈব রসায়ন"(দুই খন্ড), ড. লুৎফর রহমানের "ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক্স"(দুই খন্ড), ড. সৈয়দ হুমায়ুন কবীরের "প্রাণীবিদ্যা", ড. মুনিবুর রহমান চৌধুরীর "বীজগনিত (দুই খন্ডে), ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারীর "নিউক্লিয় রসায়ন," ড. কুদরত-ই-খোদার "কলেজ কিমিয়ার কথা" ও "জৈব রসায়ন (চার খন্ডে), ড. ফররুখ খলিলের "সংনম্য প্রবাহ" এবং ড. মকবুল হোসেনের "আধুনিক বিশ্লেষন গণিত," ড. নজরুল ইসলামের "প্রাকৃতিক ভূগোল," ড. জহুরুল হকের "তড়িৎ কৌশল পরিচয়," প্রফেসর আব্দুল জব্বার ও এ.কে হাজরার "ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস," ড. রমজান আলী সরদারের "ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস" ও "প্রাথমিক বিশ্লেষন গণিত," প্রফেসর আব্দুল জব্বারের "তারা পরিচিতি," "খগোল পরিচিতি" ও "প্রাচীন জ্যোর্তিবিদ্যা", প্রফেসর এ.এম.হারুন-অর-রশীদের "আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব," ড. রেজাউর রহমানের "বাংলাদেশের সাপ," প্রফেসর আখতারুজ্জামানের "বিবর্তন বিদ্যা," ড.মকবুল হোসেনের "জটিল ফাংশন"(দুই খন্ডে), মোঃ আলী রেজা খানের "বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী "(২ খণ্ড), মোস্তফা কামাল পাশার "আণবিক জীববিজ্ঞান"(৩ খন্ডে) ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গ্রন্থগুলি উল্লেখযোগ্য এবং বেশ সুলিখিতও বটে। তবে কয়েকটি গ্রন্থ প্রথমদিককার রচনা বিধায় যথোপযুক্ত পরিভাষার অভাবে বেশ দুর্বোধ্য হয়েছে। বাংলা একাডেমীর "একুশে গ্রন্থমালা" সিরিজের বইগুলো প্রতিটিই ছিল ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ দ্বারা রচিত অসাধারণ মনোগ্রাফ। এ রকম ছোট্ট সুন্দর জ্ঞানগর্ভ বই আর হয়নি। এই সিরিজের বইগুলির মধ্যে কৃষ্ণবিবর, মৌলিক কণা, বজ্র ও বৃষ্টি, সংখ্যা, জ্যামিতি বইগুলি অসাধারণ সাহিত্য গুণ সম্পন্নও বটে।

বাংলা একাডেমীর বইয়ের সমস্যা দুটি – কোনো বইয়ের সংস্করণ/পুনর্মুদ্রণ কদাচিৎ ঘটে থাকে এবং বইয়ের বিপণন ও বিজ্ঞাপন শোচনীয় পর্যায়ের। বলা বাহুল্য, একাডেমীর বইগুলির প্রাতিষ্ঠানিক স্ট্যান্ডার্ড তুলনারহিত। এই বিষয়ে উল্লেখ করা যায় প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতিষ্ঠান "মুক্তধারার" যা অনেকগুলি সুন্দর রুচিশীল বিজ্ঞানের বই উপহার দিয়েছে।

বিজ্ঞান প্রকাশনায় প্রয়োজনীয় পরিভাষার সমস্যা শীঘ্রই দূর হবার নয়। তাই এটা নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে। তবে গ্রহনযোগ্য এবং সহজে বোধগম্য সমাধানই শ্রেয়। তাই সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবিত না হয়ে সাধারণ বিজ্ঞান ও উচ্চতর শ্রেণীর জন্য পাঠ্যপুস্তক লেখার জন্য বিজ্ঞান গবেষকদের এগিয়ে আসা উচিত।