কিছু তারবার্তা ও একজন ‘রহস্যময়’ নুরুজ্জামান…

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 16 June 2011, 08:03 AM
Updated : 6 Nov 2014, 08:47 PM

এএনএম নুরুজ্জামান আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। বীর উত্তম খেতাবধারী। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ যখন ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব ছেড়ে নবগঠিত সেনাব্রিগেড 'এস' ফোর্সের দায়িত্ব নেন, তখন তার জায়গায় সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন নুরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন নুরুজ্জামানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর। দুজনের জানাশোনাটা পুরানো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন নুরুজ্জামান। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।

১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থানটি হয়, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন নুরুজ্জামান। ৬ নভেম্বর তার বাসা থেকে সামরিক পোশাক বদলে, তারই জামা-কাপড় পরে বের হন খালেদ মোশাররফ এবং সাভার যাওয়ার পথে গ্রেফতার ও পরে নিহত হন।

ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে লন্ডনে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি দেশে থাকলে রক্ষী বাহিনী হয়তো এতটা হতোদ্যম অবস্থায় থাকত না। তার বন্ধু ও সাবেক সহচর কর্ণেল (অব.) আনওয়ার-উল-আলম এ বছরের ১৪ মার্চ ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, মোশতাক সরকার নুরুজ্জামানকে দেশে ফিরতে বাধা দিলেও তিনি কৌশলে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি দিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে জনমত গড়ে তোলেন।

এ পর্যন্ত তথ্যগুলো ঠিকই আছে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ১৯৭৫ এবং ১৯৭৬ সালের কিছু তারবার্তা পড়ার পর চাইলেই ব্যাপারটার দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যেকার এই অতিগোপন বার্তাগুলো আগস্ট এবং নভেম্বরে নুরুজ্জামানের সত্যিকার অবস্থান রহস্যময় করে তোলে। দেরি না করে সেদিকেই বরং যাওয়া যাক।

প্রথম তারবার্তাটি ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের। রাষ্ট্রদুত ইউজিন বোস্টারের পাঠানো এই বার্তায় বলা হয়েছে, রক্ষীবাহিনীর প্রধান (ডিরেক্টর জেনারেল) এএনএম নুরুজ্জামান ১১ আগস্ট, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। তার ভিসার জন্য আবেদনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়লের তরফে লেখা হয়েছে, নুরুজ্জামান অফিশিয়াল ডিউটিতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। তার অফিশিয়াল ডিউটি কী ধরনের জানতে চাইলে আমাদের বলা হয়, তিনি সেখানে একমাসের শিক্ষা সফরে যাচ্ছেন। এরপর দশদিনের ছুটি কাটাবেন। যতদূর জানা গেছে. নুরুজ্জামান সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কারও সঙ্গে থাকবেন।

আনওয়ারউল হক তার মেমোয়ারে লিখেছেন, ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর নুরুজ্জামান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। ৭ নভেম্বর পরবর্তী সরকার তার দেশে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারত থেকে পরে তার আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন নুরুজ্জামান। এর আগ পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশে আক্রমণ করার জন্য একটি বাহিনী সংগঠিত করছিলেন বলে জানা যায়।

এখানে একটু বলা দরকার, ৭ নভেম্বরের পর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর অনুগতদের অবস্থা সম্পর্কে। শেরে বাংলা নগরে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। সঙ্গী ছিলেন স্রেফ বেড়াতে এসে কমান্ডারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কর্নেল হায়দার এবং কর্নেল নাজমুল হুদা। তাদের লাশ ফেলে রাখা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সামনের মাঠে। লাশে থুতু দেয় বিপ্লবী সৈনিকরা।

সশস্ত্র বাহিনীতে খালেদের অনুসারীদের ভাগ্য সম্পর্কে জানা যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ ডিসেম্বরের একটি তারবার্তায়। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ:

৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর পর সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে তৎপর হয়েছেন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থরা। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফকে সহায়তা দেওয়ার জন্য বিমান বাহিনীর ৮ জনকে গ্রেফতার ও দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেদিন সকালে মিগ ২১ নিয়ে আকাশে ওড়া স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও পরে তা মওকুফ করেছেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর কিছু অফিসার এবং বেস কমান্ডার রউফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে খালেদ এবং জাসদ অনুগতদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত ঠিক কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের ভাগ্য সম্পর্কে সঠিক জানা যায়নি।

সে হিসেবে ভাগ্যবান বলতেই হবে শাফায়েত জামিল এবং নুরুজ্জামানকে। বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালানোর সময় পা ভেঙে যায় জামিলের। এরপর তিনি মুন্সিগঞ্জে ধরা পড়েন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই সিএমএইচেই তার চিকিৎসা চলে যার বাইরে বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের লাশ। শাফায়েত জামিলের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত দেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। নুরুজ্জামানের ভাগ্যও একই রকম ভালো বলে আমরা জানতে পারি আমাদের আলোচ্য পরবর্তী তারবার্তায়। জানতে পারি কার উদ্যোগে তিনি গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ফরেন অফিসে হেনরি কিসিঞ্জার বরাবর পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার যা লিখেছেন তার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ এমন:

১৯ তারিখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন আমাকে ফোন করে একটি অতিগোপন অনুরোধ রাখার ইচ্ছে জানান। জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান এএনএম নুরুজ্জামান ভারতে আশ্রয় নেওয়াদের একজন। সেখানে বাংলাদেশে অভ্যুথানের জন্য একটি বাহিনী গঠন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অভিভূত হয়ে তিনি ভারত ত্যাগ করার ইচ্ছে জানিয়েছেন। সরকারও তাই চাইছে। যেহেতু তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তাই যুক্তরাষ্ট্রে তাকে বছর খানেকের জন্য কোনো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক যাতে পরে তাকে ফিরিয়ে এনে কোনো কূটনৈতিক পদে কাজে লাগানো যায়। তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু (সেখানে বাঙাালি অভিবাসীদের সংখ্যা বিশাল বলে) কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। তবারক অনুরোধ করেন যাতে সিআইএ নুরুজ্জামানকে তাদের তত্ত্বাবধানে নেয় এবং কোনো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর খানেকের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেয়।

বোস্টার জানান, তিনি অনুরোধটা জায়গামতো জানাবেন। তবে এর সমস্যাগুলোও তুলে ধরেন, বিশেষ করে নুরুজ্জামানকে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা বিব্রতকর। তবারক বলেন ব্যাপারটা বাংলাদেশ সরকারই সামাল দেবে। এটা এমনভাবে সারা হবে যাতে অস্বাভাবিক মনে না হয়। অন্য দশজন বিদেশি ছাত্রের মতোই নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাবেন। তার পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে তবারক জানান যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমস্যা হলে বাংলাদেশ সরকার তা বহন করবে।

এই প্রসঙ্গে দিল্লীর মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্নেইডার সরাসরি আপত্তি জানিয়ে যে বার্তাটি পাঠান তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিতর্কিত নুরুজ্জামানকে যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য কোনো দেশে পাঠানো। অস্ট্রেলিয়া বা ফিলিপাইনের মতো নিরপেক্ষ দেশের নাম সুপারিশ করে স্নেইডার জানান, নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে গেলে ভারত সন্দেহ করবে, ঠিক কতটা সন্দিগ্ধ তারা হবে সেটা মাপার জো নেই।

২৭ জানুয়ারি হেনরি কিসিঞ্জারের ফিরতি তারবার্তাটি থেকে আমরা জানতে পারি মার্কিনিদের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই, তবে ভারত থেকে আমেরিকা যাওয়া এবং তার পড়াশোনার খরচ বাংলাদেশ সরকারকেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন নুরুজ্জামানের পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করবে এবং প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা হবে। তবে কিসিঞ্জার দিল্লির সুপারিশমতো অস্ট্রেলিয়া ফিলিপাইন বা অন্য কোনো দেশের ব্যাপারটিও বিবেচনা করার জন্য ঢাকাকে অনুরোধ করেন।

২৮ জানুয়ারি বোস্টার এই বিষয়ে ফিরতি তার দেন। সেখানে লেখা হয়:

তবারক হোসেন জানিয়েছেন পুরো ব্যাপারটা অতি-গোপনীয় বলেই এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনের কাউকে জড়িত করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি একই প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো দেশেও তাকে পাঠানো যাচ্ছে না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এই গোপন তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পুরো ব্যাপারটা খুব কম মানুষই জানে। বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া, মিসেস নুরুজ্জামান (দিল আফরোজ জামান) যিনি এ বিষয়ে স্বামীর হয়ে মধ্যস্থতা করছেন এবং তবারক হোসেনই জানেন বিষয়টা এবং তা আর কেউ জানুক তারা চান না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দেওয়ার একটাই কারণ যে, গোপনীয় বিষয় এবং সম্পূরক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে তাদের উপর আস্থা রাখা যায়।

এরপর ৫ ফেব্রুয়ারির একটা বার্তায় জানা যায় যে, বোস্টার তবারককে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা দেন যা দেখে তবারক উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, মাঝ বছরে কোনো প্রতিষ্ঠান নুরুজ্জামানকে ভর্তি নেবে কিনা। সে ক্ষেত্রে তারা যাতে নেয় সে রকম কোনো ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান তিনি। 'নুরুজ্জামান কেস' শিরোনামে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলের অনেকগুলো বার্তা কার্ড উইড্রন বা আবারও গোপনীয় হয়ে গেছে। কিছু তারবার্তা মুছে ফেলা হয়েছে এর স্পর্শকাতরতা বিচারে।

১২ আগস্ট লন্ডন থেকে জানানো হয় নুরুজ্জামান সম্ভবত ২১ জুলাই ইংল্যান্ড ত্যাগ করেছেন, তবে তা নিশ্চিত করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে নুরুজ্জামান পৌঁছেছেন কিনা এ নিয়ে বোস্টারের তদারকির উত্তরে ২০ আগস্ট জানা যায় যে বিষয়টির অতি-গোপনীয়তা (কনফিডেনশিয়াল হ্যান্ডেল) বাংলাদেশ দুতাবাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য একটি বাধা।

এরপর আরও কিছু বার্তা বিনিময়ের পর ২৫ আগস্ট পাঠানো এক টেলিগ্রামে কিসিঞ্জারের তরফে নিশ্চিত হওয়া গেছে নুরুজ্জামান চার সপ্তাহ হল পৌঁছেছেন, থাকছেন ভগ্নিপতি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গেই। তবে এই মুহূর্তে পূর্ব আমেরিকায় ঘুরতে গেছেন। সে দেশে পড়াশোনার ব্যাপারটি তিনি ভাবছেন। কিসিঞ্জার বলেন, ব্যাপারটিতে মার্কিন সরকারের আর জড়িত থাকার দরকার নেই, বাংলাদেশই এখান থেকে চালিয়ে নিতে পারবে।

নুরুজ্জামান দেশে ফিরেননি আর। বিদেশেই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন মিশনে। ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ সুইডেনের স্টকহোমে মৃত্যু হয় তার। ফলে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তার এই গোপন সমঝোতায় তার ভাষ্যটা আমাদের আর জানা হয় না। জানা হয় না কীসের পুরস্কার দিয়েছেন জিয়া তাকে বা কী হতে পারে সেটা। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে অন্তর্ঘাত? তাঁর গাড়ি এবং গন্তব্য জানিয়ে দেওয়া? কে জানে!

অনুমান দিয়ে গল্প হয়, ইতিহাস হয় না। তবে নিশ্চিতভাবে পঁচাত্তরের আগস্ট ও নভেম্বরের প্রেক্ষাপটে নুরুজ্জামানকে বিতর্কিত আরোপ দেওয়ার মশলা আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি। বি জেড খসরু তার 'বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু অ্যান্ড দ্য সিআইএ লিংক' বইয়ে জিয়া-নুরুজ্জামানের গোপন সমঝোতার উল্লেখ করেছিলেন।

আমি প্রমাণও দিয়ে দিলাম।