কোথায় প্রগতি কোথায় তার ধারক

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 31 Oct 2014, 11:20 AM
Updated : 31 Oct 2014, 11:20 AM

আমাদের যত উত্তেজনা এখন কাগুজে বা ইলেকট্রনিক বাঘ-ভালুক। মাঠে-ময়দানে যারা বাঘ না হলেও দাপটের সঙ্গে আছে তাদের আমরা বলছি স্বাধীনতাবিরোধী। গোলাম আযম জীবদ্দশায় যা ভাবেননি বা ভাবতে পারেননি, মৃত্যুকালে সেটাই করে দেখিয়েছে তার দলের লোকজন। কেউ বলছেন আপোসে; কেউ বলছেন নিজেদের দাপটে। যেভাবেই হোক তারা তা করে দেখিয়েছে।

আপোসের কথাই যখন উঠল এবং আমরা দেখলাম ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের কথিত আন্দোলনের প্রতি সাহসী পুলিশের নিরব ভূমিকার পর তারা যেন গোলাম আযমের ব্যাপারেও নিরব নিথর। দেখে গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছিল, "তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে হৃদয়ের কুঠুরে রাখব।''

আমার এক বিজ্ঞ বন্ধু ঘোরতর আওয়ামী-বান্ধব, শীর্ষ-নেতৃত্বের আত্মীয়ও বটে, বললেন, "কী কাণ্ড দেখুন তো! আরব আমিরাতের নেতারা যখন জানতে চাইবেন একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর জানাজা পড়তে দেওয়া হচ্ছে না কেন, এর কী উত্তর দেবেন নেত্রী? এদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা বা শ্রমিক বিনিময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটাই মানুষ বোঝে না।"

তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম; তাই কথা বাড়াইনি। তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, গোলাম আযম যেন দিন-তারিখ ঠিক করে আরব আমিরাত সফরের আগে আগে ইন্তেকাল করেছেন, যাতে তার জানাজায় সরকার ইচ্ছে থাকলেও বাধা দিতে না পারে। তাছাড়া বিচার করে 'ফাঁসি ফাঁসি' থেকে ৯০ বছর কারাদণ্ড পাওয়া আসামির মৃত্যুর পর জানাজার ব্যাপারটা বড়, না পুরো প্রক্রিয়া? সরকার সে ভয় পেলে নিশ্চয়ই এ বিচারকাজে হাত দিত না। আর দিলেও এক পর্যায়ে তা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হত। সেটা যখন হয়নি, বরং নানা ধরনের বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর খেলা চলছে– তখন আমরা যারা বেকুব টাইপের মানুষ তারা এটুকু ধরে নিই যে, এটা এক ধরনের সন্ধি বা দুরভিসন্ধি।

কে কখন কার সঙ্গে সন্ধি করবে সেটা নির্ণয় করে সময়। দেশ ও রাজনীতি ভেদে চরম শত্রুকেও আমরা মিত্রে পরিণত হতে দেখি। আবার উল্টোটাও ঘটে। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ, এদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক মেরুকরণ বোঝা সহজ কিছু নয়। গোলাম আযমের বেলায় মানুষের সেন্টিমেন্টও তাই সহজে বোঝার কিছু ছিল না। যেভাবেই দেখি না কেন, তিনি ধর্মের নামে রাজনীতি করতেন এবং তার আচরণ ও বিশ্বাসের জায়গা বরাবর এক রকমের। এতে একটা লাভ তো হয়-ই, চরম শত্রুও বোঝে এ মানুষ সহজে হেলে পড়ার নয়। যে যত কম হেলে সে দেয়ালে ঠেস দিতে ততই ভরসা। তাছাড়া এর ওপর আছে ধর্মের আচ্ছাদন। ফলে বিশ্বাস ও রাজনীতির যোগে গোলাম আযমের ফলোয়ার বা সমর্থকের সংখ্যাও কম নয়।

মানুষকে আমরা কীভাবে দোষারোপ করব? 'মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ' করলেই কি চেতনা ফিরে আসে? মানুষ অ্যাদ্দিন ধরে এত বছর ধরে কী দেখে আসছে? জামাতের রাজনীতির বেলায় সরকার ও বিএনপি উভয়েই কোনো না কোনোভাবে পরিপূরকের ভূমিকায়। যখন যাদের ভোটের সমস্যা বা অপরকে ঘায়েল করার জন্য দরকার, তখনই জামাতের ডাইরেক্ট বা ইনডাইরেক্ট সাহায্য নেওয়া তারা বৈধ মনে করেছে। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধকে আমরা যারা সমার্থক মনে করি, আমরা কখনও এ বিষয়ে কঠোর হতে পারিনি বা সমালোচনা করতে শিখিনি।

স্বাধীনতার তথাকথিত ঘোষকের দল তো জামাতের ছায়াসঙ্গী। ওদের সঙ্গে পাকিস্তানি ভাবধারা আর বিকৃত বাংলাস্তানের কারণে দহররম মহররম ছিল আরও বেশি। আমি বলব, গোলাম আযমের মৃত্যুর পর জামাতের জন্য যদি কোনো শক বা আঘাত থেকে থাকে তবে তা বিএনপির নীরবতা। আওয়ামী লীগ ও গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে রেখেই তারা জানাজায় যাননি। বন্ধু হিসেবে এটা তাদের জন্য অপরাধ। অন্যদিকে জামাতের নেতারা কায়া না দেখলেও হাজার হাজার আওয়ামী নেতা-কর্মীর ছায়া দেখে জেনে গিয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চেতনা গদি ও দলের কাছে আসলেই কোনো বিষয় নয়।

আগেই বলেছি, বড় গোলমেলে আমাদের দৃশ্যপট। এই গোলমাল সমাজের সর্বত্র। এত বছর ধরে আমরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা লালন করে হঠাৎ বলছি ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করতে হবে, অমুক ব্যবসা চলবে না তমুক বিষয় চলবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কোনো তর্কে না গিয়ে বলব, একটিও বন্ধ হয়নি এবং হবে না। সে সময় সরাসরি সরকারবিরোধী অবস্থান ও অধিক বিএনপি-প্রীতির কারণে 'আমার দেশ' বা 'দিগন্ত টিভি'র কপালে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। বুঝে শুনে দুদিকে পা রাখলে তাদেরও অন্ধকারে পড়ে থাকতে হত না। যে সব টিভি চ্যানেল বা মিডিয়া গোলাম আযমকে হাইলাইট করেছে, তাদের কি আসলে কোনো কাফফারা দিতে হবে? মোটেই না। কারণ আমাদের সরকারি দলও বলে, তারা ধর্মে বিশ্বাসী এবং সেভাবে দেশ চালায়। ফলে একজন বিশ্বাসী আরেকজন বিশ্বাসীর বেলায় কঠোর হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক!

রাজনীতির ধর্ম আর জীবনের ধর্ম-আচরণ যখন থেকে একাকার, সমাজ ও দেশে উগ্রতা-অন্ধত্বের জয়জয়কার, তখন থেকে আসলে দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছিল। এখন আমরা যত অবাক-ই হই না কেন, আসলে আমাদের পিঠ ঠেকার মতো চেতনা বা বিশ্বাসের কোনো দেয়াল নেই। জানাজা আর শেষকৃত্যে যত মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের মনে যে একই ধরনের বোধ কাজ করেছে এবং তা মৃতের কারণে এটা কি অস্বীকার করা যাবে?

এ কারণেই মেরুকরণের কথা বলছিলাম। যদি তা সন্ধি-স্থানীয় হয়ে থাকে, তবে চেতনার নামে খামোখা বাড়াবাড়ি আর তারুণ্যের বিভ্রান্তি না বাড়ানোই হবে কাজের কাজ। আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলি, কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলনই আলোর মুখ দেখবে না যদি মধ্যবিত্ত সঙ্গে না থাকে। বাংলাদেশে সে জায়গাটায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। এরা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবে, নিজেরা হৈ-হল্লা করবে, বিমানে কাগজ মুড়িয়ে বিয়ার পান করবে, নাইট ক্লাবে যাবে, কিন্তু সমাজের বেলায় চাইবে 'পর্দাপ্রথা'! নিজেদের একাউন্ট থাকবে বিদেশি ব্যাংকে, চড়া সুদে টাকা খাটাবে আর সদকা বা ফিতরা দেবে ইসলামী ব্যাংকে!

এদের নিজের ছেলেমেয়েদের কথাই ভাবুন। গোলাম আযম নিজেই পারফেক্ট উদাহরণ। তার এক ছেলেও সাধের পাকিস্তানে ছিল না বা নাই। সবাই তাদের তথা্কথিত 'ঘোর দুশমন' আমেরিকায় চমৎকার জীবন কাটায়। পিতা তাদের বেলায় ধর্ম বা আদর্শের বরখেলাপ দেখেননি। কিন্তু দেশের নিরীহ ছেলেদের বেলায় মাথার ভেতর ধর্মের নামে পোকা আর উগ্রতা ঢোকানোই ছিল তার রাজনীতি। তাদের বেলায় কোনটা শরীয়াহ আর কোনটা বেশরিয়তী সে জ্ঞান ছিল বড় টনটনে। একথা সব নেতানেত্রীর বেলায় প্রযোজ্য।

এই যেখানে অবস্থা সেখানে গরিব মানুষ বা লেখাপড়া না-জানা মানুষকে বোকা বানানোও গেলেও, মধ্যবিত্ত সে ফাঁদে পা দেবে না। সে জানতে চাইবে, তারেক কোথায়, জয় কোথায় বা কে কোথায় থাকে? তার নিজের টাকা বা মেধায় সেও যখন তা পারে, সে কেন দেশের নোংরা রাজনীতির জন্য রিস্ক নেবে? নেয়নি। তাছাড়া একবার যখন ঘটনাক্রমে প্রায় নিয়ে ফেলেছিল, তখন তাকে শাহবাগ থেকে সোজা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার অংশগ্রহণে ব্লগার রাজীবের জানাযায়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। সে জায়গাটা গোলাম আযমরা কীভাবে পেলেন রাজনীতিই বিচার করুক।

আবারও বলি, মেরুকরণের রাজনীতির করুণ ফলাফলে আজ ভারত পাকিস্তানে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের এই দশা। অন্যের পায়ে ভর না দিয়ে পাওয়ারে যেতে পারে না, পারবেও না। সে কারণে বিদ্যুতের মতো আসে আর যায়। আওয়ামী লীগ এখন যদি সে পথ ধরে, তবে তাদেরও একই পরিণতি বরণ করার বিকল্প থাকবে না। দু'চারজন বাম আর জাসদের পায়ে ভর দিয়ে এই কঠিন পথ পার হবে, নাকি আদর্শের রাজনীতির ধারাবাহিক চর্চায় সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধ-প্রেমে রাজনীতি করবে, সেটা তাদের চয়েস। তবে গোলাম আযমের বিদায়ের পর এটা প্রমাণিত যে, গোঁজামিলের রাজনীতির দিন শেষ। চারিত্র্য ও পরিচয়ে উদারতা আর আধুনিকতা চাইলে নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর রাজনীতি বেছে নিতে হবে।

দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সে দায়িত্বটা গুটিকয় বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়াকে দিয়েই তৃপ্ত। আমাদের ধারণা, কিছু তরুণ-তরুণীই সব করে ফেলবে। এই যদি হয়, দলের দরকার কী আর? এত হাঁকডাকের ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনই-বা কোথায়? একটার পর একটা বিচার, ফাঁসি না যাবজ্জীবন, না আপোস না সংগ্রাম, এ জাতীয় রাজনীতিতে আবদ্ধ জাতি আসল কাজ করবে কখন?

কারা আসলে আমাদের প্রহরী বা আমাদের প্রগতির ধারক সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

সিডনি থেকে