প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইবোনদের কাছে একটি আবেদন

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 2 Nov 2014, 07:38 PM
Updated : 2 Nov 2014, 07:38 PM

সামনেই বাংলাদেশের শীতকাল। আজ সকালে যখন এই কলামটি লিখতে বসেছি, সকাল থেকে মেঘলা আকাশ দেখছি। ধারণা করছি, মেঘে ঢাকা এই কয়েকটি দিন কেটে গেলেই শীত পড়তে থাকবে।

আমার চাকরিজীবনে এবং তার আগে-পরে দুনিয়ার যে প্রায় চল্লিশটির মতো দেশে গিয়েছি, কতগুলো জায়গায় বছরের পর বছর থেকেছিও, আমার মনে হয় বাংলাদেশের শীতকালের মতো এত সুন্দর সময় দুনিয়ার এইসব দেশের কোথাও দেখিনি। আমার আরও মনে হয়, লন্ডনের 'সামার' হচ্ছে আমাদের শীতকাল। প্রকৃতি একান্তই দয়াময়, 'মার্সিফুল' হলে লন্ডনের সামার পাওয়া যায় মাস দেড়-দুই, জুন-জুলাইতে। লন্ডনের শীতকালটা এত বিরক্তিকর, নির্যাতনমূলক ছিল যে ওটির হাত থেকে বাঁচতে আমি তদবির করেই লন্ডন থেকে বদলি নিয়ে নতুন দিল্লিতে চলে গেছিলাম।

মনে আছে, লন্ডনের সকালে, ৯টার দিকে যখন আমি বাসে করে কর্মস্থলে যাচ্ছি, তখনও রাস্তায় বাতি। বেসমেন্টে আমার অফিসও অন্ধকার; সুতরাং বাতি জ্বলছে। আর বিকাল সাড়ে ৫টায় যখন বাসে বাসায় ফিরছি, তখন 'স্ট্রিট লাইট'। তার উপর সকাল-বিকাল-রাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি; কখনও কখনও তুষারপাত। দুপুরে যদি সপ্তাহ বা দু'সপ্তাহ পর একটু রোদ দেখা যায় তাও হয়তো আধঘণ্টার মতো।

কলেজ জীবনে আব্বাস উদ্দিনের একটি বই 'আমার শিল্পীজীবনের কথা' উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। এই বইয়ের এক জায়গায় তিনি লন্ডনের আবহাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, লন্ডনে রোদেলা দিন দেখলে মানুষজন নাচতে থাকে। তাঁর এই বর্ণনাটি তখন আমার কাছে অদ্ভূত, অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। আমি তখন ভাবছিলাম, আমাদের দেশে তো প্রায় সাত আট মাস রোদ থাকে, কই, আমাদের তো নাচতে ইচ্ছে করে না?

কিন্তু লন্ডনে সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পনের-বিশ দিন পর যদি একটু রোদের দেখা মেলে তাহলে আসলেই নাচতে ইচ্ছে করে। আর লন্ডনের 'সামার'এ এই আনন্দটা আরও অনেক বেশি অনুভব করা যায়। লম্বা দিন, ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে সন্ধ্যা হয়, অনেক কিছু করা যায়, দূরে বেড়াতে যাওয়া যায়। কিছুদিনের মধ্যে পাতার রঙও বদলাতে থাকে। তখন বলা হয়, 'ট্রিজ আর ইন ফ্লেমস', গাছে রঙএর আগুন লেগেছে।

নিউইয়র্কে থাকতে নিয়মিতই 'নিউইয়র্ক টাইমস' পড়তাম। ভোর ৫টায় দরজার ফাঁকে পত্রিকাটি দিয়ে যেতেন হকার। দৈনিক নিয়মিত প্রায় ১৫০ পৃষ্ঠার এই ব্রডশিট পত্রিকার পুরো একটি পৃষ্ঠায় থাকত আবহাওয়ার খবর। খুব আমোদের সঙ্গে লক্ষ্য করতাম, নিউইয়র্ক শহর থেকে কোন দিকে কত মাইল গেলে গাছে রঙএর পরিবর্তন, 'ট্রিজ ইন ফ্লেমস' দেখা যাবে। গাছের পাতার এই পরিবর্তন দেখার জন্য সপ্তাহান্তে শনিবার রোববার হাজার হাজার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটত। রাস্তাঘাট ভালো, কোথাও কোথাও আট-দশ লেনের রাস্তা, যানজট নেই, পথে খাবারের জন্য মোটেল-রেস্টুরেন্ট, হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা, পেট্রোল স্টেশন, কোথাও একটু অঘটন ঘটলেই পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যে উপস্থিত, কোনো কারণে গাড়ি বিকল হয়ে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকারী গাড়ি, মেরামতকারীসহ।

সুতরাং জীবন উপভোগ করার এতসব আয়োজন। ছোট বড় একটি চাকুরি বা কাজ থাকলে নিরাপদ নিরুপদ্রব একটি জীবন।

কিন্তু তারপরও আবার বলি, আমার এই বাংলাদেশের শীতকালের মতো এমন ঋতু আমার অভিজ্ঞতায় আর কোথাও দেখিনি। আমার দেশকে আমি ভালোবাসব, আমার দেশকে দুনিয়ার সবচাইতে সেরা দেশ হিসেবে বর্ণনা করব, তাও প্রত্যাশিত। কিন্তু আজ আমার বাংলাদেশটাকে নিয়ে কেন এমন ভাবি, কেন এমন গর্ব করি, এখন তার কিছু কারণ।

বাংলাদেশের শীতকালের কোনো একটি রোদেলা দিনে শুধু একটি সাধারণ জামা, হতে পারে হয়তো একটি হাফ শার্ট গায়ে, এক জোড়া কেডস পরে মাইলের পর মাইল গ্রামের সরু কোনো সড়ক বা আইল দিয়ে হাঁটার এমন সুযোগ দুনিয়ার আর কোন দেশটিতে পাওয়া যাাবে? কোনো দমকা বা ঝিরঝিরে বাতাস, ঝড়-বৃষ্টি নেই। আকাশটি যদি মেঘমুক্ত নীল হয়, যদি একটু মিষ্টি রোদ থাকে, প্রকৃতির এমন সমাহার-সমাবেশ, আর কী চাই! হ্যাঁ, এই সময়টাতে ধূলাবালির কারণে গাছপালার পাতা ঝকঝকে সবুজ নয়, রাস্তার পাশে বলে রাস্তার ধুলাবালির কারণে হয়তো বেশ বিবর্ণই।

কিন্তু এই একই সময়ে পথে-ঘাটে হাজারো রকমের ফুলের প্রদর্শনী তো পুরো শীতকালটা
অপরূপ সাজে সাজিয়ে রাখে। বিভিন্ন বাগান এবং বাসাবাড়িতে ডালিয়া ফুল কত বড় সাইজের এবং বর্ণের হতে পারে, তাও তো বাংলাদেশের শীতকালের একটি বৈশিষ্ট্য।

আর শীতের সবজি! সাদা ফুলকপি এবং লাল টমেটো, সবুজ বাঁধাকপি, বেগুনি রঙএর বেগুন– রঙএর এমন সমাহার বাংলাদেশের যে কোনো হাট-বাজারে তখন ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যেন প্রতিযোগিতা করে।

সাদা মূলা এবং সবুজ লাউয়ের স্তূপ বাংলাদেশের অনেকগুলো সড়কের পাশে ট্রাকের অপেক্ষায় থাকে, দূরের কোনো শহরের বাজারে যাওয়ার জন্য। কুমিল্লা শহর থেকে সাত-আট মাইল পশ্চিমে, কয়েক মাইল জুড়ে মহাসড়কের দু'পাশে শীতকালীন এইসব সবজির যে স্তূপ দেখা যায়, তা আমাকে মুগ্ধ করে।

শৈশবে গ্রামের আশপাশের জলাভূমিতে, নদী-নালাতে খালি হাতে মাছ ধরার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে। কখনও কখনও ছোট জাল দিয়ে, কখনও পানি সেঁচে বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। বিকালে খেলেছি ডাংগুলি, হাডুডু, কানামাছি। তখন ক্রিকেটের নামও শুনিনি। গ্রামের সেই জমানার খেলাগুলোকে এখন ক্রিকেট গ্রাস করেছে।

গ্রামের শীতকালের পিঠাপুলি, খেজুরের রস, এইসব স্মৃতি বয়স নির্বিশেষে সকলকেই কাতর করে তুলবে। সেই তিন-চার বছর বয়সে উঠানে মা পিঠা বানাচ্ছেন, পাশে কয়েক বছরের বড় 'বড় ভাই'। মা কোনো কারণে ঘরে গিয়েছেন, কোনো এক ছোটখাট দুর্ঘটনায় পাতিলের পানি আমার গায়ে পড়ল। তাতে আমার ডান কান এবং ডান হাত সেই যে পুড়ল, তার ক্ষত এখনও আমার শরীরে আছে। আমাকে শনাক্তকরণের জন্য এই ক্ষত আমি আজও পাসপোর্টে উল্লেখ করি।

|| তিন ||

এখন শীতকালের আর একটি অসাধারণ দৃশ্যের একটু বর্ণনা এবং প্রাসঙ্গিক মনে করি বলেই প্রবাসী ভাইবোনদের কাছে আবেদনটি। আমাদের জমানায় শীতকালেই স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষাগুলো হত। এখনও তাই হয়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে নানান রকমের ভয়ভীতি, উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা আমাদের অবশ্যই এখনও আলোড়িত করে। সে সঙ্গে আমাদের স্কুলজীবনের বন্ধু এবং শিক্ষকদের কথাও। পরীক্ষায় পাস করলে প্রমোশন; না-করলে মা বাবা কী করবেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গটা কেমন হবে এইসব স্মৃতিও এখনও প্রায় সকলকেই তাড়া করে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে আমাকে মুগ্ধ করে এই শীতকালে যখন দেখি গ্রামের রাস্তা ধরে দঙ্গল দঙ্গল কিশোরী মেয়ে, স্কুল ইউনিফরম পরে বই হাতে কলকল করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে বা স্কুল থেকে ফিরছে। এই কিশোরীরা যখন দিগন্তবিস্তৃত হলুদ সর্ষে ফুলের মাঝখানের আইল দিয়ে আসা-যাওয়া করে বা এমন সর্ষেক্ষেত ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে, এমন দৃশ্য কি দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যায়?

বাংলাদেশের এতসব ব্যর্থতার মাঝেও যে কয়টি ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য দেখি তার একটি হচ্ছে, মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি। গত তিরিশ বছর ধরেই দেখছি আমাদের সবগুলো সরকারেরই 'স্ট্রং কমিটমেন্ট' আছে নারীশিক্ষার প্রতি। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই কমিটমেন্টের বিস্তার এবং ব্যাপকতা ঘটেছে।। মেয়েদের এখন উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বারই ঘোষণা দিয়েছেন।

তারপর, প্রতি বছর প্রতিটি ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য সব বিষয়ের বই বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থাও আমাদের বর্তমান সরকারটির একটি অসাধারণ সাফল্য। প্রায় ৩০ কোটি বইয়ের বিষয়বস্তু ঠিক করা, ছাপার কাগজ জোগাড়, মুদ্রণ এবং বছরের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারিতে দেশের সবগুলো স্কুলে বিতরণ– দুনিয়ার কয়টি দেশে এমনটি সম্ভব? প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র হচ্ছে 'নাউরু'। স্বাধীন সার্বভৌম; জাতিসংঘের সদস্যও। কিন্তু এর জনসংখ্যা মাত্র ১০ হাজার! এই দশ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে আমাদের সরকারের ৩০ কোটি বই বিতরণের বিশাল ফিগারটির তুলনা করলে সাফল্যের বিশালত্বটাও সম্যক বোঝা যাবে।

পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি যখন সৌদি আরবে আমাদের দূতাবাস থেকে বদলি হয়ে ঢাকায ফিরে আসি, তখনও জেদ্দা শহরে রাস্তা বা বাড়ির নম্বরই ছিল না। ছিল না চিঠিপত্র বিতণের কোনো ব্যবস্থা। আমাদের অ্যাম্বেসির ঠিকানা ছিল, কিলো ৩, মক্কা রোড। মানে মক্কা রোড জেদ্দা শহরের যেখান থেকে শুরু হয়ে মক্কার দিকে গিয়েছে, সেই পয়েন্ট থেকে তিন কিলোমিটার মক্কার দিকে গেলে আশেপাশে কোথাও বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি খুঁজে পাওয়া যাবে। চেনার আরেকটি সহজ উপায় ছিল, ভবনের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা। জেদ্দার প্রধান পোস্ট অফিসে আমাদের পোস্টবক্স নম্বরে চিঠিপত্র আসত, আর প্রত্যেক দিন লোক পাঠিয়ে সেইসব চিঠিপত্র আনাতে হত। চিঠিপত্র রেজিস্টার্ড হলে জটিলতা আরও বেশি ছিল, আমাদের অ্যাম্বেসির লোককে তখন পাসপোর্ট নিয়ে যেতে হত।

অথচ তখন সৌদি আরবের তুলনায় আমাদের ডাক ব্যবস্থা কত উন্নত ছিল। বাংলাদেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রত্যন্ত বাড়িটিতে কয়েক পয়সা দামের অন্য যে কোনো শহর, জায়গা থেকে পাঠানো পোস্টকার্ডটি প্রাপক ঠিকই পেয়ে যেতেন। প্রতি বছর তখন কোটি কোটি চিঠিপত্র আমাদের পোস্ট অফিস বিলি, বিতরণ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল একটি দেশ, কিন্তু ৩০ কোটি বই বিতরণ এবং আমাদের ডাক ব্যবস্থার জন্য সারা দুনিয়াতেই গর্ব করতে পারি।

|| চার ||

আমি যখন রিকশায় চলাফেরা করি, রিকশাওয়ালার সঙ্গে দিন-দুনিয়া, রাজনীতি, দেশের অবস্থা, তাঁর গ্রামের বাড়ি, তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। আমি সকল রিকশাওয়ালার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, তাঁরা মেয়েদেরকেও স্কুলে পড়াতে আগ্রহী। লেখাপড়ার প্রতি, বিশেষ করে আমাদের মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও লক্ষ্য করি, তা আমাকে চারপাশের এতসব অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতার মাঝেও সাহস, উৎসাহ জোগায়। আমাদের দেশের কোথাও নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো মানুষের প্রকাশ্য অবস্থানের কথা আমি এত বছরে একবারও শুনিনি। আমাদের এমন গণসচেতনতার বিপরীতে পাকিস্তানের সোয়াতসহ আরও কতগুলো জায়গায় মালালা ইউসুফজাইয়ের অভিজ্ঞতা তুলনা করলে আমাদের অগগ্রতিটা উজ্জল হয়ে উঠবে।

নারীশিক্ষার পরিবেশ বাংলাদেশে এখন সম্পূর্ণ অনুকুলে। এই ব্যাকগ্রাউন্ডেই প্রবাসী ভাইবোনদের কাছে আমার আবেদনটি। মেয়েদের শিক্ষার প্রতি দেশের প্রত্যেক মা-বাবার আগ্রহ থাকার পরেও, সরকারের নারীশিক্ষার প্রতি এমন সব কমিটমেন্ট সত্ত্বেও দেখা যাবে কোনো রিকশাওয়ালা হয়তো তাঁর মেয়েটির নিয়মিত খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থাই করতে পারছেন না; ফলে মেয়েটির শিক্ষাও বন্ধ হয়ে গেছে। সামর্থ্যবান প্রবাসী ভাইবোনরা এমনসব দরিদ্র বাবা-মাকে তাদের মেয়ের লেখাপাড়ায় সাহায্য করতে পারেন।

সাধারণত ধরা হয়, আমাদের প্রায় ৮০ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তাঁদের কাজ প্রায়ই কঠিন, কঠোর। পঁয়ত্রিশ বছর আগে জেদ্দা থেকে মদিনা যাওয়ার পথের নির্মাণাধীন সড়কটিতে আমাদের শ্রমিকদের ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, গরম লু হাওয়াতে নাক, কান, মুখ, মাথার চারপাশে চাদর জড়িয়ে পাথর ভাঙতেও দেখেছি। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতি বছর এখন যে ১৫ বিলিয়ন ডলার বৈধ পথে দেশে পাঠাচ্ছেন, তা দেশের অর্থনীতিতে প্রবল ভূমিকা রাখছে। দেশের সকল মানুষ প্রবাসী ভাইবোনদের এই ভূমিকাটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করেন।

আমি জানি, আমাদের দেশে এখন লক্ষ লক্ষ কোটিপতি আছে। তাদের অনেকেই আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করে থাকে। কিন্তু এদের বেশিরভাগই লুটেরা, লুণ্ঠনকারী, প্রথম জেনারেশনের ধনশালী। কানাডার অটোয়ায় 'বেগমপাড়া'য় বাড়ি-গাড়ি জোগাড় এবং মালয়েশিয়ায় 'সেকেন্ড হোম' প্রজেক্টের সুযোগ নেওয়াতেই তাদের আগ্রহ বেশি। আমার ধারণা, বিদেশ থেকে বাংলাদেশে যে সরাসরি বিনিয়োগ আসছে তার চাইতে বেশি এই লুটেরারা বিদেশে পাচার করছে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাদের চাইতে বিদেশে কঠোর পরিশ্রমী আমাদের ভাইবোনদের দেশপ্রেম অনেক বেশি এবং গভীর। তাই প্রবাসী ভাইবোনদের কাছে এই আবেদন।

আমি বলছি সামর্থ্যবান যারা, তাদের কাছে। ৮০ লাখের মধ্যে যদি ১০ লাখই পারেন, দয়া করে আপনাদের আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের এলাকার মানুষজনের এমন কেউ যদি থাকেন যাদের ছেলেমেয়েরা এই ফাইনাল পরীক্ষার সিজনে টাকা-পয়সার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না, তাহলে তাদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী ৫০ বা ১০০ ডলার পাঠিয়ে দিন। আমি নিশ্চিত জানি, প্রবাসী অনেক ভাইবোন এমন সাহায্য-সহযোগিতা এখন এমনিতেও করছেন। বিভিন্ন দেশে এমনসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, প্রবাসী প্রায় প্রত্যেকের উপরই আরও কয়েকটি পরিবার নির্ভরশীল। আমাদের সমাজে পারিবারিক টানটা এমন শক্ত, এমন গভীর যে, ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টিও প্রবাসী ভাইবোনরা উপেক্ষা করতে পারেন না।

তবু বলব, আত্মীয়-স্বজনকে দেখছেন, খুবই ভালো কথা। কিন্তু আপনার আত্মীয়-স্বজন বা গ্রামের কোনো মুক্তিযোদ্ধা, আপনার শৈশবের কোনো বন্ধু এবং আপনার প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কেমন চলছে তার খোঁজ-খবর কি একটু নিয়েছেন? জাকাত হিসেবেও কি এইসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করা যায় না? আমাদের অনেক বাবা-মা দারিদ্র্যের কারণে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে থাকেন। কারণ অনেক মাদ্রাসায় বিনা পয়সায় পড়ানো হয়; বিনা পয়সায় খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। দয়া করে আরও মনে রাখুন, আমাদের কতগুলো ক্ষেত্রে এতসব অগ্রগতি-সাফল্য সত্ত্বেও, এই দেশে এখনও প্রায় ৪ কোটি মানুষ হতদ্ররিদ্র; রিকসাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালার চাইতেও কঠোর কঠিন তাদের জীবন।

তাই আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সাহায্যের জন্য আমার পক্ষ থেকে আবেদন থাকছে আপনাদের প্রতি। পাশাপাশি বলব, যদি সম্ভব হয়, আপনার গ্রামের বা ইউনিয়নের কোনো বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় প্রবীণ শিক্ষক এবং সমাজে এককালের কোনো একজন সম্মানী ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে এখন আর সাহায্য চাইতে পারেন না– তাঁদের সাহায্যের কথাটাও মনে রাখতে পারেন।

আমাদের প্রত্যেক গ্রাম এবং ইউনিয়নে সাহায্য করার মতো লোক অন্তত কয়েক জন থাকার কথা। কিন্তু এদের বেশিরভাগ ওই লুটেরা শ্রেণির। নেতানেত্রীরা এই লুটেরাদের গ্রাম বা এলাকায় সফরকালে তাদের জন্য তোরণ নির্মাণ করে লাখ লাখ টাকা খরচ করবে এরা। এদের আত্মীয়দের মধ্যেও কঠোর সংগ্রাম করে ছেলেমেয়ের নিয়ে হয়তো দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই, কিন্তু ওই দরিদ্র আত্মীয়দের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে না এরা।

তাই আপনারা যারা প্রবাসে আছেন, আপনাদের শ্রম আর দেশপ্রেম নিয়ে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, দেশকে ভালোবাসার দাম চুকিয়ে দিচ্ছেন, আমরা জানি আপনারা প্রায় সকলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ওসব দেশে গিয়েছেন। তারপরও বলি, আপনারা ভাগ্যবান। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্রায় দুইশত বাংলাদেশি ভাসতে ভাসতে থাইল্যান্ডে গিয়ে এখন ক্রীতদাস হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন। কোটি কোটি লোক এই দেশটি থেকে পারলে আগামীকালই পালিয়ে যেতে চায়। সুযোগ দিলে তারা ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন এইসব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও যাবে।

সে দিক থেকে দেখলে, আপনারা যারা বৈধভাবে কোনো একটি দেশে আছেন, কাজ করে ভালোভাবে উপার্জন করে সমাজের জন্য, দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কাছে আমাদের অনেক চাওয়া। দয়া করে আমাদের দরিদ্র পরিবারে মানুষজন, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় সহযোগিতার এই আবেদনটি একটু সহানুভূতির সঙ্গেই বিবেচনা করুন।

'শিউলীতলা'; উত্তরা; বুধবার ২৯ অক্টোবর, ২০১৪।