জামাতের রাজনীতির জনভিত্তি ও ভবিষ্যত

Published : 19 March 2019, 05:03 AM
Updated : 5 Nov 2014, 08:55 PM

বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতে ইসলামী কোনোদিন গুরুত্বপূর্ণ বা বড়মাপের দল ছিল না। এখনও নেই। তাদের কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই। তাদের ইতিহাস স্বাধীন স্বতন্ত্র নয়, সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী। তাদের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তাই তাদের বাড়তি কোনো ঐতিহাসিক পরিচয় দেওয়ার মানে হয় না।

এই দলটি কেবল দুটি সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ১৯৭১ সালে এবং ২০০১ সালে। ১৯৭১ সালে তাদের নিজস্ব কোনো শক্তি ছিল না। দেশ তখন ছিল পাকিস্তানিদের দখলে, তারাই ছিল প্রধান শক্তি। জামাত তাদের রাজনৈতিক ভৃত্য হিসেবে ভূমিকা পালন করে, তাদের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করে। তারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করলেও তাদের কোনো ভিত্তি ছিল না। তাদের ওই ভূমিকা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানিদের জন্য। তাই তাদের আলাদা পরিচয় নেই। তাদের কোনোভাবেই এক ধরনের 'মহাক্ষমতাবান' প্রতিপক্ষ ভাবার কারণ নেই। তারা লেজুড়বৃত্তিতে নিজেদের স্থান খুঁজতে চেষ্টা করে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু সেই কালে কেন তারা জামাতকে নিষিদ্ধ করল না সেটা বোঝা যায় না। এমনকি তারাও কোনোদিন এই বিষয়ে বক্তব্য দেয়নি। 'যা আছে তা চলুক' এই মতাদর্শে এই দল তার ঘোড়া চালিয়ে বড় আঘাত পায় ২০০১ সালের নির্বাচনে। এই সময় বিএনপি ও জামাত জোট বাঁধে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে।

এর আগে জামাত সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত চিন্তাভাবনা ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। থাকলে তারা ২০০১ সালের অঘটন এড়াতে পারত। এর পরপরই তারা জামাতকে সিরিয়াসলি নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উৎসের পিছনে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে এমন অভিযোগের উত্তর তাদের সবলভাবে দেওয়া প্রয়োজন। তবে এটা ঘটলে আমাদের আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ আমাদের রাজনীতির চেহারা ও চরিত্র নিষ্ঠুর এ কথা কে-ই-বা বলবে না, স্বয়ং তারাও নয়।

বিএনপি বা জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে সুযোগ করে দিয়ে প্রমাণ করেন 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' এই কথা গভীরভাবে আমাদের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। তারা বিনা ভাবনায় এই রাজনীতিতে সবচেয়ে cynical কারবারটা চালু করে। কোনো দল যেচে গিয়ে দেশদ্রোহীদের সঙ্গে রাজনৈতিক হাত মেলাতে পারে এটা স্বাভাবিক ভাবনায় মনে আসে না। তারা এটা করেছে এবং আমাদের ইতিহাসের শেষ পর্যন্ত এই কলংকের বোঝা তাদের বইতে হবে।

এটা ঠিক যে ১৯৭৫-৭৬ সালে যখন জিয়া ক্ষমতায় আসেন তখন দেশের অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। বাকশাল ছিল প্রবল রকমে অজনপ্রিয় এবং মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি ছিল ক্ষোভ ও রাগ। কিন্তু যে দল দেশদ্রোহীদের সঙ্গে আতাঁত করে, তাদের রাজনীতিতে অনৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ক্ষমতায় থাকার জন্যে আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু দেশদ্রোহীর প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি করা অসাধারণ রকমের সুবিধাবাদী একটি কাজ।

অদ্ভূত বিষয় হল, যদিও এর ফলে ২০০১ সালে বিএনপির নির্বাচনে জিততে সুবিধা হয়েছে, এটা এখন তাদের সবচেয়ে বড় বোঝা। এই সম্পর্কের কারণে তাদের মাথা নিচু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আজকে মানুষ তাদের 'বিশ্বাসঘাতকের বন্ধু' হিসেবেই জানে। জামাতের বিচার বিষয়ক প্রভাব তাদের ওপর পড়েছে সবচেয়ে বেশি, দল সবল হয়নি, যে দুর্নাম জামাতের তা গেছে তাদের তহবিলে, জামাতীদের প্রতিবাদে সহিংসতার দায় তাদেরও নিতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত জামাতমুক্ত আগামীর কথা ভাবতে গিয়ে তারা নতুন পথ অনুসন্ধান করতে পারেনি।

এদিকে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে এই বদনামী সম্পর্ক। সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের দল পরিণত হয়েছে জামাতী বিএনপিতে, যার ফলে ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে গেছে। অতএব স্বল্পমেয়াদে তারা লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের ক্ষতি অনেক বেশি। দেশের স্বার্থের ওপরে স্ব-স্বার্থ দেখলে সবসময় না হলেও, মাঝে মাঝে কর্মফল ঘটে।

জামাতের কোনো আগামী আছে কিনা এই কথা আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন। তারা এটা ভাবেন যে, বিশ্বব্যাপী জামাতের বিচার নিয়ে যে কথা হয়েছে এটাই তাদের প্রকৃত শক্তির পরিচায়ক। কিন্তু এটা ভুল। বিচার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, আছে এবং থাকবে; কারণ আদালতপাড়া থেকে এটা চলে গেছে রাজনীতির জগতে। তাছাড়া এই মামলাসমূহের প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। শাহবাগ আন্দোলন যে মাত্রা যোগ করেছে তার ফলে এটা হওয়াই স্বাভাবিক।

অর্থাৎ সেই নিরিখে এই মামলাকে দেখা হয় সেটা আইনের বিষয় বা দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, রাজনীতির পরিসর থেকে হয়। সেই কারণে এই বিচার নিয়ে যে তর্ক, বিতর্ক তার সূত্র আমাদের বিচার ব্যবস্থার চেয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত। অতএব এই বিচার বা মামলার মূল চেহারা বহুমাত্রিক এবং সেই অনুধাবন সরলরৈখিক নয়। এটা কেবল ১৯৭১ নিয়ে নয়, এর পরিধি বর্তমান পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।

১৯৭১ সালে যারা নির্যাতন ও হত্যা করে, তাদের বিচার তো হয়ইনি বরং অনেকেই বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে জামাতীরা অন্যতম। তবে ১৯৭১ সালে যারা আমাদের ওপর নির্যাতন করেছিল তারা আসলে পাকিস্তানি। আমরা তাদের ব্যাপারে কিছুই করতে পারিনি। এই জন্য এই বিচারের ব্যাপারে মানুষের এত আগ্রহ, উৎসাহ। এখনও আসলে আমরা জামাতীদের বিচার করছি না, করছি পাকিস্তানিদের। আমাদের ক্ষোভের এটা প্রকাশ, আমাদের প্রতিশোধ। অতএব এই বিচারের মধ্যে 'সুবিচার'এর চেয়ে প্রতিশোধ গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে বিভিন্ন যে অভিযোগ উঠেছে এই আদালতের কার্য, কারণ ও প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, সেগুলো মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বস্তুতপক্ষে শাহবাগ আন্দোলনের মূল দাবি 'ফাঁসি চাই' সেটিই প্রমাণ করে।

আমাদের মাথায় দুটি বিষয়কেই রাখতে হবে। আমাদের ইতিহাস এত দুর্বল হয়ে গেছে যে, আমরা বিচারের ওপর যতটা না আস্থাশীল তার চেয়ে বেশি নির্ভর করি রাস্তার আন্দোলনের ওপর। শাহবাগ আবার প্রমাণ করেছে যে, রাস্তার চাপই কাজ করে। যে দেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাস গড়ে ওঠে না সেখানে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্য বিষয়টি হচ্ছে মানুষের রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতা। এই আন্দোলন কেন্দ্র করে যে মোবিলাইজেশন ঘটে সেটা কেবল 'ফাঁসি' কেন্দ্র করে ছিল না। এই ক্ষোভ ছিল বাংলাদেশের বিবিধ ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি ও গণতন্ত্রের অভাবের সঙ্গে জড়িত। এই রায়ের পরিসর চলে গেছে অসহিষ্ণুতার নাগালে। কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয়েছে আমাদের নিজের ব্যর্থতার সূতিকাগারে।

জামায়াতে ইসলামীর কোনো রকম সামাজিক ভিত্তি নেই এ দেশে। তাছাড়া তারা এখন অনেক দুর্বল। তারা কোনো দিনই আপন শক্তিতে সবল ছিল না। অতএব তাদের কোনো আগামী আছে বলে মনে হয় না। নিঃসন্দেহে জামাতের কোনো অধিকার নেই এই দেশে রাজনীতি করার; কারণ তারা এর জন্মের বিরোধিতা করেছে।

তবু বলব, সকল জামাতকর্মীকে মেরে ফেলে দিলেও আমাদের রাজনৈতিক অসুস্থতা যাবে না; কারণ আমরা রাজনীতিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রচর্চা শিখতে পারিনি। আর এটাই আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা।

আফসান চৌধুরী: লেখক ও সাংবাদিক।